প্রবল জীবন্ত একজন মানুষ যখন হঠাৎ করে নিঃশব্দ হয়ে যায়, তখন তাঁকে নিয়ে লেখা বড়ো কঠিন। আজ নিন্দা বা প্রশংসামুখরিত বাক্যে তাঁর কিছুই যায় আসে না। আমি কবি প্রবুদ্ধসুন্দর করকে চিনি বাইরে থেকে, কবির কবিতা, গদ্য এবং স্যোসাল মিডিয়ায় নানারকম স্ট্যাটাস তাঁর সম্পর্কে একটি ভাবমূর্তি তৈরি করেছে, আমি নিতান্তই সেই পথের অনুসারী। আমাদের রাজ্য কবিতামুখর। কবিতামুখর রাজ্যের অধিবাসী এই কবি আবহমান বাংলা কবিতার এক দুরন্ত কলম, যাকে বসন্তকালীন অব্যর্থ ব্যাধের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে, কবিতার হৃদয়কে যিনি বিদ্ধ করেছেন আঘাতে আঘাতে। কালজয়ী শব্দটি যদিও নিতান্তই আপেক্ষিক এবং প্রজন্মে প্রজন্মে এর ভাষ্য এবং মূল্যায়ন বদলে যায়, তবুও সন্দেহাতীত ভাবে কবি প্রবুদ্ধসুন্দর কর প্রাসঙ্গিক থাকবেন দীর্ঘ দীর্ঘ দিন।
আজ এই মুহূর্তে বসে এসব কথা লিখতে কেমন অবাস্তব এবং দুঃস্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে, বেঁচে থাকার বয়স যত বাড়তে থাকে ততই তা হয়ে ওঠে বেদনাদায়ক, কারণ তখন কিছু মানুষের চির বিদায় দেখতে হয়। তবুও আমি বিশ্বাস করি একজন প্রকৃত কবি মৃত্যুহীন। পৃথিবীর জলহাওয়ায় অরুচি হলে তিনি বেড়াতে যান। তাঁকে দূর থেকে দেখার লোক তখন বৃদ্ধি পায়। আসলে কবির তো তখনই মৃত্যু হয়, যখন কবিতা তাকে ছেড়ে যায়। আর রেখে যাওয়া প্রত্যেকটি সার্থক কবিতাই কবির বেঁচে থাকা। আমার কাছে ব্যক্তি প্রবুদ্ধসুন্দর থেকে কবি প্রবুদ্ধসুন্দর গুরুত্বপূর্ণ। সেদিক দিয়ে ভাবলে, তাঁর কবিতার মাধ্যমে তিনি জীবিত থাকবেন আলোছায়াকুয়াশাময় মায়াবী ইন্দ্রজালে, যেখানে একজন কবিসত্তার প্রবেশ ঘটে শুধু, তা থেকে নিষ্ক্রমণ নেই, এ হলো বারোমুডা ট্র্যাঙ্গেলের সেই রহস্যজনক ওয়েব লেংথ, নিজেকে প্রতিটি সৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নিঁখোজ করে হঠাৎ জানান দিতে হয় অরণ্যদেবের মতো প্রবল পদচারণায়। অপরিচিত অথচ লেখালেখির জগতে যাদের মেধা প্রত্যেকটি খণ্ডিত সময়ে মুগ্ধ, বিস্মিত করে, তারা তখন হয়ে ওঠেন অবশ্যপাঠ্য। কবিতার সঙ্গে আপোষহীন এই মানুষটিকে তাই পড়তেই হবে বর্তমান এবং উত্তর প্রজন্মকে। নিন্দিত এবং নন্দিত হওয়া যেকোনো সৃজনশীল মানুষের যাত্রাপথের পাথেয়, কেউ হয়তো ইচ্ছে করেও অধিক আলোচিত হওয়ার জন্য নিজেকে নিন্দিত এবং সমালোচিত হতে দেন, এসময়টা তখনই আসে যখন সৃজনশীলতার গতিপথে সামান্য ছায়া ঘনিয়ে ওঠে, একজন কবির কাছে এই সময়টা হলো সবচেয়ে কঠিন এবং অন্ধকারতম সময়। কোনো কোনো কবি তখন স্তব্ধ থাকেন, সরিয়ে রাখেন নিজেকে, কেউ বা অত্যন্ত প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠেন, সমস্ত বিষয়েই আক্রমনাত্মক বিচ্ছুরণ, কবিতা তখন শ্লেষ, বিদ্রুপ এবং কবির স্বভাবগত তীক্ষ্ণ মেধা ও শব্দের ওপর আসুরিক ও ঐশ্বরিক দখলে এক একটি যন্ত্রণাদায়ক উল্কির মতো বিঁধতে থাকে পাঠককে, এই চলমান সময়ে কবি প্রবুদ্ধসুন্দরের লেখাকে আমার তাই মনে হয়েছে।
