উত্তর কোলকাতার একটা পুরনো বিল্ডিং। বাইরের দিকে গজিয়ে উঠেছে একাধিক গাছপালা। তার ভেতরেই পত্রিকার অফিস। একটা দড়ি দিয়ে বাঁধা পায়ার চেয়ারে বসে রয়েছেন বসাক বাবু। পরিমল বসাক। এলাকার খবরের কাগজের ডিলার।টেবিলের একপাশে দাঁড়িয়ে ভজা। তার পাশে একটা ছেলে। নতুন এসেছে। উসকোখুসকো চুল। গাল ভর্তি দাঁড়ি। পরনে ময়লা একটা ধুতি, আর কালের বিবর্তনে রঙ পাল্টানো একটা সাদা পাঞ্জাবি। পায়ের চটিটার গোড়ালি ক্ষয়ে গেছে অনেক দিন আগেই। মাথার চুলে একরাশ ধুলো বাসা বেঁধেছে। ছেলেটি এদিক-ওদিক দেখছে আর মুচকি হাসছে বসাক বাবুর দিকে তাকিয়ে।
“আরে ছেলে তোমার নামটা তো বুঝলুম, তা তোমার টাইটেলটা কি? চক্কোতি না চক্রবর্তী?” খানিক গভীর চিন্তার পর বেশ বিরক্তির সাথেই প্রশ্নটা করলেন বসাক বাবু।
শিবরাম মাথা চুলকে, এদিক ওদিক তাকিয়ে,ছেঁড়া জুতোটা ডান পা থেকে খুলে পায়ের তেলোটা বাম হাত দিয়ে চুলকে আবার সেই হাত দিয়ে কপালের একপাশ চুলকে ভাবতে লাগলো আসলে তার টাইটেলটা কি? চক্কোতি না চক্রবর্তী? সেই কোন কালে বাপ-মা নাম দিয়ে পগার পাড়। আর সেই স্কুল জীবন থেকে এই চক্কোতি আর চক্রবর্তীর মাঝের বিবাদটা প্রতি নিয়ত তাকে ধাওয়া করে আসছে।
আজ সে নিজের সেই জন্মভুমি ছেড়ে কয়েকশ মাইল দূরে কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে। তবুও এই অনামুখো টাইটেল তার পিছু ছাড়ছে না। কি বিপদ।
তার এই অবস্থা দেখে কাগজ ডিলার কি যে তার টাইটেল ফর্মে বসালেন জানা নেই। তবে তিনি নাকটা সিঁটকে বললেন “ওহে ভজা,এ কাকে তুলে এনিচিস? ছেঃ ছেঃ, পায়ের তেলো চুলকে আবার সেই হাত দিয়ে কপাল চুলকায়। জানিনা বাবা আর কোথায় কোথায় চুলকায় ব্যাটা"!
শিবরাম বেশ খানিকটা হেসে নিয়ে বলল “উফফ, কি যে বলেন মশাই। শরীরের অঙ্গ যেমন হাত, তেমনি পা, আবার তেমনি কপাল। এবার পায়ের তেলো চুলকালে পা দিয়ে তো আর চুলকানো যায়না অথবা কপাল চুলকালে ঠোঁট দিয়েতো আর চুলকানো যায়না। যেখান থেকেই চুলকানির ডাক আসুক না কেন, সেই হাত দিয়েই চুলকাতে হবে। এবার সব যদি একসাথে চুলকায় কি করব বলুন?”
বসাক বাবু বললেন “ তা ও ছেলে চুলকানি সঙ্গে করে নিয়ে কোথা থেকে এসেছ বাবা?”
