নাহ, সীতা ও বোধহয় এঁদের থেকে ভালো ছিলেন, ওনার আসে পাশে রাবণ নিযুক্ত চেড়ি রা সর্বদাই মুখের কাছে খাদ্য বস্তু, এটা ওটা ধরছেন, রাবণ মাঝে মধ্যে এসে মিষ্টি কথায় চিঁড়ে ভেজাবার চেষ্টা করছেন আর সীতার সেখানে কাজ বলতে যাকে বলে "ল্যাদ" খাওয়া আর মাঝে মাঝে রামের নাম ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠা। "এঁরা" বলতে এদেশে অর্থাৎ আমেরিকায় যে সমস্ত সদ্য বিবাহিতা নারী ভারত থেকে স্বেচ্ছায় এসে উপস্থিত হন তাঁদের গল্প কিন্তু অন্য। সিনেমায় দেখা আমেরিকা আর শিকড় উপড়ে আসা অভিবাসী ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মধ্যে বিশাল ফারাক। কুড়ি বছর আগে সেটা আরোই কঠিন ছিল কারণ বর্তমানে ইন্টারনেট, হোয়াটসঅ্যাপ, বিভিন্ন ওটিটি প্ল্যাটফর্ম, স্থানীয় অঞ্চলে ভারতীয় দোকানের সংখ্যা বৃদ্ধি, ভারতীয়দের জোট বেঁধে নির্দিষ্ট শহরে থাকা ইত্যাদি বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত যেন একেবারে হাতের মুঠোয় এসে গেছে, তবুও যে সমস্ত সমস্যা রয়ে গেছে তা চিরন্তন।
নববধূ এদেশে পদার্পণ করলেন, স্বামী হয়তো বছর দু'য়েক যাবত একটি সংস্থায় কর্মরত, একটি দু-কামরার বাসস্থান ভাড়ায় নিয়েছেন, দু'জনের প্রয়োজনীয় সব কিছুই রয়েছে সেখানে, শুধু নেই কোনো পরিচারিকা। কর্তা ঘুম থেকে উঠে মাইক্রোওয়েভে চা খেয়ে অফিস চলে গেলেন, লাঞ্চ হয়তো সেখানেই সেরে নেবেন। নববধূ রান্নার 'র ' ও জানেননা, উচ্চ শিক্ষিতা, হয়তো বা উচ্চপদে কর্মরতা ও ছিলেন এককালে। এদেশে স্ত্রীর কর্মসংক্রান্ত ভিসা না থাকলে সে কোনো কাজ করতে পারবে না। ব্যাস, হয়ে গেল এক মুক্ত বিহঙ্গ খাঁচায় বন্দী, হোক সে সোনার খাঁচা তবু খাঁচাই তো!
এসব জেনে শুনেই এদেশে পদার্পণ করা, মনে হয় সব পেয়েছির দেশে কী আর এমন সমস্যা। কিন্তু সমস্যা গুলো অনেক গভীরে। যে সমস্ত স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বোঝাপড়া অটুট তাঁদের কোনো সমস্যাই নেই, সে পৃথিবীর যে দেশেই তারা থাকুন না কেন। পারস্পরিক সম্মান যে সমস্ত সম্পর্কের ভিত্তি তাঁদের কাছে সোনার খাঁচাও ফুলেল বলে মনে হয় তাই তাঁদের কথা থাক। যে সব দাম্পত্য সুমধুর হয় না সেই রকম পরিবারে অচিরেই দেখা দেয় গার্হস্থ্য হিংসা, কারণ বলতে ক্ষমতার অপব্যবহার। যখন স্বামী টি বুঝে যায় স্ত্রী সম্পূর্ণ ভাবে তার অধীনে এবং এক অসহায় পরিস্থিতির শিকার তখনই সে সর্বতোভাবে সেই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে শুরু করে। আমেরিকার অনেক রাজ্যেই পরিবহন ব্যবস্থা খুব একটা ভালো নয়, বাস, ট্রেন ইত্যাদির ভরসায় থাকলে হাতে অন্তত দু'ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় নিয়ে বেরোতে হয়, আবার ট্রেন স্টেশন বা বাসস্টপ অনেক সময় এতটাই দূরে থাকে যে সেখানে পৌঁছতে গেলেও গাড়ির প্রয়োজন দেখা দেয়। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে সদ্য আসা দম্পতি একটি গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারে যেটি প্রধানতঃ স্বামী ব্যবহার করেন। অনেক সময় স্ত্রী টি গাড়ি চালাতে জানেন না অথবা জানলেও এদেশের গাড়ির উল্টো দিকে স্টিয়ারিংয়ে ব্যবহার করতে ভয়ে তটস্থ হয়ে থাকেন। এর ফলে তাঁদের দৌড় বড়জোর পদব্রজে বাড়ির পাশের পার্ক অথবা গ্রসারি স্টোরস, সেখান থেকে ভারী ব্যাগ ভর্তি করে বাজার করে আনাও এক বিষম দায়।
