একটি বস্তি, তাতে ১০০ খানা ঘর, সেই ঘরগুলির মধ্যে অভিনীত হয়ে চলেছে বিচিত্র সব জীবন নাট্য, রচিত হচ্ছে তারা ক্ষণে ক্ষণে, কখনো রঙ্গীন, কখনো বা সাদা কালো। কিন্তু বস্তির বেড়ার বাইরেও রয়েছে বিশাল একটি দুনিয়া, সেখানেও ঘটে চলেছে অনেক কিছু, ভেতরের মানুষগুলোর সেসবের সাথে রয়েছে কোন না কোন সংযোগও, হোক সে ড্রেনের সরু-সংকীর্ণ নালি বেয়ে বা অন্য কোথ অচেনা পথে। কাঁটাবনের বস্তিটা যেন একটি ক্ষুদে গ্রহ, যার ১০০ ঘর বাসিন্দার উপর নজর রেখে চলেছে এক জোড়া চোখ, এক সার্বজনীন শুভবোধের সন্ধানে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে তারা প্রতিটা পাত্র-পাত্রিকে, উল্টেপাল্টে, কখনো বা, ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে তালাশ করছে ভেতরে কিছু আছে কিনা অমূল্য কিছু! এ করতে যেয়ে চোখজোড়া হিসেবে রেখেছে সময়কে, স্থানকে, বড় যত্নের সঙ্গে চলেছে চিত্রনাট্যের কাজ, যার অবধারিত ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর মুখ দেখে একটি মহৎ উপন্যাস, জ্বলজ্বল করে উঠে বাংলার সাহিত্যাকাশ। ১৯৭৩ সালে কালিকলম প্রকাশনী থেকে প্রথম প্রকাশিত প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের ‘জ্যোস্নায় সূর্যজ্বালা’ সম্ভবত তার সেই অল্প পঠিত উপন্যাসগুলির একটি, বাংলাদেশকে চিনে নিতে যার প্রয়োজন কখনোই ফুরোবার নয়।
“নিকষ কালো রাতে কবরের অন্ধকার সব জায়গা জুড়ে। …বস্তির চালাগুলো বুঝি এ অন্ধকারে দম আটকে দাঁড়িয়ে আছে। তার ভেতরের মানুষগুলো প্রেতিনীর আত্মা। বহু যুগ যুগান্তর হতে ক্ষুধার্ত হৃদয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আলোর দিকে এগিয়ে আসতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। কে যেন পিছন থেকে টেনে ধরে।“ কোন এক কোণায় ঘাপটি মেরে থাকা এই বর্ণনা যেন উপন্যাসটির জন্য একটি সম্পূর্ণ গতিপথ নির্দেশ করে; পেছন থেকে টেনে ধরা অদৃশ্য ভুতটিকে বের করে আনার এক শ্রমসাধ্য প্রয়াস দৃশ্যমান হয় তার সারা শরীরে।
রসিদা উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র। উপন্যাসটির শুরুতেই লেখিকা ইঙ্গিত রাখেন রসিদাকে নিয়ে তার অনেক কাজ আছে, বস্তির নর্দমায় মানবিকতার যে ফুল ফোটানোর কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন, সেখানে রসিদাকে অনেক কিছু করতে হবে, লেখিকার চশমাখানা যে রসিদার হাতেই ন্যস্ত রয়েছে, তার হাতে ধরা আছে তার অতি স্বচ্ছ ছাঁকুনিখানা! আর তাই রসিদা কাঁটাবন বস্তির ১০০ ঘর বাসিন্দার মধ্যে ভীষণই অন্যরকম, উপন্যাসটির সামান্য পথ এগুতেই রসিদার শাশুড়ির বর্ণনা থেকে পাওয়া যায় যার বিশ্বস্ত পরিচয়ঃ “প্যাডে নাই ভাত পোন্দে নাই কাপড় কিন্তুক ভালো মাইনষের বেটির কইলজা করে হাঁপর হাঁপর।“
এমনকি রসিদার পকেটমার স্বামী ওসমান পর্যন্ত বুঝতে পারে না তাকে। ভাত না পেলে তার মা চিৎকার করে ওঠে, গালাগাল পর্যন্ত করে ছেলেকে, ওসমানের তা সহ্য হয়; কিন্তু রসিদা যে সব কিছু নীরবে সয়ে যায়, সেই বদান্যতা ওসমানের অসহ্য। তাই যেদিন চুরির দায়ে জেলে ঢোকে, রসিদা শিক ধরে কাঁদতে থাকলে ভীষণ অবাক হয় ওসমান। আসলে রসিদাকে আর দশজনের ছঁকে ফেলা খুব কষ্টকর, কারণ তার চরিত্রটি তৈরী করা হয়েছে বহুবিধ উপাদানের (কখনো-সখনো পরষ্পরবিরোধী) জটিল সংশ্লেষে, আর তারই একটি নমুনা ফুটে উঠে এই লাইনটিতে, “ ‘ওসমান ছিল এ অনুভূতি যেমন ভয়ানক – ওসমান নেই এ অনুভূতিও তেমন তীব্র।“ ওসমানের তো মাঝেমধ্যেই মনে হত, তার স্ত্রীর মধ্যে জ্বীন ভর করেছে। শাশুড়ি ও স্বামী উভয়েই তার দিকে সমীহের দৃষ্টিতে তাকাতো, আর তাতে “রসিদার নিজের সম্পর্কে একটা মোহ জন্মেছিল। “
