করোনায় স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ার আগে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রকাশিত অরিন্দম চক্রবর্তীর লেখা নতুন বইটি—‘এ তনু ভরিয়া’— লক-ডাউনের মধ্যেই হাতে এল। সংকলিত প্রবন্ধগুলোর মধ্যে কয়েকটা আগেই ‘অনুষ্টুপ’-এর বিভিন্ন সংখ্যা থেকে পড়া ছিল। সেগুলো যথেষ্ট ভাবনার খোরাক জুটিয়েছিল। তাই ঘরবন্দি হয়ে পড়তেই গোটা বইটা আবার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়লাম, অন্য কাজ সরিয়ে রেখে। অরিন্দমের অন্যান্য বই-এর মতো ‘এ তনু ভরিয়া’-ও একইরকম পুলক-জাগানো, চিন্তা উসকে দেওয়া একটি সংকলন। লেখক শব্দ নিয়ে খেলায় পারদর্শী—বই-এর নাম থেকে পাদটীকা পর্যন্ত সর্বত্র তার প্রমাণ প্রকট। ‘দর্শন আপাদমস্তক’ নামকরণেও তা দেখতে পাবেন। এটি আনখশির একটি দর্শনের বই—দার্শনিক প্রশ্ন তোলা ও তার উত্তরে দার্শনিক যুক্তিবিন্যাসই বইটির অবলম্বন। আবার অন্যভাবে বিশ্লেষণ করলে শব্দ দুটোর মানে দাঁড়ায় পা থেকে মাথা পর্যন্ত গোটা শরীর এখানে চর্চার বিষয়বস্তু। এখান থেকেই চমকের শুরু। যে-দেহ সাধারণত দর্শনের পরিসরে ব্রাত্য, উপেক্ষিত, মনের প্রতিতুলনায় নিকৃষ্ট বলে বিবেচিত; যে-দেহের রূপকে বর্ণিত বলে নারীরাও তাদের প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত, সেই দেহকে আরও ভালোভাবে বুঝে নেওয়ার তাগিদ থেকে লেখক দর্শনের আঙিনায় কেবল ঠাঁই দেওয়াই নয়, তার ওপরে এগারোটি সুলিখিত প্রবন্ধ ও কিছু কবিতা পাঠককে উপহার দিয়েছেন। উপরি পাওনা হিসেবে আছে পরিশিষ্টে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে শরীর নিয়ে সংস্কৃত, ইংরেজি ও অন্যান্য ভাষায় যেসব আলোচনা চলেছে, সাধারণ জিজ্ঞাসু পাঠকের জন্য তার খানিকটা সাবলীল বাংলায় সাজিয়ে দিয়ে, তার ওপরে নিজের সরস মন্তব্য সহযোগে, অরিন্দম বাংলা ভাষায় দর্শনচর্চার অনবদ্য এক নজির সৃষ্টি করেছেন।
ভিট্রুভিয়ান পুরুষ। শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। ১৪৯০।‘ড্রয়িংপেন, ইঙ্ক অ্যান্ড ওয়াশ অন পেপার’
