‘পারি না বলবে না, পারি। উঠি না, কেননা
দরকারই হয় না তত, নিচে বেশ থাকি। তোমাদের খবর কী বলো।
লিখছ তো এখনো? লেখো। হ্যাঁ, এইখানে কাজ চলছে এপিডিআর-এর।
কী কাণ্ড দেখছ তো দেশ জুড়ে! এ এক আশ্চর্য কাল।
মানুষ তবুও কিছু প্রতিবাদ করে, করে যায়।
তোমাদেরও কথা মনে পড়ে।
নিশ্বাসের কষ্ট? খুবই। ঘুমও হয় কম—শরীরং ব্যাধিমন্দিরম্!
কাজেই চব্বিশ ঘণ্টা সান্ত্রী হয়ে বসে থাকি—শুয়ে থাকি—এইখানে
এই ঘরও এপিডিআর-এর।
শব্দগুলি মুছে আসে। বিদায় নেবার জন্য নিচু হতে গিয়ে চেয়ে দেখি
আশি বছরের মুখে ছায়ায় লেগে আছে
শীতের সব্জির মতো হাসি—
সেই হাসি, এপিডিআর- এর।’
কবি শঙ্খ ঘোষের ‘ধুম লেগেছে হৃৎকমলে’ কাব্যগ্রন্থের (১৯৮৭) পাঠকরা এই কবিতাটির সঙ্গে পরিচিত। কিন্তু ‘কবিতার মুহূর্ত’ গ্রন্থের মতো এখানে ব্যাখ্যা বা ইঙ্গিত নেই কবিতাটির উৎস কোথায়। কোন্ মুহূর্তের। কোনো বিশেষ সংযোগসূত্র আছে কি না। ‘কবির অভিপ্রায়’ গ্রন্থে পড়েছি, শঙ্খ ঘোষের ‘নিউ ক্রিটিক’ হওয়ার সম্ভাবনা কীভাবে সমূলে বিনষ্ট হয়ে গেছিল কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ছোটো একটি চিরকুটে লেখা মন্তব্যের জন্য, ‘‘এত কাণ্ড থাকে কোনো একটা লেখার মধ্যে?’’ তবু পাঠকের কৌতূহল থেকেই যাবে, কে সেই আশি বছরের মুখ? কবির সঙ্গে এপিডিআর-এর কোন্ ঘরটায় হঠাৎই দেখা হয়ে যায় তাঁর? সেই আশি বছরের মানুষটির নাম কপিল ভট্টাচার্য। কবির অভিন্নহৃদয় বন্ধু প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্যের বাবা। বহু বছর ধরেই সেই বাড়িতে—১৮ মদন বড়াল লেন-এ—কবির যাতায়াত ছিল।
এই কবিতার উৎস নিয়ে আমি একটা কারণ শুনেছিলাম। সমিতির একটি প্রচলিত বিধিভঙ্গের কারণে শঙ্খ ঘোষ ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন। সমিতির সভাপতি কপিলবাবুকে তাঁর অনুযোগ জানাতে এসেছিলেন ১৯৮৬ সালের কোনো একদিন দুপুরে। কুশল বিনিময়ের পর্ব শেষে অনুযোগ শোনার পরে কপিলবাবু তাঁর পুত্রসম, পুত্রের বন্ধুকে বলেন, “আমিই নাম দিতে বলেছিলাম। কী হয়েছে তাতে? তোমার নামে যদি অধিকারের ‘cause’ উপকৃত হয়, তাহলে আপত্তি কোরো না।’’ শঙ্খবাবু লজ্জিত হন। ফিরে আসেন। কপিলবাবুর ‘স্নেহমিশ্রিত বকুনি’ ও তাঁর এপিডিআর-এর প্রতি নিবিড় টান কবিকে অভিভূত করেছিল। তারই ফলশ্রুতি ওই অসাধারণ মানবিক কবিতাটি। এপিডিআর পরবর্তীকালে এই কবিতাটিকে নানাভাবে তার প্রচারে ব্যবহারও করেছিল। উল্লেখ্য, কপিলবাবু কিন্তু সেদিনই বিকালে দপ্তরে আমাদের বারণ করে দেন, ভবিষ্যতে আমরা যেন কারও নাম সম্মতি না নিয়ে প্রচারপত্রে বা কোথাও উল্লেখ না করি।
দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় ধরে এপিডিআর তথা নাগরিক, গণতান্ত্রিক ও মানবাধিকার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার সুবাদে দেখেছি, যখনই গেছি, তখনই শঙ্খবাবু সমিতির সমস্ত প্রতিবাদী পত্রে, কোনো মিছিলের, সভার আমন্ত্রণপত্রে সাগ্রহে স্বাক্ষর দিয়েছন। ন্যায্য দাবির ক্ষেত্রে কখনও আমাদের ফেরাননি, প্রত্যাখ্যান করেননি। একবার একটি গুরুতর প্রশ্নে তিনি, দেবেশ রায় প্রমুখ দ্বিধা, সংশয় দেখিয়েছিলেন। ২০০২ সালের পর পশ্চিমবাংলায় রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির প্রশ্নে রাজনৈতিক হিংসা ও অহিংসার বিষয়টিকেও কীভাবে দেখা উচিত, কতখানি তাকে অসমর্থন জানিয়ে বক্তব্য পেশ করা উচিত, বা হিংসা-অহিংসা নিরপেক্ষ ভাবে শুধু নিঃশর্তে মুক্তির দাবি তোলাটাই ন্যায়সংগত কি না তা নিয়ে তাঁদের টানাপোড়েন ছিল। পরে সেই দ্বিধার অবসান ঘটিয়ে রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির দাবিতে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন। বন্দিদের মনে কয়েদখানায় থাকার সময়ে কীধরনের অনুভূতি, অনুভব হয় তার অনবদ্য ব্যাখ্যা করেছিলেন শঙ্খবাবু ‘কয়েদির আকাশ’ শীর্ষক নিবন্ধে (১৯৯৪ ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ প্রবন্ধ সংকলন গ্রন্থের অন্তর্গত, ১৯৯৮ সংস্করণ); গোপাল হালদারের ‘স্বপ্ন ও সত্য’ বইয়েরও অন্তর্গত ‘কয়েদির আকাশ’-এর পাতায় পাতায় স্বাভাবিক প্রত্যাশিত মন-খারাপ-করা বন্দি মানুষের মুখচ্ছবি ছেয়ে থাকার মধ্যেও কীভাবে বন্দি-লেখক তারই ফাঁকে ফাঁকে আভাস পান জীবনের অপ্রত্যাশিত মুক্ত ‘আনন্দ রূপের’ তা পাঠকের সামনে শঙ্খবাবু তুলে ধরেছিলেন। তুলনামূলক আলোচনা করেছিলেন গোপাল হালদারেরই আর-একটি কারাগার সংক্রান্ত উপন্যাস ‘একদা’-র ও তার মুখ্যচরিত্র অমিতের; তুলনা করেছিলেন সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘জাগরী’ উপন্যাসের চারজন মানুষের আত্মকথন, তাদের ভাবনার নানাস্রোতের সঙ্গে।
‘কয়েদিদের’ অনুভবের একটি সাধারণ সত্যকে শঙ্খ ঘোষ ব্যক্ত করেছিলেন অননুকরণীয় ভাষায়: ‘‘কয়েদির কাছে আকাশ তার মুক্তির জন্য এক ব্যাকুলতা মাত্র। তার অনুভূমিক দৃষ্টি যখন থমকে আছে পাঁচিলে-পাঁচিলে, গরাদে-দেওয়ালে, উচুঁ থেকে একফালি আকাশের চকিত টান অনেকখানি ভরসা দিয়ে যায় তখন। কিন্তু কয়েদিমাত্রেরই স্মৃতিকথায় সেই আকাশ যে অনেকটা জায়গা নিয়ে থাকে তা নয়, শাসকের সঙ্গে প্রতি মুহূর্তের লড়াইটাই—নীচতা-বর্বরতার উদ্ঘাটনটাই’’ কারা-সাহিত্যের বিশেষ বৈশিষ্ট্য।
প্রত্যক্ষত আমি তাঁর ছাত্র ছিলাম না। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলাম স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে। বাংলাবিভাগের বন্ধুদের কাছ থেকে শুনেছি, আমাদের ইতিহাসের শিপ্রা সরকারের মতোই তিনিও অসাধারণ মাস্টারমশাই ছিলেন। মনে পড়ে, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পর্বে (১৯৭৭-৭৮), কলাবিভাগের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে আমরা দুই বন্ধু—সুজাত ও মনসিজ—জয়ী হয়েছিলাম। ভোটগণনার দায়িত্বে ছিলেন অধ্যাপকরা—যশোধরা বাগচী, মিহির ভট্টাচার্য, শঙ্খ ঘোষ প্রমুখ। আজও কানে বাজে স্যার শঙ্খ ঘোষের ব্যালট রিডিং—সুজাত, মনসিজ, বিমান—আমাদের প্যানেলের পক্ষে ব্যালটগুলো পড়ছেন