ওসমান যদিও বলে, রসিদার দুঃখ নাই, কিন্তু রসিদা তো আর ফেরেশতা না, যদিও লোকের করুণা কুড়োনোর ভয়ে সে তা প্রকাশ করে না, কিন্তু ‘মনের গহনে শ্বাসরুদ্ধ করা বেদনা আছে।‘ ফরিদপুরের এক অখ্যাত গ্রাম কামাড্ডায় রসিদার কৈশোরের নায়ক ছিল দবির। সে কানের কাছে যেন ফিসফিস করতে থাকে সারাদিন, রাঙা-বৌ, রাঙা-বৌ! অন্যদিকে, লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে ভেসে আসে ওসমানের শেষ কথাগুলি, ‘ধয্যি রাখিস! আবার ফির্যা আসুম!’ আর তাই ‘দ্বিধাবিভক্ত রসিদার চিন্তা পথহার পথিকের মতো কাঁটাবন বস্তির বেড়ার গায়ে মাথা খুঁড়ে মরে।‘ দবিরের বউ সকিনা বড় রাস্তার মুদির দোকানের মালিক জব্বারের কাছে চলে যাওয়ার তিনমাস পরই ওসমান জেলে যায়, “দবির ও রসিদার জীবনে যেন এ দু’টো ঘটনার এক অদৃশ্য যোগ ছিল। পাংশু নদীর বুকে যে জীবন ওরা বিসর্জন দিয়ে এসেছে তা বুঝি আবার কাঁটাবন বস্তির সীমানার মধ্যে বেঁচে ওঠার প্রয়াস পাচ্ছে?” একদিকে দবির ফোঁস করে ওঠে ‘তোর কোন সাধ নাই রাঙা-বৌ। থাইকলে এ্যাত পাষাণ হতি না। মাইনষের লাইগা এটটু দুখ করতি।‘ অন্যদিকে, ওসমানও সব সময় বলে এসেছে, সে বুঝতে পারে না রসিদাকে। লেখিকা এক নিপুন জীবন শিল্পীর মত বস্তির মধ্যে এঁকেছেন এমন এক চরিত্র, নর্দমা থেকে তুলে এনেছেন এমন এক সম্রাজ্ঞী, যে তার অগাধ সম্পদ নিয়ে আমাদের পাশেই অবস্থান করছে, অথচ আমরা তার খোঁজও রাখি না।
সকালে যখন রসিদা কাজে বেরোয় তখন কাঁটাবন বস্তির চালাগুলো মিষ্টি নরম রোদে মাখামাখি হয়, অথচ রাতে “বড় রাস্তার উজ্জ্বল বাল্ব থেকে ছিটেফোঁটা আলো এদিকে এসে পড়ে না।“ তখন কাঁটাবন বস্তি বদলে যায়, ‘’কাজ-ফিরতা মানুষগুলোর বিমিশ্র কণ্ঠস্বর বেপর্দার উচ্চগ্রামে অধিষ্ঠিত“ তখন। অনবদ্য চিত্রকল্পের বাহারে লেখিকা পরিষ্কার করেন বস্তির সেই অবস্থানকে, “বেড়ার ফাঁক দিয়ে বিভিন্ন চলায় প্রজ্বলিত কুপির ক্ষীণশিখা বস্তির অন্ধকার রাস্তার দেহে কুষ্ঠরোগের মতো সাদা সাদা হয়ে ছড়িয়ে থাকে।“
‘কাঁটাবন বস্তির একশো ঘর বাসিন্দার’ গল্পগুলো, শিশুর কান্না, সদ্য বিয়ে হওয়া যুগলের বিশ্রম্ভ আলাপের ফিসফিসানি, কোন দম্পতির বিশ্রী ঝগড়া, ছেলেমেয়েকে ধরে ঠেঙ্গানি – এসব কিছু ময়লা বীভৎস উৎকট গন্ধের মতই ‘রসিদার মগ্ন চৈতন্যে ঘা খেয়ে কাঁটাবন বস্তির ঘরে ঘরে ফিরে’ যেতে থাকে, যখন সে ‘বস্তির নিচু চাল ঘেঁষা রাস্তাটা দিয়ে মাথা বাঁচিয়ে যেতে গিয়ে গিয়েও কয়েকবার ঠোকর’ খায় নিত্য। রসিদার ‘সারা দেহ জুড়ে এত ক্লান্তি তবুও ঘুম আসে না’, হয়ত রসিদাকে জেগে থাকতে হয় সবার জন্য। এই যে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, রসিদ ‘আজকের দিনের সমস্ত ঘটনাগুলো একবার তলিয়ে দেখ আর চেষ্টা করে। সবগুলোর মধ্যে যেন অদৃশ্য যোগসূত্র আছে।“ রসিদার এই যে জীবন দর্শন, পাঠককে তা অভিভূত না করে পারে না।
রসিদার জীবন প্রতিদিন দুটো গ্রহকে ঘিরে আবর্তিত হয় – রাতের কাঁটাবন বস্তি থেকে তার পদার্পন ঘটে ভোরের ধানমন্ডিতে, যার একটি বাড়িতে হালকা নীল বাল্ব, নীল পর্দা, মিষ্টি গন্ধ ভুরভুর করে বের হতে থাকে। সেখানে কোন শব্দ থাকে না বটে, তবে মাঝে মাঝে ‘শুধু নিঃশ্বাসের গভীরতা বড় দ্রুত ওঠানামা’ করে, রসিদা শুধু দেখে যায়, আর এজন্য মিলে বখশিশ বেগম সাহেবার কাছ থেকে। সেখানে ‘কত বাতি দিনের আলোর মত ফরফর করে। যা খায় তার বেশি ফালান যায়।‘ যেখানে রসিদারা ‘মাথা ফাডাইয়া এটটুহানি’ পায়।