শিবরাম আবার খানিকটা ভাবতে শুরু করল। তারপর উত্তর দেওয়ার জন্য সবে জুতোটা খুলে হাতটা পায়ের চেটোতে দিতে যাবে বসাক বাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন “ আচ্ছা বাবা, আমার ঘাট হয়েছে। তোমাকে কিচ্ছুটি বলতে হবেনা আর। তুমি এখন এসো।“ আরও একটু চেঁচিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে বললেন “ ওহে ভজা একে নিয়ে যা। আর কাগজ দিয়ে দে। বেচুক ব্যাটা। আর এখানে আনলেও আমার সামনে আনিস না। ছেঃ ছেঃ কি গেদরা ছেলে’রে বাবা"।
ভজা কাগজের একটা গোছা শিবরামের হাতে ধরিয়ে বলল “চলো এবার। বেশ লোক তুমি পথ থেকে তুলে এনে একটা কাজ দিলুম, সেটাও খেতে বসেছিলে। আচ্ছা ওই মন্দিরে ভিক্ষা করে খেতে ভালো লাগছিল?”
শিবরাম তখনকার জন্য কিছু বলল না ভজাকে। বাড়ি থেকে পালিয়ে এই কৈশোর বয়সে কলকাতা এসে উঠেছে সে। না খেয়ে না দেয়ে এসে এখানকার এক মন্দিরের বাইরে ভিখারিদের সাথে বসে ভিক্ষা করে যেটুকু জুটেছিল তাতেই রাবড়ি আর রসগোল্লা খেয়ে কাটিয়েছে দু-দিন। তিনদিনের মাথায় ভজার সাথে দেখা। তারই বয়সী একটা ছেলে। শিবরামকে দেখে প্রথমে তার দিকে মিনিট দুই তাকিয়ে ছিল ভজা। তারপর তার সামনে এসে প্রশ্ন করল “ ও ভাই। তোমাকে দেখে তো এদের বংশধর বলে মনে হচ্ছে না। কে তুমি? এখানে কেন?”
শিবরাম একটু হেসে বলল “ আমার আর এদের মধ্যে কোথায় তফাৎ একটু বল দিকি ভায়া।“ তারপর পাশে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল “এই দেখো, ওদেরও দুটো করে হাত আছে, দুটো করে পা আছে, দুটো করে চোখ আছে……” আরও কিছু হয়ত বলত শিবরাম। ভজা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল “ তুমি কি অন্ধ?”
শিবরাম অবাক চোখে ভজার দিকে তাকিয়ে বলল “কই ! দিব্যি দেখচি তুমি দাঁড়িয়ে আছ। রোগা গড়ন। রিকেটে ভোগা রুগির মত।“
ভজা ভ্রুটা কুঁচকে বলল “অনেক তফাৎ, এই যেমন দেখ ওই কাকার একটা হাত নেই। ওই দিদা চোখে দেখতে পায়না। যাই হোক, সে যদি বুঝতে আজ ওদের মধ্যে থাকতে তুমি? তা ভায়া দেখে তো ভদ্র ঘরের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। এইভাবে ভিক্ষা করে ক’দিন চলবে?”
শিবরাম এবার বেশ জোড়ে জোড়ে অট্টহাসি হেসে বলল “ আচ্ছা ভাই, ভদ্রলোক কি আমার কপালে লেখা আছে? কই আমিতো কোনদিন দেখতে পেলুম না। এইতো বেশ ফাস্টক্লাস আছি। কোথায় দুঃখ ?আর কাল দু-বেলা বাবড়ি খেয়েছি, রসগোল্লা খেয়েছি। একটা সিনেমাও দেখেছি। আর কি চাই বলো?”
ভজা আর কিছু বলতে পারলনা শিবরামকে। এক-দু বার তার দিকে তাকিয়ে হাতটা ধরে বলল “ চলো,একটা কাজ করো। খেটে খাও, ভগবান হাত দিয়েছে পা দিয়েছে। ভিক্ষা করার জন্য নয়। যেদিন ওইগুলো থাকবে না। তোমাকে আমি আবার এখানে এসে বসিয়ে দিয়ে যাব।“
শিবরাম ভজার দিকে অবসন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল “ আবার কাজ? ও ভাই রেহাই দাও। এই কাজ-টাজ করতে একেবারে ভালো লাগেনা আমার। বেশ আছি দেখো একেবারে ফাস্ট-ক্লাস।“
ভজা আর কিছু না বলে হাতটা ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে এই কাগজের ডিলারের কাছে নিয়ে এসেছে। সেও খবরের কাগজ ফেরি করে বেড়ায় আর তার সাধ্য অনুযায়ী শিবরামকে সে এই কাজটাই দিতে পারত। আর তাই দিলও সে।
শিবরাম অবশ্য কাজের কথা যে একদম ভাবেনি তা নয়। কাগজ হাতে তুলে সে ভজাকে বলল “ খবরের কাগজ মানেতো বেশ ভারী জিনিস। আচ্ছা ধূপকাঠি বেচলে কেমন হয়?”
