এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  স্মৃতিকথা

  • মুক্তারাম বাবু স্ট্রিটের ছেলেটি - দ্বিতীয় পর্ব

    Rajkumar Mahato লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | স্মৃতিকথা | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৬৫৯ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (২ জন)
  • প্রায় এক সপ্তাহ কেটে গেল খবরের কাগজ ফেরি করে। কখনও কোলকাতার উত্তর প্রান্তে আবার কখনও দক্ষিন কোলকাতার অলিতে-গলিতে। আজ এখানে তো কাল ওখানে। এখানে পুরানোদের তাড়া খেয়ে ওখানে যায় ওখানে পুরানোদের তাড়া খেয়ে এখানে আসে। যাই হোক করে কাটছিল ওই আরকি। একেবারে ফাস্টক্লাস।

    বিপদ হল রবিবারের দিন। রবিবার স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সব বন্ধ। প্রত্যেকের ঘরে খাসির মাংস ভাত। তো সেই মাংস ছেড়ে কি আর কেউ কাগজ খোঁজে। রাস্তায় বেরোনো হয়না সেরকম। কাগজ পড়ুয়ে লোকেদের বাড়িতে পুরানো লোকেরা কাগজ দিয়ে আসে। কিন্তু শিবরামের তো এখন ওতটা পরিচিতি হয়নি। তাই বাড়িতে কাগজ নেওয়ার অর্ডার থাকেনা তার কাছে।

    প্রথম রবিবার শিবরামের রাবড়ি খাওয়ার টাকাটাও জোগাড় হলনা। অগত্যা, মন্দিরের নীচে গিয়ে কিছু ভিক্ষা করে যা পেল একটা কাটলেট খেয়ে রবিবারটা কাটল কোনরকমে। কিন্ত এভাবে তো চলতে পারেনা। রবিবার বলে কথা। এক বাটি রাবড়ি, দুটো রসগোল্লা না জোগাড় করতে পারলে কিসের আর পুরুষ। তাই ঠিক হল সোমবার থেকে শনিবারের কমিশনের টাকা থেকে কিছু বাঁচিয়ে রবিবারের আহারের ব্যবস্থা হবে।

    তবে এই ভাবনাটা কেবল রবিরারের জন্য ছিল। তারপর দিন থেকে আবার যা কমিশন আসছিল সবই ওই রাবড়ি-রসগোল্লা-কাটলেট আর সিনেমার পেছনে গিয়ে শেষ হতে থাকল। কিছু বাঁচিয়ে রবিবারের জন্য জমিয়ে রাখার ভাবনাটা কখন যেন ডানা মেলে মাথা থেকে উড়ে গেছে শিবরামের।
    পুনরায় ভাবনাটা আবার মগজে ফিরে এল শনিবার রাতে। ফুটপাতের শক্ত একটা চাদরে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকল “রবিবারটা আবার রাবড়ি সিনেমা ছাড়া থাকতে হবে?এ বিরম্বনা সইতে পারব না ঠাকুর। পারব না।“ সারারাত মাথা খাটিয়ে একটা ফন্দি এল মাথায়। যেমন ফন্দি তেমনই কাজ।

    দুপুরে কলকাতার এক সিনেমা হলের বাইরে খবরের কাগজ নিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইল শিবরাম। কোন চেঁচানো না, কোন তোষামোদ না। কেবল দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে থাকল সে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে কারোর অপেক্ষা করছে গভীর আগ্রহে।
    ধীরে ধীরে সিনেমা হল ভর্তি হল। কিন্তু কেউ কাগজ নিল না, তাও শিবরামের কোন হেলদোল নেই। তার অবস্থানে সে অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে। অনেকক্ষন থেকেই পাশের চায়ের দোকানের একজন ভদ্রলোক তাকে লক্ষ্য করছিল। যখন সবাই টিকিট কেটে খবরের কাগজ না নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল তখন সেই ভদ্রলোক শিবরামের কাছে এসে বলল “ ভায়া, এই সিনেমা দেখতে এসে কে খবরের কাগজ নেয় বল দিকি? তার থেকে একটু নড়ে-চড়ে ঘুরে-ফিরে বেচো। দেখবে অন্ততঃ খাবার টাকাটা জোগাড় হয়েছে। জোয়ান ছেলে এক জায়গায় তখন থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছ। বলি লজ্জা করেনা? “

    শিবরাম তার দিকে তাকিয়ে তার হাতটা ধরে বললেন “দাঁড়ান মশাই এখানে, আপনাকে আজ রাবড়ি খাওয়াবো। একটু অপেক্ষা করুন খালি।“

    ভদ্রলোক তো অবাক। ভ্রুটা কুচকে বললেন “আগে নিজের খাবারটা জোগাড় করো। তারপর নাহয় আমায় খাওয়াবে। আবার রাবড়ি? তোমার নলা নেহাত কম নয় ছোঁড়া।“

    ভদ্রলোকের কথা শেষ না হতে হতেই সিনেমা হল থেকে একে একে বেশ কয়েকজন লোক বেড়িয়ে এসে কাগজ কিনে আবার ভেতরে ঢুকে গেল। আরও একজন, ওইতো আরও একজন। দেখতে দেখতে সব কাগজ শেষ হয়ে একটা পরে রইল। ভদ্রলোক অবাক। হাঁ করে শিবরামের দিকে তাকিয়ে তিনি। শেষ কাগজটা একজন নিতে এলে শিবরাম বলল “আর নেই ভায়া,শেষ।“