ওসমানের পকেটামারির কাহিনি পড়তে গিয়ে পাঠক আবিষ্কার করে যে , ‘সে হাসিতে কৌতুকের উপলব্ধি ছাড়া আর কোন তত্ত্বরসের সন্ধান ছিল না।‘ এ সেই তত্ত্বরস যার অনুসন্ধান করা হয়েছে সর্বত্র, যার একটি নমুনা মেলে কিছুদূর পরেই “‘মৃত্যুর পর মানুষের জন্য সাড়ে তিন হাত জায়গা নির্দিষ্ট থাকে কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে কতটুকু জায়গা তার প্রাপ্য তার কোন নির্দিষ্ট হিসেবে কেউ করে রাখেনি।“ লেখিকা যেন নিজের গড়া চরিত্রকে নিজেই বর্ণনা করেছেন নিখুঁত মনোবিজ্ঞানির মত, মনের গোপন বন্দরে ঘুরে বেরিয়েছেন সন্তর্পনে। প্রতিটা কথা, সংলাপ, ঘটনাকে বিস্তার দিতে চেয়েছেন।
উপন্যাসটির সবচেয়ে আকর্ষনীয় জায়গাগুলির একটি হল রসিদার সাথে তার বুড়ি শাশুড়ির সম্পর্কের নিপুন রসায়ন, যা একই সাথে জীবনের এক সার্থক দলিলও বটে। যে রসিদার নির্মম উপলব্ধি, প্রতিদিন বুড়ি ভাতের গামলাটার জন্যই অপেক্ষা করে, ওর জন্য নয়, সে-ই রসিদাকে একা ঘরে দম আটকে যাওয়া থেকে বাঁচায়। শুধু তাই নয়, “একটা নীচ স্বার্থপরের জঘন্য মনোবৃত্তির অনুশাসনে নিজেকে যাচাই করতে ভালো লাগে’ রসিদার। একদিন যখন রসিদা জ্বরের কারণে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না, বুড়ি শাশুড়ির যেন পুনর্জন্ম হয়; বেড়ার গায়ে গুঁজে রাখা ছোট্র তারে জড়ানো টিনের কৌটা থেকে ঝনঝন করে ওঠা পয়সা দিয়ে বার্লি কেনে সে বউকে সারিয়ে তুলতে। সেই পয়সা ফুরিয়ে গেলে বাজার থেকে হাত পেতে পচা-আধা পচা কমলা, কলা, পাউরুটি চেয়ে নিয়ে আসে শয্যাশায়ী রসিদার মুখে তুলে দিতে। এ করে করে বুড়ির ভিক্ষেয় হাতে খড়ি হয়, আর দুটো পয়সার মুখ দেখতে শুরু করে। এরপর রসিদা সুস্থ হওয়ার পরেও ভিক্ষের রাস্তা থেকে সে আর ফিরে আসে না, কারণ ‘খাঁচায় আবদ্ধ তার বুড়ি শাশুড়ির পঞ্চাশ বছরের জীবনে এ এক স্বপ্নবার্তা। সে স্বপ্ন নীল আকাশে ওড়ার স্বপ্ন – সে স্বপ্ন নিজেকে খুঁজে পাওয়ার মোহ।“
কিন্তু এই বুড়ি শাশুড়িই যখন কাঁথা মুড়ি দিয়ে পড়ে থাকে মুখ হা করে আর মাছি ভনভন করতে থাকে, রসিদার চোখে জল আসে। একদিন যখন বেড়ার ফাঁক দিয়ে রোদ বুড়ির মুখের উপর পড়ছিল, বেড়ায় গামছা গুঁজে দেয় সে। কিন্তু বুড়ি যে বেড়াটার মতই ফুটো হয়ে গেছে! সারা শরীর জুড়ে বরফ, একটুও বিরক্ত না করে নিঃশব্দে সরে পড়েছে। কান্না না, আতঙ্ক ভর করে রসিদার মনে - সমস্ত কাটাবন বস্তিটা যেন এক বিরাট সাগর আর তার মাঝে তার এক চিলতে ঘরটি যেন এক ভাসমান দ্বীপ।
‘মৃদু বাতাসে কুপির আলো কাঁপে’ আর তার মধ্যেই যমজ ছেলে প্রসব করে কেঁদে ফেলে রিকশাওয়ালা হাসুর বউ, ‘খাওয়ামু কি?’ পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো দবির ও রসিদা সাক্ষী হয় হাসুর অসহায় সংলাপেরঃ ‘সারাদিন রিশা বাইয়া আইলে শরীল একদম ভাইঙ্গা পড়ে – মন চায় মজা – ফূর্তি।‘ ঘরটি থেকে ফিরতে ফিরতে তাদের সাক্ষী হতে হয় বাতাসে দুলে দুলে উঠা ‘সদ্য বিবাহিত তারা আর জামালের বিশ্রম্ভ আলাপের ফিসফিসানি’র আর তার পরেই ওহাব আর রাহেলার অশ্লীল অকথ্য ঝগড়ার। রাহেলা বিপত্নীক চাঁদমিয়ার ঘরে উঁকি দিয়েছে, আর ওহাব তা দেখে ফেলেই চুলের মুঠি ধরে বউয়ের, যদিও ‘রাতের অন্ধকারে বুনো হয়ে উঠতে ওহাবের বাঁধে না। রাহেলার প্যাকাটির মতো দেহ থেকে মাংস খুবলে বের করে নরক সাজায় প্রতি রাতে।“ এভাবে উপন্যাসটি জীবনের অনেক বড় ক্যানভাস নিয়ে যেন নামে, রসিদা আর দবিরে চোখ দিয়ে জীবনের অনেক বড় চলচ্চিত্র দেখানোর আমন্ত্রণ তার।
