লাইভ ভিডিউটির দিকে নির্বাক তাকিয়েছিলাম, করার কিছু ছিল না আমার। মেঝেতে শুয়ে সমানে চিৎকার করছিল, ইন না, ইন না, না, না। মাথা ভর্তি কোঁকরানো চুল আলুথালু হয়ে রয়েছে। চোখ-মুখ ফুলে বিভৎস আকার ধারণ করেছে।
একটা কল, প্রথমে জোরালো শব্দে আবেদন, পরে নোটিফিকেশান বার্তার আঘাতে ভিডিওটির উপর পর্দা ফেলে দিল। আমি কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলাম বার্তাটির দিকে, বুঝতে পারছিলাম না কি করবো। জানি না, আজ কি তৈরী করে রেখেছে সে আমার জন্য? প্রতিদিনই থাকছে নিত্য নতুন চমক। সপ্তাহের শুরুতে গান ছিল, গতকাল তো কিছু অভিনব খাবারের দৃশ্যধারণ করে পাঠিয়েছিল। আরও কিছুটা সময় দোনামনা করার পর না ঢোকারই সিদ্ধান্ত নিলাম। তবে যে ভিডিওটি হাতে ধরা ছিল, তাও আর অন করলাম না। ফোনটা সরিয়ে রেখে সিলিংয়ের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।
সুহা। আমার এই সাড়ে চার বছর বয়েসী ভাগ্নিটা দেখতে, কথা-বার্তায় একেবারে ডলের মত। ও যখন হাঁটে, তখন ডলের মত করেই পা ফেলে। যখন হাসে, তখনো তেমনি। ওর বয়সী অন্যরা যখন খেলে, তখন ও তাদের ধারে-কাছেও যায় না। ওর পিঠাপিঠি ভাইবোনদের সাথেও সব সময় একটা দূরত্ব রেখে চলে। ও সব কিছু দূর থেকে দেখে, আর ভাবে। তারপর সব কিছু সবিস্তারে বলে। না, বাবা বা মাকে নয়, আমাকে। এই মামাই হচ্ছে তার দুনিয়ার প্রায় সবটুকু। ধরুন, মা খেতে ডেকেছে, ছুটতে যেয়ে হয়ত হোঁচট খেয়েছে, আর যায় কোথা! সঙ্গে সঙ্গে মামার আদালতে নালিশ। ‘আমি ব্যথা পাইছি’ বলে শরীরের কোন একটা জায়গার দিকে সে মামার দৃষ্টি আকর্ষন করবে, আর মামা হন্তদন্ত হয়ে সেখানে হাত ছুঁইয়ে মালিশ করে দেবে, চাই কি ফুঁ দিয়ে ভাপও দেবে। কিন্তু তাতেই হচ্ছে না, আরও কাজ বাকী থেকে যাচ্ছে; যেমন, মামাকে ছুটে যেতে হবে সেই দানবীয় স্থানটাতে যেখানে সে পড়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পা দিয়ে আঘাত হানতে হবে সেখানে, তারপর সুহার ব্যথা ভোজবাজির মত উধাও হবে, আর সে উড়তে শুরু করবে প্রজাপতির মত।
সুহা পাগলামি করবে জেনেও আজ নিয়ে এসেছিলাম বাসায়, ওদের বাসাটা আমাদের বাসা থেকে মাত্রই কয়েক দালানের দূরত্ব। আজ আমাদের বাসাটা ছিল খালি, আর আজই এসেছিল উর্মি। আমার পুরনো বান্ধবী। কাছেই একটি বাড়িতে ছিল তার মেজ ভাইয়ের ফ্ল্যাট, সেখানে দুপুরে খেয়ে দেয়ে সে ভাবল, বিকেলটা আমার বাসায় একটু জিরিয়ে যাবে। এছাড়া আমার ফ্ল্যাটটা থেকে যে পুরনো জমিদার বাড়িটা চোখে পড়ে, সেখানেও কয়েকটা মুহূর্ত কাটিয়ে আসার ইচ্ছে তার; আমার ফেইসবুকে বিচিত্র অলংকারে সজ্জিত প্রাসাদটা দেখার পর থেকেই অস্থির হয়ে উঠেছে সে। যখন উর্মিকে নিয়ে এগুচ্ছিলাম সেদিকে, হঠাৎ করেই সুহার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল, জানালাটা ধরে একমনে তাকিয়ে থাকে সে প্রায়ই প্রাসাদটার দিকে, আর তারপর গলাটা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘আমায় নিয়ে যাবে ওখানে?’ ওর মা রাজী হচ্ছিল না ভর দুপুরে মেয়েকে ছাড়তে। প্রাসাদটা দেখা হলেই দিয়ে যাব, এই শর্তে নিয়ে এলাম বটে, কিন্তু সুহা সেই যে আমায় জাপটে ধরলো, এরপর আর নামলো না, এমনকি আমার স্বাভাবিক নড়াচড়াতেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করে চললো। ঐ অবস্থাতেই আমি উর্মির সাথে কথা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু এক সময় সুহা মোচড়াতে শুরু করলো, পরে টানাটানি, গুঁতোগুঁতি – তার একটুও ভাল লাগছে না এখানে, সে বাসায় যাবে। আমি মুক্তির সুযোগ পেয়ে ফোন করেছিলাম তার বাবাকে, নিয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু সে এসে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পরেও সুহা যাওয়ার নামটি নিল না, এমনকি ভাল করে বাবার মুখের দিকে তাকালো না পর্যন্ত। বরং আগের থেকেও শক্ত করে ধরে রাখলো আমায় আর কথাবার্তা শুনতে লাগলো মনোযোগী শ্রোতার মত।
উর্মির সাথে অনেক দিন বাদে দেখা, আমাদের কথাবার্তা দ্রুতই বাঁক বদল করছিল। নিরক্ষরেখা, ক্রান্তিয় পার হয়ে কখন যে সে মেরুবৃত্তকে অতিক্রম করে যাচ্ছিল টেরই পাইনি। এক পর্যায়ে কোন একটি বিষয় নিয়ে আমরা দুজনেই হেসে উঠেছিলাম, যা শব্দবহুল ও দীর্ঘস্থায়ী ছিল। আর সে সময়টিতেই সুহা তার অস্তিত্বকে প্রকটভাবে জানান দিল; নড়াচড়া দিয়ে শুরু, এরপর মৃদু স্বরক্ষেপণ, চিৎকার, এবং অন্তিমে কান্নার ঝড় – তার বার্বি ডল চাই, এক্ষুণি, এই মুহূর্তে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল, আর উর্মি ঘড়ি দেখতে শুরু করেছিল। বিদেয় হলেই ভাল, ভাবলাম আমি, ভাল লাগছিল না আমারো! পরে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে যাব উর্মিকে, সেখানেও বাঁধ সাধল সুহা। অগত্যা ফ্ল্যাটের সামনের লিফটেই বিদায় জানাতে হল উর্মিকে।
মনটা খচখচ করতে লাগলো, সেই অবস্থাতেই সুহাকে পাড়ার একটি দোকান নিয়ে বার্বি ডল কিনে দিতে হল। পরে যখন ওকে দিয়ে আসতে ওদের তেতলার বাড়িটাতে ঢুকলাম, সে তার মাকে হন্তদন্ত হয়ে আনন্দ সংবাদটা জানালো, মামার কাছে থাকছে সে আজ রাতে। সুহার মা কিছুক্ষণের মধ্যে যে রুদ্ররূপ ধারণ করলো, আমি প্রমাদ গুণতে শুরু করলাম। এক পর্যায়ে সুহাকে আস্তে করে ড্রইং রুমে নিয়ে এসে বোঝালাম, “আমার রুমের সাথেই ঐ যে পুকুরটা, ওখানে ভুত থাকে, মা… !” কথাটা শুনে সে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ! তারপর আমার হাতটা শক্ত করে ধরে রাখলো যেন পালিয়ে যেতে না পারি। তাকে রেখে আসার জন্য যত প্রকার কৌশল প্রয়োজন ছিল, সব প্রয়োগ করা হল। তারপরো যখন সে আমার হাত ছেড়ে দিল না, ব্যাগ গোছাতে বললাম। নতুন কেনা বার্বি ডলটা, একটা রাইমসের বই, একটি ড্রয়িং খাতা, রং পেন্সিল, একটা চুইংগাম এর প্যাকেট, আর ঈদের জমানো কিছু সালামি ঢুকিয়ে ব্যাগটা কাঁধে পুরে যখন সে ড্রইং রুম আসে, তখন দেখে মামা নেই, আর ছিটকানিটাও উপর থেকে লাগানো রয়েছে, যার নাগাল সে চেয়ারে দাঁড়িয়েও পেতে পারে না!