ভারতে প্রথম থেকেই দর্শনের কাজ ছিল মোক্ষলাভে সহায়তা করা। উপনিষদের ঋষি তাই নির্দ্বিধায় বলেছিলেন, “আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্য— শ্রোতব্য, মন্তব্য, নিদিধ্যাসিতব্য।” শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের সঙ্গে শরীরের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ধীরে ধীরে ধ্যান, ধারণা ও সমাধির সোপান বেয়ে কায়-বিযুক্ত আত্মার মুক্তিই তাদের কাছে ছিল পরম পুরুষার্থ। পাশ্চাত্য দর্শনেও— সে প্রাক্-আধুনিক বা আধুনিক যে পর্বেই হোক না কেন— দর্শন চর্চায় দেহ বিপরীত মনেরই প্রাধান্য। দেহের মালিকানা যার, সে-ই দেহী (আত্মা বা মন)। দেহী চেতন, দেহ জড়। দর্শনের কারবার চিন্তা নিয়ে; চিন্তা চেতনার ধর্ম, দেহের তাতে কোনো ভূমিকা নেই। দেহ যন্ত্র, দেহী যন্ত্রী। দেহ রথ, ইন্দ্রিয় রূপে গৃহীত মন-বিশিষ্ট আত্মা রথী। দেহী স্বতন্ত্র, দেহ পরতন্ত্র। যদিও দার্শনিক শরীর অবচ্ছেদেই দর্শন-চর্চা করেন, অশরীরী অবস্থায় নয়, তবুও মনে করা হয়েছে দৈহিক অভিজ্ঞতা দর্শন চর্চার প্রতিবন্ধক, সহায়ক নয়। দেহের বাইরের সৌন্দর্যে আকৃষ্ট হয়ে মুমুক্ষু যাতে মোক্ষপথভ্রষ্ট না হন, তাই ভারতের আস্তিক-নাস্তিক দর্শন সম্প্রদায় একইরকম ভাবে দেহ বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। বিপাসনা ধ্যান ও যৌগিক ধ্যান—দু-ক্ষেত্রেই বৈরাগ্য সঞ্চারের উদ্দেশ্য শরীরের প্রতি জুগুপ্সা জাগানোর উপায় নির্দেশ করা আছে। শান্তিদেবের বোধিচর্যাবতারের উদ্ধৃতিতে পাই, “মাংসের কাদামাখা, স্নায়ুর দড়ি দিয়ে বাঁধা এই হাড়ের খাঁচাটিকে আলিঙ্গন করার জন্য যে ছুটে চলেছ এই শরীরই তো শকুন ও অন্যান্যদের খাদ্য হবে; তাহলে এই কাক-শকুনের আহার্য মাংসপিণ্ডকে মালা-চন্দন-অলংকার দিয়ে সাজিয়ে পুজো করতে চাও?” (পৃ: ১১)
রসোত্তীর্ণ সাহিত্যেও বীভৎস রসের উদাহরণ হিসেবে শরীরের ঘেন্না জাগানো বর্ণনা পাওয়া যায়। অরিন্দম তাই বলেন যে সব মিলিয়ে মানুষের জীবনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কদর্যতা নান্দনিক দৃষ্টিকোণ থেকে আমাদের চমকে দিতে পারে। শরীরকে যে ভাবেই বর্ণনা করা হোক না কেন (“যা বেছানো থাকে, বিতত, তাঁতে বোনা কাপড়ের মতো ছড়ানো জড়ানো থাকে, তাকে বলে ‘তনু’, যা শীর্ণ হয়ে যেতে থাকে তাকে বলে ‘শরীর’, যার বীজ উপ্ত হলে ফুলে ফেঁপে ওঠে তাকে বলে ‘বপু’, যা তিলে তিলে উপচীয়মান... তাকে বলে ‘কায়া’ আর যা গর্ভক্লেদের ‘কলে’ নোংরা তরলে