রবীন্দ্রনাথের রক্তকরবী নাটকের একটি জায়গায় আছে, 'নরকেও সুন্দর আছে, কিন্তু সুন্দরকে কেউ সেখানে বুঝতেই পারে না, নরকবাসীর সবচেয়ে বড় সাজা তাই।’ ‘জ্যোস্নায় সূর্যজ্বালা’ উপন্যাসে যে অসাধারণ মানবিক চরিত্র এঁকেছেন লেখিকা রসিদা আর দবিরের মধ্য দিয়ে, মাঝে মাঝে সংশয় জাগে, এমন কি বাস্তবে পাওয়া যায়? কিন্তু লেখিকা তো শুধু এমন এক ছবি নির্মাণ করবেন না, যা শুধুই যা ঘটে চলেছে তার প্রতিচ্ছবি, লেখিকা তো তার স্বপ্নের সৌন্দর্যের জগতকেও আহবান করবেন। রসিদা ও দবিরকে বিবেক চরিত্রে রূপদান করাতে যাওয়া নিশ্চিত চ্যালেঞ্জের, বিশ্বাসযোগ্যতা বিনষ্টের শংকা প্রতি পদে পদে। কিন্তু লেখিকা এক নিপুন দক্ষতায় চিত্রনাট্য সাজিয়েছেন, যে একটুও অস্বাভাবিক ঠেকেনি কোথাও। খুব সচেতন ছিলেন তা বোঝা যায় চরিত্রদুটোর হঠাৎ হঠাৎ বাঁক বদলে, তাদের অনুভূতির সূক্ষ্ম আলোড়নে, যা উচ্চকিত নয়, কিন্তু যার সুতীব্র ঢেউয়ে ভিজেছে পাঠক প্রথম থেকে শেষ অবধি।
হাসুর বড় মেয়ে বেগমের প্যাঁকাটির মতো চেহারা, সানু মিস্ত্রির জোয়ান দেহে রসের জোগান দেওয়া ওর কর্ম নয়। তবু এ কথা বললে মেয়েটি যখন মুখ করুণ করে ফেলে, তখন মাত্র চার আনা দিয়েই সানু মেয়েটিকে ভোগ করে। পরে চুলের মুঠিটা চেপে ধরে বেগমের পোয়াতি শরীরটা যখন হিড়হিড় করে টেনে এনে মেঝের মধ্যে ফেলে, হাসু লাফ দিয়ে এসে বউর চুলের মুঠি ধরে, ‘মেয়ে তোর না আমার?’ হাসু সযত্নে মেয়ের মাথাটা কোলের ওপর তুলে নিয়ে এলোমেলো চুলের গোছাটা গুছিয়ে দিতে থাকে আর ভাঙা পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে অল্প অল্প। আরো পরে বেগম সানুর ঘরে মার শাড়ি গলায় পেঁচিয়ে ঝুলে পড়লে মায়ের উপর গালমন্দের ঝড় বয়ে যায়। পুরো লেখা জুড়েই এমন এক শিল্পীত দৃশ্যায়ন চোখে পড়ে, মানে, এই সংঘর্ষ, আর তার পরক্ষণেই সন্তাপ, তাই বিশ্বাসযোগ্যতার সীমা কখনো অতিক্রম করে না সম্পর্কের সংশ্লেষগুলি।
যখন পাশের ঘরের ছোট্র শিশু সোনা ওর ছোট্র মুরগির বাচ্চাগুলোকে আতাগাছের তলায় বসে মহানন্দে কুঁড়ো খাওয়াতে থাকে, রসিদার মাধ্যমে তখন যেন লেখিকাই বলে উঠেন, “এই ছোট্র সংসারটায় একটা চমৎকার ছন্দ আছে।‘’ সোনার বাবা দূর্ঘটনায় পা হারালে সোনার মা মুরগি, ছাগল ইত্যাদি পেলে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা, তুচ্ছ জিনিস নিয়ে কোন ঝগড়া নেই আর দশটা সংসারের মত। সোনাদের সংসারটাও আসে উপন্যাসে, কারণ এই বস্তির ক্যানভাসে লেখিকা যে পুরো পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে ধরতে চাইছেন, বিচিত্র সব জীবন, আর বিচিত্র তাদের আখ্যান, বিশ্বস্ত রঙ ও ইজেলের ব্যবহারে তিনি আঁকবেন মানবিকতা, অমানবিকতা, আশা, হতাশা, স্বপ্ন ও স্বপ্নভংগের গল্প।
উপন্যাসের একটি দৃশ্যে মতি নামের একটি বালককে রসিদার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে ফোঁপাতে থাকে - আর এক লোকের হাত ধরে চলে যাওয়ার আগে তার মা তাকে ভিক্ষা করে পেট চালানোর উপদেশ বিলিয়ে গেছে, অথচ সড়ক দূর্ঘটনায় বাবা মারা যাওয়ার পর মা’ই ছিল তার একমাত্র সম্বল। এর ঠিক পরেই আসে মোস্তফার মায়ের গল্প, অনেকদিন খোঁজ পেয়ে এসেছেন ছেলেকে দেখতে। অথচ বুড়িকে সেই ছেলের মুখেই শুনতে হয় ‘য্যামনে আইতে পারছেন ত্যাম নে ফিরা যান গা’। বউ ঘরে শাশুড়িকে ঘরে আসতে বললে তাকেও শুনতে হয় ‘তুই চুপ কর মাগি।‘ প্রচলিত ধারণার বাইরে এক মানবিক ছবি আঁকা হয় পুতের বউয়ের, যা আসলে বিশ্বস্ত চোখের কারুকাজ লেখিকার। এরপর ‘মা অইয়া আমার মাতা কিনছে। মা অইতে কৈছিল কেডা?”