রণবীর চক্রবর্তী : অধ্যাপিকা সুকুমারী ভট্টাচার্য, আমাদের প্রায় সবার কাছে সুকুমারীদি, তাঁর জন্মের ১০০ বছর পূর্তি হচ্ছে ২০২১ সালে। আমরা আজকে কথা বলব সুকুমারীদির কন্যা, প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ, অধ্যাপিকা তনিকা সরকারের সঙ্গে তাঁর মায়ের বিষয়ে।
আমি সুকুমারীদিকে চিনতে আরম্ভ করি ১৯৮৬-৮৭ সালে। তার আগে ওঁর দু-একটি লেখা পড়েছি। ব্যক্তিগত আলাপ হওয়ার মাধ্যমে তাঁকে ধীরে ধীরে চিনতে পারা, তাঁর লেখনীর মাধ্যমে চিনতে পারা এবং যেটা বরাবর আমার কাছে মনে হয়েছে, সুকুমারীদির লেখা পড়লে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের একটা অন্য জগত খুলে যায়। আমি তনিকাদির কাছ থেকে প্রথমে একটু জানতে চাইব, সুকুমারীদির যে পড়াশোনার বিস্তার, সেই চর্চাটা তিনি কীভাবে রাখতেন? তাঁর বহু বিষয়ে উৎসাহ, সংস্কৃত ভাষা সাহিত্য তো বটেই, বিশেষ করে ইয়োরোপীয় ভাষা এবং সাহিত্যের ধ্রুপদি রচনাগুলির সঙ্গেও তাঁর সম্যক পরিচয় ছিল। গ্রিক-ল্যাটিন সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। এবং সেই সঙ্গে একধরনের অত্যন্ত সমাজসচেতন বামপন্থী মনোভাব তাঁর লেখার মধ্যে আমরা বরাবর দেখতে পাই। এই এতগুলো দিক—এর তৈয়ার যাকে হিন্দিতে বলে, সেই তৈয়ারটা কীভাবে হয়েছিল, যদি একটু বলো।
তনিকা সরকার : এই তৈয়ারটা সবই যে একসঙ্গে হয়েছিল, তা না। কয়েকটা আগ্রহ খানিকটা আকস্মিক ভাবে হয়েছিল, কয়েকটা হয়তো জন্মসূত্রে পাওয়া। যেমন ধরো, মা তো খ্রিশ্চান পরিবারে জন্মেছিলেন। বাইবেল খুব ভালো করে জানা ছিল। গোঁড়া খ্রিশ্চান পরিবার। কিন্তু সংস্কৃততে আমার দাদামশায়ের খুব আগ্রহ ছিল। উনি স্কটিশচার্চ স্কুলে পড়াতেন। মার প্রধানত সাহিত্যে অনুরাগ ছিল বলে, সেই প্রজন্মের মানুষ তো... রবীন্দ্রনাথ তখনও বেঁচে... তখনও নতুন নতুন বই বেরোচ্ছে রবীন্দ্রনাথের... মানে সাহিত্যে একেবারে ডুবে থাকতেন তাঁরা, তা সে যে-কোনো বিষয়ের লোকই হন না কেন। কাজেই বাংলা সাহিত্য, রবীন্দ্রনাথ..., যদিও রবীন্দ্রোত্তর সাহিত্যে মার কোনোদিনও খুব একটা আগ্রহ দেখিনি। এই সাহিত্যপ্রীতি থেকেই প্রথম সংস্কৃততে ঝোঁক হয়। তবে রবীন্দ্রনাথ, বাইবেল মার খুব ভালো করে পড়া ছিল, মুখস্থ বলতেন—এই সমস্ত নিয়েই তিনি বড়ো হচ্ছিলেন। বলা ভালো, তার ওপর সংস্কৃত আসে পরবর্তীকালে। এবং একে একে মাকে কয়েকটা টোলের পরীক্ষাও দেওয়ান আমার দাদামশায়। কাজেই ওই জগতটার সঙ্গে মার একটু পরিচয় ছিল। পরে যখন আমরা ১৯৬২ সালে প্রথমবার কাশী যাই, মাও যান আর কী, বেনারস ইউনিভার্সিটিতে, তখন উনি দু-একজন প্রাচীনপন্থী পণ্ডিতদের কাছে যেতেন। আমাকেও সঙ্গে নিয়ে যেতেন কেন জানি না। তাঁরা কীভাবে ভাবেন কাশীর বিষয়ে, কাশীর ইতিহাস সম্বন্ধে কী জানেন ইত্যাদি মা তাঁদের জিজ্ঞেস করতেন।
র : এই যে কাশীতে উনি গিয়েছিলেন, সেটা কি কাশীর হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, নাকি কাশীর সংস্কৃত বিদ্যাপীঠ? কোথায় গিয়েছিলেন মনে আছে?
ত : কোথাওই নয়। আমরা এমনই বেড়াতে গিয়েছিলাম। আমাদের পরিবার এবং আর দুটি পরিবার—আমরা একসঙ্গে বেড়াতে গিয়েছিলাম। পারিবারিক সূত্রে পরিচিত বিএইচইউ-এর একজনের বাড়ি খালি ছিল, সেখানে আমরা থাকার জায়গা পেয়েছিলাম। মা আমাকে নিয়ে নিয়ে মাঝে মাঝে বেরোতেন। এইভাবে সংস্কৃত নিয়ে চর্চা করতে করতে... তারপর ভিক্টোরিয়া কলেজ। কিন্তু কোথাও কোনো ঠেকেনি, সংস্কৃত পণ্ডিতমশাইরা এসে পড়াতেন। তার পরে যখন এমএ পড়তে গেলেন, সেখানে আপনারা সকলেই জানেন যে মেয়েদের কাছে বেদ পাঠ করা হবে না, তিনি ক্লাসে থাকতে পারবেন না... তার পরে মাকে স্কলারশিপ দেওয়া হবে না... সংস্কৃতে স্কলারশিপ বাঁধা থাকত। কিন্তু সেবছরই ভূগোলকে আর্টস হিসেবে ধরে ভূগোলের একজনকে দেওয়া হল, কিন্তু মাকে দেওয়া হল না, যেহেতু মা খ্রিশ্চান। এইখানে একটা বড়ো ধাক্কা খেয়ে মা মাঝপথে গতি বদলে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে এমএ পড়তে শুরু করলেন এবং যেহেতু খানিকটা সময় নষ্ট হয়ে গেছে, আমার দাদামশায় একে ওকে জিজ্ঞেস করে, আরও ভালো ভাবে বলতে গেলে, আশিস নন্দী মশায়ের বাবা, তিনি ওয়াইএমসিএ-র দায়িত্বে ছিলেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করে, আমার বাবা তখন সদ্য সদ্য এমএ পাস করে বেরিয়েছেন, অত্যন্ত নামকরা ছাত্র ইংরেজি সাহিত্যের, ওঁকে প্রাইভেট টিউটর করেন। মা তখন ইংরেজি সাহিত্য বাবার কাছে পড়েন, প্রথমবার সিরিয়াসলি ইংরেজি সাহিত্য পড়েন। খুবই আগ্রহ পান এবং তা ছাড়া বাবা তখনই, ওই বয়সেই খুব সমাজতন্ত্রে, মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। কিছুদিন পার্টির সঙ্গেও কাজ করেছিলেন, ঠিক মেম্বারশিপ নিয়ে নয়। মা যখন এমএ পড়েন, কিংবা ভিক্টোরিয়া কলেজে, আমার ঠিক খেয়াল নেই, রেণু চক্রবর্তী, যিনি পরে সিপিআই-এর সঙ্গে যুক্ত হন, তিনি কিছুদিন মা-দের ইংরেজি পড়িয়েছিলেন। তিনি তখন সদ্য সদ্য অক্সফোর্ড থেকে ফিরেছেন, মা-দের কাছে সোভিয়েত ইউনিয়নের গল্প করতেন। কিন্তু ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে একটা সংঘাত বাধে। তারপর বাবার কাছে পড়েন, তারপর বিয়ে— একটা সামাজিক বিপ্লবই বলা যায়। বাবা অত্যন্ত গোঁড়া হিন্দুবাড়ির ছেলে, মা খ্রিশ্চান বাড়ির মেয়ে। বাবা বলেন যে আমি ধার্মিক মহিলাকে বিয়ে করব না, যতদিন ধর্মে বিশ্বাস থাকে আমাদের মিল হবে না। চার বছর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এটা একটা ব্যক্তিগত শুধু না, একটা সামাজিক ইন্টারেস্টের জায়গা।
র : হ্যাঁ, এটা একটা মতাদর্শের অবস্থানও বটে।
ত : হ্যাঁ, মতাদর্শ। এবং আমি পরে মাকে ঠাট্টা করতাম যে বাবাকে বিয়ে করার জন্যই তুমি নাস্তিক হয়ে গেলে। তা ঠিক নয়। কিন্তু মা যখন নাস্তিক হলেন, অত্যন্ত গোঁড়া নাস্তিক। আমার বাড়িতে কোনো বন্ধু এলেই, আমার খুব লজ্জা করত, মা প্রথমেই জিজ্ঞাসা করতেন, তুমি কি ভগবানে বিশ্বাস কর? কেন কর?—এই ধরনের। এইভাবেই আলাপ শুরু করতেন।
তারপরে মা ইংরেজিতে এমএ পাস করলেন। তারপরে ব্রাবোর্ন কলেজে পড়াতে পড়াতে সংস্কৃতের জন্য বলতে পারেন মন কেমন করতে লাগল। মা বলতে লাগলেন যে এটাই আমার জায়গা। আমি খুব ছোটো তখন। বাবা-মা মিলে ঠিক করলেন সংস্কৃতে প্রাইভেটে এমএ পড়ে আবার সংস্কৃতের দিকেই যাবেন। মাকে দুজন পণ্ডিতমশাই পড়াতে আসতেন। টিকিধারী পণ্ডিত।
তারপরে মা তখন যাদবপুরে কম্প্যারেটিভ লিটারেচার পড়াচ্ছেন। বুদ্ধদেব বাবু (বসু) ওঁকে ডাকেন। কিছুদিন কাজ করে মার মন বসছিল না। মা আবার একটু পিওরিস্ট ছিলেন। উনি মনে করতেন, এতগুলো সাহিত্য একসঙ্গে পড়া যায় নাকি, পড়ানো যায় নাকি, ইত্যাদি। তারপর যখন সংস্কৃততে জায়গা খালি হল তখন মা যখন চলে গেলেন, তখন মার ভীষণ খারাপ লাগত। কাজেই, আমি যেটা বলতে চাইছি, মা কিন্তু টিপিক্যাল সংস্কৃতর জগৎ থেকে আসেননি, গোঁড়া জগৎ থেকেই হোক, বিবাহসূত্রেই হোক—নানারকম ছিল।
তুমি বলছিলে গ্রিক, ল্যাটিন—মা গ্রিক, ল্যাটিন জানতেন না। ওটা আমার বাবা জানতেন।
র : হ্যাঁ, কিন্তু তৈরিটা হয়েছিল।
ত : বাবার সঙ্গে কথা বলে বলে খুব আগ্রহ হয়েছিল। খুব আগ্রহ নিয়ে শেকসপিয়ার পড়তেন। কাজেই সেদিক থেকে নানাধরনের সাহিত্যচর্চা আমি দেখেছি—মা, বাবা, বন্ধুরা, বাবার ছাত্রছাত্রীরা খুব আসতেন, তার মধ্যে আমার স্বামী ইতিহাসের মানুষ, তিনিও আসতেন। কাজেই মার আলোচনার জগতটা শুধুই সংস্কৃতের ছিল না।
র : হ্যাঁ, আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, আমি জানি না কতটা প্রাসঙ্গিক, এই ধরনের ইংরেজি সাহিত্যের চর্চা করতে করতে সমান্তরাল ভাবে সংস্কৃত সাহিত্য এবং তার জগৎকে নিয়ে সমাজের আলোচনা বা মননশীল সংস্কৃত আলোচনা এটা একসময় জ্যোতি ভট্টাচার্য মহাশয় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে করেছেন। তিনি ইংরেজি সাহিত্যের মানুষ কিন্তু অসামান্য ভালো সংস্কৃত জানতেন... আমার মনে হয় ওই সময়টায় বোধ হয় ওইরকম একটা বৃত্ত ছিল। এই যে এই জগতটা একইসঙ্গে সাহিত্যের পাঠ, সংস্কৃতির পাঠ, সঙ্গে সমাজের পরিপ্রেক্ষিতটা মনে রেখে এবং কোন্টা সমাজের পক্ষে শ্রেয় বা প্রেয়, সেখানে তাঁদের রাজনৈতিক মতাদর্শ কাজ করত। এটা বোধ হয় ওই সময়কার চর্চার বৈশিষ্ট্য।
ত : আর ওই সময়কার মার্কসবাদেরও বৈশিষ্ট্য। কারণ তখন, (পি. সি.) যোশির আমলে যেরকম... বড়ো কালচারাল আপসার্জ হয়েছিল, সিপিআই থেকে ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রমেলা করা হয়েছিল, এগুলো তো বটেই। মা যখন যাদবপুরে পড়াতে এলেন, তখন মার প্রতি পদে ঠেকত। তখনই মার কাছে খুব শুনতাম যে সংস্কৃত বিভাগে আরএসএস-এর পণ্ডিতরা আছেন। কেউ কেউ অন্যরকম ছিলেন, মা তাঁদের কথা খুবই বলতেন, হেমন্ত গাঙ্গুলী মশাই একজন ছিলেন, সেইরকমই কেউ কেউ অন্যরম ছিলেন।
তুমি যেমন বলছ, অন্য একটা অনেক বড়ো জগত থেকে মা আসছেন সংস্কৃত পড়াতে। সংস্কৃত সাহিত্য মা অসম্ভব ভালোবাসতেন। এবং মার একটা ব্যাপার ছিল। মা তো যেমন গোঁড়া নাস্তিক ছিলেন, সেইরকমই উচ্চারণের ব্যাপারে তাঁর সাংঘাতিক গোঁড়ামি ছিল। ভুল সংস্কৃত উচ্চারণ মাকে ভীষণ পীড়া দিত। উচ্চারণের ব্যাপারে, হাতের লেখার ব্যাপারে মা ভীষণ গোঁড়া ছিলেন। মা আমাকে সংস্কৃত পড়াতেন। মা নাকি নিজেই যারা নতুন সংস্কৃত শিখছে তাদের পড়াবার একটা প্রক্রিয়া বার করেছিলেন। মা চাইতেন, যারা সংস্কৃত পড়বে না, অর্থাৎ যারা অন্য বিষয় থেকে আসছে, তাদের ক্ষেত্রে যদি মুখস্থ না করে সংস্কৃত পড়া যায়।
র : এইটা খুব জরুরি জিনিস যে আমরা সংস্কৃত বলতেই বুঝি শব্দরূপ, ধাতুরূপ, নানারকম প্রত্যয়—এর একটা যেন মুখস্থ বিদ্যা এবং আমরা চিরকাল দেখতাম, যেগুলোকে আর্ষ প্রয়োগ বলে, যেগুলো সাধারণ নিয়মে হয় না, সেইগুলোকেই মুখস্থ করে পরীক্ষার দিনে উগরে দেওয়া। এইটার থেকে সুকুমারীদি এই যে একটা ব্যতিক্রমে যাচ্ছেন, কারণ উনি বোধ হয় চাইতেন যে এই ভাষা এবং সাহিত্যটা কেবলমাত্র পণ্ডিত কয়েকজনের মধ্যে আবদ্ধ না থেকে এর রসাস্বাদন বহু জন করুক।
ত : হ্যাঁ, সাহিত্য হিসেবে, দর্শন হিসেবে। ধর্মশাস্ত্র তো তুমি জানই মা অপছন্দ করতেন ঘোরতর।
র : এইটা তোমার কাছ থেকে জানতে চাইছিলাম। তুমি একটু বলো, একটা সময়ে, যখন আমরা ভারতবর্ষে খানিকটা সমাজসচেতন বামপন্থার দৃষ্টি থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসচর্চা দেখছি, যেরকম (ডি. ডি.) কোশাম্বির হাতে, যেরকম রামশরণ শর্মার হাতে, কিংবা ডি. এন. ঝা-র হাতেও। এঁরা কেবলমাত্র ধর্মশাস্ত্রের বচন দিয়ে কিন্তু প্রাচীন ভারত বা সনাতন ভারতীয় সমাজকে কখনও বিচার করতেন না। সুকুমারীদির ইংরেজি-বাঙলা প্রবন্ধের বই আমি যা দেখেছি, তাতে ওনার যেমন ধর্মশাত্র নিয়ে তেমন মাথাব্যথা ছিল না, পুরাণ নিয়ে কি ছিল? এইটা তুমি যদি একটু বলো।
আর একটা বিষয় হল, পুরাণে নিশ্চয়ই একটা সমাজ সংস্কৃতির আধার আছে। কেন বৈদিক সাহিত্য থেকে সরে গিয়ে পুরাণ জনপ্রিয় হয়ে যাচ্ছে একটা পর্যায়ে তার একটা ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক পটভূমি আছে। কিন্তু এখন এই যে বেদ-পুরাণ সমীকরণ করে দেওয়া হয়, এই জায়গাটায় সুকুমারীদির কী ভাবনা ছিল?
ত : ঠিক এখনকার যেভাবে ইতিহাসে... আমি জানি না তুমি দেখেছ কি না, ইউজিসির নতুন সিলেবাস...
র : আমি জানি। আমি ইউজিসির তৈরি করা নতুন পাঠক্রমে যা দেখেছি, তা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। আমি এইটুকু বলতে পারি, যেসব অংশে বেদ, ধর্মশাস্ত্র সব একাকার করে দেওয়া হয়েছে এবং যেসমস্ত প্রশ্ন তোলা হয়েছে, যেসমস্ত বিষয় পড়ানো হচ্ছে, তাতে আমার মনে হয় সেই উনিশ শতকের গোড়াতে যখন প্রথম কোম্পানির তাগিদে ধর্মশাস্ত্রের অনুবাদ হাতড়াচ্ছে, সেই হাতড়ানোর চেহারাটাই যেন ফিরে এসেছে। মনে হয় না যে ঊনবিংশ শতকের মানসিকতার থেকে এখনও ইউজিসির লোকেরা কোথাও বেরিয়ে আসতে পেরেছে।
ত : ঊনবিংশ শতকে হাতড়ানো হত, এখন হাতড়ানো হয় না। এখন না জেনে বলা হয়। যাই হোক, মা পুরাণের গল্পগুলো বলতেন, জানতেন। পুরাণের যেটা ভাবাদর্শ, সেগুলো পছন্দ করতেন না একেবারেই। তখন একটা সুযোগ ছিল খুব নিষ্করুণ ভাবে পুরাণের সমালোচনা করার, যেরকম অনেক আগে আম্বেদকর করে গেছেন। কিন্তু আম্বেদকর তো কখনও আমাদের পাঠ্যক্রমে আসে না, কাজেই মা ওগুলো পড়েননি। আর রামায়ণ তো মার খারাপ লাগত খুব।
র : এইটা আমারও ওনার লেখা পড়ে মনে হয়েছে বার বার। এবং আমি ওনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত, আদি কাব্য হিসেবে তার নিশ্চয়ই সংস্কৃত ভাষার কাব্যগুণ আছে, কিন্তু কাহিনিটা এত একপেশে! মহাভারত যে কারণে সুকুমারীদি পড়তে এত ভালোবাসতেন—তার জটিলতা, তার নানা রঙের মিশ্রণ, সেখানে কেউ একরঙা চরিত্র নন—ভীষ্মও নন, যুধিষ্ঠিরও নন—কেউই নন। দ্রৌপদীর ক্ষেত্রেও নয়। এবং তাতে যেভাবে ব্রাহ্মণ্য হস্তক্ষেপটা পড়ছে, আজকে কিন্তু এই ব্রাহ্মণ্য হস্তক্ষেপ ধরেই ভারতবর্ষের ঐতিহ্যকে বিচার করা হয়। অন্তত আজকে দক্ষিণপন্থী যে ইতিহাস চর্চা বা ধারণা, সেটা একটা মারাত্মক জায়গায় চলে যাচ্ছে।
স্বয়ংসেবকদের সঙ্গে কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার। ১৯২০-র দশকে
ত : সে তো বটেই। এবং এই দক্ষিণপন্থা সম্পর্কে কিন্তু প্রথম মার কাছেই শুনি। আরএসএস, আরএসএস—তা তখন আর কে আরএসএস নিয়ে মাথা ঘামায়! আমরা তখন বলেছি, কী তোমার অবসেশন একটা আরএসএস নিয়ে! পরে যখন ১৯৯০ থেকে নানাদিকে আরএসএস নিয়ে কাজ করতে শুরু করলাম, তখন মনে হল, আরে, মা তো বলেছিলেন! তখনকার দিনে মা বলেছিলেন আরএসএস কী সাংঘাতিক ব্যাপার ইত্যাদি।
যাই হোক, তারপরে মা কিছুদিন, যখন পার্টি ব্যান্ড ছিল ফর্টি নাইনে, তখন ব্র্যাবোর্ন কলেজে মা সবে চাকরি নিয়েছেন, বাবারও সরকারি চাকরি। দুজনেই লুকিয়ে লুকিয়ে অনেক সাহায্য করতেন পার্টিকে। ইস্তাহার কপি করা, তখন কলেজের কয়েকজন মুসলমান বেয়ারা ছিলেন, তাঁরা সেগুলি বিলি করতেন মার কাছ থেকে নিয়ে। বাবার কাছে শুনিনি, কিন্তু কনক মুখোপাধ্যায় আমাকে পরে বলেছিলেন, বাবা ওনাকে ইংরেজি পড়াতেন গোপনে। অনেককে বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন, এইসব আর কী। পরে বোধ হয় যখন স্টালিনের সম্বন্ধে বেরোতে শুরু করল, তখন বাবা কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্কে অত্যন্ত বীতস্পৃহ হয়ে ওঠেন। তারপরে বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন পার্টির সঙ্গে বিশেষ কোনো সম্পর্ক রাখতেন না। যদিও আমার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে অত্যন্ত ভালো সম্পর্ক ছিল। আমার শ্বশুরমশাইকে (অধ্যাপক সুশোভন সরকার) তো বাবা-মা দুজনেই অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন, আমার ননদ শিপ্রা সরকার—এঁদের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক ছিল।
(বাঁ দিক থেকে) বি.টি. রণদিভে, গঙ্গাধর অধিকারী ও পি.সি. যোশি। ১৯৪৯। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর বৈঠকে
আমার মনে আছে, ছোটোবেলায় যখন বাবা ছাত্রদের সঙ্গে বা বন্ধুদের সঙ্গে বা ভাইদের সঙ্গে খুব উত্তপ্ত রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করছেন, মাকে বড়ো একটা যোগ দিতে দেখিনি। মার পরে হল, আর সেটা খানিকটা হল ওই যে ফর্টি নাইন, ফিফটি, ফিফটি সিক্স অবধি, স্টালিনের মৃত্যু অবধি। তারপরে মোটামুটি একটু সিপিআই-এর সঙ্গেই সংযোগটা ছিল। যদিও মার বন্ধু ছবি বসু, সুনীল বসু, ওঁরা সিপিআই(এম)-এ ছিলেন। তারপর বাবা মারা যাওয়ার অনেক দিন পরে যখন লেফট ফ্রন্ট পাওয়ারে আসে, খুশি হয়েছিলেন মা।
র : সাতাত্তর সালে, উনিশশো সাতাত্তরে।
প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিচ্ছেন জ্যোতি বসু। ১৯৭৭
ত : বোধ হয় আশির দশকের শেষের দিকে লেফট ফ্রন্ট বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার একটা প্রচেষ্টা করে। এবং লেফট ফ্রন্টের অনেকে তখন মার কাছে আসেন, মাকে বলতে বলতেন, মাকে সভায় নিয়ে যেতেন এবং যদি কোনো সরকার হয় তাহলে লেফট অর্থাৎ, বামপন্থী সরকারকেই মা অনুমোদন করবেন, এটা তো অবধারিত। তখন যার মধ্যে বামপন্থার ছিটেফোঁটা থাকত সবাই তাই করত। মা তখন কলকাতায় থাকতেন, আমরা দিল্লি চলে গেলাম। মা ধীরে ধীরে খুবই ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলেন পার্টির। এবং তখন সাধারণ পাঠকের জন্য বাংলায় লিখতে শুরু করলেন।
আমি একটু রাগ করতাম যে, তুমি আর ওই ভাবে গবেষণা করে লেখ না, তুমি সেটা ছেড়ে দিলে একেবারে। কিন্তু মা ওই পথটাই বেছে নিলেন—বাংলায় লিখব, সাধারণ পাঠকের জন্য লিখব। তারপরে খানিকটা ঝোঁক এল প্রাচীন ভারতে মেয়েদের অবস্থান নিয়ে লেখা। সেটার কারণ খানিকটা ওই আনন্দ পাবলিশার্স থেকে বইটি লিখতে বলেছিল।
র : খুব চমৎকার। আমি শুধু এইটুকু বলি, প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ছে, ওই বই যখন আনন্দ পুরস্কার পেল, ‘প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য’, সুকুমারীদির বই, সেই প্রথম আমি ওঁর লেখা পড়লাম। এর আগে বাংলায় উনি যে কাজটা করেছিলেন, সেটা শূদ্রকের মৃচ্ছকটিকমের অসামান্য ভালো বাংলা অনুবাদ।
ত : মার পছন্দ হত না মৃচ্ছকটিকমের অন্য বাংলা অনুবাদগুলো। মা এই কাজটা খেটে করেছিলেন।
র : বুঝতে পারা যায়, প্রাকৃতের উপর ওনার দখলটা কতটা ছিল। এবং এখানেও আমার বারবার মনে হয়েছে, এই যে এখন সারাক্ষণ ধুয়ো উঠেছে যে প্রাচীন ভারত বা সনাতন ভারতে সংস্কৃত ছাড়া কোনো অস্তিত্বই নেই অন্য কোনো ভাষার, এটা একটা সম্পূর্ণ দক্ষিণপন্থী, ভ্রান্ত, মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে, তাহলে নাটকগুলোর মধ্যে একমাত্র রাজা বা উচ্চপর্যায়ের মানুষ বাদে সবাই প্রাকৃত বলে কেন? এই যে অভিজ্ঞতাটা, উনি প্রাকৃতটা এত ভালো জানতেন এবং সেটা এত ঘরোয়া ভঙ্গিতে বাংলায় অনুবাদ করা! আমি জানি না, উনি পরে কি কখনও এরকম ধরনের অনুবাদকর্ম করেছিলেন?
ত : না, তারপরে মার আর ইচ্ছেও হয়নি।
র : শুনেছি অশীন দাশগুপ্ত মশাই ‘প্রাচীন ভারত: সমাজ ও সাহিত্য’ বইটার কথা বলতে গিয়ে বলেন যে, সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য নিয়ে এইরকম আমিষগন্ধী রচনা এর পূর্বে পড়িনি। অশীনদার পক্ষেই বলা সম্ভব এটা। ওই বই আমাদের কাছে চোখ খুলে দেয় নানা বিষয় সম্বন্ধে।
ত : ওই সময় মার উপরে আর-একটা প্রভাব পড়েছিল, যেটা মাকে খুব সাহায্য করেছিল। ‘সচেতনা’ বলে কলকাতায় একটি নারীবাদী সংগঠন হয়, যশোধরা বাগচী, মালিনী ভট্টাচার্য—এঁরা অনেকে মিলে গড়ে তোলেন। সেই সভায় যা আলোচনা হত, যা অভিজ্ঞতা হত, সেটাও মাকে খানিকটা নারীবাদ-সচেতন করে তোলে। যদিও মা অনেক অর্থে খুব যে নারীবাদী ছিলেন তা না। মার কতগুলো বিষয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বও ছিল নারীবাদ নিয়ে। আমার সঙ্গে অনেক তর্ক হত, কিন্তু ওইটা নিয়ে খুব সিস্টেমেটিকালি ভাবা এবং লেখা এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সংস্কৃত সাহিত্য পুনর্বিচার করা, যেটা তিনি আগে করেননি, সেইটা শুরু হল।
র : ওনার অনেকগুলি প্রবন্ধ আমার অন্ত্যন্ত জরুরি মনে হয়েছিল। তার মধ্যে গণিকা নিয়ে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন বাংলায়, ইংরেজিতে বসুমতী প্রকাশন থেকে বেরোল যখন, তাতেও লিখেছেন। এটা শুধু পাণ্ডিত্য দিয়ে আসেনি, একটা গভীর সহানুভূতি একটি মহিলার জীবন সম্বন্ধে, যাকে এই বৃত্তিটা নিতে হল। উনি বারবার দেখাচ্ছেন কুলবধূ অনেকটাই পারিবারিক আধিপত্যের অধীনে থাকে, গণিকার স্বাতন্ত্র্য সেখানে অনেক বেশি, গণিকা সাক্ষর। গণিকার নিজস্ব পছন্দ অপছন্দ আছে এবং গণিকাকে নিশ্চয়ই ভোগ্য হিসেবেই পুরুষের চোখে দেখা হচ্ছে, কিন্তু কেবলমাত্র শারীরিক আবেদনের কারণেই তার পরিচিতি না। সে নানা বিদ্যায় সে দক্ষ, যে বিদ্যা কিন্তু কখনও কুলবধূকে দেওয়া হয়ই না। এবং সুকুমারীদি একটা খুব জরুরি কথা লিখেছিলেন, যে এই সমাজব্যবস্থা, যাকে সারাক্ষণই আমাদের সনাতন সমাজের গৌরব বলা হচ্ছে, তা এমনই পুরুষতান্ত্রিক, যেখানে একজন পুরুষকে কিন্তু দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, তার যদি মানসিক, সাংস্কৃতিক রুচিগত নানারকম সান্নিধ্যের দরকার হয়, সেটা কিন্তু কুলবধূর কাছে সে পাবে না, তার জন্য একটা অন্য খিড়কির দরজা সমাজই দেখিয়ে দেয়। এই তো হচ্ছে ব্রাহ্মণ্য সমাজের চরিত্র! এটা সুকুমারীদির উন্মোচন আমার কাছে খুব জরুরি মনে হয়েছিল। এর মধ্যে হয়তো একটা রাজনৈতিক প্রেক্ষিতও আছে।
ত : মা একবার দিল্লিতে এসেছেন, তখন আমাদের বন্ধু মঞ্জরী দিংওয়ানে এবং জয়তী গুপ্ত, দুজনেই সিপিআই(এম)-এর, তো তার আগে ওরা দুজন আমাকে, উমা চক্রবর্তীকে আর সেলিম কিদোয়াইকে দিয়ে একটা বই লিখিয়েছিল, উৎসা পট্টনায়ক তার ভূমিকা লিখেছিলেন, ক্রীতদাসত্ব নিয়ে। তারপরে ওদের মাথায় এসেছিল যে গণিকাবৃত্তি নিয়ে একটা বই করবে। মাকে দিয়ে, প্রাচীন গণিকাবৃত্তি নিয়ে। এবং মা তখন লেখাটা লিখেছিলেন খুব খেটে, তাতে নানা ক্যাটেগরির গণিকার উল্লেখ করেছিলেন।
র : খুবই জরুরি লেখা। এবং একই সঙ্গে লিখছেন, কীভাবে ধর্মশাস্ত্রে নারী আর শূদ্রের অবস্থান প্রায় একই জায়গায় ছিল। এখন নানা সময় শুনি প্রাচীনকালে, বিশেষত ইসলাম আসার আগে, নাকি নারীর মর্যাদা বিরাট উচ্চে ছিল। এর মতো ভ্রান্ত কথা প্রায় কিছু হয় না। এমনকি সুকুমারীদি এটাও পরিষ্কার করে বলেছিলেন, সম্ভবত কোনো বাঙলা লেখাতে, যে ভারতীয় সমাজে মায়ের মর্যাদা নিশ্চয়ই দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কার মা? পুত্রের মাতা না কন্যার মাতা? ধর্মশাস্ত্র কী বলে? এই যে প্রশ্নগুলো তোলা বারবার করে—সুকুমারীদির সব কথা সবাই মানবেন কেউ আশাও করে না, কারণ উনি তো কাউকে মানাবার জন্য কথাগুলো বলছিলেন না, লোককে ভাবতে বলছিলেন। যদি তর্ক করে দেখা যায় যে এর কোনো বিকল্প অবস্থান আছে কি না। উনি কিন্তু শুনতেন। আমি এইটুকু বলছি, আমি ওঁকে খুব ঘনিষ্ঠ ভাবে আলোচনা করতে দেখেছি আমার মাস্টারমশাই ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মশায়ের সঙ্গে, যিনি সেই অর্থে একেবারেই মার্কসবাদী নন এবং খানিকটা আমরা যাকে সাবেকপন্থী বলে থাকি আর কী। ব্রতীন বাবুর পড়াশোনার বিস্তার বিশাল ছিল, তুমি জান। কিন্তু এই যে নানা বিষয় যখন উনি ব্রতীন বাবুর সঙ্গে আলোচনা করছেন, ব্রতীন বাবু প্রাকৃতের আলোচনা করছেন, ভাষা নিয়ে আলোচনা করছেন, সংস্কৃত পাঠ নিয়ে আলোচনা করছেন, বিশেষ করে ব্রতীন বাবুর নিজস্ব জগৎ যেটা, কুষাণদের সময়কার লেখ, মুদ্রা এই নিয়ে আলোচনা করছেন, তখন কিন্তু সুকুমারীদি ব্রতীন বাবুর কথাগুলো অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। তিনি কিন্তু ব্রতীন বাবুর থেকে মার্কসবাদের কোনো অনুসন্ধান বা ওইরকম ব্যাখ্যা পাবেন না। এই যে নিজের মার্কসবাদে অটল থেকেও, সমাজসচেতন অবস্থান থেকেও, তিনি অন্য বহুরকমের ধারণাকে একজায়গায় নিতে পারতেন। এই উদারতাটা আমার চোখে ধরা পড়েছে। আমি জানি না পরের দিকে, বিশেষ করে যখন উনি সিপিআই(এম)-এর হয়ে অনেক ধরনের কাজ করেছেন, তখন কি ওঁর অবস্থান সেই অর্থে আর-একটু গোঁড়া হয়েছিল?
ত : না, না, না। মার দুটো আলাদা দিক ছিল। মা সেইভাবে যে মার্কসবাদ খুব সাংঘাতিক চর্চা করেছেন, তা নয়। সমাজব্যবস্থা সম্বন্ধে মার খুব সমালোচনা ছিল। এবং ধনসম্পদের বণ্টন নিয়ে গভীর প্রশ্ন ছিল। কিন্তু কোন্টা সঠিক মার্কসবাদ, আসলে মার্কসকোথায় কী বলেছেন, এই নিয়ে মার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। এবং আমি তো সচেতন ভাবে মাকে কখনও মার্কসবাদ পড়তে দেখিনি। তত্ত্ব ব্যাপারটা মাকে যে খুব আকৃষ্ট করত তা না। মা অনেকটা বেশি সমাজে কী ঘটছে, সাহিত্যে তার কী প্রতিফলন পড়ছে, এইগুলো ভালো করে বোঝবার চেষ্টা করতেন।
র : আমার তো ধারণা উনি বোধ হয় পথসভাও করেছেন একটা সময়ে।
ত : হ্যাঁ, হ্যাঁ। পথসভাও করেছেন।
র : আমার এইটুকু মনে আছে, উনি আমাকে বলেছিলেন, ১৯৯০-এ, বাবরি মসজিদ ধ্বংস হওয়ার আগে যখন করসেবা চলছে, ওই করসেবার একটা অঙ্গ ছিল ইট নিয়ে আসা, যাকে রামশিলা বলা হত। সুকুমারীদি কোনো একটা সভায় বলেছিলেন, কোনো মানে আছে, এতগুলো ইট তৈরি করে নিয়ে এসে একটা প্রতীকী মন্দির তৈরি করার? কেন এরকম ধরনের কাজ করা হচ্ছে? তখন এক ব্যক্তি বললেন, এগুলো তো রামশিলা, আপনি ইট বলছেন কেন? সুকুমারীদি সপাটে জবাব দিয়েছিলেন, আপনি ইটকে শিলা বলছেন কেন? যে ব্যক্তি প্রশ্ন তুলছেন, তাঁর কাছে ধরাই পড়ছে না যে শিলা বলতে কী বোঝায়! যিনি প্রশ্নটা করেন তিনি বসে পড়তে বাধ্য হন। এটা তো একদম সাধারণ জ্ঞানের কথা, ইটকে শিলা বলছেন কেন।
ত : ওইরকম পরিপ্রেক্ষিতেই রামায়ণের রাম, বাল্মীকির রাম, ফিরে দেখা লিখেছিলেন। আমি একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি তখন জিজ্ঞেস করছিলে মার উপর প্রভাব বা কীভাবে মানুষ হয়েছিলেন—ওটা একটা খুব জরুরি কথা। কেন মা একটা বাইরের জগতের মধ্যে সংস্কৃতকে দেখতেন, তাকে ঠেলে রেখে সংস্কৃতকে দেখতেন না, এর একটা খুব বড়ো কারণ হচ্ছেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মার অধ্যাপক ছিলেন ইউনিভার্সিটিতে। মা খুব প্রভাবিত হন ওঁর পড়ানোয়। তার পরে যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু একষট্টি সালে আমরা যখন কেয়াতলার বাড়িতে উঠে আসি, তখন মা খুব সানন্দে আবিষ্কার করলেন যে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় আমাদের দুটো গলি পরেই থাকেন। ভীষণ যাতায়াত শুরু হল।
সুনীতিবাবু খুব স্নেহপরায়ণ লোক ছিলেন। এমন বোধ হয় দিন ছিল না যে মা একবার করে গিয়ে না ঢুঁ মারছেন, যত অল্প সময়ের জন্যই হোক। আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাওয়ার পর নিয়ে যেতেন আমাকে। তারপরে বিয়ের পরে সুমিতকে (সরকার) নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার বাবার দাহকার্যের সময় সুনীতিবাবু আগাগোড়া ছিলেন। মেমোরিয়াল মিটিং-এ ছিলেন। এই যে সুনীতিবাবু, শুধু যে ওঁর জ্ঞানের ভাণ্ডার অসামান্য ছিল, তা নয়। উনি আবার বেড়াতে খুব ভালোবাসতেন, দেশবিদেশ ঘুরতে ভীষণ ভালোবাসতেন, সেই গল্প করতে ভীষণ ভালোবাসতেন, লিখতে খুব ভালোবাসতেন। সেখানকার সাজগোজ নিয়ে বলতেন...
র : সেই সঙ্গে খাদ্যরসিক।
ত : সুতরাং, ওঁর সঙ্গে মা যতবার গল্প করতেন, ততবার একটা নতুন দেশ, নতুন পরিবেশের সঙ্গে পরিচয় হত।
র : সুনীতিবাবু কিন্তু সেই অর্থে বামপন্থার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নন।
ত : একেবারেই নন। সুনীতিবাবুর সঙ্গে মার যে মতাদর্শগত ভাবে খুব যে মিল ছিল তা না। মার এই গুণটা ছিল যে যার কাছ থেকে যা পাওয়া যায়—মা খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতেন, উনি যা বলতেন, উনি যা দেখেন, উনি যা বুঝেছেন। সেটাতে মায়ের খুব আগ্রহ ছিল। সেসময় সুনীতিবাবু জীবিত এবং মার সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, বা বিদেশি পণ্ডিত যাঁরা, যেমন (এ. এল.) ব্যাসম, চিনতেন ওঁকে, তাঁরাও কিন্তু মার্কসবাদী ছিলেন না।...
১৯৬৬-৬৭ ওই একবছর আমাকে কলেজে ড্রপ দিতে হয়। মা-বাবা কেমব্রিজে ছিলেন একবছর ফেলোশিপে। তো এইসময় মার একটা খুব উপকার হয়, কারণ ক্লেয়ার হলে ছিলেন, নানা সাবজেক্টের লোক, যেমন, ধর্মাকুমার, ওঁর সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয়। যশোধরা বাগচী-অমিয় বাগচী তো বাবার খুবই প্রিয় ছাত্র, এবং ওঁরা বাবাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন। যাই হোক, ওখানে গিয়ে একটা বিশাল জগত খুলে গেল। মা-বাবার খুব ভালো লেগেছিল লাইব্রেরিতে কাজ করতে। ওখানে মা সংস্কৃত পড়াতেন এবং যাদের সংস্কৃত পড়াতেন, সেইসব ছাত্ররা সংস্কৃতের অ-আ-ক-খ-ও জানতেন না। মা তাদের নিজস্ব পদ্ধতিতে পড়াতেন। পরে ২০১০-এ গিয়ে আমি মার অনুরোধে মার দু-একজন ছাত্রকে খুঁজে বার করি। তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেছিল, আচ্ছা, তোমার মা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন, সাহিত্য পড়াতেন, ওঁর আমাদের পড়াতে খারাপ লাগত না, একেবারে অ-আ-ক-খ থেকে তৈরি করা? পরে এসে আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম। মা বললেন, না, কারণ যারা কিচ্ছু জানে না, তাদের একেবারে আমি নিজের প্রণালীতে সংস্কৃত শেখাচ্ছি। তাদের কোনো পটভূমিকা নেই সংস্কৃতের।
র : এই জায়গাটায় যদি একটু আলোকপাত করতে পারো যে সুকুমারীদি কীভাবে এইটা শেখাতেন?
ত : মা আবার উপক্রমণিকাটা একেবারে পছন্দ করতেন না, মা একেবারে ব্যাকরণ কৌমুদী। আমাকে পড়িয়েছেন তো। আমাদের তো সংস্কৃত কম্পালসারি ছিল। আমি মাকে প্রচণ্ড ভয় পেতাম শিক্ষক হিসেবে। মা খুব কড়া শিক্ষক ছিলেন। কিন্তু আমাকে দিয়ে ওই কারক বিভক্তি, ওগুলো যে খুব করাতেন তা না, কিন্তু আমাকে দিয়ে প্রতিদিন ডায়ারি লেখাতেন একপাতা, সেটা আমার কাছে একটা টর্চার মনে হত।
র : সংস্কৃততে?
ত : হ্যাঁ। চোখে জল এসে যেত লিখতে। আমার পরিচয়টা খুব সিমপ্লিফাই করে আমি লিখতাম, যে ক-টা শব্দ আমি জানি, সে ক-টা দিয়ে। তারপরে যারা পরিণত বয়সের ছাত্র প্রথম সংস্কৃত শিখতে আসছে, তাদের,আমার এটাও মনে আছে, মা ব্যাকরণ শেখাতেন মাঝে মাঝে কিছু ছড়া বলে। প্রপরাপসম..., মা বলতেন ওইগুলো মুখস্থ করার চেয়ে এই কবিতাটা মুখস্থ করা তোমার সহজ হবে।
আবার মার খুব প্রিয় ছিল ‘উদ্ভট কাব্য’—বোধ হয় সতেরো-আঠেরো শতকে মজার মজার কিছু স্যাটায়ারিকাল ছড়া বানানো হয়েছিল সংস্কৃতে। ওগুলো মা খুব বলতেন। খুব মজার। আমাকে ওই বইটা আনিয়ে দিয়েছিলেন।
র : ওই ‘উদ্ভট কাব্য’?
