‘উকুন বুঝলে, অনেকটা লিটিল ম্যাগাজিনের মতো। আন্ডারগ্রাউন্ড অ্যাকটিভিটি। তার মানে, বোঝাই যাচ্ছে এর মধ্যে একটা প্রতিষ্ঠান বিরোধী ব্যাপার আছে। আর অন্য দিকে কাগজ, টিভি, ইন্টারনেট, এরা হচ্ছে এক-একটা প্রতিষ্ঠান। উকুনের জন্য এরা কেন স্পেস নষ্ট করবে? উকুন যে আছে এরা তা স্বীকারই করে না।
স্বীকারই করে না! সুকান্ত কেমন বোবা হয়ে যায়। উকুন নেই! ওই যে লক্ষ লক্ষ কীট রঞ্জার মাথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, যাদের মারার কুট শব্দটা পর্যন্ত পরিষ্কার শোনা যায়, যেন উইকেটের মতো ওখানেও ট্রান্সমিটার লাগানো আছে, তারা নেই! আবার সুকান্তর পুরানো ছড়াটা মনে পড়ল।’
বউয়ের মাথায় উকুন হওয়ার মতো তুচ্ছ জাগতিক বিষয় নিয়ে শুরু হয়েছে তৃষ্ণা বসাকের ‘উকুন’ সিরিজ। চাকরি, মেয়ের স্কুল ও মধ্যবিত্ত-সুলভ দাম্পত্যর মধ্যে কেটে যাচ্ছিল সুকান্তর জীবন। সেখানে সে এক দিন আবিষ্কার করে ফেলল বউয়ের মাথায় উকুন হয়েছে। আধুনিক নিয়ম-মাফিক সুকান্ত ভাবে তাকে হয়তো তাড়াতাড়ি এ বিষয়ে একটি ফেসবুক বা হোয়াটসঅ্যাপের পোস্ট দিতে হবে, এবং সেখান থেকেই উকুন তাড়ানোর ওষুধের খোঁজ পাওয়া যাবে। কিন্তু তার চাইতেও জরুরি যে বিষয়টি তার মাথায় টোকা মারে তা হল, বউয়ের মাথায় উকুন এল কোথা থেকে!
বউ একটুও না ঘাবড়ে বলল, মেয়ের স্কুল থেকে অবভিয়াসলি, আমার বাপের বাড়ি থেকে নিশ্চয়ই নয়।
এত দামি স্কুলে উকুন! বিশ্বাস হয় না সুকান্তর। বউয়ের আড়ালে সে মেয়েকে জিজ্ঞাসা করে, তোমার মাথায় উকুন হয়েছে নাকি সোনা?
মেয়ে অবাক চোখে বাবার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বলে, হোয়াট ইজ ইট?
উপন্যাস নয়, গল্পও যেন নয়, শুধু মাত্র উকুনের ওপর ভর করে তৃষ্ণা বসাকের আখ্যান এগিয়েছে পরপর। এবং সেই আখ্যান এগিয়ে নিয়ে গেছে সুকান্ত, রঞ্জা, তাদের মেয়ে। উকুনের ওষুধ-বেচা ক্যানিং লাইনের হালিমা বিবি ও লোকাল ট্রেনে তার কাছে পৌঁছোনোর কাহিনি, সুকান্তর অফিসের বড়োবাবু, জনৈক চিফ-লাইব্রেরিয়ান, যার কাছে সুকান্ত উকুন বিষয়ক বইয়ের সন্ধানে যায়, এবং উকুন আমদানির প্রাথমিক সন্দেহর তালিকায় থাকা কাজের মেয়ে সীমা, এরা সকলেই সুবিন্যস্ত পার্শ্ব-চরিত্র। এবং আরও অনেক চরিত্র ও আখ্যান যারা প্রায় সৌর জগতের মতো উকুনকে কেন্দ্রে রেখে নিজ-নিজ কক্ষপথে ঘুরেছে। তবে ৮৮ পাতার একটি চটি বই, যার সূচনা পৃষ্ঠায় লেখা ‘গুপ্তঘাতকের মতো ছড়িয়ে পড়ছে উকুনেরা’ ও সমাপ্তি পৃষ্ঠায় একটি মাত্র বাক্য, ‘উকুনের মৃত্যু নেই...’ সে-বইয়ের মূল চালিকা শক্তি তৃষ্ণা বসাকের বিচিত্রগামী গদ্য, যা মুচমুচে ও ক্রাঞ্চি, পঠনের পক্ষে নির্ভার অথচ ভাবনার গায়ে আঁচড়-কামড়ে পটু। ট্রামের তারের মাথায় স্ফুলিঙ্গের মতো যে গদ্য যত্রতত্র জ্বলে ওঠে এবং নিভে যাওয়ার পরও খানিক ক্ষণ অপটিকাল ইল্যুসন হয়ে কোথাও লেগে থাকে। এমন একটি বিষয় এবং তা নিয়ে কারিকুরি করার ক্ষেত্রে খুবই জরুরি ছিল এই ভাষা।