- লেখিকা যেন মোস্তফার এই বিদ্রুপ-সংলাপের মধ্য দিয়ে এক সূক্ষ্ম অভিমানের ইংগিত রেখে যান, যেন তাকে জন্ম দেয়ার জন্য, এমন ক্ষিধে ও দারিদ্রপীড়িত জীবনে নিয়ে আসার অপরাধে তার মায়ের এমন শাস্তি প্রাপ্য। অনেক পরে ধানমন্ডির সাহেবের বাসাতেও বাবাকে তাড়িয়ে দেয়ার এরকম দৃশ্য দেখে রসিদা – চিরায়ত সম্পর্কগুলোয় ছোট-বড়, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষে কোন ভেদাভেদ নেই, তাই যেন উচ্চকিত হয়ে উঠে। একদিকে মতির ব্যাকুলতা মায়ের জন্য, অন্যদিকে মোস্তফার মায়ের আকুলতা ছেলেকে পাওয়ার জন্য, দুটো ছবি আঁকেন পাশাপাশি। পরষ্পর সাংঘর্ষিক হলেও আসলে জীবন তো এরকমই, কোন সরল রেখায় কখনোই আঁকা যায় না, চলে না কোন সূত্রে আবদ্ধ করা, বিচিত্র এক রেল লাইন ধরে এবড়ে থেবড়ো পথ ধরে চলে সে, সবসময়।
সাধু মুন্সি যখন পরকালের পথ ছাফা করার জন্য মসজিদে যাওয়ার কথা বলে, দবিরের ফুঁসে উঠে, ‘যার এইকালই নাই হের আবার পরকাল কী…?” দবিরের কাছে ‘জীবনের অর্থবোধ যেন অজস্র শূণ্যতার ফাটলে ভরা। জীবনের সঙ্গতি যেন ও কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না।‘ সকিনা চলে যাওয়ার পর মনে হয়েছিল মুক্তি এসেছে, কিন্তু পরে তা থিতিয়ে যায়, মনে হয় ‘বন্ধনের মাঝেই বুঝি মুক্তির স্বাদ লুকিয়ে আছে।“ বড় কৃষ্ণচূড়া গাছটায় হেলান দিয়ে বসে থাকা অবস্থায় এগিয়ে আসা রিকশাটায় জব্বার মিয়া আর সকিনাকে দেখে ধক্ করে উঠে বুকটা, রাজপথের প্রসারিত উদাররত দবিরের সহ্য হয় না, “ওর কেবলই মনে হচ্ছে পথ যদি ওদের রিকশাটা উল্টিয়ে ফেলে দিত।“ এভাবে বুকের ওঠানামার মত চরিত্র ওঠানামা করতে থাকে, ধড়ফড় করতে থাকে ক্রমশ।
যে দবির ‘বৌয়ের সোয়ামির’ কাছ থেকে পাওয়া রেডিও বাজাতে বাজাতে রাস্তায় ঘুরতো, সে-ই একটা সময় সুলতানের দোকানে চাকরি করার পাশাপাশি নিউমার্কেটের এক দোকানেো কাজ নেয়, কাজে ডুবে থাকলে স্নায়ু শান্ত হয় সত্য, তবে মতি যখন চিৎকার করে পড়া মুখস্ত করে, তার বিচিত্র ধ্বনি দবিরের কানে শান্তির তরঙ্গ বইয়ে দেয়। রসিদাই অসহায় মতিকে দবিরের বুকে তুলে দেয়, তবে এত শুধু মতিই নয়, দবিরও যেন জীবন ফিরে পায়।
যখন নইমের সাথে মারপিট করার পর আরেক কিশোর ভজার ফুলো ফুলো চোখের প্রান্ত বেয়ে অবিরল ধারায় যখন পানি গড়াতে থাকে, তখন উঠে আসে আরেক আখ্যান, বস্তির জীবনের হলেও মানুষের জীবনেরই এক চালচিত্র যেখানে শিশুদের কি মূল্যই না চোকাতে হয় বাবামায়ের স্বাদ বদলের কারণে। এই উপন্যাসটি সবার কথা বলেছে, কোন ব্যক্তি, বিশ্বাসের প্রতি তার নেই পক্ষপাত, যা ঘটে চলেছে সব দেখতে চেয়েছে অনুবীক্ষন যন্ত্রে, বিশ্লেষন করতে চেয়েছে, অপূর্ব এক মনোসমীক্ষণ।
দোকানের আট আনা বাকি শোধ করে রহম শেখ বৌ আর ছেলেমেয়ে নিয়ে পোঁটলাপুটলি কাঁধে করে গ্রামে ফিরে যাওয়ার আগে উপলব্ধি করে, ‘গায়েও কাম আছে ভাই। হাল বামু-মাছ ধরমু-নৌকা টানমু। কত কাম! কামের শ্যাষ নাই!’ কাঁটাবন বস্তি ছয় মাসেই তার মোহভঙ্গ ঘটিয়েছে, ‘তোমাগো ইহানে হাঁফ ফালাইবার জাগা নাই … গাঁয়ে আমার বাতাস আছে।“ আসলে বোঝা যায়, কর্মের সাথে কর্মস্থলের একটা নিবিড় যোগ আছে। তারপরও যারা থাকে, তারা কোন টানে বা মায়ায় থাকে, তারই অনুসন্ধান চলে উপন্যাসটির পাতায় পাতায়! রহম শেখের বিদায় দবিরকে এক অকারণ স্বস্তি যোগায়, ওকে ‘একটা স্থির প্রশান্তির আলোকে স্নাত করে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে, কাঁটাবন বস্তির এই অসংখ্য কোলাহলের মাঝ থেকে রহম শেখের প্রস্থান যেন শান্তির পথে প্রস্থান।“ অন্যের মুক্তির হাওয়া তাকেও যেন পরশ বুলিয়ে যায়, মুক্তির হাওয়ার এমনি গুন।