    সেই ছোঁড়াটা বলল “ওইতো একটা, ওটাই দাও। ডবল দাম দিচ্ছি। “

    শিবরাম হেসে বলল “তুমি লাখ টাকা দিলেও ওটা আমার থেকে পাবেনা ভায়া। তাই গিয়ে ওই ছাড়পোকার মধ্যে বসেই সিনেমা দেখো। আমি এই চললুম।“

    শিবরাম সেই ভদ্রলোকের হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে গেল । ভদ্রলোক বললেন “তা বাপু, এ কি করে সম্ভব হলো একটু বল দিকি? তুমি কি গননা-টননা করতে পারো নাকি? নাকি তন্ত্র-মন্ত্র এর কাজ এটা? তা আমার হাত দেখে বলবে আমার বিয়েটা কবে হবে? কবে থেকে সংসার করারা আশায় বুক বেঁধে বসে রয়েছি।"

    শিবরাম খুব জোড়ে হেসে উঠল। তারপর লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল “ এখনো বিয়ে করার সখ যায়নি আপনার? এই বয়সে বিয়ে করলে বউ অন্য কারোর বাচ্ছা নিয়ে আপনার নাম দিয়ে দেবে।“

    ভদ্রলোক এই উত্তরটা আশা করেননি বোধহয়। তার পৌরুষত্বে আঘাত তিনি সহ্য করবেনই বা কেন? শিবরামের দিকে কটকট করে তাকিয়ে ভদ্রলোক বললেন “ কেন হে ছোঁড়া! কি কমতি আছে আমার মধ্যে? সরকারী চাকরি করি। আবার কি চাই?তোমার মত কাগজ ফেরি করে বেড়াই না, বুঝলে?“
    বলেই ভদ্রলোক মুখ ঘুরিয়ে আবার চলে যেতে যেতে বলল “ তুমি রাখো ভাই তোমার রাবড়ি, একটু রাবড়ির জন্য এত বড় অপমান সহ্য করা যায়না।“

    শিবরাম তার হাতটা ধরে আবার তাকে সামনের দিকে টেনে এনে বলল “আরে মশাই, আপনি রাগ করছেন কেন? আমিতো মজা করছিলাম। আজ আপনাকে আমি রাবড়ি খাওয়ালে তবেই তো আপনার বিয়েতে গিয়ে ভালো করে জম্পেস করে খেয়ে আসতে পারব। একদম ফাস্টক্লাস।“

    ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন “ তাহলে বলছ, আমার বিয়েটা হবে?”

    শিবরাম মাথাটা নেরে বলল “ হবে বৈকি, আলবাত হবে। এমন সুপুরুষ কে না চায় বলুন? আমার কথায় একেবারে রাগ করবেন না। নেহাত ছেলেমানুষী করে বলে ফেলেচি।“

    কথা বলতে বলতে একটা মিষ্টির দোকানে ঢুকল তারা দুজন। চেয়ারে বসে শিবরাম আওয়াজ দিল “কে আছো ভায়া, দুটো ফাস্টক্লাস রাবড়ি দাও দেখি।“

    রাবড়ি হাতে ঠোঁটে মুখে মেখে ভদ্রলোক প্রশ্ন করল “তা ছোঁড়া তুমি কি সত্যি সত্যিই জাদু জানো নাকি? নাকি গননা করতে পারো?”

    শিবরাম কোন কথা না বলে আগে রাবড়ির বাটিটা শেষ করল তারপর চেঁচিয়ে বলল “ ওহে কে আছো, পাঁচটা করে রসগোল্লা দিয়ে যাও এদিকে।“ তারপর ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল “আসলে আমি ওই সিনেমা হলে বহুবার গেছি। তাই ওখানকার ভেতরের অবস্থা আমার জানা আছে। বসার সিটগুলোর মধ্যে অসংখ্যক ছাড়পোকা ভর্তি। তাই কাল রাতে ফন্দি এঁটে ওখানে এসে দাঁড়ালাম। জানতাম সবাই আমাকে লক্ষ্য করেই হলে ঢুকেছে। যখনি ছাড়পোকা তান্ডব চালাবে তখনি তারা আমার কাছে ছুটে আসবে। আর হলোও তাই। সবাই বসার জন্য খবরের কাগজটাকেই শ্রেয় বলে মনে করে আমার থেকে কিনে নিয়ে গেল। আর আমার রাবড়ি খাওয়ার টাকাটাও জুটে গেল।“

    ভদ্রলোক অবাক নির্বাক বাক্যহীন হয়ে শিবরামের দিকে তাকিয়ে তখন । মুখ থেকে রসগোল্লার রস ঝড়ছে তখনও। শিবরাম আবার তার দিকে তাকিয়ে বললেন “এবার একটা সিনেমা হয়ে যাক?”

    তারপর থেকে প্রতিটা রবিবার এইভাবেই সিনেমা হলের বাইরে কাগজ বেচে রাবড়ি জোগাড় হতে লাগল শিবরামের। খাওয়া শোওয়া আর ঘুম, আবার ঘুম থেকে উঠে আবার খাওয়া আবার খেয়ে আবার পুনরায় ঘুমিয়ে পরা ছাড়া আর কোন কাজ নেই তার। সবই তার ফাস্টক্লাস থাকত সবসময় যেদিন খাওয়া জুটত সেদিনো আবার যেদিন জুটত না সেদিনও।

    (চলবে)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ | ১৬৫৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • santosh banerjee | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১৮:৫১503802
  • দারুন। অপূর্ব। কল্পনাতীত।যত পড়ছি শিবরাম সম্পর্কে তত বিমোহিত হচ্ছি। চালিয়ে যান দাদা।
     
  • Rajkumar Mahato | ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ২২:০৬503807
  • ধন্যবাদ। পড়তে থাকবেন পাশে থাকবেন ‌
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন