যদিও 'রাত বারোটার পর কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক- 'এর মিথ আজ পঞ্চাশের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী, তবু। তাকে ছাপিয়ে উঠে, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের কবিতার পূর্বাপর পাঠক জানেন, সুনীল-শক্তি-শঙ্খ-উৎপল-অলোকরঞ্জন-তারাপদদের থেকে অনেক অনেক দূরে সরে এসে পঞ্চাশের এই কবি নিজের ডিক্সনের জন্ম দিয়েছেন ব্যক্তিত্বের সেই স্তব্ধতায়, যেখানে কোনো হুল্লোড় নেই, মিথ হয়ে যাওয়া নেই, খ্যাতি প্রতিপত্তি তো নেইই, আছে শুধু ব্যক্তিগত নিঃসীম অন্ধকার। সেই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বহে যাওয়ার নামই যদি শরৎকুমারের কবিতা বলি তাহলেই বোধহয় একমাত্র বোঝানোর চেষ্টা করা গেল মনে হবে যে, 'কোথায় সেই দীর্ঘ চোখ'-এর 'আমি তো কামধেনু নই' কবিতায় শরৎকুমার 'নিজেকে নিংড়লে যত রক্তপাত' বলে ঠিক কী বোঝাতে চেয়েছিলেন। এই রহস্যময় রক্তপাতের সঙ্গে নিঃসন্দেহে জড়িয়ে রয়েছে জীবন যাপনের সমস্ত প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিরল সেই উদ্ভাস, যাকে শরৎকুমার এই ছ-দশকে শুধু নিজেই নিজের গভীরে টের পাননি, তাঁর পাঠককেও তার জন্য গভীর অভিনিবেশে, তৈরি নয়, বরং বলা ভাল তিলে তিলে নির্মাণ করে তুলেছেন।
শরৎকুমারের প্রথম কাব্যগ্রন্থ 'সোনার হরিণ' প্রকাশিত হয় ১৯৫৭-তে, কৃত্তিবাস প্রকাশনা থেকে। কবি তথা চিন্তক হিসাবে নিজের সময়কে চিনিয়ে দিয়েছেন তিনি এ বইয়ের নাম কবিতাতেই। সেখানে তাঁর প্রজন্মের বনলতা সেন, নিরুপমা রায় এসে কবিকে শুধোয় না 'এতদিন কোথায় ছিলেন', বরং কবি নিচু অভিমানী গলায় উচ্চারণ করেন, 'আমি জানি এ জীবনে জীবনের নিরুপমা রায়/কোনোদিন শুধাবে না, প্রিয়তম চলেছ কোথায়?' যতদিন যাবে, স্বাধীনতা-উত্তর-বাঙালি-বাঙালি তথা, ভারতীয় প্রজন্ম যে নিস্পৃহতা অর্জন করবে এ কবিতায় কি তারই ইঙ্গিত রেখে গেছিলেন কবি সেই সেদিনেই! দেখেছিলেন কি এই ভবিতব্য, যে, 'এক এক করে এই জীবনের সমস্ত প্রহর/সাঁতরিয়ে পার হব। ঘুরে ঘুরে সব ক'টি ঘর/ঘুঁটি এসে স্থির হবে গোধূলির মুমূর্ষু আলোকে/তখন অবাধ্য কোনো স্বপ্ন যদি আসে ঘুমচোখে/সোনার হরিণ তুমি জীবনের নিরুপমা রায়/সেইদিনও বলবে না, প্রিয়তম এসেছ কোথায়! 'নিজের সময়ের বৃত্তে দাঁড়িয়ে শরৎকুমারের লেখার উড়াল সেই ১৯৫৭ তেই নিজের প্রজন্মের মোহভঙ্গের কোন ইশারা বহন করছিল তা বোঝাতে এই উদ্ধৃতি জরুরি বলে মনে হয় আমার।
প্রকৃত কবিতার রহস্য বোধহয় এখানেই রে, সে যাঁকে ছোঁয় তা-ই যেন অনিবার্য আলো হয়ে হয়ে যায়। আকাশের মত ব্যাপ্ত। আর হয়ত-বা অনেকখানি একাও হয়ে যায় ভেতরে ভেতরে। না হলে, 'পৃথিবীর সঙ্গে মানুষের, সূক্ষ্ম এবং বিস্ময়কর সম্পর্ক আছে' কিংবা 'আমরা প্রাণবন্ত থাকি/যতদিন/ব্যক্তিগত মৃত্যুর প্রত্যাশা/আছে, আর আছে আমাদের/অপভ্রংশ, বুদ্ধিহীন ভাষা' বা, 'যাচ্ছ যখন, এমনভাবে যাও/থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল/তেমন আঁচড়/দেয়ালে লেগে না থাকে কোথাও'-র মত উচ্চারণগুলি যে সম্ভব হত না একথা, আর যা-ই হোক, আলাদা করে বলে দেবার নয়।
প্রখর, অভিমানী এবং স্পষ্টবক্তা। এই তিনটি অভিধায় কবি হিসাবে তো বটেই, গদ্যকার, ব্যক্তি হিসাবেও এমনকি, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়কে অনায়াসে চিনিয়ে দেওয়া যায়।
অনায়াসে, কারণ সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যে তিনিই হয়ত একমাত্র নন, কিন্তু অন্যতম ব্যক্তিত্ব, যিনি নিজের দাঁড়াবার জায়গাটা নির্দিষ্ট করে দিতে গিয়ে লেখালেখির প্রায় গোড়ার পর্বেই একরকম, বাধ্যতামূলক জানিয়ে রাখতে পারেন: 'ভাবালুতা আমি বিশেষ পছন্দ করি না!'
