(৬) এসো আমার ঘরে এসো ২৭/০৩/২০০২ সন্ধ্যে ৫.৩০
দরজার গুমগুম আওয়াজ থামল। আমি কান খাড়া করে রয়েছি। ওপাশে একটু ফিসফিস কথাবার্তা। তারপর উঁচুগলায় — আমরা, সৌরভবাবু। দরজা খুলুন। ডাইনিং হলে গিয়ে একসঙ্গে চা খাব।
আমি চটপট রিভলবার আমার এয়ারব্যাগে চালান করে দিয়ে দরজাটা খুলি। প্রায় ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়েন দুই বোন - শৈবলিনী ও কুন্দনন্দিনী।
- কী পড়ে পড়ে ঘুমুচ্ছেন? চটপট চোখেমুখে জল দিয়ে তৈরি হয়ে চলুন। একসাথে চা’ খাব। আমরা রান্নাঘরে লোকটাকে বলে দিয়েছি। চা তৈরি হয়ে গেছে। তারপর একসাথে বেড়াতে যাব - নদীর পাড়, মন্দির, পূজোর জায়গা সব ঘুরে ফিরে এসে খেয়ে দেয়ে তারপর পূজো দেখব। কী বলেন?
-- ঠিক আছে দিদি।
-- গুডবয়! তাহলে তুমি বলতে পারি তো? কোন আপত্তি আছে?
আমার চোখে তখনও ঘুমের ঘোর, কোনরকমে মাথা নাড়ি।
চায়ের টেবিলে আড্ডা জমে যায়। ওঁরা জেনে নেন যে আমি যুবরাজ সায়েবের পিএ শুধু ওঁর বিলাসপুর অফিসের জন্যে। এখানে অন্য লোকজন দায়িত্বে রয়েছে। আমার কোন কাজ নেই। বুড়ার জায়গাটায় প্রথম এসেছি। কাল ফিরে যাবো।
- কোন ট্রেনে?
-- ওই ইন্দোর এক্সপ্রেস; দুপুর দুটোয়। টিকিট কাটা আছে। তবে ফেরার সময় স্লিপার ক্লাস, এস-৪।
ওরা দু’বোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করেন।
-- কী হল দিদি?
একটুক্ষণ ভেবে মুখ খোলেন ছোটবোন - কুন্দদি।
- না, মানে আমাদের ফেরার টিকিট কাটা হয়নি।
- কেন কাটেন নি?
- আরে সেই কোচে তোমার বস যুবরাজ বীরেন্দ্রপ্রতাপকে একটা নেমন্তন্ন চিঠি দেখিয়েছিলাম না? তার সঙ্গে খামে আমাদের আসার জন্যে এই টিকিট ছিল, ফার্স্ট ক্লাসে বি-কেবিনে। কিন্তু তাতে ফেরার টিকিট ছিলনা। আমরা ধরে নিয়েছিলেম যে ফেরার টিকিট বোধহয় এখানে দেয়া হবে। আফটার অল, তোমরা যখন আমাদের নেমন্তন্ন করে পুজো দেখতে ডেকে এনেছ!
-ঠিক কথা; এ’রকমই হবে। ওসব নিয়ে ভাববেন না। ড্রাইভার শান্তিরাম এসেছে, খুব চটপটে। ওকে ধরছি, সব হয়ে যাবে।
- দেখ, ওকে বল ফেরার সময় যেন আমাদের স্লীপার কোচে তোমার সঙ্গেই কেটে দেয়। তিন বাঙালী বিদেশ-বিভুঁইয়ে, একসঙ্গে গল্প করতে করতে যাব। পাঁচ ঘন্টার জার্নি। তারপর বিলাসপুরে নেমে আবার রাত্তিরে রায়পুর যাবার ট্রেন ধরতে হবে, তুমি একটু হেল্প করে দিও?
- নিশ্চয়ই দিদি। কিন্তু কালকেই ফিরে যাবেন? আরও দু’একদিন থেকে একটু বেড়িয়ে টেরিয়ে--!
ঝাঁঝিয়ে ওঠেন বড় বোন শৈবলিনী।
- নাঃ ; ঢের হয়েছে। কালকেই ফিরে যাব। দরকার হলে নিজেদের পয়সায় টিকিট কেটে। একটা দিনও বেশি নয়।
সায় দেন ছোটবোন কুন্দ।
- ইন ফ্যাক্ট না আসলেই বোধহয় ভাল হত।
ভগবান কি কখনও কখনও অসতর্ক মুহূর্তে মানুষের মুখ দিয়ে দৈববাণী করেন? এই কথাটা আমার ক’দিন পরে বিলাসপুরের অফিসে বসে মনে হয়েছিল।
-- এমন কথা বলছেন কেন দিদি? কী হয়েছে?
- কী হয়েছে? তোমার সামনেই তো হোল? দশ বছর পরে চিঠি লিখে ডেকে এনে আবার অস্বীকার? আমরা কি ভিখিরি?
