কবি সুদীপ বসুর সাম্প্রতিকতম কবিতাগুচ্ছ ‘মৃত্যু ও ময়ূর’ ক-দিন আগে আমার হাতে আসে। একই সঙ্গে তাঁর পূর্বপ্রকাশিত আরও দুটি কবিতার বই, ‘নীল গয়নার মতো বাড়ি’ এবং ‘সবুজ কাঠের পার্টিশন’ এসে পৌঁছেছিল। কবিতাগুলি পড়তে গিয়ে বেশ খানিকটা বেসামাল হয়ে পড়ি। এই অশান্ত, বিপন্ন সময়ে সুদীপের প্রবল শক্তিশালী কলমের আঁচড় যেন ভিতর থেকে ছিন্নভিন্ন করতে থাকে।
সুদীপের লেখা পাঠককে তৈরি করে এক স্বতন্ত্র কাব্যভাষার মর্মোদ্ধারের জন্যে। তবুও পাঠক পুরোপুরি তৈরি হতে পারে কই? তাই যদি পারত তাহলে কবিতাগুলি পড়তে গিয়ে বারবার এমন হাড়-হিম-করা অনুভূতি হত না। কণ্ঠনালি বেয়ে একটা অব্যক্ত কষ্ট দলা পাকিয়ে উঠত না। আসলে সুদীপের লেখায় বারবার আক্রান্ত হতে হয় এক গভীর নিরানন্দে। কবিতাগুলি এতটাই যন্ত্রণাপ্রদ যে এক নৈর্ব্যক্তিক হতাশায় মন ভারী হয়ে ওঠে। সত্যের অন্বেষণে সুদীপ ঠিক যতটা সৎ, তাঁর কবিতা ঠিক ততটাই মর্মান্তিক এবং যথার্থকথনে একনিষ্ঠ। অথচ তিনি মানবীয় অভিজ্ঞতাগুলিকে বাস্তবতা থেকে খানিক বিচ্ছিন্ন করে তাকে জাদুর মোড়ক দিয়ে অদ্ভুত এক রূপান্তর ঘটিয়ে তোলেন। আর্থিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অভিঘাতের মধ্যে দিয়ে বাস্তবতাকে বিচিত্র ভাবে প্রসারিত করে নানান অর্থব্যঞ্জনার সৃষ্টি করেন।
মৃত্যু উপত্যকা-১। শিল্পী হিরণ মিত্র
তাঁর ‘ভিশন’ কলাকৈবল্যবাদের গজদন্তমিনারের তোয়াক্কাই করে না, বরং মিতবচনের অভ্যাসে অবিচল রেখে তাঁর সত্যকথনকে আরও বেশি নির্মম করে তোলে। তাঁর কবিতা হয়ে ওঠে গভীর বিষণ্ণতার এক নগ্ন উপাখ্যান, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ, অন্যায়ের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রতিস্পর্ধী চিৎকার, অনাচারের বিপক্ষে হাহাকার।
তাঁর অবশ্যম্ভাবী ও আশু বিপর্যয়-কথা এক অজানা ভয়ে সংক্রমিত করে পাঠককে। তার সযত্নলালিত পরিপাটি মধ্যবিত্ত জীবনকে ছিড়ে-খুঁড়ে দেয়। সুদীপের কবিতার সঙ্গে বসবাস করতে করতে সমস্তরকম আত্মতুষ্টি যেন ভেতর থেকে মুছে যায়।
মৃত্যু ও ময়ূর
অসম্ভব দেবদারু পাতা
আমাকে টলিয়ে দাও কেন?
আগুন
আমাকে বোঝাও।
দ্যাখো
যে মেয়েটি ঘুমের ভেতরে চুরি যায়
আমি তার খালি গলার গান
আমি তার ধুলো ও কুমকুম।
দূরে দূরে রেলকলোনির আলো
দূরে দূরে মৃত্যু ও ময়ূর
বলো
যে রাত্রি যায়
শুধু
চোরচালানের দিকে যাবে?
শুধু জুলেখার দিকে?
কামিনী ঝোপ
আমাকে সামলাও।…
(মৃত্যু ও ময়ূর)
নিদালি বিহ্বল কোনও পেলব অনুভূতি সুদীপের কবিতা পাঠে কখনোই হয় না। তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ বড়োই স্পষ্ট, ভাষা নির্মেদ এবং নির্ভান। বস্তুসাদৃশ্য থেকে তিনি তাঁর কাব্যভাষার নির্মাণে পরাবাস্তবকে নিয়ে এসে পাঠককে এক তীব্রতর সত্যের সামনে খাড়া করেন। তাকে বারবার শিউরে উঠতেই হয়। সেই ভেজালহীন নিরাভরণ সত্যের প্রাখর্য সহ্য করার দায় কিন্তু পাঠকের নিজের!