জন্মে ‘বর’ হয়, বরণীয় রমণীয় হয়ে ওঠে তাকেই বলে ‘কলেবর’।” পৃ: ২৬) একে কেবলমাত্র একটি খাঁচা বা পোশাক/আবরণ হিসেবেই দেখা হয়েছে। তাই মুক্তির জন্য দেহ-মোহ ত্যাগ করা প্রয়োজন। অভিনবগুপ্ত অবশ্য বলেছেন যে দেহের গ্রন্থিগুলো যদি সাধনার ফলে শিথিল হয়ে খুলে যায় তাহলে দেহটাই মহামুক্তিতে পরিণত হয়।
সনাতন অধিবিদ্যা, জ্ঞানতত্ত্ব ও নীতিবিদ্যায় দেহের গুরুত্ব অস্বীকৃত হলেও নন্দনতত্ত্বের বিভিন্ন শাখায় দেহ নিয়ে দর্শন চর্চা অবধারিত ছিল। তাই লেখকের বেশিরভাগ জোরালো যুক্তিই নন্দনতত্ত্ব-নির্ভর।
শরীর নিয়ে দর্শন চর্চা নানা ভাবে করা সম্ভব। গোটা শরীর বা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ঘিরে দর্শন চর্চা সম্ভব। অরিন্দমও অখণ্ড ও খণ্ড—শরীরের দুই দিকই সংশ্লেষণ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে মেলে ধরেছেন। অতি সম্প্রতি দর্শনের জগতে এক নতুন ঢেউ এসেছে যেখানে বলা হচ্ছে এতদিন আমরা বিমূর্ত ধারণার মাধ্যমে দর্শন চর্চা করলেও এখন বোঝা যাচ্ছে আপাত-বিমূর্ত চিন্তাভাবনার বিকাশেও মূর্ত শরীরের অবদান কতখানি।
ডাক্তার য়ান ডেইমানের অঙ্গব্যবচ্ছেদ-বিদ্যা পাঠ। রেমব্রান্ট। ১৬৫৬। ক্যানভাসে তেল-রঙ (ছবির একাংশ। ১৭২৩ সালে ছবিটিতে আগুন লেগে তার বহুলাংশ পুড়ে যায়)
প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক, আমাদের চেতনার প্রকাশের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের ভূমিকা কী? সাধারণভাবে মনে করা হয়, চিন্তাভাবনা মস্তিষ্ক-নির্ভর আর জড়বাদী স্নায়ুবিজ্ঞানীরা দাবি করেন মস্তিষ্কই চেতনার আধার। তবে অনেকেরই চেতনার মস্তিষ্কে অন্তর্ভাব মেনে নিতে অসুবিধে হয়। চেতনার দর্শনে চেতনাকে মূলত দুই প্রকার বলা হয়—১) বিষয়মুখী চেতনা ও ২) সংবেদী চেতনা। অর্থাৎ যে-কোনো চেতন অভিজ্ঞতা হয় বিষয়মুখী নয় সংবিৎ-বিশিষ্ট। অনেকে আবার বলেন কোনো কোনো চেতন অভিজ্ঞতার দুটি ধর্মই থাকতে পারে। এবারে প্রশ্ন ওঠে যে চেতন-কর্তা যখন বিষয় সম্বন্ধে অবহিত হয় বা কোনো কিছু টের পায়, তখন সে জ্ঞাতা হিসেবে নিজের সম্বন্ধেও কি অবহিত থাকে? আমি যখন হলুদ গোলাপ দেখে মুগ্ধ হই তখন আমার চেতনার আকারটি ঠিক কী রকম হয়? এটি একটি হলুদ গোলাপ? না কি আমি একটি হলুদ গোলাপ দেখছি?