আবার একটা শব্দের ঝাঁকুনি খেয়ে স্মার্টফোনটা নড়ে উঠল। শায়লার বার্তা। আবারো সে ছেদ টেনে দিল পর্দায়, তবে এবার প্রদর্শিত হচ্ছিল মনের ভিডিও। সে একটা কিছু দেখাতে চাইছে, এবং পাগল হয়ে উঠেছে। কল বাটনটি অন করে দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে কিছু শব্দের বিদ্যুত, কাঁপা, কাঁপা ভঙ্গিতে! “খাওয়াদাওয়া হইছে? একটা ছবি আঁকলাম, কেমন হইছে দেখবা একটু?“ একটা লাভ ইমো ছেড়ে দিয়ে আমি জানালাটা মেলে দেই। বিশাল পুকুরটা চোখের সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রতিদিনই প্রদর্শন করে সে নিজেকে, তবু এতটুকু ক্লান্তি নেই, নিত্যনতুন সাজ নিয়ে হাজির হয়। অযত্নে-অবহেলায় তার বুকে পানা জমেছে, আগের থেকে অনেক রুগ্ন দেখায়, কিন্তু এখনো পাখিরা আসে। মাছরাঙাগুলো টুপ করে ডুব দিয়ে মাছ মুখে করে ফিরে আসে এর পাড়ে বসত গাড়া গাছের ডালে! তবে এ দৃশ্যকেও হার মানায় বর্ষা। যখন নামে অঝোর ধারায়, তখন যে কত জলের মুক্তো তৈরী হয় পুকুরটিতে, আর চারপাশে নক্ষত্রের মত ছড়িয়ে পড়ে; সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য যারা না দেখেছে, কেউ বিশ্বাস করতে পারবে না।
ভরা পূর্নিমায় প্রাসাদটিকে তাজমহলের মত দেখায়, আর তার পুরো ছবি ফুটে উঠে এই আয়তকার পুকুরটিতে। শোনা যায়, এক জমিদার আরেক জমিদারের কাছে অপমানিত হয়ে এই বাগান ও প্রাসাদ গড়ে তুলেছিল। কিন্তু প্রাসাদটির নির্মাণ শেষ হওয়ার আগেই সে দেউলিয়া হয়ে যায়। অনেক জমজমাট আসর বসতো এখানে, নাচ-গানে ঘেমে-নেয়ে উঠতো কত শত তপ্ত হৃদয়, সুরের ঝংকারে কেঁপে উঠতো প্রাসাদটির ইট-পাথরের প্রাণ। সুরের স্রোত চলমান ছিল জমিদারী প্রথা বাতিল হওয়ার পরেও। তখন এটি পুরোদস্তুর শ্যুটিং স্পট, কত নামীদামী নায়িকার নৃত্য-গীতে মুখরিত হয়েছে এর গোলাপ বাগান, শান বাঁধানো ঘাট আর আলোকিত নাচঘর। এখন অবশ্য প্রাসাদটি একদম নীরব হয়ে গেছে, অচিরেই পোড়ো বাড়ির আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। এর চারপাশটা এককালে গ্রাম ছিল, অথচ এখন শুধু দালান আর দালান, আর তাতে মুরগির খোয়ারের মত ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটের গর্বিত মালিক-মালকিন রাতের বেলা জানালা দিয়ে আলোর খেলা উপভোগ করতে পারে। প্রাসাদটার আলো তো আছেই, সাথে চতুর্পাশের দালানগুলোও আলো বিলোয়। কিন্তু আজ সব অন্ধকার, জানালার পাশেই পুকুরের মাথায় মস্ত ছাদ হয়ে বিরাজ করা গাছগুলো পর্যন্ত চোখে পড়ছে না; যতটুকু আবছা দেখা যাচ্ছে, তাতে এগুলোকে বিশাল আলখেল্লা পড়া মানুষ বলেই মনে হচ্ছে!
পুকুরটা থেকে চোখ সরাতে পারছিলাম না আমি, কি যেন একটা আটকে দিয়েছে আমাকে, কিছু একটা দেখেছিলাম, একটা ঝলক মাত্র, আর তারপর হতেই আমার অবচেতন মন খুঁজে ফিরছে তাকে। পুকুরটার দিকে ভাল করে তাকালাম আমি। বেশ কদিন বৃষ্টি হয়নি, ফলে আবর্জনার বিশাল বিশাল ভেলা ভেসে বেড়াচ্ছে, চারপাশের দালান থেকে তাদেরকে সমাধিস্থ করা হয় এখানে। হঠাৎ একটা ভেলা আমার জানালাটার গায়ে ধাক্কা খেয়ে অন্যদিকে পাড়ি জমাতে শুরু করে, আর সঙ্গে সঙ্গে জিনিসটা চোখে পড়ে যায় আমার, যা এতক্ষণ অস্থির করে রেখেছিল আমায়। ভয়ে কাঠ হয়ে যাই আমি! একটা বার্বি ডল। লতা-পাতা দিয়ে ঢেকেছিল, এইজন্য দূর থেকে বোঝা যায়নি, এখন কাছ থেকে পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে তার চোখ, মুখ। এক অজানা আতঙ্ক যেন আমায় পুরো গ্রাস করেছিল! সুহাকে কিনে দেয়া ডলটার মত দেখাচ্ছিল, কিন্তু সেটিই কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখতে মন চাইছিল না। বরং শরীরের সব শক্তি খাটিয়ে জানালাটা সপাট বন্ধ করে দিয়ে ভারী পর্দাটাও আচ্ছা করে টেনে দিলাম আমি।
অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, অথচ চোখে এক ফোটা ঘুমও ছিল না। যতবারই সুহার কথা মনে পড়ছিল, হৃদয়ে একটা রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছিল। সুহা অন্যরকম, ওর বয়সী অন্যরা কত সুন্দরভাবে মানিয়ে নিচ্ছে, কত বন্ধু হয়েছে। ওর কোন বন্ধু নেই, কেউ ওর কাছে ঘেঁষতে পারে না, এলেই কমপ্লেইন খাওয়ার ভয়! একবার তো ওর বাবা-মা চাইল্ড সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। ‘বয়স হলে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে’ বলে বাঁধা দিয়েছি আমি। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে, আরো একা, আরো আত্মকেন্দ্রিক এবং সব শেষে, মামা-নির্ভর হচ্ছে। আমি ওর একমাত্র মামা, এখনো বিয়ে থা করিনি, কিন্তু পাত্রী দেখা চলছে। বিয়ের পর যখন নতুন মানুষ ঢুকবে ঘরে, তখন কি হবে? শংকায় আমার অন্তর কেঁপে উঠে।