স্পষ্টভাবে। ছাত্রসংসদের ম্যাগাজিন ‘অরণি’-তে প্রকাশিত আমার কাঁচা মানের ‘মুখুজ্জের সাথে আলাপ’ (কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়-এর মূল্যায়ন) লেখাটি পড়ে স্মিত হেসে বলেছিলেন, লেখাটা শুধু একপেশে নয়, অন্যের লেখার প্রভাব প্রবল ভাবে আছে। কাটিয়ে ওঠা উচিত। শিক্ষক হিসাবে তিনি তাঁর মাস্টারমশাইদের দ্বারা কীভাবে প্রভাবিত হয়েছেন, তাঁদের থেকে শিক্ষা নিয়েছেন, তা তাঁর ‘এখন সব অলীক’-এর পাঠকরা জানেন। পাশাপাশি, তিনি নিজেকে কিন্তু স্বতন্ত্র ভাবে গড়ে তুলেছিলেন।
এই স্বতন্ত্র শঙ্খ ঘোষকে বোঝা যায়, অনুভব করা যায়, এবং সর্বোপরি অনুপ্রেরণা পাওয়া যায় তাঁর সমসাময়িক, চলিষ্ণু ঘটনাপ্রবাহের উপর নিবন্ধ, কবিতাগুলো পড়লে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দমনপীড়নের বিরুদ্ধে যেমন বলেছেন, বাকস্বাধীনতার সপক্ষে যেমন বলেছেন, তেমন ভাবেই ক্ষমতার স্পর্ধার বিরুদ্ধে নিরলস ভাবে বলেছেন। পাশে কাউকে পাচ্ছেন কি না দেখেননি। সমাজের বিবেকের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। তাঁর নানা লেখায়, স্মরণ-নিবন্ধে, স্মারক বক্তৃতায় বারবার কয়েকজনের নাম পরম সম্ভ্রম ও শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লিখিত হয়েছে তাঁদের আপসহীন আদর্শগত প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ভূমিকার জন্য—বিশেষ করে সমর সেন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। আমার মতে, পরবর্তী দশকের পর দশক জুড়ে শঙ্খ ঘোষ সেই প্রতিবাদী প্রবাহমান ধারার অন্যতম ধারক ও বাহকের শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তাঁর লেখার কিছু প্রতিনিধিত্বমূলক উদাহরণ এই ধারণাকে তুলে ধরছে ।
১. পশ্চিমবাংলায় সত্তরের দশকের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস নিয়ে জ্যোতির্ময় দত্তকে প্রতিক্রিয়াসূচক চিঠি, ‘বিশেষণে সবিশেষ’ পড়লে আজও সেই বীভৎস গণহত্যা, গণনিপীড়নের যুগটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ‘কবিতার মুহূর্ত’ বইটির পাঠক হিসাবে আমি মাঝেমধ্যেই লেখাটি পড়ি।
২. সরকারের দমনপীড়ন, গুলিচালনা, তাতে মানুষের মৃত্যু কবিকে গভীর ভাবে নাড়া দিত। লিখছেন ‘ন্যায়-অন্যায় জানিনে’ কবিতায়, ‘‘... আত্মরক্ষা ছাড়া কিছুই জানে না বুলেটরা/ দার্শনিক চোখ শুধু আকাশের তারা বটে দেখে মাঝে মাঝে/ পুলিশ কখনো কোনো অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ।’’
অথবা
৩. ‘তুমি কোন দলে’ কবিতায় লিখছেন, ‘‘... পুলিশের গুলিতে যে পাথরে লুটোয় তাকে টেনে তুলবার আগে জেনে নাও দল/... বিচার দেবার আগে জেনে নাও দেগে দাও প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দল/ আত্মঘাতী ফাঁস থেকে বাসি শব খুলে এনে কানে কানে প্রশ্ন করো তুমি কোন দল...।’’
(উপরিউক্ত দুটো কবিতাই ‘লাইনেই ছিলাম বাবা’ কাব্যগ্রন্থে সংকলিত)
অথবা