বেগুনি ও সাদা আলোয় ‘সেল্ফ রিফ্লেক্টেড’। শিল্পী স্নায়ুবিজ্ঞানী গ্রেগ ডান। নিউরন এবং অ্যাক্সন-এর অ্যালগোরিদম-নিয়ন্ত্রিত মাইক্রো-এচিং। ২০১৭। সূত্র Scientific American (https://www.scientificamerican.com/article/watch-the-human-brain-come-to-life-in-this-stunning-piece-of-art/ ) এবং (https://www.gregdunn.com)
অর্থাৎ যে-কোনো চেতন অভিজ্ঞতার সঙ্গে কি আমি-বোধ আবশ্যিকভাবে জড়িয়ে থাকে? আধুনিক স্নায়ুবিজ্ঞানী জোরের সঙ্গে বলেন মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষেই চেতনার অবস্থান। তবুও প্রশ্ন থাকে। চেতনা কি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের সঙ্গে এক ও অভিন্ন? কেমন করে হবে? চেতনা ও মস্তিষ্ক যে সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী? চেতনাকে স্নায়ুকোষের ধর্ম বলতেও বাধে। স্নায়ুকোষ জড় অতএব অচেতন। জড় থেকে চেতনের উৎপত্তি হয় কীভাবে তা আজও অজানা। মস্তিষ্কের অতিরিক্ত আত্মা স্নায়ুশারীরবাদীরা স্বীকার করেন না। তাহলে চেতনা কার ধর্ম? বাগর্থতত্ত্বের দিক থেকেও একটি সমস্যা হয়। আমার মস্তিষ্ক বললেই আমি ও মস্তিষ্কের মধ্যে ভেদ সূচিত হয়। তাহলে জড়বাদীকে অনুসরণ করে কেমন করে বলব আমার মস্তিষ্কই চেতন-আমি? তা ছাড়া আমি কোথায় থাকি? আমার অবস্থান কি মস্তিষ্কে না শরীরে? পাটনামের ‘ব্রেইন ইন দ্য ভ্যাট’ কল্প পরীক্ষণে বা ডেনেটের বিকল্প সংস্করণে মস্তিষ্কটি আমার মাথার ভেতর থেকে বের করে এনে অন্যত্র রাখা যায় এবং বেতার তরঙ্গের সাহায্যে সেই মস্তিষ্কের সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের সংযোগও স্থাপন করা যায়। সেক্ষেত্রে আমার শরীর আর মস্তিষ্ক বিচ্ছিন্ন অবস্থায় দুই জায়গায় থাকতে পারে। তখন ‘আমি’র অধিকরণ কাকে বলব—আমার শরীরকে না আমার মস্তিষ্ককে? না কি আমি মস্তিষ্ক, শরীর, মন কোনোটাই নই? স্নায়ুবিজ্ঞান যত এগিয়ে চলেছে, মস্তিষ্কের মানচিত্র যত নির্ভুলভাবে আঁকা হচ্ছে, আমাদের অমীমাংসিত প্রশ্নের সংখ্যা সেই অনুপাতে বেড়েই চলেছে। অরিন্দম তাই লেখেন—
আমারি ‘আমি’র এই অ্যামিগডালা
এ কী গৎ-জোড়-ঝালা, এ তনু ভরিয়া করে ঝালাপালা
নিউরন-ব্যাকরণবিৎ তুমি
তুমি কি সত্যিই বোঝ সেই ব্যথা কবিতার ভাষা? (পৃ: ৩৩)
ভারতীয় দর্শনে বলা হয়েছে আত্মার সঙ্গে দেহের সংযোগই হল জন্ম। যদিও জীববিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের মধ্যে ঠিক কখন জাতকের সঙ্গে শরীরের সংযোগ হয় তা নিয়েও বিবাদ আছে। হিবটগেনস্টাইনকে অনুসরণ করে বলা যায়, জন্ম বা মৃত্যু কোনোটিই ব্যক্তির জীবনের ঘটনা নয়। এই দুটি সীমা নির্দেশক মাত্র। মৃত্যুতে ব্যক্তির কর্তৃত্ব কখনো-কখনো স্বীকার করা গেলেও, জন্মে জাতকের কোনো কর্তৃত্ব থাকে না। অবশ্য যারা পূর্বজন্ম স্বীকার করেন তারা বলতেই পারেন প্রত্যেকেরই জন্ম তার পূর্বজন্মের কর্মফল অনুসারে হয় বলে জাতকের কর্তৃত্ব পুরোপুরি অস্বীকারও বোধহয় করা যায় না। দার্শনিক