প্রসঙ্গত আরও যা বলার তা হল, একটি পরজীবী ক্ষুদ্র কীটের কথা বলতে গিয়ে লেখক সমাজ ও সামাজিক ধ্বস্ততার কথা বলেছেন। বিষয় শেষ পর্যন্ত উকুনে থেকে গেলেও নিত্যকার চরিত্র ও চরিত্রর ভেতর অবচেতনকে এবং শ্রেণি কাঠামোর অসারতাকে উন্মোচনের চেষ্টা করা হয়েছে। এ বিষয়ে ভূমিকায় লেখক যা বলেছেন সেটি গ্রন্থ বিষয়ে প্রণিধানযোগ্য। ‘২০১৪ সালে মেটেফুল উৎসব সংখ্যায় যখন প্রথম উকুনটি বেরোল তখন ঘুণাক্ষরেও জানতাম না এটা একটা সিরিজ হতে যাচ্ছে। হ্যাঁ সিরিজ, উপন্যাস নয়। জানতাম না উকুন হয়ে উঠবে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার এক অভিনব স্বর, যা পড়ে পাঠক হাসবে এবং ভাববে। একটি বাচ্চার মাথায় উকুন হওয়া এবং তার ওষুধ কিনতে গিয়ে অস্বস্তিকর অভিজ্ঞতা, এই ব্যক্তিগত বীজটুকু থেকে কীভাবে যে এক মহীরুহ ডালপালা মেলল, তা কে বলবে! শুধু বলতে পারি, ভদ্র ও সুশীল সমাজের চেপে রাখা, বলতে মানা কথাগুলো উকুনের মধ্যে দিয়ে উঠে এসেছে, যেমন উঠে এসেছে ক্ষমতার পীড়ন, বহুজাতিক সংস্থার নয়া ঔপনিবেশিকতা, যৌনতার অবদমন থেকে অতিমারি-কালীন চরম রাষ্ট্রিক নিস্পৃহতা।’
‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ছবির একটি দৃশ্য
রাহুল দাশগুপ্তও নিজের গল্প সমগ্র-র ভূমিকায় নিজের গল্প সম্বন্ধে অনেক দরকারি কথা জানিয়েছেন। যথা, ‘বাংলা গল্প নানা রকম ভাবে লেখা হয়েছে। আমি আমার মতো করে চেষ্টা করেছি। এইসব গল্পের বিষয়, আঙ্গিক ও উপস্থাপনা সম্পূর্ণ মৌলিক।’ আবার, ‘আমার গল্পগুলি সেই অজস্র ছোট ছোট বিস্ময়, আবিষ্কার ও চিৎকারের কোলাজ, যা অবিরত প্রশ্ন করতে চেয়েছে স্থিতাবস্থার কৃত্রিম নিষ্পাপতাকে।’ এবং, ‘এসব কথা না বললেও চলত। বলার কারণ, গল্পগুলি গতানুগতিক ধারার নয়’।
রাহুল দাশগুপ্তর গল্প সমগ্র-র অনেক গল্পেই রয়েছে এক দ্বিধাগ্রস্ত বাঙালি মধ্যবিত্ত মন। সেই চরিত্রের কথা এসেছে, যে বেড-রুমে মৃত মায়ের ছবি রাখে এবং স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গমের সময় আঁতকে আঁতকে ওঠে। এই দ্বিধা অনেকাংশেই বর্তমান সময়ের রেখে যাওয়া ছাপ, লেখক বাংলা ছোটোগল্পে তার প্রয়োগের চেষ্টা করেছেন।
‘তনুশ্রী সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। আমিও পুরোপুরি প্রস্তুত। হঠাৎ একটা দমক বাতাস ঢুকে ছবিটার গায়ের কালো কাপড়টাকে খসিয়ে দিল। আর সেই মুহূর্তে আমার মনে হল, এক জোড়া দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ছুরির মতোই আমার পিঠে এসে বিঁধল। আমি চকিতে পিছন ফিরে তাকালাম। আর মনে হল, এক জোড়া আগুনের গোলা যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ভস্ম করে দেবে আমায়। কী প্রচণ্ড রাগ আর ঈর্ষা সেই দৃষ্টিতে। আমি তনুশ্রীর ওপর থেকে নেমে গেলাম। তারপর অসহায়ের মতো বললাম, অসম্ভব। আমি পারব না তনুশ্রী।’ (ফটোগ্রাফ)