৪. গণতন্ত্রের মধ্যেও ব্যক্তি ক্ষমতার চূড়ান্ত স্তরে আসীন হলে যে স্বৈরতন্ত্রের চেহারা নিতে পারে তার সম্পর্কে আমাদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন তাঁর ‘দুর্যোধন’ কবিতায়, ‘‘…আমিই গম্বুজচূড়া, আমি দেশ, আমিই সমাজ।’’ সেই ভয়ংকর আমি কেবল আনুগত্য চায় তার নাগরিকের কাছ থেকে; প্রশ্ন তোলা একবারেই না-পছন্দ। পেতে চায় সেইধরনের মানুষ, ‘‘তালি দিতে বললে তালি দেবার/ গালি দিতে বললে গালি দেবার” (অধিকার) জন্য প্রস্তুত। অথবা, ক্ষমতা চায় এক প্রশ্নহীন বাহিনী, ‘‘...সব প্রশ্ন সরিয়ে নেবার / তুমুল অধিকার আছে আমার’’ (অধিকার)।
অথবা,
৫. ‘‘যত দূর যেতে বলি যায় এরা, কখনো আসে না/কোনো কূটতর্ক নিয়ে। ভাবলেশহীন/ ধ্বংস হাতে ছুটে যায়। যদি বলি দিন, এরা বলে দেয় দিন/ যদি বলি রাত, বলে রাত।’’ (দুর্যোধন)
তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আহুত বুদ্ধিজীবী সমাবেশে অকপটে কবি পাঠ করেছিলেন লিখিত বক্তব্য। তাতে তিনি ক্ষমতার প্রতাপ অন্ধতার বিরুদ্ধে, বাম সরকারের কাজকর্মের ‘বিপজ্জনক শিথিলতা এবং চেতনাহীনতার’ সমালোচনা করেছিলেন। ২০০৯-এর ঐতিহাসিক ১৪ নভেম্বরের মিছিলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
পাশাপাশি, এপিডিআর-এর প্রকাশনা, ‘রবীন্দ্রনাথ ও মানবাধিকার’ পড়ে ভীষণ খুশি হয়েছিলেন। এপিডিআর-কে অনুমতি দিয়েছিলেন ১৯৫১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত প্রকাশিত তাঁর নানা কবিতা নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশ করার। দীপংকর চক্রবর্তী এবং সব্যসাচী দেবের সম্পাদনায় ‘সময়পটে শঙ্খ ঘোষ’ ২০০৮ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। মুখবন্ধে তাঁরা তুলে ধরেছিলেন কবির সদাপ্রতিবাদী চরিত্রকে, ‘‘উচ্চকিত মুখরতাকে সযত্নে পরিহার করেও কতো বাঙ্ময় হয়ে ওঠা যায়, স্পর্শ করা যায় চেতনার গভীরে, এবং হৃদয়েও, আমাদের সামনে তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কবি শঙ্খ ঘোষ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও ক্ষমতার মদমত্ততার উলঙ্গ প্রকাশ ঘটলেই ঝলসে উঠেছে...’’ তাঁর কলম।
ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহও তাঁর ‘তিন আমির কথা’ গ্রন্থে (২০১১) ‘‘কৃত্তিবাস সম্প্রদায়ের অগ্রগণ্য কবিদের মধ্যে শঙ্খ ঘোষ অন্যতম’’, এই উক্তি করে ‘‘রোমান্টিক অনুভূতিতে যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের দ্বৈতলীলার’’ প্রেক্ষিতে তাঁর কবিতার মূল্যায়ন করেছেন। সমকালীন সমাজ থেকে বিছিন্ন করে সমাজসচেতন কবি শঙ্খ ঘোষের কবিত্বের ইতিহাস লেখা সম্ভব নয় বলে রণজিৎ গুহ মনে করেন। এ প্রসঙ্গেই মনে পড়ছে, সাংবাদিক বাহারউদ্দিনের অনুরোধে সুদূর ইরাকের ক্ষমতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদী, নির্যাতিত কবিদের কবিতাগুলো বাংলাভাষী পাঠকদের কাছে অনুবাদ করে তুলে ধরেছিলেন।