মেঘের ভারে ভ্যাপসা গরম, আর সেই ভারে আকাশ ভেঙে পড়তে চায়, কাঁটাবন বস্তির নব্বইটা ঘরেই পানি পড়ে, তারা ঘুমোতে পারে না, কিন্তু একমাত্র ভিন্ন দবির, যাকে লেখিকা রোমান্টিকতায় চিত্রিত করেছেন আগাগোড়া, বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দে তার চোখের পাতা ভারী হয়ে ওঠে, স্নায়ুগুলো অবশ হতে হতে ঝিমিয়ে যায়। ফর্সা রঙের আম্বিয়ার ভাসা ভাসা চোখের দিকে তাকিয়ে দবিরের পাংশু নদীর টলটলে স্বচ্ছ পানির কথা মনে পড়ে, লেখিকা এভাবে দবিরকে আরো বিশ্বস্ত করে তোলেন, ওর নিঃসঙ্গ জীবনে রসিদা ছাড়াও অন্যদের চোখে ভাসা মহত সাহিত্যের দাবি মেটায়।
উনসত্তরের আঠারই ফেব্রুয়ারি। নিউমার্কেটের একটি মিছিলে না বুঝতেই ঢুকে পড়ে দবির, সেও অন্যদের মত ‘বাঁচার মত বাঁচতে চাই’ শ্লোগান ধরে, ‘মিছিলের শোভাযাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপে ও যেন অনুভব করল কাঁটাবন বস্তির আলোবাতাসহীন এক টুকরো ঘর আর মরিচডালা পান্তাভাতের মধ্যে বেঁচে থাকার কোনো সার্থকতা নেই।“ কিন্তু যখন ‘কিছু করতে চাই’ বলে তার সবল পেশিবহুল হাত উত্তেজনার একটা অদ্ভুত কর্মশক্তিতে তখন মতি তাকে টেনে ধরে। মতিকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। বস্তির অন্য ছেলেরা, যারা চায়ের দোকানে, লোকের বাসায় কাজ করে, নিউমার্কেটের সামনে লোকের গাড়ি পাহাড়া দেয়, কাগজ কুড়োয়, মিস্তিগিরি করে আর মেয়ে দেখলেই শিস, অশ্লীল বাক্য ছাড়ে, এভবে ‘’নোংরা জীবনের উত্তেজনা প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে’, মতি সেই ডেপোগুলোর মত হবে, দবির তা ভাবতেই পারে না। কিন্তু সেই মতিই তার সমান লম্বা হয়ে যখন মগটা ঘুরাতে ঘুরাতে বলে, আদমজি চটকলে কাজ নিবে, স্বপ্নের প্রাসাদ ভেঙে গুড়িয়ে গেলেও দবিরের বোধোহয় হয়, মতি নিরীহ পিয়ন হয়ে কেবল ধুঁকতে ধুঁকতে বাঁচতে শিখবে, বিদ্রোহের আগুন জ্বালিয়ে ছুটতে পারবে না। এ যেন এক আত্মসমর্পন, যা গল্পটির বিশ্বাসযোগ্যতার পারদকে অন্য মাত্রায় উপনিত করে।
‘বস্তি জীবনে কোন আব্রু নেই। গায়ে গায়ে লাগা বেড়ার ঘর। ফিসফিসিয়ে কথা বললেও শোনা যায়। ফুটোর মধ্যে চোখ লাগালে প্রতিটি জিনিস খুব ভালোভাবে দেখা যায়।‘ মতিদের ফেলে যাওয়া ঘরে সেকান্দার আলী নামে যে নতুন ভাড়াটে উঠেছে, তার উন্মুক্ত নিঃশ্বাস ঘনঘন পড়তে থাকে, ব্লাউজটা খুলতে গেলেও চারপাশ চোখ বুলিয়ে নিতে হয়। আবার সেই রসিদার অন্তরেই পুরুষের বিশাল বুকে মুখ গুঁজে স্বপ্ন দেখার বাসনা গুমগুম করে। একদিন বিদ্যুতের চমকে কাঁটাবন ঝলসে যাচ্ছে। দোকান বন্ধ করে দবির রসিদার হাত ধরে মৃদু আকর্ষণ করে। একটা দমবদ্ধ করা উৎকণ্ঠা গলার কাছে কাঁটার মতো বিঁধে থাকে রসিদার, সযত্নে নিজেকে গোপন করতে থাকে, ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে পারিপার্শ্বিকের সব ঘটনা। যখন দবিরের নিঃশ্বাসের উত্তাপ গায়ে এসে লাগে, রশিদার কান্না পায়, ‘ভয়ানক ইচ্ছের কান্না’। যখন দরজাটা অল্প ফাঁক করে দাঁড়ায়, বৃষ্টির জোর কিছু কমে আসে, পেছন থেকে দবির কাঁধে হাত রাখে, ঝরঝর কেঁদে ফেলে রসিদা, রসিদা ‘অয় না’ বলে অন্ধকারে পথ খুঁজে এক রকম দৌঁড়াতে থাকে। আবার সময়ের সিড়ি বেয়ে নাটকের শেষাংশে যখন দবির ওসমানের বালিশটা নিজের কোলের ওপর টেনে রসিদার দিকে তাকায়, সমস্ত ব্যাপারটা উপলব্ধি করেও রসিদা নিজেকে মুক্ত করতে চায়নি। ওর বুকের জমাট কানান বরফ গলা নদী হয়ে ছুটে বেরিয়ে গেছে। যখন মুরগিগুলো বাগ দিচ্ছে, তখনও দবির রসিদার বুকে মুখ গোঁজে, ‘না বেহান অয় নাই – অয় নাই। কনুদিন অইব না।‘