আচ্ছা, সেহের কি করছে এখন? ওকে লাইভে এনেছিল ওর বাবা, তাও তো ঘন্টাখানেক হয়ে গেছে। অনুরোধটা আমিই করেছিলাম, যদি বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করা যায়। ঘুমিয়ে পড়েছে নির্ঘাৎ। কিন্তু দমবন্ধ অসুখটা আসেনি তো আবার? ওকে যতটুকু জানি, খাওয়াতে পারেনি। ও এভাবেই চিৎকার করতে করতে ঘুমিয়ে গেলে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে মা। সুহার এই অসুখটা ওর জন্মের সময়ই সেই যে বাসা বেঁধেছে, এখন পর্যন্ত যাওয়ার কোন নামগন্ধ করছে না। হঠাৎ হঠাৎ ওর দমবন্ধ লাগে, অবস্থা সিরিয়াস হলে হাসপাতাল থেকে নেবুলাইজার দিয়ে আনতে হত। বহু ডাক্তার দেখানো হয়েছে, কিন্তু অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেও কেউ কিছু পায়নি। নিয়মিত চেকাপ ও স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল রাখার কথা বলে তারা রোগীকে বিদায় জানিয়েছে। কিন্তু সুহার দিকে খেয়াল রাখা সহজ কাজ নয়, ভীষণ চ্যালেঞ্জ যেকোন মায়ের জন্যই। কে জানে, আজ আবার মেরেছে কিনা! আমার বুকটা ধড়াস করে উঠে! আমি দোয়া দুরুদ পাঠ করতে শুরু করে দেই, আল্লাহ, আমার সুহার কষ্ট দূর করে দাও, ও তো ব্যথা সহ্য করতে পারে না! আমিও নেই যে, ওর মাকে ঠেকাবো!
তবে সুহার জন্য এমন দোয়া-দরুদ প্রায়ই পড়তে হয় আমায়, ওর কথা মনে হলেই কেন জানি, প্রবল এক আশংকা পেয়ে বসে আমায়। একদিন আপন মনেই দোয়া ইউনুস পড়ে ওর জন্য সাহায্য প্রার্থনা করছিলাম সৃষ্টিকর্তার কাছে, আর তা দেখে হেসে ফেলেছিল শায়লা। আমরা এক ছুটির দিনে একটি ক্যাফেতে বসেছিলাম মুখোমুখি। সুহা মায়ের ফোনটি দিয়ে ভিডিও কল দিয়েছিল, ভাই তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে। এদিকে শায়লার হাসি থামছিলই না। আমি প্রশ্ন-মাখা চোখে তাকালে সে হাসির প্রস্থ এতটা বাড়লো যে মনে হল, গড়িয়ে পড়বে যেকোন মুহূর্তে! একটা দ্বিধা, ধন্দ, অনিশ্চয়তার মেঘ আমার চারপাশে পাঁক খেতে থাকলো দলা পাকিয়ে। সেখান থেকে বেরোতেই কিনা, আমি ওর হাতটা ধরে বললাম, “জানো, সুহাকে নিয়ে সারাক্ষণ টেনশানে থাকি আমি।“ শায়লা কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল, একটা থমথমে মেঘ চকিতে উঠেই আবার সরে গেল, এরপর হাসিভরা মুখে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “ভাগ্নির জন্য ভাবনা তো ভাল! কিন্তু মনে রেখো, ওর বাবা-মা আছে, আর সন্তানের জন্য বাবা-মার ভাবনাটাই বেশী উপকারী।“
স্মৃতির পাখায় চড়তে চড়তে চোখের পাতা ভারি হয়ে এসেছিল আমার! হঠাৎ একটা শব্দ শুনে ঘুমটা টুটে যায়! ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে, একা ঘরে, এই অবস্থায় মৃদু শব্দও টর্নেডোর আকার ধারণ করে বুকের মধ্যে। আমি পড়িমরি করে বেড সুইচটা হাতড়াতে থাকি। ওহ! এটা যে কই লুকিয়েছে! পর্দার আড়াল থেকে শেষ পর্যন্ত বের হয় সে। এরপর টিপে দিতেই যা চোখে পড়ল, বুকের রক্ত হিম হয়ে গেল আমার! বিষ্ফারিত চোখে চেয়ে দেখলাম, সুহা আমার চেয়ারটিতে বসে এক মনে কি যেন লিখছে, আমার বেডের অদূরে বসানো চেয়ারটায় শুধু সুহার পেছনটাই দেখতে পাচ্ছিলাম, বিকেলের সেই ফ্রকটাই পড়া, একটু ধুলো লেগে রয়েছে। ঢেউ খেলানো চুলগুলো ঝোঁপের মত বেয়ে পড়েছে মাথার চারদিকে।
আমি আরো কিছুক্ষণ সয়ে নিলাম ব্যাপারটি ভাল করে বোঝার জন্য। এমনো তো হতে পারে, স্বপ্ন দেখছি! হঠাৎ সে পিছু ফিরলো, এবং যেন কিছুই হয়নি এমনি ভাব করে চেয়ার থেকে উঠে আমার কাছে এল, হাতে তার ক্ষুদে খাতাটি। ‘’মামা, দেখো তো, অনেক সুন্দর হইছে না?” বলে সে তাকায় আমার দিকে আর মাথা ঝাঁকিয়ে হাসতে থাকে। অন্য সময় হলে শাবাশ্ বলে উঠতাম কয়েকবার, পিঠ চাপড়ে দিতাম, আর চুমু খেতাম। কিন্তু এখন কিছুই হল না এসব! আমার অস্থি মজ্জা সহ ঠক্ ঠক্ করে কাঁপছিল!