সংসারে ছোটখাটো অশান্তি হতেই পারে কিন্তু এদেশের যে সমস্ত গৃহবধূ এক সময় বুঝে যান যে চারদেয়ালের মধ্যেই তাঁদের মুক্তি খুঁজতে হবে তখনই হয় তাঁরা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েন অথবা প্রতিবাদী। এ ধরণের জীবনযাত্রায় তাঁরা অভ্যস্ত নন, ফলে দিনে দিনে পুঞ্জীভূত ক্রোধ আর হতাশা কখনো ফুটন্ত লাভার মত বেরিয়ে আসতে চায়। তাঁরা হুট বললেই একটা ট্যাক্সি ডেকে বাপের বাড়ি পালিয়ে যেতে পারেননা, আমেরিকার এক একটি রাজ্য থেকে ভারতে ফেরার প্লেন ভাড়া একেক রকম এবং যাঁরা প্রথম প্রথম এদেশে এসেছেন তাঁরা হুটহাট দেশে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারেন না এতটাই ব্যয় সাপেক্ষ সে যাত্রা। স্ত্রী অপেক্ষা করেন কবে স্বামীটি দয়া পরবেশ হয়ে একটিবার দেশে যাওয়ার টিকিট কেটে আনবেন। সমস্ত কিছুর জন্যই তাঁরা স্বামীর ওপর নির্ভরশীল যতদিন না তাঁদের কর্মসংক্রান্ত ভিসার ব্যবস্থা হচ্ছে, সেই আবেদন পদ্ধতিও ব্যয় ও সময় সাপেক্ষ। অনেকে অবৈধ ভাবে টুকটাক কাজ করতে শুরু করেন, যেমন কোনো পেট্রল পাম্পের ক্যাশে বসেন অথবা বাচ্চা দেখার কাজ করেন, এগুলো খুব ঝুঁকির কাজ, ধরা পড়লে মালিক ও শ্রমিক দু-পক্ষের ই সাজা। মালিক তবু এই ঝুঁকি নেন কারণ এঁদের সরকারের ধার্য করা ন্যূনতম মজুরীর চেয়ে অনেক কম বেতন দিলেই চলে যায়।
তা এসব কাজ করে তো আর মেয়েরা সম্পূর্ণ ভাবে স্বাবলম্বী হতে পারেন না বরং স্বামীকে খুশী করতে অনেকে সেই মাইনের টাকাটাও ওনাদের হাতেই তুলে দেন। স্বামী মনে করেন স্ত্রী যখন বাড়িতে তখন সমস্ত কাজ তাঁদের ই করা উচিৎ। এর মধ্যে সন্তান এসে গেলে আরও বিপত্তি, ডে কেয়ারের খরচ এতই বেশি যে সমস্ত ঝক্কি বাড়িতে মা কে একলা সামলাতে হয়। অথচ সন্তান প্রসবের পর হাসপাতালে শিখিয়ে দেওয়া হয় মা এবং বাবা দু'জনে ভাগাভাগি করে যেন সন্তানকে লালন পালন করেন। বাস্তবে বাবা রা অফিসের কাজের দোহাই দিয়ে সমস্ত রকম দায়িত্ব থেকে হাত ধুয়ে ফেলেন। মায়েদের অসম্ভব পরিশ্রম ও মানসিক অবসাদের কারণে সন্তানদের অনেক সময় শারীরিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়। মা তার সন্তানকে মারধোর করছে খবর পেলে আবার সরকারের চাইল্ড প্রোটেকশন সংস্থাটি এসে বাচ্চাটিকে ফস্টার হোমে চালান করে দেয় মা বাবা ঠিকমত সন্তান পালন করছে না এই অপবাদে। মায়েদের হল শাঁখের করাত।
অভিবাসী পরিবারের স্ত্রী রা জানেনই না যে আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে যেমন পশ্চিম উপকূলের ক্যালিফোর্ণিয়াতে আইন সর্বতোভাবে তাঁদের সপক্ষে, কি করেই বা তাঁরা জানবেন? অনেকে ভালো করে ইংরেজী বলতে পারেন না, ফোন করে কোথাও খোঁজ নেবেন সেটাও হয় না। স্বামীরা উল্টে শাসিয়ে রাখেন বেশি বাড়াবাড়ি করলে বাড়ি থেকে বার করে দেবেন বলে। আবার সন্তানকে নিয়ে কোনো মা যদি কোনো মতে টাকা জোগাড় করে দেশে পালিয়ে বাঁচতে চান তাহলে সেই স্বামীটি তৎক্ষণাৎ শিশু চুরির অপরাধে মায়ের নামে কেস করে দিতে পারেন। শিশুটি জন্মসূত্রে আমেরিকান নাগরিক কাজেই তাকে ফিরিয়ে আনতে সরকার কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এদেশে প্রায় ই ফোনে এই ধরণের অ্যালার্ট আসতে থাকে যে একটি লাল টয়োটা গাড়ি তে এক মহিলা একটি পাঁচ মাসের শিশুকে অপহরণ করে মেক্সিকো বর্ডারের দিকে রওনা দিয়েছেন, কেউ খোঁজ পেলেই যেন নাইন ওয়ান ওয়ান এ ফোন করেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় ওই মহিলা শিশুটির মা, স্বামীর অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে পালিয়েছেন।