একদিন নওয়াবপুর রোডে গাড়িঘোড়ার ব্যূহ ভেদ করে ওয়াইজঘাটের সরু চিপা গলিতে ছোট পুরনো বাড়িতে দবিরের হাতটা টেনে নিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয় হাবিব। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেও নিজ দেশেই দেশদ্রোহীতার অভিযোগে দীর্ঘদিন জেল খাটা সরদার আমিন ফজল ঘরটিতে বসে কাজ করছিলেন। ঘরের দেয়ালভর্তি মাকড়সার জাল, সময়ের ছবিভর্তি রেলটা সরে যাচ্ছে দ্রুত, হারিকেনটা মিটমিট জ্বলতে থাকা হারিকেনটার স্বল্প ছায়া বৃদ্ধের তোবড়ানো গালের চামড়ায় লুকোচুরি খেলতে থাকে। লোকটির নিভাজ কণ্ঠে ‘এ দেশের মানুষের লড়াই গদির জন্য লড়াই। এরা আর কারো কথা ভাবতে পারে না।‘ – এমন সংলাপ বিস্মিত করে দবিরকে। যখন দেয়ালের গায়ে অসংখ্য খুদে মাকড়সা দেখে সরদার সাহবে বলেন, কখন ওদের জন্ম হয়েছে টেরই পাননি, রাজনৈতিক ঘুনপোকার এক প্রচ্ছন্ন আভাষ পায় পাঠক। সম্রাটের আসন যার প্রাপ্য ছিল সে বিনা চিকিৎসায় অখ্যাত অজ্ঞাত হয়ে এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লে, প্রশ্ন করে হাবিব, ‘আমরা কি শুধু এ অন্যায়ের দ্রষ্টা হবার জন্যই জন্মেছি।‘
একটা সময় ‘সোন্দুর কাপুড়, চুল বড়, খালি সিগারেট টানে, বহুত পইসা কামাই আনছে‘ এমন বর্ণনার সাথে মিলিয়ে রসিদার মনে হয়, ওসমান একটা ধূর্ত শয়তান হয়ে ফিরে এসেছে। যখন দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে ট্যাকে গোঁজা টাকার ওপর হাত রেখে কোমরটা জড়িয়ে রসিদাকে বুকের কাছে টেনে এনে গোঁ গোঁ করতে থাকে, রসিদার হিমশীতল চোখ দিয়ে ফেটে পানি আসে। দুইশ ছেচল্লিশ টাকা রোজগার করে কাঁটাবন বস্তির সম্রাট মনে করতে থাকে সে, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরের ছন্নছাড়া জীবনে একটি স্বাধীনতা ছিল। যাকে কোনদিন পুরুষ বলে গণ্য করেনি ওসমান, সেই দবিরকে দেখে মাথাটা বন করে উঠে, ‘বারবার মনে হয় দবিরের অক্ষম ও দুর্বল পৌরুষের অন্তরালে সর্বনাশা আগুন আছে। সে আগুনের দীপ্তিহীন নীল আলো ওসমানের সংসারজীবনকে দহন করে চলেছে।‘’ এরপর পরোটা ও ভাজি নিয়ে পথের পাশে এসে দাঁড়ায় যেখানে তার বুড়ি মা ভিক্ষাকর্মে নিয়োজিত ছিল। সেখান রাস্তার ওপর আঁকিবুকি কাটতে কাটতে শরতের নিরুত্তাপ রোদে একটি খসড়া পরিকল্পনা করে ফেলে সে। কিন্তু মার ‘আজ কদিন ধইরা খাই নাই। সাব গো দুগা পইসা দেন‘- সুর তার ধ্যান ভাঙ্গায়, বুড়ির টিনের থালাটা এক লাথিতে ফেলে ব্জ্রমুঠিতে পিঠের উপর গুম গুম কিল বসিয়ে তার দুর্বল শরীর হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলে। তেল চিটচিটে বালিশটা বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে কাঁদতে থাকলে বুড়ি ওসমান আবার ঘা বসায়, রসিদা প্রতিবাদ করলে তাকেও চুলির মুঠি ধরে, “তোরা সব ভিখারি। ভিখ মাইগা খাইতে শিখছস‘ হাঁকিয়ে উপন্যাসটি থেকে স্থায়ীভাবে বিদায় নেয় সে। ওসমানের মানবিকতা, অমানবিকতা, সন্মানবোধ, আর পশুত্ব - সব খুব স্বল্পদৈর্ঘ্যে একে একে ফুটিয়ে তোলা হয়।