“মামা, তোমার কি হইছে?....জ্বর আসছে? …আচ্ছা, দাড়াও সারাই দিতেছি!” টেবিলের ড্রয়ারে একটা হেডফোন ছিল। ওটাকে স্থেথোস্কোপ আর তার পেন্সিলটাকে সিরিঞ্জ বানিয়ে হাতটার মধ্যে ইনজেকশান পুশ করা মামার সাথে তার প্রিয় খেলাগুলোর একটা। আমি সব শক্তি হারিয়েছিলাম, মুখ দিয়ে অনেক সময় নিয়ে ভেঙেচুরে কয়েকটা টুকরো বের হলঃ “কার সাথে … এসেছিস এখানে?.. তোর বাবা… দিয়ে গেছে…?” এ প্রশ্নটা নিতান্তই অনর্থক, ওর বাবা যদিও এত রাতে ওকে দিয়ে যাওয়ার মত পাগলামি রোগে আক্রান্ত হয়ও, ভেতরে ঢুকবে কি করে! এমন তো না যে, আমি দরজা খোলা রেখেই বিছানায় এলিয়ে পড়েছিলাম!
হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। এতটা রাতে শুধু একজনেরই ফোন আসতে পারে। সুহা তার যন্ত্রপাতি সরিয়ে রেখে ফোনটা আমার কানে তুলে দিল, আর সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশ থেকে অনেকটা হুড়মুড় করেই নেমে এল এক পশলা শিলাবৃষ্টি, “ নো ওয়ান ক্যান অ্যাকসেপ্ট সাচ ইনসাল্ট। ইয়ো আর আভয়েডিং মি!” শায়লার কথা শুনে যাই, জানি জবাব দিতে গেলে শিলাবৃষ্টির তেজ বাড়বে বই কমবে না। চুপচাপ থাকলে সে উত্তেজনার পারদে চুবানো আরো কিছু উত্তপ্ত বাক্য ছেড়ে দেবে, তারপর আস্তে আস্তে তেজ কমে আসতে থাকবে, তারপর একটা আশংকা ঘিরে ধরবে তাকে যখন, আমার নিতান্ত সাধারণ কিছু বিষয়ে খোঁজ নেবে সে; যেমন, ‘’কাল অফিস যাচ্ছো তো? দরজা জানালা ভালমত আটকেছো? কাপড়গুলো ইস্ত্রি করে এনেছো তো? অ্যাালার্ম দিয়ে রেখেছো তো?’’ শায়লার হাতে আসলেই সময় খুব অল্প ছিল। এ বছরের গোড়ার দিকে তার বাবা যে পাত্রটির হাতে তুলে দিতে চেয়েছিল, সে সামান্য কোন লোক ছিল না। একটি নামকরা কোম্পানির সফটওয়্যার ইঞ্চিনিয়ার, অভিজাত বংশ, দেখতে শুনতে মন্দ না – এই প্রচেষ্টা রুখে দিতে ব্যাপক গোলমাল করতে হয়েছিল শায়লাকে, শেষমেশ অসুস্থ বাবাকে কথা দিতে হয়েছিল, এ বছরই বিয়ের পিঁড়িতে বসবে, আর সে যেই হোক, বাবা মেনে নেবে।
আমি মন দিয়ে শুনে যাচ্ছিলাম, আর ‘হ্যাঁ’, ‘হুম্’, ‘ঠিকই তো’ করে যাচ্ছিলাম। সংলাপগুলো আওরানো শেষ হয়ে গেলে শায়লা কিছুটা চুপসে গেল, প্রতিবারই যায়, তার মনে হয় আরেকটি পর্ব বড্ড প্রয়োজন। ছোট গল্পের জন্য সে পার্ফেক্ট নয়; অন্তরে রবে কিছু অতৃপ্তি, রয়ে যাবে রেশ - এই নীতির সে ঘোর বিরোধী। তার চাই একটা সমাপ্তি, দিন রাত রহস্য গল্পে ডুবে থাকলেও রহস্য তার মোটেই প্রিয় নয়।
“কী ‘ঠিকই তো’ করে যাচ্ছ সেই থেকে? আমি নিশ্চিত, একটা কথাও কানে ঢুকে নাই।“
“ না…না … তোমার জন্য দেরীটা তো আসলেই সমস্যা। …বাবাকে দেয়া কমিটমেন্ট …” আমি তড়িঘড়ি করে বলতে যাই।
“থাক্, থাক্, হইছে আর শোনাইতে হবে না….একটা স্টুপিডের জন্য …আমি …” আমার কথা যেমন শেষ করতে দেয় না, নিজের কথাও শেষ করতে পারে না মেয়েটি। লাইনটা কাটার আগে একটি অদ্ভুত শব্দ শোনা যায়, ফোঁপানো কান্নার মত মনে হলেও নিশ্চিত হতে পারি না আমি। কেমন যেন একটা আশংকা তাড়া করে ফেরে আমাকে। বিন্দু বিন্ধু ঘাম জমতে থাকে শরীর জুড়ে। তীব্র এক অস্থিরতায় বিছানার এপাশ-ওপাশ করতে থাকি। হঠাৎ কপালে একটি হাতের স্পর্শ টের পাই, তুলতুলে, ক্ষুদে! বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে আমার! হঠাৎ শুরু হয়ে যায় হাসি, ক্ষুদে এক শিশুর, রক্ত হিম করা! এতক্ষণ খেয়াল ছিল না, ভুলে গিয়েছিলাম সুহার উপস্থিতি। কিন্তু এ ঘরেই তো ছিল সে, তাহলে দেখতে পাইনি কেন এতক্ষণ? যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছিল, এখন ফিরে এসেছে আবার। কিছুটা মুহূর্ত কেটে গেলে থিতু হই আমি, আর তাকিয়ে থাকি ওর দিকে কোন কথা না বলে।