ত : হ্যাঁ, উদ্ভট কাব্য। খুব দুষ্প্রাপ্য গ্রন্থ। কীভাবে যে মা সংস্কৃত পড়াতেন, আমি নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বা খানিকটা ছাত্রদের। এই উদ্ভট কাব্য কখনও এনে, কখনও অন্য ছড়া বলে, কখনও মজার গল্প বলে। মা আমাকে সংস্কৃত যখন পড়াতেন, হিতোপদেশের গল্পগুলো পড়াতেন। একটু কালিদাসও পড়াতেন।
র : কখনো-কখনো সুকুমারীদির সঙ্গে আলোচনা করলে মনে হত সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের কথা যখন বলছেন, দর্শনের চর্চাও বটে, এই যে একটা ধারণা আছে—সংস্কৃত মানে হচ্ছে প্রাচীন ভারতের একেবারে গৌরবের সময় সংস্কৃত ভাষা তুঙ্গে উঠল, তারপরে তথাকথিত ইসলামের আগমনে মধ্যযুগের অন্ধকার, তাতে সংস্কৃত ডুবে গেল, এর থেকে ভুল কথা কিছু হয় না। সুকুমারীদি অসংখ্য বার বলেছিলেন, এমনকি ধর্মশাস্ত্রের টীকাগুলি তো সবই তথাকথিত মধ্যযুগের রচনা। উনি প্রসঙ্গক্রমে বলেছিলেন, চৈতন্যদেবের যে ন্যায়ের পাণ্ডিত্য, সেটা কোন্ যুগে হয়েছে? এই যে ন্যায়শাস্ত্রের আলোচনা চলছে, এমনকি বেদান্ত দর্শন নিয়ে পরবর্তী কালে যে আলোচনাগুলো হয়েছে, এবং যেভাবে পূর্বপক্ষকে কেটে উত্তরপক্ষের বয়ানটা হচ্ছে, এই সংস্কৃত চর্চার বিরতিটা কখন হল, ভারতবর্ষের তথাকথিত মধ্যযুগে? এগুলো একেবারেই মানা যায় না। এখন একটা সম্পূর্ণ ভুল কথা বাজারে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, একটা মিথ্যে কথা বলা হচ্ছে—প্রাচীন ভারতে গৌরব এল আর মধ্যযুগের থেকে একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল। যে কারণে আমার নিজের বাংলা রেনেসাঁস কথাটায় ঘোর আপত্তি আছে। রেনেসাঁস বললে একটা অন্ধকার মধ্যযুগ বলতে হয়। আমার কখনও সেটা মনে হয় না। সুকুমারীদিও কখনও রেনেসাঁস বা নবজাগরণ নিয়ে খুব আলোড়িত ছিলেন বলে তো আমার মনে হয় না। জানি না। তোমাদের কাছে কি কখনও বলতেন?
ত : না, রামমোহন, বিদ্যাসাগর—এঁদের খুব শ্রদ্ধা করতেন, এবং শেষের দিকে আমি যখন সতী নিয়ে কাজ করতাম, ঊনবিংশ শতকের সতীপ্রথা নিয়ে কাজ করছি তখন মাকে বলতাম— জান, একটা অদ্ভুত জিনিস দেখলাম, আর্কাইভে নিদর্শন রয়েছে, কোনো কোনো জায়গায় হয়তো বউ নেই, সেখানে বোনকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। মা খুব সচকিত হয়ে বলতেন, সে কী রে! মেয়ে দেখলেই পুড়িয়ে দিত বল! তার মানে পোড়ানোর জন্য হাত নিশপিশ করত!
র : সুকুমারীদি যখন মহাভারত নিয়ে বাংলায় লিখছেন, ওঁর একটা গল্প খুব পছন্দের ছিল। সেটা দু-তিনবার লিখেওছেন। কিন্তু আমার যতদূর মনে পড়ছে, সেটা ঠিক মহাভারতের ভার্গবায়ন, বা অনুশাসন পর্ব, শান্তি পর্বের বচন নয়। এমনকি ভগবদ্গীতার বচনও নয়। উনি বলতেন এমন কিছু—যে শব্দটা উনি ব্যবহার করতেন—স্বধর্ম নয়, সামান্যধর্ম—যেগুলো ধর্মীয় গোষ্ঠীর বেড়াকে ডিঙিয়ে যায় এমন কিছু মানবিক গুণ। এই প্রসঙ্গে উনি একটা গল্প বলেছিলেন। রাক্ষস-বহুল এক অরণ্যে কূপের মধ্যে এক ব্রাহ্মণ হঠাৎ পড়ে যান। মাথা নীচে, দুই পা উপরে--এই অবস্থায় তিনি ঝুলছিলেন কূপের গায়ে একটি লতাকে আঁকড়ে ধরে। কূপের ঠিক বাইরে এক বিশাল হাতি দৃশ্যমান, কূপের নীচে এক বিষধর সাপ। যে লতা ধরে কোনোক্রমে ওই ব্যক্তি ঝুলে আছেন, তার শিকড় কেটে চলেছে কয়েকটি ইঁদুর। লতায় যে ফুল ফুটেছে, তা থেকে মধু আহরণের জন্যে মৌমাছিরা ব্যস্ত। মৌমাছিদের সংগৃহীত মধুর কয়েক ফোঁটা মাঝে মাঝে সেই হেঁটমুণ্ড ঊর্ধ্বপদ মানুষটির মুখে কখনো-কখনো পড়ছে। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সেই ব্যক্তি মধুপানের আনন্দ পাচ্ছেন। সুকুমারীদি-র কাছে এটি ছিল প্রাচীন ভারতে জীবনমুখিনতার, জীবনকে ভালবাসার এক মহৎ উচ্চারণ। কেবল পারত্রিক মুক্তির সন্ধানই যে প্রাচীন ভারতীয় জীবনাদর্শ নয়, তার সমর্থনে তিনি মহাভারতের স্ত্রীপর্বের এই আখ্যানটি বলতে ভালোবাসতেন।
ত : হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওটা মার খুব প্রিয় গল্প।
র : অসাধারণ! এবং ওঁর মুখে এটা শোনা, জীবনবোধে উদ্দীপিত একজন মানুষ ঘোর বিপদে মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও সে কিন্তু জীবন থেকে বিমুখ হচ্ছে না। রামায়ণ-মহাভারতের চেহারাটা যে বীরগাথামূলক কাব্যের থেকে প্রায় শাস্ত্রের চেহারা নিল, যা শুনলে পুণ্য হয়—এই দুই মহাকাব্যের শাস্ত্রীয় চেহারা নেওয়াটা সুকুমারীদিকে খুব একটা আবেদন করত না বলে আমার ধারণা, উনি তার মানবিক চরিত্র নিয়ে অনেক বেশি উৎসাহিত ছিলেন।
যেটা বারবার মনে হয়, এখন সুকুমারীদির মতো মানুষকে বড্ড দরকার ছিল। কারণ উনি অনেকগুলো প্রশ্ন তুলতেন। প্রশ্নের জবাব যে আমরা সবসময় মনমতো দেব, তার কোনো মানে নেই। কিন্তু প্রশ্নগুলো তোলা খুব জরুরি। এখন তো লোকে প্রশ্ন করছে না।
ত : মার মতন লোকের থাকা দরকার ছিল, কারণ এখনকার দিনে যারা প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য, সংস্কৃতি, সমাজ নিয়ে বলেন, তাঁরা অনেকেই কিচ্ছু জানেন না।
র : মূল কিছুই পড়েননি।
এবার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। ওঁকে আমি দেখেছি অসম্ভব অতিথিপরায়ণ। আমার তো মনে হয় না, যে-কেউ বাড়িতে দেখা করতে গেছেন, শুধু মুখে কেউ বেরিয়ে এসেছেন। ওই অসুস্থ অবস্থায়ও নিজে গিয়ে টুকটুক করে এটা তুমি খাও, চা খেয়ে যাবে, মিষ্টি খাবে—এইসব একদম বাঁধা।
ত : মার কাছে বাড়িতে যিনিই থাকতেন, তাঁকেও এগুলো শিখিয়ে দিতেন খুব ভালো করে। আমার ছোটোবেলা থেকেই দেখছি, মার মনে হত সময়ের অপচয় করা এবং সময়ের অপচয় করা মানে আমি যে সময় পড়াশোনা করছি না, সেইটা মা একদম করতে চাইতেন না।
র : বুঝতে পারছি। ওঁর কাছে বিষয়টা হচ্ছে সময় যেন নষ্ট না হয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজগুলো করে ফেলতে হবে। আসলে কাজটাও তো ওঁর কাছে কমিটমেন্ট, সমাজের কাছে কমিটমেন্ট, মানুষের কাছে কমিটমেন্ট।