বছরের শেষে, বোধ করি, উপন্যাসটির জীবনসায়াহ্নেও, হুহু করে শীত ঢুকে পড়ে কাঁটাবন বস্তিতে, তবে নির্বাচনের জোয়ারে বস্তিবাসীর চোখে রঙ্গের নেশা। জয়তুনের নানির ভাঙা গালেও ঝিলিক, “নৌকায় ভুট দিলে ধান চাইল মাছ গোছ বেবাক হস্তা অইয়া যাইব। এমুন ছিঁড়া তেনাও আর পিন্দা লাইগব না।“ শেখ মুজিব আর নৌকার রঙ্গিন পোস্টারে বস্তির চেহারা বদলে যায়। রসিদার মনে হয়, যদি সব কিছু এমনি করে বদলে যেত। কিন্তু ওর চৌদ্দ পুরুষ তো জীবনের পথ পরিক্রমা করেই চলেছে, বস্তির ভাঙা বেড়ায় দালান উঠেনি। হাবিব বলে “মুক্তির পথ এ নয়। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার হস্তান্তর হবে মাত্র। বুর্জোয়া ক্লাসের মধ্যে দিয়ে কি আর সাধারণ মানুষের মুক্তি আসে?” হাবিব তবু নির্বাচন করতে চায়, কিন্তু মতি চায় বন্দুক ধরতে, রসিদা খালাকে সে বলে ‘’কাইড়া আইনতে না পাইরলে কেউ যে দ্যায় না এইডা তুমি বুজ না? বেবাক পাঞ্জাবি কুত্তা।‘’ ওদিকে রসিদার মনে হয়, “নৌকাও যা কুঁড়েঘরও তা, লাঙ্গলও যা লন্ঠনও তা। অন্ধকারে আর কিছু দেখা যায় না।“
রসিদার ঘরে নতুন কেনা মাদুরের ওপর ছেঁড়া কাঁথা বিছিয়ে বাসরশয্যা তৈরী হয় মতি আর মৈফুলির জন্য। আর এরপরই দবির ঘোষনা দেয় যে, সে সন্ধ্যার লঞ্চে পরদিন গ্রামে ফিরে যাবে। ওসমানের জেল হবার পর যে শক্তি পথ চলার প্রেরণা দিয়েছিল, রসিদা তা খুঁজে পাচ্ছে না। আলগা হয়ে এসেছে মনের গ্রন্থি। ও চায় আশ্রয়। সংকোচ অত্রিক্রম করে জয় করতে হবে সংস্কারকে। দবির বিদায় নিতে এলে সেও দবিরের সাথে রেলিং্যের এক পাশে জায়গা করে নেয়, বুকের মধ্যে হাসুর দ্বাদশ ছেলেটি, যে জন্মেই হারিয়েছে মাকে, ঘুমিয়ে থাকে। রসিদার ইচ্ছে করে, নদী যেমন মাটির বুকে মুখ গুঁজে আছে, ঠিক তেমনি করে দবিরের মুখ গুঁজে শুয়ে থেকে জীবনটা পার করে দিতে।
লেখিকা কি কোন শ্রেণী সংগ্রামের গাঁথা আঁকতে চেয়েছেন উপন্যাসটিতে? গোর্কির ‘মা’ বা ‘একদিন যারা মানুষ ছিল’ উপন্যাসের মত? আসলে উপন্যাসটি পুংখানুপুংখ পাঠ করলে বোঝা যায়, এমন কোন দিকে নিয়ে যাওয়া লেখিকার উদ্দেশ্য ছিল না, তিনি যেন এক পর্যটক, যুগযন্ত্রনাকে বুঝে নিতে চেয়েছেন সমূলে, হ্যাঁ, একজন লেখকের দায়িত্ববোধ থেকেই, তিনি খুবই নিঃশব্দে চোখ খুলে দিতে চেয়েছেন প্রথমে দবিরের, পরে মতির মাধ্যমে, একজন কল্পিত নেতার চরিত্রকে সামনে রেখে, কিন্তু যখন মতি চোখ মেলতে শুরু করেছে, তখনই পর্দা টেনে দিয়েছেন মঞ্চের। দবির ও রসিদার গ্রামে ফিরে যাওয়া মনে হতে পারে এক প্রকার মিলনাত্বক সমাপ্তি কাহিনিটির, কিন্তু এ যেন এক অনিশ্চিত যাত্রা, তারা স্বপ্ন দেখে সত্যি, কিন্তু গ্রামে কী অপেক্ষা করে আছে পাঠকের তা অজানা, এমনকি মতি কি করতে যাচ্ছে, সেও তো অজানা। মতি কি এক শ্রেণী সংগ্রামের ডাক দেবে, যার ইংগিত লেখিকা দিয়ে রাখেন তার সংলাপে, নাকি, সেও অন্যদের মত বাচ্চা ফুটিয়ে যাবে, আর একটি গতানুগতিক জীবন কাটিয়ে যাবে ( “অশান্ত প্রাণটা হাঁসফাঁস করে। যদি না বুঝত জীবনের এতো শক্ত প্যাচ।…নিজেকে আবিষ্কার করার মতো দুঃসহ যন্ত্রণা আর কী আছে?’) সেই অর্থে ‘জ্যোস্নায় সূর্যজ্বালা’ কোন সমাধানসূত্র নয়, বরং, এক বিরাট জিজ্ঞাসা!
‘কিন্তু সূর্য থেকে এক ধরণের আলো বেরুলো
মনে হল না, ততো বিরক্ত
আর আমি, নিজের ঝঞ্জাট ছেড়ে ..
উজ্জ্বলতার সাথে কথা বলতে থাকলুম
আর সূর্য বলবেঃ তোমরা ভুলে যেও না –
তোমরা পরষ্পরের জুড়ি, বন্ধুও বটে’ (মায়োকোভস্কি, একটি অদ্ভুত রহস্যময় অভিযান)
পাদটিকাঃ
১. ‘ নির্মোহ যন্ত্রণায় সমাচ্ছন্ন দবির চিৎকার করে ওঠে এক অব্যক্ত যন্ত্রণায়।‘ /‘কেননা দবিরের সঙ্গতি না থাকলেও চরিত্রের মধ্যে কোন স্থিতি ছিল না।‘- এমন কিছু জায়গায় সম্পাদনা প্রয়োজন বলে মনে হয়েছে।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।