“আমাকে ভয় দেখিয়ে নিজেই ভয় পাচ্ছে এখন…আরে বুকা, আমি তো গায়ে জ্বর আসছে কিনা দেখতেছিলাম…”
আমি নিরুত্তর থাকি। আর আগের মতই তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে হয়, ও আমার সুহাই!
“ইস্ কী গরম! কতবার না বলছি, জানালাগুলো খোলা রাখবা! আলো-বাতাস নাই ঘরটাতে, এই জন্যই তো অসুখ-বিসুখ ছাড়ে না’’ বলেই পর্দাটা টানতে শুরু করলো সুহা। ওর মা এভাবে বলতো, এখনো বলে, সংসার থা করে জাঁকিয়ে বসেছে, অথচ এখনো ভাইয়ের উপর শাসনটুকু চালানো চাই। এদিকে পর্দাটা ছিল ভারি, আর সুহার কোমল হাতে তা পুরো মেলতে সময় নিচ্ছিল। ওদিকে আস্তে আস্তে বিভিন্ন টুকরো জোড়া লেগে লেগে একটি আস্ত বাড়ি গড়ে উঠছিল জানালার ওপারে। যখন পুরো পর্দাটা সরে গেল, একটি অচেনা জগতের দরজা যেন খুলে গেল আমার চোখের সামনে। এই ঘোর অমাবস্যাতেও সেখানে আলোর বন্যা। তার তীব্র প্রদাহ শুষে নিল আমার সব, থেমে গেল ভাবনা, চিন্তা, স্পন্দন। শুধু এইটুকু মনে আছে, মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত পৃথিবী আমার উপর চাপা পড়ল যেন।
যখন জ্ঞান ফিরে আসে, দেখতে পেলাম একটি পুরনো দিনের বিচিত্র নকশা-কাটা খাটে শুয়ে, আমার চারপাশে উদ্বিগ্ন মুখ, শোকার্ত চোখ! আমার কক্ষটিতে লম্বা লম্বা জানালা। এছাড়া রয়েছে কয়েকটা খিলান, খাঁজ কাটা। একে একে সবাইকে লক্ষ্য করছিলাম আমি; কিন্তু কিছুই মনে করতে পারছিলাম না। হঠাৎ এক কোণে চোখে পড়লো একটি ফ্যাকাশে মুখ, রক্তের কোন চিহ্ন নেই সেখানে। তার দিকে সরাসরি তাকাতেই সে মুখ ঢেকে ফেললো, আর একটা আর্তনাদ সেই বিশাল কক্ষটার শক্ত দেয়াল ভেদ করে ছড়িয়ে পড়লো বাইরে। আস্তে আস্তে সব মনে পড়তে লাগলো আমার। বোনটির পাঁচ বছরের একটি মেয়ে ছিল যে সারাটা দিন আমার কাছেই থাকতো, আমি ঘুম পাড়িয়ে না দিলে ঘুমোতেই পাড়তো না। হঠাৎ একদিন সে হারিয়ে যায়, তিন দিন পর তাকে বাড়ির পেছনের একটি পুকুরে ভেসে উঠতে দেখা যায়।
একটা মেম পুতুলের খুব বায়না করেছিল, যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোর কি চাই? আমার বিয়ের তোড়জোর চলছিল, পাত্রী নির্বাচন আগেই হয়েছিল, এমনকি দিন তারিখও পাকা, আশ্বিন মাসটা পেরুলেই। ওর জন্য একটি ভাল পুতুল হন্যে হয়ে খুঁজছিলাম এই বিয়ের ডামাডোলের মধ্যেও। কিন্তু মনমতো পাওয়া যাচ্ছিল না, এদিকে প্রতিদিনই খালি হাতে বাড়ি ফিরে আসি, আর সে মুখ ভার করে। একদিন যখন দেখলাম পুতুলের অপেক্ষা ফুরিয়েছে, সেদিন থেকে কি হল আমার, দিন রাত আর কোন কাজ করলাম না, শুধু পুতুল খুঁজে চললাম। এ করতে করতে আমার শরীরের সব শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছিল, আমি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লাম অচিরেই। বিয়ের পাট শিকেয় উঠলো, জমিদারের একমাত্র বংশধরকে বাঁচানোই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালো। দূর-দূরান্ত থেকে বৈদ্য এসে ভরে ফেলল প্রাসাদটা।