কবির কাছে ছিল দুর্দান্ত শব্দ ভাণ্ডার এবং শব্দের যথাযথ সুকৌশলী, সংবেদনশীল, নিঁখুত প্রয়োগ, যা তাঁর প্রত্যেকটি কবিতাকে স্মরণযোগ্য করেছে। বিশেষ কোনো জায়গায় একটি আধিভৌতিক শব্দ এসে কবিতাটিকে রহস্যময় করে তুলেছে। এ প্রসঙ্গে উনার লেখা একটি কবিতার কথা উল্লেখ করবো, কবিতাটির নাম, 'পুরুষানুক্রম'।
কবিতাটি এরকম,
"আরও একটি রাত অনিদ্রায় গেল। ঘুম একধরনের বিরল পাহাড়ি কর্পূর। বিষণ্ণ রাত্রির টানে উবে যায়। এই যে অনন্তমোম, তাতে এখনও আমার মা রানিমৌমাছির ডানার গন্ধ। আজ, তাড়িত শিয়রের পাশে তোমার বসার জায়গা রাখি, বুড়ো মজ। যে শ্রুতি রাত্রি ও বিষাদ থেকে লীনকর্পূর ফিরিয়ে আনে ..পাঠ করো সেই পুরুষানুক্রম। আরও একবার চেষ্টা করে দেখি এই শরীরকে শ্রীবিগ্রহের মন্দির বলে ভাবা যায় কি না।"
এখানে, বিরল, অনন্তমোম, বুড়ো মজ, লীনকর্পূর এই চারটি শব্দ কবিতাটির চালিকা শক্তি। এর মধ্যে বিরল, অনন্তমোম এবং লীনকর্পূর হচ্ছে অভিজাত আর বুড়ো মজ হলো দেহাতি, এই বিপরীত শব্দটি না থাকলে কবিতাটি বেশ খানিকটা দুর্বল হয়ে যেত। এখানেই একজন মেধাবী কবির নিজস্বতা।
"আমার অ্যাম্বুশ" কবির লেখা বহুল আলোচিত একটি গদ্য সংকলন। নির্দিষ্ট কোনো বিষয় নয়, তবে প্রথম থেকে শেষপর্যন্ত কবিতা সম্পর্কিত, কবিতাকে হৃদয়ে রেখে স্পষ্টভাবে কবিতাচর্চার একটি মুক্ত আকাশ একজন বুদ্ধিমান কবির মস্তিস্কে যথাযথ আলো হাওয়া বিস্তার করবেই। বইটি পড়তে হবে নির্লিপ্তভাবে। কবি প্রবুদ্ধসুন্দর করের লেখা এই গদ্য সংকলনটিতে বহু কবিতার বই এবং কবির নামের উল্লেখ আছে, যা বর্তমানের অনেক তরুণ কবি শোনেননি, কিন্তু সেইসব কবিরা বাংলা কবিতা জগতের ধারালো কিরিচ, যাদের লেখা পড়া উচিত। গদ্যগুলো কবির ব্যক্তিগত পছন্দ, অপছন্দের কবিদের কবিতা এবং নিজের কবিতা জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে উঠে এসেছে। সমস্ত গদ্যগুলোই এত দৃঢ়তা এবং আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে লেখা হয়েছে যে, পড়লে মনে হবে কবির কথাই ধ্রুব। এবং লেখাগুলো পড়ার পর বহু তরুণই হতাশাগ্রস্ত হবেন কিংবা অন্য দিক দিয়ে দেখলে আত্ম সমালোচনা করার একটি যথার্থ ক্ষেত্র খুঁজে পাবেন।
তীক্ষ্ণ ও সমালোচনামূলক লেখার মেধাবী সংকলনটি কবিকে যারা পছন্দ করেন না, তারাও নিশ্চিত পড়েছেন, এই সমস্ত ছুরি সদৃশ গদ্য ও কবিতার সমন্বয়েই আমার তাঁকে দেখা।
"বিষাদ ও নিষাদ ; ধ্বনিসাযুজ্য ছাড়াও দুয়েরই সাদৃশ্য শিকারজীবিকা। শহর কেন্দ্রিক লোকালয় যত বেড়ে ওঠে, বিষাদের মুখ তত চকচক করে। নিষাদের লক্ষ্য, লোকালয় থেকে ক্রমে আরোও দূরে সরে আসা। অন্ধকারাচ্ছন্ন অরণ্যের দিকে ও ভেতরে নিষাদের যাত্রা ও পদচারণা ; আর লোকালয়ে থেকেও যেসব মানুষের মনের গভীরে, অজান্তেই লোকালয়হীন, অন্ধকারাচ্ছন্ন অরণ্য রচিত হয়, সেই গন্তব্যের দিকেই বিষাদের নীরব আনন্দযাত্রা", ... কবি প্রবুদ্ধসুন্দর কর।"
অসময়ে কবির এই যাত্রা আমাদের এখনও বিষাদে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, তাঁর শত্রু মিত্র সকলেই মনে মনে হয়তো অনুভব করছেন এক প্রতারক শূন্যতাকে, এখানেই তিনি নিজেকে অনুবাদ করেছেন তাঁর কবিতার বিতর্কিত শিবিরে।