- দিদি, আমি তোঁ মাত্র দু’মাস হোল এই নতুন চাকরি জয়েন করেছি। কিছু বুঝতে পারছি না।
দুইবোনের মধ্যে আবার চোখে চোখে কিছু কথা হোল।
- দেখ সৌরভ, তুমি আমাদের ছোট ভাইয়ের মত। তোমাকে সব খুলে বলছি। কিন্তু তোমাকে একটা কাজ করে দিতে হবে। তুমি যুবরাজ সাহেবের পিএ। তুমি কি আমাদের ওনার সঙ্গে আলাদা করে একবার কথা বলার ব্যবস্থা করে দিতে পারবে? কনফিডেনশিয়াল?
- দেখুন দিদি, উনি যেভাবে ট্রেনে আপনাদের চিনতে অস্বীকার করলেন তার পরে আমি কথা দিই কী করে? আমি সামান্য কর্মচারি।
-- বেশ; আগে সবটা শোন। তারপর দেখ কী করতে পার। তুমিই আমাদের শেষ ভরসা।
তারপর দু’বোনে মিলে আমাকে শোনান এক আশ্চর্য কাহিনী - প্রেম ও বিশ্বাসঘাতকতার। প্লটের চমকে হিন্দি সিনেমাকে হার মানায়। সবটা শুনে আমার ফিউজ উড়ে যায়, চুপ করে বসে থাকি।
ওরা জিদ করেন। দেখ, বীরেন্দ্রপ্রতাপ সবার সামনে যদিও আমাদের চিনতে চান নি, কিন্তু এস্টেট থেকে পাঠানো নেমন্তন্ন চিঠি তো অস্বীকার করতে পারেন নি। তুমি একটু চেষ্টা করে দেখ।
আমার মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়। শর্ট সার্কিট, অনেকগুলো ফ্ল্যাশ পয়েন্ট।
-- দিদি, কী করে জানলেন উনিই বীরেন্দ্রপ্রতাপ?
-- কেন, উনি কি যুবরাজ ন’ন? সবাই জানে যে বোম্বাগড়ের এস্টেটের যুবরাজের কী নাম। এছাড়া নেমন্তন্ন চিঠিতে তো ওনারই নাম রয়েছে।
- তা বলছি না। চিঠিতে শুধু আপনাদের ডাকা হয়েছে, খামের ভেতর ফার্স্ট ক্লাস কোচের টিকিট রয়েছে বি’কেবিনের। আপনারা কেমন করে জানলেন যে যুবরাজও ওই ট্রেনে যাচ্ছেন? উনি তো নিজের গাড়িতেও যেতে পারতেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। আর উনি যে জি কেবিনে আছেন সেটা আপনাদের তো জানার কথা নয়? আর এতদিন পরে এক নজরে চিনে ফেলা?
-- ঠিকই বলেছ, আমরা জানতাম না। কিন্তু বিলাসপুর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে টাঙানো ফার্স্ট ক্লাসের রিজার্ভেসন চার্টে মাত্র আটটা কেবিন। নিজেদের টিকিট ও কেবিন মিলিয়ে নিতে গিয়ে চোখে পড়ল - বীরেন্দ্রপ্রতাপ সিং, কেবিন জি, ব্যস্।
- কিন্তু উনি যে বললেন ওঁর নাম বীরেন্দ্রপাল সিং?
- ‘বাজে কথা’। কুন্দনন্দিনী বেশ উত্তেজিত। ‘আচ্ছা, পিএ সাহাব, সব টিকিট তো তোমার কাছেই আছে। একবার বের করত’।
আমি জানাই যে টিকিটে এবং চার্টে নাম বীরেন্দ্রপ্রতাপই প্রিন্ট করা আছে। কিন্তু উনি কন্ডাক্টরকে ধমকে ওর চার্টে নাম কাটিয়ে বীরেন্দ্রপাল করেছেন।
-- এসব বদমাইশি! নিশ্চয়ই কোন প্ল্যান আছে, হয়ত ঝোঁকের মাথায় আমাদের ডেকে ফেলেছে। এখন ভয় পাচ্ছে।
আমাদের মুখ গম্ভীর। আকাশপাতাল ভেবেও কুলকিনারা পাচ্ছি না। অন্ধকার নেমে এসেছে। মার্চ মাসের শেষ; কিন্তু পাহাড়ি এলাকা।এখন শীত শীত করছে। নিজের কামরায় গিয়ে একটা সোয়েটার বা জ্যাকেট বের করতে হবে। উঠব উঠব করছি।
এইসময় কেয়ারটেকারকে নিয়ে হাজির হোল শান্তিরাম। এসে কোন কথা না বলে সোজা সুইচ টিপে লাইট জ্বালিয়ে দিল। কেয়ারটেকার চায়ের বাসনপত্তর নিয়ে যাবার আমাদের মোটা মোটা দুটো মোমবাতি আর দেশলাই দিল। বলল, এখানে সোলার লাইট, তাই রাত এগারটার পরে বন্ধ হয়ে যায়। মাঝরাতে বাথরুম যেতে হলে কাজে আসবে। আমাদের কাছে টর্চ আছে, তবু ওর কথাটা ভাল লাগে।
ও চলে গেলে আমি শান্তিরামকে বলি কালকের জন্যে ও দিদিদের টিকিট কেটে দিতে পারবে কিনা?
