জীবনটা জুড়ে বিশেষ কিছু পড়া হয়নি। বিস্তারে এবং গভীরতায়। যা পড়েছিলাম তার কিছুটা ভাবতাম, বুঝেছি। অতিক্রান্ত জীবনের অভিজ্ঞতায় আর অবরে সবরে ছেঁড়া ছেঁড়া নূতন পাঠের ঢেউয়ে বুঝেছি আগের সেই বোঝাগুলোর বেশীটাই বোঝা – ফেলে দেয়ার। তাই হাতে থাকা সম্বল পেন্সিল – ঐ, পার হয়ে আসা জীবনের, প্রতি মুহুর্তে বিবর্ণ হতে থাকা স্মৃতির হেথা হোথা টুকরো ছবি – এক লহমার টুকিটাকি।
বাবার বদলির চাকরী আমার শৈশবটাকে খানিকটা অগোছালো করে দিয়েছিল। খুব ঘোরাঘুরি নয়, মাত্রই তিন জায়গা আর পাঁচটি বিদ্যালয়। কিন্তু এর ফলে কোন জায়গাটাকেই আমি আমার নিজের জায়গা বলে মনে করে উঠতে পারিনি। সব সময় মনে হয়েছে, এখানে আমার থাকার কথা ছিল না। আমি এখানে থাকবও না। শুধু এই বর্তমানটাকে যতটা পারা যায় জড় করে নিয়ে উঠে যেতে হবে পরবর্ত্তী বসতটায়, যেতে হবে পরের বিদ্যালয়টায়। কে জানে এর ফলেই কি না, একটু একটু করে আমি জীবনটাকে তার বাইরে থেকে দেখতে শুরু করেছিলাম। যে সব তুচ্ছাতিতুচ্ছরা জমা হচ্ছিল মগজের কোণে কোণে তাদেরকে তুলে রাখছিলাম এ তাকে ও তাকে।
আমার দূরতম স্মৃতি একটা গন্ধরাজ গাছ। বনগাঁ লাইনে দমদমের কাছাকাছি এক রেলস্টেশন এলাকার এক পাড়ায় দু কামরার ভাড়াবাড়িতে আমার প্রথম দিনগুলোকে আমি দেখতে পাই। সেখানে আমি জন্মাইনি। কিন্তু তার আগের কোন স্মৃতি আমার নেই। ঘরের সামনে চওড়া বারান্দা। তার পরে উঠান। তার একধারে কলতলা – হাত-চাপা টিউবকল আর চৌবাচ্চা। অন্যধারে - আঃ! কি সুন্দর গন্ধ! বড় বড় সাদা ফুলে পুষ্পিত গন্ধরাজ গাছ। নিচু গাছ। তাই গাছে ওঠা যেত, তবে উঠে খেলা করার কথা মনে পড়ে না। যা মনে পড়ে - কুড়িয়ে নেয়া ফুল বারান্দার এক কোনায়, আমার কোনায়। হাতের কাছের ডাল থেকে কয়েকটা ফুল ঠাকুমার পূজার থালায়। একটা ফুল মায়ের খোঁপাতে। আমার নাকে আজও হঠাৎ করে কোথাও কিছু নেই সেই গন্ধ ভেসে আসে। আর তার পরেই ভেসে আসে প্রথম ধাক্কাটাও। বড়রা সবাই জানত। কিন্তু আমার জন্য হঠাৎ ছিল। গাছটা কেটে ফেলা হল। বাড়ির মালিক প্রতিষ্ঠিত, বয়স হয়েছে, গাড়ি কিনবেন। গ্যারাজ উঠল সেখানে। আমার মতই বাবা-মায়েরও প্রিয় ছিল গাছটা। আমি জানতাম চারপাশে সবাই বাবার কথা শোনে। এই বারে প্রথম বুঝলাম বাবার এটায় কিছুই করতে পারার নেই। ভাড়াটে। অনেক বয়স হওয়ার পর আগাথা ক্রিস্টির গল্পে সেই যে কুকুরটা এক চমৎকার আনন্দের সকালে সহসাই গাড়ী চাপা পড়েছিল! শৈশবের সেই দিনটায় আমি প্রথম জেনেছিলাম - ধ্বংস কেমন হঠাৎ করে আসে, শূন্য করে দিয়ে চলে যায়। আর সে প্রথম আমি বুঝলাম আমার তুচ্ছতা। বাকি জীবন ধরে যা ক্রমাগত বুঝব।