রাস্তায় কি জন্তু ঘোরে মরিয়ম
এত রাতে
রেলইয়ার্ড থেকে ভেসে আসে শিস।
ভেসে যায়
পালটা শিস, মেয়েদের।
একটি কোণঠাসা তারা
সারা রাত
তোমাকে শাসায়।
রাস্তায় কি জন্তু ঘোরে মরিয়ম?
জন্তু নাকি?
রাগি, নীল, রণরক্ত মাখা?
রসাতলেরও পরে ব্রিজ
কেউ ধরে ঝাঁকাচ্ছে।
একটা কালো ট্যাক্সি এসে থামল।
একটা নিষ্ঠুর লোক
উর্দি পরা
দেয়ালে হেলান দিয়ে কাঁদে
বলে ‘নিশীথিনী আমি বাড়ি যাবো।’
রাত বাড়ে।
রাগ পড়ে গেলে
তুমি দ্যাখো
তোমার বাড়ির সামনে
অন্ধকার জলে
চাঁদ ভেঙে আছে।
(মৃত্যু ও ময়ূর)
মৃত্যু উপত্যকা-২। শিল্পী হিরণ মিত্র
অন্ধকার সুদীপের কবিতায় নানান অশনিসংকেত নিয়ে বারবার ফিরে আসে। তাঁর কল্পদৃষ্টিতে অস্পষ্ট আলোহীনতা কোনো এক জটিল প্রক্রিয়ায় অজানা আশঙ্কায় প্রাণিত হয়। আবছায়া যেন তাঁর কবিতায় প্রতীকী এবং প্রত্যক্ষ অর্থব্যঞ্জনা সৃষ্টির মাধ্যম হয়ে ওঠে। এমন সব ইঙ্গিত তিনি উপর্যুপরি সাজাতে থাকেন এই অন্ধকারকে কেন্দ্র করে যা কিনা আমাদের পরিতৃপ্ত নাগরিক জীবনের ভিতটাকেই প্রবল শক্তিতে নাড়িয়ে দেয়।
জ্যোৎস্নাজড়িত নিশ্চিন্ত শান্তির রাতকে বিদীর্ণ করে কবি ছুড়ে দেন একের পর এক গভীর অসুখকর আর্ত প্রশ্ন। রাজনৈতিক ভণ্ডামি, সামাজিক বৈসাদৃশ্য, সংঘাতময় জীবনের খতিয়ান, ব্যর্থতা, হতাশা, অস্থিরতা তাঁর কবিতার ভিতর ভিড় করে আসে। প্রশ্নগুলি বাতাসহীন রাতের অন্ধকারকে ভারী করে অনবরত ঘুরপাক খেতে থাকে, খেতেই থাকে। যেন উত্তর না পাওয়া অবধি তাদের শান্তি নেই। আর ততক্ষণ অবধি নিস্তার নেই পাঠকেরও।
পার্টিলাইন
তোমাকে নিয়ে অসম্ভব লিখতে ইচ্ছে করে
এই বেশি জোছনার রাতে
অর্জুনের নরম কুয়াশায়
ব্রিজের ওপরে
ও আমার ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া
শীতের কমিউন
আমার নিঃস্ব পার্টিলাইন
যদি একবর্ণ লিখতে জানতাম!
(মৃত্যু ও ময়ূর)
সুদীপের কবিতা পড়তে শুরু করার পর থেকে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের স্বপ্নকে কেমন যেন অলীক, সুদূর পরাহত মনে হতে শুরু করেছে। গভীর অশান্তি সেই থেকে গ্রাস করে রেখেছে। সমষ্টিগত জীবনে মহামারির দৌরাত্ম্যের এক কঠিন বাঁকে দাঁড়িয়ে সুদীপের কবিতা কানে কানে বারবার বলে উঠছে,
নাগপাশ
হিরণ আমি যেতেই পারতাম
কিন্তু এখনও যে আমার
রাস্তার কল থেকে মা-বাবার স্নান করবার জল
তুলে আনা বাকি
রাতের রান্না বাকি
গান বাকি
বাসি কাপড়ের কথা না হয় বাদই দিলাম
হিরণ
আমার যে মৃত্যু বাকি…
(মৃত্যু ও ময়ূর)