কিন্তু ওর জবাব শোনার আগে শৈবলিনীদি জিজ্ঞেস করে বসে - যুবরাজ সাহাবের সঙ্গে একটু দেখা করা যাবে কিনা?
শান্তিরাম যেন একটু অবাক। বলে - আমি কথা বলে আপনাদের জানাবো। কিন্তু কী দরকার?
শৈবলিনীদি একটু থতমত খেয়ে যায়। কিন্তু কুন্দদি বলে - কিছু নয়। আমি তো কোলকাতায় ফিরে যাব। তার আগে বুড়ারের কুলদেবী ছিন্নমস্তা দেবীর সামান্য ইতিহাস যদি ওঁর মুখের থেকে শুনে নিতে পারি আর ওঁর একটা ফটো, তাহলে একটা প্রবন্ধ লিখে কোলকাতার কোন ম্যাগাজিনে পাঠিয়ে দেব। দারুণ হবে, তাই না?
- দিদি, আমি ওনার সঙ্গে কথা বলে আপনাদের খবর দিচ্ছি, ওনার মুডের ব্যাপার আছে, আর শরীরটাও ভাল নয়। ওনার একটা ফটো কালকে দিনের বেলায় পেয়ে যাবেন।
চলুন, আপনাদের দেবীর মন্দিরে নিয়ে যাই আর যুবরাজের নিবাসও দেখিয়ে দিচ্ছি। যাবার পথে দেবীর মাহাত্ম্য আমিই আপনাদের শুনিয়ে দেব। দেখে টেখে ফিরে এসে খেয়ে আবার পুজো দেখতে যাবেন তো?
কিন্তু মন্দিরের কাছে একটা দীঘি আছে। তার আশেপাশে রাত্তিরে বেড়াতে যাবেন না যেন। ওখানে একটা ঘড়িয়াল আছে। সেটা ইদানীং রাত্তিরে পাড়ে উঠে এসে ঝোপঝাড়ে ঘাপটি মেরে থাকে। আগে বকরা বছিয়া হাঁস-মুরগী এসব টেনে নিয়ে যেত। কিন্তু গত মাসে ইতওয়ারিন বাঈয়ের ছোট মেয়েটকে খেয়েছে। ওকে মারা কঠিন। গাঁয়ের লোক মনে করে ও ছিন্নমস্তা দেবীর বরপ্রাপ্ত। কাজেই সাবধান হওয়া ভাল।
আমি নিজের কামরায় ঢুকে গায়ে একটা জ্যাকেট চড়ালাম, তারপর তালা লাগিয়ে ফিরে এসে দেখি দুই দিদি নিজেদের কামরার তালা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। চাবিটা আদ্দেক ঘুরে আটকে যাচ্ছে, আমি একটু চেষ্টা করলাম। লিভারটা জ্যাম মত, বোধহয় বেশ কিছুদিন এই তালাটা ব্যবহার করা হয়নি, তেল দিতে হবে। যাহোক, ইতিমধ্যে শান্তিরাম এর সল্যুশন বের করে ফেলল। কেয়ারটেকারের থেকে আর একটা সাত লিভারের বড় তালা এনে লাগিয়ে তারপর চাবিটা ও বড়দিকে ফেরত দিল। আমার চোখে পড়ল ওর বাঁহাতে ছ’টা আঙুল, একটা বুড়ো আঙুলের গায়ে। আর অনামিকায় একটা আঙটি, তাতে সাদা পাথর বসানো। চাবিটা বাঁহাতে দিল কেন? ও বোধহয় ন্যাটা। আমরা হিন্দিতে বলি খব্বু, যেমন বাঙালীর গর্ব সৌরভ হল‘খব্বু বল্লেবাজ’।
আমরা এভাবে কামরায় তালা লাগিয়ে ওর সঙ্গে বেরিয়ে পড়ি। পেছন থেকে কেয়ারটেকার মনে করিয়ে দেয়। যেন আটটা সোয়া আটটার মধ্যে ফিরে আসি।
আমাদের চলা শুরু হয়।
অন্ধকার নেমেছে গাঢ় হয়ে। আজ বোধহয় অমাবস্যা। বনইমলির ঝাড়ে অসংখ্য জুগনু বা জোনাকি জ্বলছে নিভছে। বাঁশঝাড়ের ওখান থেকে একটা তক্ষক টর টর করে ডেকে উঠল। আমি ছোটবেলা থেকে মানা ক্যাম্পে এসব দেখে অভ্যস্ত। ভয় করে না। কিন্তু ছোড়দি কুন্দ আমার কাঁধের কাছে খিমচে ধরেছে। একটা ঠান্ডা হাওয়া পাহাড়ের দিক থেকে মাঝে মাঝে আসছে, শিরশিরানি বেড়ে যাচ্ছে।
শান্তিরাম বলতে শুরু করে।