‘বার্ধক্য’ গল্পে এসেছে জনৈক অতলান্ত-র শহর ছেড়ে চলে যাওয়া, যে কারণে বক্তার অন্যত্র বিবাহিত পিসির চল্লিশ বছর বয়স থেকে সৌন্দর্যহানি হতে হতে পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে মৃত্যু হয়। ‘পূজার শৈশব ও এক নিরুপায় বাবা’ গল্পে বক্তা একজন কর্মস্থানে অতি-ব্যস্ত থাকা বাবা, যার কন্যা-সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। গল্পের শেষে দূরে বেড়াতে গিয়ে বাবা ও মেয়ের দূরত্ব ঘোচে। ‘যে গ্রামে মৃতদের কেউ ভোলে না’ একটি আশ্চর্য পরিকল্পনা। স্থিতাবস্থার এক শহরে বেড়ে ওঠা একটি চরিত্র নিজ শ্বশুরবাড়ির গ্রামে গিয়ে হঠাৎ দেখতে পান সেখানের সব মৃত মানুষেরাই জীবিত মানুষের স্মৃতির ভেতর বাহিত হয়ে চলে। লেখক দেখান, সেখানে কারও আয়ু ফুরিয়ে যাওয়া মানেই সে মৃত নয়। সে তার কাজের মধ্য দিয়ে বেঁচে আছে, তার উত্তরাধিকারের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকে, আস্ত একটি গ্রামের স্মৃতির মধ্যে তার বেঁচে থাকা। ‘বিবাহবার্ষিকী’ গল্পে লেখক প্রশ্ন রেখেছেন বৈবাহিক সম্পর্ক শেষ পর্যন্ত ধৈর্য আর ভালোবাসা, না কি একত্র যাপনের নিত্য অভ্যাস। গল্পের স্বার্থে লেখক নিজে আগ বাড়িয়ে কোনো উত্তর দেননি এর। বরং নিয়ে গেছেন সম্পর্কের এক টানাপোড়েনের দিকে, যেখান থেকে পাঠককেই উত্তর খোঁজা শুরু করতে হয়।
‘ঠিক সেই সময় বাবা-মা ওদের হাত নেড়ে ডাকে। ছেলে-মেয়ের কাছে আজ ওরা একটা দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। দৃষ্টান্ত হওয়া কি অতই সহজ? কত সহ্য করেছে ওরা। কত ধৈর্য ধরেছে। কত প্রলোভন উপেক্ষা করেছে। জীবনে পদে পদে বিভ্রান্তির কত চোরাবালি ছড়িয়ে আছে। সেগুলো এড়িয়ে নিরাপদে পঞ্চাশ বছর পার করা কী সহজ কথা! সমাজের সঙ্গে, চালু মূল্যবোধের সঙ্গে, বাতাসের অভিমুখের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চললে, জীবনে আর কোনও আশঙ্কাই থাকে না। জীবনে তখন কত নিশ্চিন্তে থাকা যায়।
কিন্তু সেটা কি কোনও জীবন? তাপস ভাবে। যে জীবনে কোনও ঝুঁকি নেই, কল্পনা নেই, সত্য নেই, অভ্যাসের দাসত্ব ছাড়া আর কিছুই নেই...
সঞ্চারী ভাবে, কখন শেষ হবে দিনটা? যেন ফুরোতেই চাইছে না। কাল যে বিকাশের সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা... ’
রাহুল দাশগুপ্তর গদ্য-কথন প্রাণবন্ত। ফলে কোনো গল্পের ভেতরে পাঠ-জড়তার প্রশ্ন নেই। বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে লেখকের সাবলীল যাতায়াত। শহুরে ও আধা-নাগরিক মধ্যবিত্তকে তিনি প্রায় যাপনের অনুপুঙ্খতায় দেখেছেন। সে-ভাবেই উপস্থাপন করেছেন পাঠকের কাছে। বাস্তব থেকে সরে গিয়ে অনেক গল্পেই তিনি রূপক, প্রতীক বা ফ্যান্টাসির সাহায্য নিয়ে প্রবেশ করেছেন সমান্তরাল অন্য এক বাস্তবে। যে বিকল্প পাঠকের পক্ষে অসংগত মনে হয় না।
তবে মধ্য বয়সের আগে কোনো চলমান লেখকের যদি ‘গল্প সমগ্র’ প্রকাশ হয়ে যায় তবে তা নিয়ে পাঠক মনে খানিক সংশয়ের উদ্রেক তো হয়ই।
উকুনের মতো নাছোড় জিনিস নিয়ে গল্প সিরিজ হতে পারে কে ভেবেছে। খুব কৌতূহল হচ্ছে ব ই নিয়ে ।