শৈশবের আরেক স্মৃতি দুই কুকুর। নেড়ি। তাদের প্রাচীনটির নাম ছিল কামান। সম্ভবতঃ যৌবনে তার বিশেষ দাপট ছিল। বাবা তাকে নিয়মিত খেতে দিত। নিজের খাবার থালা থেকে বেশ পরিমাণমত কিছু অবশেষ। আমাদের বাসার দুটো দরজা ছিল। খাওয়া হয়ে গেল বাবা ডাক দিত – কামান, কামান। সাধারণতঃ সে যেখানেই থাকুক ডাক শুনে হাজির হয়ে যেত। কোন কোন দিন তার দেখা মিলত কিছুক্ষণ বাদে। বাবা এ দরজা ও দরজা করত। এক দরজায় তার দেখা পাওয়া গেল বাবা যদি বলত অন্য দরজায় যেতে – ঐ দিকে আয় - সে অন্য দরজায় চলে আসত। কি করে বুঝত কে জানে! কিছুদিন বাদে কামানের থেকে বয়সে অনেক ছোট এক কুকুর কোথা থেকে এসে হাজির হল। রোগা। বাবা তার নাম দিল – মেঘডন। কোন বৈশিষ্ট্যে এমন নাম, জানা নেই। বাবার পাতের ভুক্তাবশেষের পরিমাণ বাড়ল। দরজার পাশে দেওয়া খাবার কামান খানিকটা খেয়ে মেঘডনের জন্য বাকিটা ছেড়ে দিত। আস্তে আস্তে কামান বুড়ো হয়ে গেল। শেষের কয়েক মাস কামান খাওয়ার ধারা বদলে দিল। আগে মেঘডন খানিকটা খেয়ে নেওয়ার পর কামান খাবারে মুখ দিত। হয়ত মেঘডন কামান-এর সন্তান ছিল। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে কামান খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। খাবার দেওয়ার সময় চুপ করে শুয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত। কামান দুর্বল হয়ে পড়ার সময় থেকেই মেঘডন ঐ বাড়িতে আমাদের বাসার ঘরের দিকটার পাহারাদার। বাবা উত্তরবঙ্গে বদলি হয়ে যাওয়ার পর কয়েক মাস আমাদের তিন ভাই আর ঠাকুমাকে নিয়ে মা ঐ বাসায় থেকে গিয়েছিল, আমার বার্ষিক পরীক্ষা বাকি। মেঘডন কি বুঝেছিল কে জানে, আমাদের সাথে সাথে রাস্তায় পাহারা দিয়ে চলত। ছেড়ে আসার দিন বাসা থেকে রেলস্টেশন পর্যন্ত পথটার অনেকটা, মালপত্র নিয়ে ধীর গতিতে চলা আমাদের রিক্সাদুটোর পিছন পিছন এসেছিল। অনেক বছর পরেও কামান-এর গল্প করত বাবা। গলা ধরে যেত তার। মা বলত মেঘডনের কথা।
কত সামান্য জিনিষে কত অসামান্য পূর্ণতা! আমাদের পাড়া ছাড়িয়ে রেল-স্টেশনের কাছে ছিল মণিহারী দোকান। সেবক স্টোর্স। দোকানের মালিক – তার নাম কি সেবক ছিল? না হয়ত। তবে আমি ডাকতাম সেবক-কাকু বলে। সে এক নানান মজার দোকান ছিল। তবে, সমস্ত আশ্চর্য জিনিষের মধ্যে সেরা ছিল একটা ছোট্ট কাঁচের নল। তার দুই মাথা বন্ধ করা আছে রঙ্গিন পাতলা কাগজে। আর ভিতরে? ছোট ছোট গোল গোল ডিম লজেন্স। কতরকম রঙের। আর সেই লজেন্স মুখে নিয়ে চুষতে থাকলে তার রং ধুয়ে গিয়ে পাল্টে পাল্টে যেতে থাকে। আমি একটু পরে পরে মুখ থেকে বার করে হাতে নিয়ে দেখতাম যতক্ষণ না সেটা সাদা রঙের হয়ে যেত। তারপর জিভে থাকত একটা মৌরীর দানা। লজেন্স সব খেয়ে ফেলার পর রঙ্গিন কাগজ দু’-মাথায় সেই কাঁচ-নল হয়ে যেত চূড়ান্ত দামী সম্পদ। রোজ রোজ ত আর বড়রা ঐ লজেন্স কিনে দিতেন না। হাবিজাবি। তাই একটা নলের পর আরেকটা নল জমতে সময় লাগত। বেশ কয়েকটা জমেছিল আমার। উত্তরবঙ্গে চলে যাওয়ার দিন যে সব অসামান্য জিনিষ ফেলে চলে যেতে হয়েছিল তাদের মধ্যে ঐ রঙ্গিন কাগজের ছিপি আটকানো কাঁচনলগুলোও ছিল। তুচ্ছ খেলনাপাতি। আর কিছুদিন বাদে আরো একবার ফেলে চলে যাব - অজস্র তুচ্ছ রঙ্গিন খেলনা।
(চলবে কি?)
choto choto kothay apni chobi toiri kore kolaj kore bosen. darun lekha. chaliye jan
বড় মন আঁকড়ে থাকার মতো লেখা। :)