ভজা মাথা চুলকে চোখ দুটোকে গোল্লা পাকিয়ে বলল “ কি কুঁড়েরে বাবা তুমি। এত কুঁড়ে লোকের পৃথিবীতে কোন জায়গা নেই। যে কাজ’টা দিলাম করতে হয় করো আর নয়ত আবার মন্দিরের বাইরে বাটি হাতে বসে যাও। “
শিবরাম আর কিছু না বলে খবরের কাগজ ফেরী করতে চলে গেল।
“তুমি ভায়া শ্যামবাজারের দিকটা যাও। আমি অন্যদিকে গেলুম।“ বলে ভজা বেড়িয়ে গেল।
শিবরাম শ্যামবাজারের দিকে গিয়ে “কাগজ চাই কাগজ “ বলে চেঁচাতেই কোথা থেকে চার-পাঁচটা লোক এসে জুটে গেল তার সামনে। তাদের হাতেও কাগজের গোছা। শিবরাম তাদেরকে দেখে বলল “ ওহে ভায়া। তোমরাও কাগজ বেচতে বেড়িয়েছ ! আহা খুব জমবে আজ। বিকেলে রাবড়ি আর রসগোল্লা খাব একসাথে। চলো একসাথে সবাই মিলে চেঁচাই। কাগজ লাগবে কাগজ।“
কিন্তু তাদের মনে আলাদা চিন্তা-ভাবনার বীজ রোপণ করা ছিল। ওই এলাকা বাঁচানোর লড়াই। সবাই মিলে কটকট চোখে শিবরামের দিকে তাকিয়ে থাকল খানিকক্ষন। তারপর তাদের মধ্যে একজন বলল “কান খুলে শুনে রাখো ভায়া, এ এলাকা আমাদের আগে থেকে দখল করা। তুমি নতুন লোক।এখানে এখন তোমার ঢোকা চলেনা। ভালোয় ভালোয় বেরিয়ে পর। তা না হলে খারাপ হবে।“
শিবরাম বলল “ পুরো পৃথিবীটা তো একটাই এলাকা ভায়া। আমার তোমার বলে আবার ভাগ কিসের? “
তাদের মধ্যে একজন চোখ দুটো বড় বড় করে বেশ রাগী মুখে তাকিয়ে বলল “ অতশত জানিনা ভায়া, কাল থেকে তোমায় যেন এই এলাকায় না দেখতে পাই।“
শিবরাম বেগতিক দেখে বলল “ফাস্টক্লাস বলেছ ভায়া। কাল থেকে অন্য এলাকায় গিয়ে ঘাঁটি গড়ব তাহলে। আজকের দিনটা এখানেই থাকি।“
লোকগুলো চলে যেতে সেদিনের মত রেহাই পেল শিবরাম। সারাদিন কাগজ বেচে যেটুকু কমিশন এলো। বিকেলে মিষ্টির দোকানে গিয়ে রাবড়ি , রসগোল্লা খেয়ে একটা সিনেমা দেখে কোন একটা ফুটপাথে শুয়ে তার সেই দিনটা কাটলো।
হ্যাঁ এটাই তার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। রাবড়ি-রসগোল্লা-কাটলেট আর সিনেমা এইক’টা জিনিস থাকলে তার আর কিছুই তার লাগেনা। তার বিশ্বাস এই ক’টা জিনিস দিয়েই তার জীবনধারণ সম্ভব। গাড়ী-বাড়ির স্বপ্ন সে দেখেনা।
(ক্রমশ)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।