উল্লেখ্য, কবি যুদ্ধবিরোধী এবং শান্তির সপক্ষে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন বরাবর। ‘‘অন্যের ভালো করা’’ শীর্ষক একটি টুকরো লেখায় তিনি যুদ্ধের বিভীষিকার নিন্দা করেন। জাতীয়তার নামে এক দেশের ওপর অন্য দেশের হামলাকে নিন্দা করার পাশাপাশি সব ধরনের অস্ত্র বিনাশের আহ্বান জানিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। ১৯৬৭ সালে ভিয়াতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধকে নিন্দা করে সে দেশের ২০০ জন গ্রন্থ-প্রকাশক এবং ৩৫০ লাইব্রেরি-সম্পৃক্ত মানুষ যে দীর্ঘ বিবৃতি দিয়েছিলেন তার অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করেছিলেন তিনি ২০০৭ সালের তাঁর এই যুদ্ধবিরোধী নিবন্ধে, এবং সে দেশের যে কয়েকজন লেখক অন্যের ভালো করার নাম করে আমেরিকার ‘‘মহান’’ দাদাগিরি সমর্থন করেছিলেন তার সমালোচনা করেছিলেন এখানে। (বট পাকুড়ের ফেনা, ২০১১)।
যে-কোনো রঙের শাসকের অত্যাচার, প্রশ্নহীন ক্ষমতার আধিপত্যের বিরুদ্ধে শঙ্খ ঘোষের তীক্ষ্ম ও মৌলিক কবিতাগুলো গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ভাষা হয়ে উঠেছিল—স্লোগানে, পোস্টারে, প্রচারপত্রে, দেয়াললিখনে, নিবন্ধে, ভাষণে বারেবারে ফিরে ফিরে এসেছে এই কথাগুলো। আন্দোলনরত মানুষের সঙ্গে সমাজের নানাস্তরের নাগরিকের মধ্যেকার সংযোগের ভাষা হয়ে আজও দাঁড়িয়ে আছে তাঁর সৃষ্টিকর্ম। এখানেই তিনি তাঁর যুগ, সমকালকে অতিক্রম করে গেছেন। উল্লেখ্য, সমর সেন, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়, মহাশ্বেতা দেবী, তরুণ সান্যাল, শঙ্খ ঘোষ, মৃণাল সেন সহ বহু গুণীজন উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলায় ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল্স’-এর ভূমিকা পালন করেছিলেন, পরবর্তী প্রজন্মের গুণীজনদের কাছে আদর্শস্বরূপ।
ইউরোপে ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়ায় বলশেভিজমের শাসন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের নানা উপলব্ধি নিয়ে ২০০২ সালে আমাদের চমৎকার ‘একপেশেমির সংকট’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপহার দিয়েছেন শঙ্খ ঘোষ। তিনি লিখছেন, “রবীন্দ্রনাথ ১৯৩৯ সালে ২০ সেপ্টেম্বর আর এক-নিঃশ্বাসে বলতে পারেন না ‘বলশেভিজম আর ফ্যাসিজমের কথা’, তখন বলতে হয় শুধু ‘মানব-ইতিহাসে ফ্যাসিজমের নাৎসিজমের কলঙ্ক প্রলেপ আর সহ্য হয় না’’ (ভিন্ন রুচির অধিকার)। ২০০৫ সালে প্রকাশিত ‘কান-ঢাকা টুপি’ প্রবন্ধেও এই বিষয়ে বিস্তারিত লিখলেন। তথ্য গোপন করা এবং তথ্য নির্মাণ করা ফ্যাসিবাদের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তা দ্বিধাহীন ভাবে জানালেন, ‘‘…গোয়েবলস একটি ব্যক্তিনাম মাত্র নয়, গোয়েবেলস একটি প্রবণতা, একটি অস্ত্র।’’ তিনি তুলনা টেনেছেন বর্তমান ভারতের বিজেপি-আরএসএস-এর ঘৃণাবিদ্বেষের রাজনীতির তথা হিন্দুত্বের জিগির এবং তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ গোয়েবলসীয় মিথ্যাচার। তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘মুক্তধারা’ নাটকের কথাগুলো; লক্ষ রাখতে বলছেন আমাদের, কে তথ্য জানাচ্ছেন তার ওপর; আর সেই তথ্যকে যাচাই করে নিতে বলছেন। কারণ, শঙ্খ ঘোষের ভাষায়, ‘‘তথ্যজ্ঞানের জগতে এই ভয়টা তাই সবসময়েই থেকে যায়, কোন্টা যথার্থ তথ্য আর কোন্টা নয়।’’ ‘মুক্তধারা’ নাটকে ছাত্রদের শেখাচ্ছেন গুরু, রাষ্ট্রের মতিগতির উপর নির্ভর করে তথ্যের মধ্যে কতটা সত্য থাকবে। শঙ্খ ঘোষের অমোঘ পর্যবেক্ষণটি প্রণিধানযোগ্য, ‘‘সত্য আর মিথ্যের অবস্থানকে মুহূর্তের মধ্যে ওলটপালট করে দেওয়া যায়, করতে যদি চায় কোনো ক্ষমতা। আর, ক্ষমতার ধর্মই হল নিজের সুবিধেমতো এই ওলটপালট করে দেওয়া।’’
সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সতত সরব শঙ্খ ঘোষের নানা সংকট সময়ের লেখাগুলো আজ আর দুর্লভ নয়। ‘অবিশ্বাসের বাস্তব’ সংকলন (২০০৯ সংস্করণ)-এ সেগুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা নেই—এই ধরে-নেওয়া ধারণাকে, অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে, ১৯৯০ সালে তছনছ করে দিয়েছিল অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে জনসমর্থন তৈরির লক্ষ্যে লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রা। সে ঘটনার পরেই পশ্চিমবঙ্গের নানা সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে গিয়েছিল। কীভাবে সাম্প্রদায়িকতা মানুষের মনের গভীরে ক্রিয়া করে তা নিয়ে শঙ্খ ঘোষ আলোচনা করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে, ব্যাহিক রূপের বিরুদ্ধে শুধু লড়াই নয়, বিষাক্ত ধারণার বিরুদ্ধে নিরন্তর মননের স্তরে, আদর্শের স্তরে সংগ্রামের উপর অভিঘাত দিয়েছিলেন, দুই বা বহু সম্প্রদায়ের সংস্কৃতিগত আদানপ্রদান, নিবিড় মিলনের উপর জোর দিয়েছিলেন। ২০০২ সালে গুজরাটের গণহত্যার পর কলকাতায় দেশবন্ধু পার্ক থেকে দেশপ্রিয় পার্কের মিছিলে যেমন হেঁটে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন, তেমনি কলমও ধরেছিলেন ‘‘...শকুনি আহ্লাদে ফাটে কান/ইয়ে তো পহেলা ঝাঁকি হ্যায়। /ইয়ে তো পহেলা ঝাঁকি হ্যায়/ হাওয়ায় হাওয়ায় ঝাঁকি অক্ষরে জাগুয়ার/ স্বপ্নের ভারতবর্ষ স্বপ্নের ভিতরে অন্য কার!’’ (স্বপ্ন)
গৌরী লঙ্গশের হত্যাকাণ্ডের পর কবি ধিক্কার জানিয়ে আবার লিখলেন ‘‘তিসরা ঝাঁকি’’—‘‘... গলায় মুণ্ডুর মালা তাথৈ তাথৈ নাচে/ গোটা দেশ হয়েছে ভাস্বর— / আজ সে-পরীক্ষা হবে আমরা শুধু শববাহক/ নাকি কোনো সত্যভাষী স্বর।’’ কবি দেখে যেতে পারলেন না, পশ্চিমবাংলার মানুষ শববাহকদের প্রথম পর্বে বিপুল ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
খুব ভালো লাগলো।
এই প্রায়নধকার সময়ে শঙ্খ ঘোষের কবিতার আলোক আমাদের বাঁচার পথ দেখাবে এই প্রদীপ্ত আলোচনা।ধন্যবাদ সুজাত।
অনবদ্য। এত অ্যানালিটিকাল!
দারুণ লিখেছেন। এতোদিন জানতাম আপনি শুধু মানবাধিকার নামক কাঠখোট্টা বিষয় নিয়েই লেখেন, আপনার মধ্যে যে এতো কাব্যময়তা সুপ্ত আছে সেটা আগে টের পাইনি।