ত : আসলে কী বল তো, মা দরিদ্র পরিবারে মানুষ হয়েছিলেন। মা-রা চার ভাইবোন ছিলেন। মার বিশেষ মেধা দেখে খুব খারাপ অবস্থার মধ্যেও আমার দাদামশাই অবস্থার অতিরিক্ত খরচ করে মার জন্য সব সাবজেক্টে টিউটর রাখতেন। মার একটা দায়বদ্ধতা ছিল— ওই সময় খুব কম মেয়ে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েছে। তারপরে আমার পরিবারে এত কিছু স্যাক্রিফাইস করে আমায় পড়ানো হচ্ছে, আমার যতদূর সাধ্য সমাজকে আমি দেব। একবার আমাকে বলেছিলেন শেষবয়সে, ফাঁকি তো কখনও দিইনি, কীরকম কাজ করেছি জানি না। কিন্তু ফাঁকি দিইনি।
র : এই যে দায়বদ্ধতার কথা তুমি বললে, এই দায়বদ্ধতা শুধু বিদ্যাচর্চার ক্ষেত্রে নয়, গোটা জীবনযাপনেই সমাজের প্রতি একটা দায়বদ্ধতা, অনেক লোকের কীসে মঙ্গল হয়, এই বোধটা বোধ হয় বারবার ওঁর লেখায় আসে।
ত : মার যাঁরা বন্ধুবান্ধবী ছিলেন সেইসময়ে, সেই প্রজন্মের আমি যাঁদের দেখেছি, বাণী ভট্টাচার্য, যাঁর কাছে আমার ইতিহাসে হাতেখড়ি, তারপর ছবি বসু, রেবা রায় বলে একজন ছিলেন, পরবর্তী জীবনে অনেক ছোটো ওঁর থেকে কৃষ্ণা দত্ত—এঁদের সকলেরই এটা আমি দেখেছি। এই যে সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা, সকলেই যে এঁরা, যাঁদের নাম করলাম, রেবা রায় না, বাকিরা বামপন্থা ঘেঁষাই ছিলেন। কিন্তু এটা হয়তো সেইসময়কার ন্যাশনালিজম থেকেও হতে পারে, প্রত্যেকেই দেশের জন্যও কিছু করতে চাইতেন। মাও ওই দেশের কাজের কথা খুব বলতেন।
র : হ্যাঁ। কিন্তু আজকে যে ন্যাশনালিজমের কথা শুনছি, সেই ন্যাশনালিজমের কথা শুনলে সুকুমারীদি বোধ হয় আঁতকে উঠতেন। ক্লিশের অধম হয়ে গেছে, এই ইউনিটি ইন ডাইভারসিটির কথা যে বলা, তাতে ডাইভারসিটি গোল্লায় গেছে, ইউনিটি নিয়েই সারাক্ষণ চেঁচামেচি হচ্ছে।
ত : মা এইটা দেখে যাননি। মা যেটা দেখেছেন, সেটার কোথায় আসছি। তার আগে বলি, ওই যে দায়বদ্ধতার কথা বলছিলাম, একেবারেই শেষ জীবনে, যখন চোখ আর কাজ করে না, তখন আমি যদি একদিনের জন্যও কলকাতা যেতাম, মা বলতেন, সকালটা আমি একটু কাজ করে নিই রে, কিছু মনে করিস না, সকালের পর আর আমি চোখে ভালো দেখতে পাই না।
আমার একটু মাঝে মাঝে অভিমান হত, আমি একদিনের জন্য এসেছি, আর তুমি সকালটা আমাকে দিচ্ছ না! খুব করুণ স্বরে বলতেন, আমি এখন আর কাজ করতে পারি না। এখন আমার সেই জিনিসটা হয়েছে। আমার মাথা কাজ করে না সকালের পরে।
র : সর্বনাশ! তুমি যদি এই কথা বল! তোমার লেখা অগুনতি গ্রন্থ কিন্তু তার একেবারে বিপরীত সাক্ষ্য দিচ্ছে।
ত : নানা, না। মার আর-একটা ব্যাপার ছিল। লীলা মজুমদারের ভাষায় সকালটা হচ্ছে মেয়েদের পক্ষে সংসারের চাকায় তেল দেওয়ার সময়। মনে পড়ে ছোটোবেলায়, সকালবেলায় মাকে বারবার ডাকতে হত। এখন আমারও সেটা হয়। মার কাছে যিনিই কাজ করতেন, সকালবেলায় বেলায় বারবার বলতেন— মা, ধোপা এসেছে। মা, কী সবজি নেব? এখনকার দিনে হলে টাকা নিয়ে বসতে হত, তখনকার দিনে মা এক পুঁটলি খুচরো পয়সা নিয়ে বসতেন, যাতে বারবার উঠে যেতে না হয়। কী যে বিরক্ত হতেন বারবার উঠতে! এখন আমি এটা বুঝতে পারি, সময়টা নষ্ট হত।
শেষের দিকে আর পারতেন না। একবার আমি ভেবেছিলাম, ছবি তুলে রাখব। একেবারে টেবিলে মাথা ঠেকে গেছে, পড়তে পারছেন না। সেইখানে অমনি করে বসে পড়ে যাচ্ছেন। চোখেও আর খুব বেশি দেখতে পেতেন না। লিখতেও পারতেন না। মা আবার হাতের লেখা নিয়ে আমাকে যে কী কষ্ট দিয়েছেন না! প্রতিটা লেখা যে কতবার করে লেখাতেন! একটা কিছু লিখলাম, মা বলতেন, আবার লিখে আনো।
র: মানে হাতের লেখা পছন্দ হচ্ছে না।
ত : ওই রাবীন্দ্রিক একটা ধারণা ছিল, হাতের লেখা খুব সুন্দর হতে হবে, সেই মায়ের হাতের লেখা একেবারে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হয়ে গেল।
র : এইটা অবশ্য আমাদের ছোটোবেলায় ছিল। হাতের লেখা সুন্দর করার চেষ্টা। আমার প্রাণের বন্ধু শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, এইটা নাকি কমলকুমার মজুমদারের ভাষায় হরফাশ্রিত সৌন্দর্য।
ত : বাংলার হরফটা বড়ো সুন্দর।
আর মার একটা বিষয় ছিল। এখন শুনলে অনেকে হয়তো রেগে যাবেন। ওই নদিয়া-কৃষ্ণনগরের ভাষা ছাড়া মার একদম পছন্দ হত না। যেমন, সাথে নয়, সঙ্গে বলতে হবে।
একটা কথা বলি। মার সঙ্গে আমার যখন শেষ কথা হয়, আমি তখন জানতাম না যে মা চলে যাবেন। আমার জানা উচিত ছিল, মা অনেক বয়সে গেছেন। আমি তখন জার্মানিতে পড়াচ্ছি। তখন ২০১৪ সালের ইলেকশন, মোদী জিতলেন। মার সঙ্গে আমার শেষ কথা সেই প্রসঙ্গে। তারপরেই মা এত অসুস্থ হয়ে পড়লেন, মারাও গেলেন হঠাৎ। আমি যাওয়ার সময়ও পেলাম না। শেষ কথা হচ্ছে, মা ঝরঝর করে কাঁদছেন, আমি তখন সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছি—ইলেকশনে ওঠাপড়া তো আছেই তুমি এত ভাবছ কেন? পরের বারে অন্যরকম হবে। মা বললেন, না রে, এটা হবে না, আমি আমার দেশে স্বাধীনতা আসতে দেখেছি, ফ্যাসিবাদ আসছে আর আমি দেখতে চাই না। আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না।
২০ মে, ২০১৪। সংসদে প্রথম নির্বাচিত হয়ে সংসদভবনে প্রবেশের সময় সহসা সিঁড়িতে মাথা ঠোকেন নরেন্দ্র মোদী
র : আসলে সুকুমারীদি বোধ হয় যেটা বলতে চাইছিলেন, ভোটবক্সের বদল অনেক সময় হবে, সেটাই প্রত্যাশিত। কিন্তু মানুষের মনে এখন যেধরনের ঘৃণার বিষ এবং বিদ্বেষের বীজটা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে গত তিরিশ বছর ধরে, হয়তো প্রায় অলক্ষ্যে, এখন তো এটা মন্ত্র জপার মতো হয়েছে। এই বিপদটা হয়তো উনি আগাম আঁচ করতে পেরেছিলেন। এখন এইটা খুব মারাত্মক পর্যায়ে।
ত : মাকে নিয়ে দেখছি অনেক লেখালিখি হচ্ছে। মার এই দিকটা কেউ বলতে চান না। বরং উলটোটাই বলেন—মা বেদপাঠ করতেন সকালে উঠে, মা পরজন্মে বিশ্বাস করতেন। আমার তখন মনে হয় এ কার কথা বলছে?!