আমি বিছানাটা থেকে উঠে দাঁড়ালাম, জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। এক মুঠো রোদ এসে আমায় ছুঁয়ে দিলে, আমি মাথাটা জানালার গরাদে মিলিয়ে দিলাম, আর বুক ফাটা কান্না বেরিয়ে এল। ও ভেসে উঠার পর এই প্রথম আমি আওয়াজ করলাম এবং কাঁদলাম। উপস্থিত একজন বৈদ্য খুশীতে চেঁচিয়ে উঠলেন, আর ভয় নেই, এখন নিরাময় শুরু হবে, রোগী শীঘ্রই সেরে উঠবে। বাড়িটার মধ্যে একটা স্বস্তির বাতাস বয়ে গেল। আমিও অনেক দিন পর পেট পুরে খেলাম, সবার সাথে কথা বললাম। রাতের বেলা বেশ একটা ঘুম ঘুম ধরেছে, হঠাৎ একটি নরম হাতের ছোঁয়ায় তা টুটে গেল। দেখি শিয়রে দাঁড়িয়ে আছে ও। আমায় বলল, “ভাল একটা পুতুলের খোঁজ পেয়েছি, দেখতে যাবে?” আমি মাথা নাড়তেই সে আমার হাতটা ধরে টানতে শুরু করলো, তারপর বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আমায় নিয়ে যতই সামনের দিকে হাঁটতে লাগলো, পেছনের বাড়ি, প্রাসাদ, বাগান, ফোয়ারা - সব কিছু নেমে যেতে লাগলো, ধ্বসে পড়তে পড়তে এক সময় পুরো প্রাসাদটা টুকরো টুকরো হয়ে উড়তে লাগলো। আমার মাথাটা আবার ঘুরে গেল, আবার যেন পুরো পৃথিবীটা চাপা পড়ল।
“মামা, কি হয়েছে তোমার, কি হয়েছে, এমন করছো কেন?” চোখ মেলে দেখতে পেলাম সুহা আমার দিকে ঝুঁকে আছে, ওর চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ, একটু আগের হাসির ছিটেফোঁটাও নেই। আমি তখনো কাঁপছি, থরথর করে, ভুত্বকের সবগুলো প্লেট মনে হয় নড়ে উঠেছে, আমার ভেতরের সব হাড়গোড় খুলে পড়তে চাইছে।
“তুমি ভয় পাইছো? আরে বুকা আমি আছি না” বলে সে তার নরম হাতটা আমার উপর রাখে, আর শুরু হয়ে যায় এক অদ্ভুত নিরাময় - আস্তে আস্তে আমার শরীরটা শিথিল হতে শুরু করে, শরীর ও মগজের খুলে যাওয়া কোষগুলো আস্তে আস্তে জোড়া লাগতে শুরু করে। এভাবে কতক্ষণ পড়ে ছিলাম মনে নেই, কিন্তু যখন সম্বিত ফিরে পেলাম, দেখি ভোর হয়ে গেছে, জানালায় তিনটে পর্দা ছিল, তাদের ফাঁক দিয়ে রক্তাভ সূর্যের কোমল আলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছিল। আমি এক টানে সরিয়ে ফেলি পর্দাটা, আর গাছ, পুকুর ছাড়িয়ে ভেসে উঠে দালানটা, একদম অবিকল আগের মতই, একটুও দুমড়ে যায়নি, মোচড়ায়নি কোথাও।
আমি সকালের কাজগুলি একে একে সাড়ি। পরে বের হয়ে যাব কাজে যোগ দিতে, হঠাৎ ফোন বেজে উঠে। বোনের ফোন, রাতে নাকি সুহার বেদম জ্বর উঠেছিল, এখন আবার শুরু হয়েছে শ্বাসের কষ্ট, হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। আমার বুকটা মনে হয় দুভাগ হয়ে যায়, পাঁজরগুলো ছলাৎ করে সরে যেতে থাকে। হাসপাতালের জন্য গাড়ি ঠিক করা, ডাক্তারের সাথে কথা বলা, টেস্ট করানো, বেড ভাড়া করা – এ মুহূর্তগুলো যে কি করে কেটে গিয়েছিল, তা একদমই মনে নেই। শুধু আইসিইউর বিশাল কাঠের দরজাটার গোলাকার কাঁচটিতে চোখ পেতে দিয়ে ওকে এক নজর দেখেছিলাম, সেটুকু মনে আছে। অক্সিজেন মাস্ক পুরো মুখটিকে ঢেকে রেখেছে। আমি বার কয়েক ঢুকতে চেয়েছিলাম, ডাক্তারকে বোঝাতে চেয়েছিলাম, আমি ওর মামা, ও আমাকেই শুধু ওর সব ব্যথা খুলে বলে, আর আমি সেসব সারিয়ে দিতে পারি। ধীরে ধীরে ওর অবস্থার অবনতি হতে থাকে, একটা সময় আমায় ভেতরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় অন্য আত্মীয়স্বজনের সাথে। কিন্তু সেই বিভৎস মুখের সামনে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। সবার অলক্ষে পালিয়ে আসি আমি হাসপাতালটা থেকে।
