না, যা ভাবছেন ঠিক তা নয়, এটা দার্জিলিং বা মসালা চা নয়। এই "এক কাপ চা" লেখাটা ক্যালিফোর্নিয়ার, স্যান ডিয়েগোর একটি হাই স্কুলে বিশেষ ভাবে সক্ষম (স্পেশাল এডুকেশন) নবম শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের যৌন শিক্ষার ক্লাসের বোর্ডে জ্বলজ্বল করছে। এখানে হাইস্কুলে ঢুকেই যৌন শিক্ষা বাধ্যতামূলক। অন্য ছাত্রছাত্রীদের এ বিষয়ে শিক্ষাদান অনেকটাই সহজ, কিন্তু এদের? যারা অটিস্টিক, বা ADHD (মনোযোগ ঘাটতি) কিম্বা ডাউন সিনড্রোম এ আক্রান্ত, অথবা প্রায় অন্ধ ও বধির তাদের কী করে এই রকম একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া যাবে? অথচ দিতেই হবে, কারণ যৌন নিগ্রহের আশঙ্কা এদেরই সব থেকে বেশি, কয়েকজন তো শিশুকালেই তাদের সৎ বাবা অথবা মায়ের পুরুষ বন্ধুর দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে মানসিক ভারসাম্য প্রায় হারাতেই বসেছে।
এই নবম শ্রেণীতে একটি মেয়ে, অটিস্টিক, একদম ই কথা বলতে পারেনা, কতটা কি বুঝতে পারে সেটাও বোঝা যায়না, শুধু দিনের পর দিন একটা রুটিনের মধ্যে দিয়ে নিয়ে গেলে নির্ভুল ভাবে সে যন্ত্রের মত কাজ গুলো করে যায়, নির্দেশ মান্য করে। তাকে যদি কেউ বলে জ্যাকেট খোলো, ও খুলে ফেলে, সে হচ্ছে ভীষণ ভাবে vulnerable বা অসুরক্ষিত। কিন্তু তাকেও বিশেষ পদ্ধতিতে বুঝিয়ে দিতে হবে আত্মরক্ষা করার উপায়। বড্ড কঠিন কাজ, আর সংবেদনশীল একটি বিষয়।
ক্লাস টি শুরু হওয়ার আগে প্রায় তিন দিন লাগলো ওদের বোঝাতে যে ক্লাস চলাকালীন কী কী আচরণবিধি কঠোর ভাবে মেনে চলতে হবে, sex কথাটা শুনেই হি হি করে গড়িয়ে পড়লে অন্য রকম শাস্তি, আবার পাশের ছেলের সঙ্গে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলেও লাঞ্চ ডিটেনশন, এই রকম নানাবিধ আইন কানুন আরোপ করে, ওদের একটু ভারিক্কি করে তুলে ক্লাস টি শুরু করা হল। বেশ গুরুগম্ভীর ভাব আনার জন্য ওদের দিয়ে কন্ট্রাক্ট সাইন করানো হল, যাতে খুব লক্ষ্মী হয়ে এই দু সপ্তাহের ক্লাসটি ওরা করে। প্রতিদিন লাঞ্চের পরে থার্ড পিরিয়ড এ এই ক্লাস। এর আগে প্রত্যেকের অভিভাবকদের থেকেও লিখিত অনুমতি নেওয়া হয়ে গেছে।
আমার কাছে এই ধরণের অভিজ্ঞতা অভিনব, কারণ এর আগে আমি একাদশ শ্রেণীর সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, নবম শ্রেণীতে এবছর প্রথম তাই একটু নার্ভাস ছিলাম। প্রধানতঃ ক্লাসটি নিলেন স্পেশাল এড এর ডিপার্টমেন্ট চেয়ার, আর আমি মুগ্ধ শ্রোতা হয়ে থেকে গেলাম।
বেশ সুন্দর ভাবে প্রথমে ওদের বোঝানো হল, সেক্স ও জেন্ডার কাকে বলে। জন্মের পরই যৌন অঙ্গের পরীক্ষা দ্বারাই পুরুষ না নারী সেটা নির্ধারণ করা হয় আর সামাজিক ভাবে তার সঙ্গে যে ব্যবহার ,সাজ পোশাক , অনুভূতি ইত্যাদি জড়িয়ে থাকে তাই জেন্ডার, অর্থাৎ স্ত্রী লিঙ্গ বা পুং লিঙ্গ। এরকম হতেই পারে যে কারোর যৌনাঙ্গ অনুযায়ী তার আচার আচরণ প্রথাগত নয় (gender non-conformity), ছেলে কিন্তু মনে মনে সে মেয়ে , অথবা ছেলে বা মেয়ে র মাঝামাঝি (gender identity)। হাইস্কুলে একটি মেয়ে আর একটি মেয়ে কে তীব্র আবেগে চুমু খাচ্ছে অথবা একটি ছেলে কানে দুল আর বড় চুল নিয়ে শুধু মেয়েদের সঙ্গেই ঘোরাফেরা করছে এ দৃশ্য খুবই স্বাভাবিক। এদের কেউ কটূক্তি করেনা, সুন্দর ভাবে মেনে নেয় এরাও মানুষ, শুধু শারীরিক বা মানসিক গঠনগত পার্থক্য রয়েছে। যদিও আমার অনভ্যস্ত চোখ বারবার সেদিকে চলে যায়।