এই সমস্ত অভিবাসী স্ত্রীদের জন্য প্রচুর হেল্পলাইন রয়েছে, গার্হস্থ্য হিংসার শিকার এমন মহিলাদের জন্য হট লাইন রয়েছে, সেখানে ফোন করে মেয়েরা নানান বুদ্ধি পরামর্শ পেতে পারে, তাদের জন্য সাময়িক আস্তানার ও ব্যবস্থা রয়েছে। যখন কোনো মহিলা আর সহ্য করতে না পেরে পুলিশে ফোন করেন তখন কিন্তু পাঁচ মিনিটের মধ্যেই পুলিশ বাহিনী অকুস্থলে এসে উপস্থিত হয়। এরপর নানা প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে তারা জেনে নিতে চায় ঠিক কী ধরণের অত্যাচার করা হয়েছে মহিলাটির ওপর। এইখানেই হয় মুশকিল, যদি না স্বামীটি তার স্ত্রী র ওপর শারীরিক অত্যাচার করে অথবা নিজে ড্রাগস সেবন করে তাহলে পুলিশ কোনো ভাবেই তাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনা। দু'জনের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করে, বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফিরে যায়, এর ফলে স্ত্রীর ওপর মানসিক নির্যাতনের মাত্রা দ্বিগুণ হয়ে যেতে পারে। এই ভয়ে অনেকেই মুখ বুঁজে সব সহ্য করেন। যা চোখে দেখা যায়না সেই অত্যাচার প্রমাণাভাবে তার গুরুত্ব হারায়।
স্বামী এতো কিছু করেও বিবাহ বিচ্ছেদের কথা কেন ভাবেন না এই প্রশ্ন মনে আসতেই পারে। এর কারণ হল, এদেশে সম্পত্তি হল যৌথ, সে যেই উপার্জন করুন না কেন তাতে স্বামী স্ত্রী দু'জনেরই কিন্তু সমানাধিকার। বেশিরভাগ অভিবাসী স্ত্রী ই এ বিষয়ে অবগত নয়। ক্যালিফোর্ণিয়া য় আইন হল কোনো স্ত্রী যদি আদালতে আবেদন জমা দেন এই বলে যে তিনি ডিভোর্স পেতে চান তাহলে তিনি ডিভোর্স পাবেন ই, শুধু তাই নয় সম্পত্তিও সমানভাবে দু'জনের মধ্যে ভাগ হবে। সন্তান যদি পাঁচ বছরের কম বয়সী হয় তবে সে মায়ের কাছেই থাকবে এবং স্ত্রী টি যদি কোনো উপার্জন না করেন তাহলে সেই সন্তান সাবালক হওয়া পর্যন্ত তার বাবা তার ভরণপোষণের সমস্ত খরচ দিতে বাধ্য।
আইন মহিলাদের পক্ষে হলেও সেটা কতটা কার্যকরী হয় সেটাই প্রশ্ন। মহিলাটিকে যদি বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে তবেই মামলা করতে হয় তাহলে তাকে সাময়িক ভাবে কোনো শেল্টারে গিয়ে উঠতে হয়, সেখানে সব সময় যে জায়গা পাওয়া যাবেই তার কোনো ভরসা নেই। এই সমস্ত মহিলাদের আশ্রয় বলতে কিছু নেই, বেশিরভাগ চেনা জানা মানুষ হয়তো প্রতিবেশী, কেউই বোঝা মাথায় এসে চাপবে ভেবে এঁদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন না। সেখানেও আবার অনন্তকাল আশ্রিত হিসেবে থাকা যায় না, অনেক সময় স্বেচ্ছাসেবকরা চেষ্টা করেন মহিলাদের জন্য কিছু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে কিন্তু যে সমস্ত মহিলার কাজ করার পারমিট নেই তাঁরা পড়েন অথৈ জলে। মামলা কতদিন চলবে সেটাও বলা মুশকিল। স্বামী যদি ক্ষমতাশালী হন তাহলে তিনি নানা ভাবে এই মামলা টেনে নিয়ে যাবার চেষ্টা করবেন। আমেরিকান দম্পতিদের মধ্যে এই যে কথায় কথায় ডিভোর্স হয় তার কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এনারা পরষ্পরের সম্মতিক্রমে বিচ্ছেদ চান, দু'জনেই উপার্জন করেছেন, দু'জনের সম্পত্তি সমান ভাবে ভাগ হয়ে যায়। অনেকে একই বাড়িতে থেকেও ডিভোর্সের মামলা চালিয়ে যান শান্তিপূর্ণ ভাবে। সব থেকে বড় কথা এনাদের পাশে থাকে এনাদের পরিবার, বন্ধু বান্ধব প্রত্যেকে। আর ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরেও মা বাবা সুন্দর ভাবে ভাগাভাগি করে সন্তান মানুষ করতে থাকেন। অভিবাসী স্ত্রীদের জন্য আমেরিকায় সমস্ত সুযোগ সুবিধা থাকলেও বাস্তবে সেটা সোনার পাথরবাটিতে পরিণত হয়।