প্রথম জীবনের খুকি সিরিজ এবং মধ্য জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে লেখা স্ট্রেস সিরিজ অবশ্যই ওঁর স্মরণীয় কাজ। তিনি আবেগ এড়িয়ে চলতে চাইতেন সবসময়, তিনি কী করে এই সিরিজে এসে পৌঁছলেন ভাবতে অবাক লাগে। একের পর এক এই সিরিজের কবিতাগুলো আজও তাড়া করে বেড়ায় আমাকে। একটা কবিতা সেই সিরিজ থেকেই তুলে দিলাম এখানে:
হালকা গোলাপী আলোয় আঙুল তুলে
আমার সঙ্গে কথা বলো কেন।
তোমার অস্বাভাবিক উঁচু নাক আমায় তাড়া করে ঘুমের মধ্যে।তর্ক
করি না, তবু তোমার অকরুণ প্রশ্ন, উচিত কথাগুলো আমি বলেছি,
সত্যি? না ভীতু কাপুরুষ, চুপ করে
মেনে নিয়েছি অপমান? বিব্রত
করো কেন শংকরপ্রসাদ, আমি লজ্জায় কুঁকড়ে যাই।
রাজগীরের নিসর্গ সামনে, আমার অতীত নোটবুক খুলে দেখাও। তুচ্ছ
দানখয়রাতের তালিকা মেলে ধরো। বই
কিনি,পড়ি না, শুধু পেজমার্ক দিয়ে রাখি
কেন জানতে চাও। কতোকাল আগে
খেলতে খেলতে আমার
ভাইয়ের সামনের দাঁত–মনে হয় পেছন
থেকে ঠেলেছিলাম–আমি
ভুলতে চাই।
কাত হয়ে শুয়ে থাকি, তুমি আমার ওপর
তারের খাঁচা চেপে ধরো।
শিক দিয়ে খোঁচাও। শান্তি নষ্ট হয়। চোখ
বাঁচাতে লেজ বেরিয়ে
পড়ে, আমার কষ্ট হয়। লোম ফুলিয়ে ভয়
দেখাতে চাই, কিন্তু গলার
কাছে ধুকধুক করে প্রাণ।
সাম্রাজ্য ফিরে পাবার আশায় কতো
শাহেনশা পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
সাম্রাজ্যের লোভ নেই আমার। ঘুমোতে দাও শংকরপ্রসাদ। আমি
মহৎ নই, সাহসী নই। আমি লেখাপড়া
কিছু শিখিনি।
নারকোলগাছের ওপর মলমের মত জ্যোৎস্না পড়েছে। ব্যানডেজ
বাঁধা শাদা বাড়িটা অন্ধকারে, দাঁড়িয়ে,
একলা। তুমি যাও। আর একটু
পরে আলো ফুটলে শান্তি। বসিরহাট
বারুইপুর থেকে কলকাতায়
ঢুকবে সারি সারি ট্রাক বোঝাই আরাম।
শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটা পারিবারিক সম্পর্ক আছে আমার সঙ্গে। শরৎদা, বিজয়াদি বলতাম। কিন্তু বস্তুত, পিসি-শাশুড়ি ও পিস-শ্বশুর। একথা বলতে গেলেই বিজয়াদি বলবেন, খবরদার! আমি দিদি হই তোর। শরৎদা, সহাস্য, বলবেন, যা খুশি বলতে পার। নাম ধরেও ডাকতে পার।
মেঘমল্লার বাড়ির ওই ফ্ল্যাটটিতে, যে কোনো অজুহাতে, যাওয়া আমার চিরকালের মত ঘুচে গেল। মুছে গেল, সেখানে পৌঁছে তিরস্কার ও স্নেহ সমেত, খাদ্য ও পানীয় সহকারে নানাবিধ গল্প শোনার সম্ভাবনাটুকুও। স্মৃতি রয়ে গেল।