র : না না, সেটা তো তাঁর লেখা পড়লেই বুঝতে পারা যায়। আজকে বেদের সংশয়, এই যখন আলোচনা করছেন এবং নাসাদীয় সূক্তের আলোচনা যখন করছেন, সেটা সত্যিই পড়লে মনে হয়, পৃথিবীতে এমন কোন্ মানুষ আছে যে নাসাদীয় সূক্তের ওই বিস্ময় এবং অনিশ্চয়তাকে প্রত্যেক দিন বহন না করছে? অনিশ্চয়তা এবং সংশয় তো মানুষের ধর্ম। এই যে বেদে ক্ষুধা—যেখানে ঋগ্বেদের বামদেব নামে এক ঋষি, তিনি ক্ষুধায় কাতর। কিছু খেতে পাচ্ছেন না, কুকুরের নাড়িভুঁড়ি খেয়েছেন রান্না করে। এবং স্ত্রীকে রক্ষা করতে পারেননি, একথাও বলছেন। আমার ধারণা এই গল্পটাই পরবর্তীকালে মহাভারতের মধ্যে বিশ্বামিত্রের যে চণ্ডালের বাড়ি থেকে কুকুরের জঘন চুরি করে খাওয়ার গল্পটা আর-একটু পল্লবিত হয়ে ঢুকেছে। এর মূলটা ছিল ঋগ্বেদে। এটা সুকুমারীদি আমাকে প্রথম জানান দিচ্ছেন।
এবং সেখানে সুকুমারীদি যে গল্পটা আমাদের বারবার বলতেন যে ঠিক আছে, আপদ ধর্মে বিশ্বামিত্র না হয় চুরি করেই খেলেন। সেই চুরিটাও শেষ পর্যন্ত চণ্ডাল গৃহ থেকেই করতে হল! একজন ব্রাহ্মণ কি আর কারও কাছ থেকে চুরি করতে পারল না! বা, যেটা বলেছিলেন, জতুগৃহ থেকে কুন্তী সহ পঞ্চপাণ্ডব রক্ষা পেলেন, সেখানে বিদুরের মন্ত্রণা, আগাম খবর দেওয়া। কিন্তু সুকুমারীদির বাঙলা লেখাতে বেরিয়ে এসেছিল যে প্রাণ দিতে হল সেই নিষাদী মহিলা এবং তাঁর পাঁচ নিষাদ পুত্রকে! লোকে নিশ্বাস ফেলে বাঁচল, পঞ্চপাণ্ডব ও কুন্তী রক্ষা পেলেন। কিন্তু কারা মরল? তাদেরকে তো সচেতন ভাবেই ওখানে রাখা হয়েছিল। এই যে বোধগুলো, মহাভারতের ভিতরে, রামায়ণের ভিতরে, কাহিনির মধ্য দিয়ে জানিয়ে দেওয়া সমাজের আচরণটা কী। কারণ শেষপর্যন্ত রামায়ণ, মহাভারত, যে-কোনো ধর্মশাস্ত্রের দর্শনের কথা কিন্তু সমাজের উচ্চবর্গের, উচ্চস্তরের মানুষের কথা। সেখানে বড়ো জোর নীচের তলার মানুষের কথা পার্শ্ব মন্তব্যের মতো আসে, ফুটনোটের মতো আসে। তাদের কোনো জায়গা হয় না। এই বোধটার কথা উনি বারবার বলতেন।
ত : (বিশিষ্ট ইতিহাসকার) আর. এস. শর্মার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল।
র : খুবই স্বাভাবিক। এখন আমার শর্মাজির একটা অসম্ভব রসিক মন্তব্য বার বার মনে পড়ে, এটা ওই জমানার চেহারা—একবার কোনো ইতিহাসের আলোচনাসভায় শর্মাজি এই মন্তব্যের মাধ্যমে বক্তব্য শুরু করেন যে, “Historians, what ever be their political premises, at the end of the day they are all revitionists! এইটা এত চমৎকার, এই রসিকতার মধ্যে দিয়ে বলা যে সারাক্ষণই তো আমরা সম্মার্জনা করছি, মার্জনা চলছেই তো। এই যে বোধগুলোকে বলা, তার মধ্যে কোথাও একটু ইঙ্গিত থাকত, কোথাও হয়তো খোঁচা থাকত, মজা থাকত। এবং আজকে ধরো, এই যে জগতটা, যে সময়তে তুমি বড়ো হয়েছ, সুকুমারীদি নিজের কর্মজগতে তাঁর বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসছেন, তোমার পিতৃদেব আছেন। ধরা যাক, অশীনদা—তিনি মার্কসবাদী, বামপন্থী একেবারেই নন, কিন্তু তাঁর যে বৌদ্ধিক আচরণ অন্য মতকে সাগ্রহে গ্রহণ করার, পড়ার—তাকে কাটছেন হয়তো—কিন্তু শ্রদ্ধার সঙ্গে সেই অন্য মতটা শুনছেন। এই বোধটাই তো চলে গেল। একেবারেই চলে গেল।
ত : অশীন দাশগুপ্ত যদিও বামপন্থী ছিলেন না, আমরা প্রথম ইরফান হাবিবের কাজের কথা তাঁর কাছেই শুনি। ওই উদারতাটা অনেক বামপন্থীর মধ্যে থাকে না। তাঁরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেন আমাদের লাইনের সঙ্গে মিলছে কি না। কিন্তু যেহেতু মার সংস্কৃত সাবজেক্ট, মা সংস্কৃতের লোক, মাকে অনেক জায়গা থেকে আহরণ করতে হয়েছে।
র : কখনও আলোচনা করব তোমার সঙ্গে। ওঁর বোধ হয় বহু জায়গাতে জীবনচর্যায়, বা, মানুষকে বোঝার জায়গা ছিল রবীন্দ্রনাথ।
ত : ওরে বাবা! হ্যাঁ। রবীন্দ্রনাথে একেবারে ডুবে থাকতেন। ফিরে ফিরে পড়তেন। একদম শেষের দিকে হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের ‘ডিটেকটিভ’ গল্পটা পড়ে বললেন, দেখেছিস এটা কী আশ্চর্য গল্প! আর শেষ কথা আমি যেটা বলতে চাই যে, মার এই ধরনের ক্রিটিকালি দেখা কোনো বিষয়কে। মার কাছে সংস্কৃত প্রধানত সাহিত্যই ছিল। তাতেই মার বেশি আগ্রহ ছিল। কিন্তু সেটাকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করতেন এবং অত্যন্ত ক্রিটিকালি দেখতেন একইসঙ্গে। এটা খানিকটা বাড়ছিল, যতই ওই আর্লি নাইন্টিজ থেকে দক্ষিণপন্থার উত্থান হচ্ছিল।
র : উনি তাতে আশঙ্কিত ছিলেন।
ত : আশঙ্কিত ছিলেন এবং তুমি যদি দেখো লেখার তারিখগুলো, সমালোচনামূলক লেখা রামায়ণ নিয়ে বা যা হোক, তখন থেকেই বেশি হয়।
র : যাঁরা সংস্কৃত সাহিত্যের দক্ষ মানুষ, তাঁদের বাইরে সমাজের একটা বড়ো অংশের মানুষ যাঁরা এই ভাষা নিয়ে সচেতন চর্চা করেন না, তাঁদের অবহিত করা—এই দায়িত্বটা নিয়েছিলেন। একটা সামাজিক দায়িত্বের কাজ করেছিলেন। সেইটা খুব বারবার মনে হয় আজ।
যাই হোক, অনেক কিছু জানলাম তোমার কাছ থেকে, একেবারে ভিতর থেকে দেখা তো।
ত : খুব আনন্দ পেলাম তোমার সঙ্গে কথা বলে।
র : অনেক ধন্যবাদ।
এই ধরণের অনায়াস পান্ডিত্য আমাদের চারিপাশে আজ বিরল। অথচ কী সহজে সব ব্যাখ্যা করেন। জীবনের শেষ কিছু দিন নাক্তলায় ছিলেন, তখন দু দিন দেখা করেছিলাম। বামপন্থী রাজনীতিতে অটল বিশ্বাস। অনাড়ম্বর জীবন। অসুস্থ্থার মধ্যেও কত মানুষ দেখা করতে যেতেন, কখনো বিরক্ত হতেন না।লেখাটা পড়ে অত্যান্ত সমৃদ্ধ হলাম। ওনাকে প্রণাম।
ঋদ্ধ হলাম।