এক সপ্তাহ পর। ফোনটা থেমে থেমে আর্তনাদ করে যাচ্ছিল। গত কদিন ধরেই সে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমার অনুভূতিগুলো যেন মরে গেছে একদম, সেখানে ক্ষোভ, আকাঙ্ক্ষা - কোনটিরই আর স্থান নেই। গত কদিন দু চোখের পাতা এক করতে পারেনি, কিন্তু সে রাত্রে কি হল, বিছানায় পড়তেই ঘুমিয়ে পড়লাম। মরার মত পড়ে ছিলাম, হঠাৎ একটা শব্দে শরীর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল; এ শব্দ আমার খুব চেনা, বাচ্চাদের জুতো পায়ে চলার শব্দ! চোখ মেলে সুহার দিকে তাকালাম। সে বললো ‘’একটা খুব সুন্দর বার্বি ডল খুঁজে পেয়েছি, মামা, দেখতে যাবা আমার সাথে?” আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়াতেই নিয়ে চলল। কিন্তু যতই এগুচ্ছিলাম, অবাক হচ্ছিলাম, কারণ এ রাস্তাঘাট, পেভমেন্ট, এবং সড়কদীপের বৃক্ষগুলো পর্যন্ত আমার চেনা!
রাস্তার ঠিক শেষ মাথায় একটি বাংলো মত বাড়ি ছিল।
সুহা আমায় নিয়ে বাড়িটাতে যেই না ঢুকেছে, সব কিছু ব্ল্যাক হয়ে গেল। ভাবলাম, সরকার যে ব্যয় সংকোচন করতে লোডশেডিং শুরু করছে, তারই ফল। কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে মুহূর্তের মধ্যেই আলো জ্বলে উঠল সাত মহলার, আর ফুটে উঠা দৃশ্যগুলো হতভম্ব করে দিল আমায়! শায়লা সেজেগুজে বসে আছে। তাকে জড়িয়ে আছে সুহা, আমার দিকে চেয়ে হাসিতে ফেটে পড়ছে, সেই আগের মতই! আমার কাছে পুরো বিষয়টা একটা ভ্রম বলে মনে হল, তাই সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে ফেরার রাস্তা খুঁজতে লাগলাম।
কিছুদূর এগুতেই সুহা দৌড়ে এল পেছন থেকে, কিন্তু বরাবরের মত জাপটে না ধরে হাত ধরে টানতে শুরু করল। আমি যতই হাত ছাড়াবার চেষটা করি আর বলি, ‘’এমন করছিস কেন, কি হয়েছে?’’, সে কর্নপাত করল না, যেমন মিছিলে প্রকম্পতি শ্লোগান উঠে, সেইভাবে চিৎকার করতে লাগলো, “আমার বার্বি ডল চাই, বার্বি ডল।“ সুহাকে ঠান্ডা করতেই আমি স্টেজটার দিকে এগুলাম।
হঠাৎ ব্যান্ড পার্টির বাদ্য বেজে উঠল। চারদিকে আলোর রোশনাই। বাজি পুড়ছে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে। আত্মিয়-স্বজনে গিজগিজ করছে চারদিক। আমি শায়লার ঘোমটা তুলে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি পৃথিবীর সব থেকে রূপসী মেয়েটির দিকে। হঠাৎ কেন জানি, দমবন্ধ হয়ে আসে আমার, নিঃশ্বাস ছাড়তে জানালাটার কাছে গিয়ে দাঁড়াই। সেখানে তখন ঘোর বৃষ্টি নেমেছে, অযুত-নিযুত মুক্তোর ফোঁটায় সয়লাপ হচ্ছে বিশ্বচরাচর! ধীরে ধীরে একটা আয়ত পুকুর ভেসে উঠে আমার চোখের সামনে, সেখানে লতা-পাতার ভেলায় চড়ে বেড়াচ্ছিল একটি বার্বি ডল।
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।