সব শেষে ওদের শেখানো হল যৌন দৃষ্টিভঙ্গি ( sexual orientation) বলতে কী বোঝায়। এই ক্লাসে ওরা ততদিনে "রোমিও জুলিয়েট" আর "টু কিল্ এ মকিং বার্ড" পড়ে ফেলেছে। আবছা হলেও প্রেম আর ধর্ষণ এই দুটি শব্দের সঙ্গে পরিচিতি ঘটেছে, যদিও ইংরিজি ক্লাস এ শিশু মনের সারল্য ফুটে ওঠে, যখন একটি ছেলে বলে ওঠে, "টু কিল্ এ মকিং বার্ড" এ মায়েলা কে টম ধর্ষণ করেনি সে তো বোঝাই যাচ্ছে, করলে তো মায়েলা প্রেগন্যান্ট হয়ে পড়তো!" ইংরিজির শিক্ষিকার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম, "না, তার কোনো মানে নেই, কখন কীভাবে গর্ভধারণ সম্ভব সেগুলো তোমরা বিশদে জীববিদ্যা ক্লাসে জানতে পারবে।"
যৌন দৃষ্টিভঙ্গি বলতে ওদের বোঝানো হল, কোনো ব্যক্তি যখন বিপরীত লিঙ্গের অথবা সম লিঙ্গের অন্য ব্যক্তির প্রতি প্রেম ভাব বা যৌন মিলনের আকর্ষণ অনুভব করে তাকেই বলা হয়। একই সঙ্গে কতগুলি পরিভাষার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হল, Heterosexual, lesbian, gay এবং Bisexual. ছাত্ররা অনেকেই আলোচনা করতে লাগলো, "হ্যাঁ , আমরা জানি, অমুক গে, তমুক লেসবিয়ান", ইত্যাদি। তাদের তখন বোঝানো হল, এতে তাদের অসম্মান করা হয়, তাদের ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা হয়, প্রত্যেকেই আলাদা তাই তাদের স্বাতন্ত্র্য কে শ্রদ্ধা করা একান্তই আবশ্যিক। আমিও শিখলাম।
এরপর এক একটি রূপক গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা শুরু হল।
প্রথমে এলো, কাকে বলে সুস্থ সম্পর্ক বা healthy relationship. হাইস্কুলে পড়ে টিম আর বিয়াট্রিস্ , তারা প্রেমিক প্রেমিকা, খুব ভালোবাসে একে অপরকে , টিম জড়িয়ে ধরা, চুমু খাওয়া এগুলো খুবই উপভোগ করে, কিন্তু বিয়াট্রিস্ বুঝতে পারেনা টিম তাকে সত্যিই ভালোবাসে কিনা, সে আরো অনেক বেশি কিছু চায় টিমের থেকে। সে খালি বলে "আমি আরও কিছু চাই তোমার থেকে"!
টিম বলে, "কী চাও?"
সে উত্তর দেয়, "আরো ঘনিষ্ঠতা, আরো ভালোবাসা।"
অনভিজ্ঞ টিম বুঝতেই পারেনা, চুম্বন আর আলিঙ্গনের থেকেও আর কীভাবে ঘনিষ্ঠ হওয়া যায়, সে হতাশায় ডুবে যেতে থাকে।
এই খানে ছাত্র ছাত্রীদের বলা হয় যে ঠিক এই জন্যই যৌন শিক্ষার সম্যক জ্ঞান প্রয়োজন। বহু ধরণের ঘনিষ্ঠতা সম্ভব, emotional, physical, spiritual, crisis, work ইত্যাদি, বিভিন্ন ধরণের সম্পর্কের ওপর এগুলি নির্ধারিত হয়, প্রতিটি সম্পর্কই ভীষণ ভাবে আলাদা।
ছাত্ররা জেনে গেছে যে একটি সুস্থ সম্পর্ক হল যেখানে পারস্পরিক যোগাযোগ, বোঝাপড়া, ক্ষমাশীলতা ও নমনীয়তা থাকে (communication, understanding, forgiveness and flexibility)। যৌন সম্পর্কে না গিয়েও সঙ্গীর সঙ্গে অনেকটা পথ হাঁটতে হাঁটতে কোনো ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলে ও ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠা সম্ভব।
কী করে বুঝলাম যে ওরা কিছুটা হলেও বিষয়টা হৃদয়ঙ্গম করেছে? প্রতিদিন একটি করে বিষয় শেষ হবার পর ওদের একটা lesson wrap-up এর মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এতে কিছু সহজ প্রশ্ন থাকে যেগুলো শুধু হ্যাঁ বা না তেই উত্তর করতে হবে, যেমন:
Love may involve passion, commitment and/or intimacy- T or F. যে একদম কিছুই বোঝেনি সে ভুল উত্তর দেবে, কিন্তু যে একটু হলেও বুঝেছে সে অন্তত ভালোবাসা আর ঘনিষ্ঠতা এই দুটি শব্দের জোরেই ঠিক উত্তর দেবে।
এবার যে ভুল উত্তর দিলো তাকে আলাদা করে আমাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। অবশ্য Severely autistic যারা, ওই আগের পর্বের মেয়েটির মত, তারা সারাজীবনই পরনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকে, সেক্ষেত্রে অভিভাবকদের দায়িত্ব অনেক বেড়ে যায়। মেয়েটি কে তখন শেখানো হয় যাতে কেউ তাকে স্পর্শ না করে, বা সে কাউকে স্পর্শ না করে, দুটি শরীরের মাঝে একটা অদৃশ্য বাবল্ আছে, ছুঁয়ে দিলে সেটা ফেটে যাবে। অবশ্য এমনিতেই ওরা অটিস্টিক হওয়ার জন্য স্পর্শ এড়িয়ে চলে, সেটা একটা ভাল ব্যাপার।
ওই প্রশ্নোত্তর লেখার পর ছাত্র ছাত্রীরা কে কী উত্তর দিলো তাই নিয়ে কিছুক্ষণ পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করে, এর ফলে বিষয় টি আর হাসাহাসির পর্যায় থাকেনা, অন্যান্য বিষয়গুলোর মতই গুরুত্ব পায়।
প্রথম ক্লাসটির শেষে প্রচুর web based resources এর লিঙ্ক ওদের সঙ্গে শেয়ার করা হয়, যেমন: Parents and friends of Lesbians and Gays ; Sex, etc; Teen Source ইত্যাদি।
এবার যখন ওরা স্বাস্থ্যকর সম্পর্ক কী সেটা জেনে গেছে, তখন আর একটি রূপক গল্পের মাধ্যমে অপমানজনক সম্পর্ক বা relationship abuse এর উদাহরণ দেওয়া হল।
এটি দুই বোনের গল্প। ট্রিনিটি বলে একটি মেয়ে নবম শ্রেণীতে পড়ে, সে বাড়ী ফিরলে তার থেকে চার বছরের বড় দিদি তাকে জিজ্ঞেস করে স্কুলে কী পড়ানো হচ্ছে, তখন সে উত্তর দেয় এই সবে সে love আর intimacy সম্বন্ধে জেনেছে, কীকরে একটা সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখা যায় তাও জেনেছে। এই অবধি শুনেই তার দিদি হঠাৎ চুপ করে গেলো ট্রিনিটি দেখল তার দিদির চোখ ছলছল করছে। জিজ্ঞেস করার পর ধরা গলায় দিদি বলল, "খুব শিগগিরি হয়তো তুমি কোনো ছেলের সঙ্গে ডেটিং শুরু করবে, তাই তোমাকে জানাচ্ছি যে আমি আমার আর আমার পুরুষ বন্ধুর মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল তাতে কিছু মারাত্মক ভুল করেছিলাম, চাইনা তুমিও সেটা করো!"
ট্রিনিটি চুপটি করে রইলো আর তার দিদি কনফেস করার মত করে বলে যেতে লাগলো....
সে তার পুরুষ বন্ধু কে অসম্ভব সন্দেহ করতো, তার প্রতিটা পদক্ষেপের ওপর নজর রাখতো। এমনকি ছেলেটির ইমেইল ও সেল ফোন এর মেসেজ ঘেঁটে দেখত যে সে অন্য কারোর প্রতি প্রণয়াসক্ত কিনা। ছেলেটি অনেক বুঝিয়েও কিছু সুরাহা করতে পারেনি। এই নিয়ে তাদের মধ্যে প্রবল অশান্তি হতো, মেয়েটি চীৎকার করে প্রায়শঃ ই ছেলেটিকে গালি গালাজ করতো এবং রাগের বসে কখনো কখনো তাকে আঁচড়ে কামড়ে শেষ করে দিতো, আবার ধাক্কা মেরে ফেলেও দিয়েছে কোনোদিন।
পরে অবশ্য রাগ কমলে সে নিজের ভুল বুঝতে পারতো, ক্ষমাও চাইতো, কিন্তু একটা দুষ্টচক্রের মতই আবার এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতো। অবশেষে একদিন ছেলেটি আর সহ্য করতে না পেরে এই অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যায়, ব্রেক আপ হয়ে যায় তাদের।
গোটা ক্লাস স্তব্ধ হয়ে শুনছিল গল্পটা, এইবার তাদের জিজ্ঞেস করা হল, "আচ্ছা বলত, কেউ যদি তোমার সব কাজে নজরদারী করে, তোমার সেল ফোনের মেসেজ জোর করে পড়ে, তোমাকে মারে, সব সময় তোমার ওপর বিনা কারণে চেঁচামেচি করে, তোমার কী ভালো লাগবে? ইচ্ছে করবে তার সঙ্গে থাকতে?"
সারা ক্লাস গমগম করে ওঠে সমস্বরে উচ্চারিত ধ্বনিতে, "না"!