ও সাহিত্যিকদের মধ্যে জন্ম নামক ঘটনাটা শুভ না অশুভ, জন্ম নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্ন বয়ে আনে না জন্ম মানেই দুঃখের সূচনা, জন্ম থেকেই কি জাতক বুড়ো হওয়ার পথে পা বাড়ায় ইত্যাদি প্রশ্ন নিয়ে ঘোর মতপার্থক্য আছে। এদের মধ্যে ব্যতিক্রমী দার্শনিক হান্না আরেন্ট। তিনি বলেন মানুষের ক্ষেত্রে মননশীলতাকে ছাপিয়ে ওঠে জীবনশীলতা। প্রতিটি কাজের শুরুতে একটি ভাবনার জন্ম, এক নতুন আরম্ভের সুসমাচার। (পৃ: ৪৬)
দর্শনের সঙ্গে যাপিত জীবনের যোগ স্থাপিত হয় কেবল মননে নয়, নানা সংবেদন/প্রত্যক্ষণ ও তজ্জনিত ক্রিয়াকলাপের ভেতর দিয়ে। এই সমস্ত ক্রিয়ার করণ হল আমাদের পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় ও পাঁচটি কর্মেন্দ্রিয়। অরিন্দম এই করণগুলোকে ঘিরে দার্শনিক আলোচনা করেছেন বেশ কয়েকটি প্রবন্ধে। কেউ বলেছেন মানব সভ্যতার সূত্রপাত হল হাতের সৃজনশীল ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে। বিবর্তনের প্রক্রিয়ায় মানুষ অন্যান্য প্রাণীর থেকে যোজন যোজন এগিয়ে গেল হাতের ব্যবহার করতে শিখে। আবার কেউ বলেছেন হাতের চেয়ে পা অনেক বেশি জরুরি। সমগ্র শরীরের ভার বহন করে, মেরুদণ্ড সোজা রেখে, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সহায়তা করল পা-ই। মানুষ যেদিন সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারল তার দৃষ্টি হল সুদূরপ্রসারিত, ভাবনাও পাখা মেলল অনন্ত আকাশে। অনেকেই পা-কে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখেছেন। বর্ণ ব্যবস্থায় বিরাট পুরুষের পা থেকে উৎপন্ন শূদ্রদের সমাজে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। তবে চরণ-চিন্তায় নিমজ্জিত যুক্তিবাদী দার্শনিক বিরল নন, আর ভক্তিরসে সিঞ্চিত যিনি, তিনি তো চরণ-বন্দনার নানা পদ্ধতি অবলম্বন করেই থাকেন।
দ্য রোড টু হোমো সেপিয়ান্স / দ্য মার্চ অফ প্রোগ্রেস। শিল্পী রুডোল্ফ জ়্যালিঙ্গার। আর্লি ম্যান (প্রকাশক টাইম-লাইফ)। ১৯৬৫
ভরতের নাট্যশাস্ত্রে নানা হস্তমুদ্রার সাহায্যে মনের ভাবকে ফুটিয়ে তোলার উপায় বলে দেওয়া আছে।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ও অভিনবগুপ্তের রচনায় অরিন্দম দেখেছেন একটি পদক্ষেপের অন্তরালে থাকা ইচ্ছে থেকে শুরু করে নানা ক্রিয়াকলাপের বর্ণনা। দুজনের মতেই প্রতিটি প্রাণীর সচেতন ও ঐচ্ছিক গমন ক্রিয়ার প্রেরণা আসে তাদের আত্মা বা চেতনা থেকে। যারা আত্মার বদলে মস্তিষ্ককেই চেতনার আধার বলে চিহ্নিত করেন, তারা অবশ্য গমন ক্রিয়ার স্নায়ুবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যারই পক্ষপাতী।
কপিলাবস্তুর রাজকুমার গৌতমের নির্বেদ আসে জরা, ব্যাধি ও মৃত্যুর সম্মুখীন হয়ে। শরীরী প্রাণীর জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর কবল থেকে নিস্তার নেই। প্রাচ্যে ও পাশ্চাত্যে দার্শনিকরা জরা বা ব্যাধি থেকে মুক্তিলাভের উপায় নিয়ে আলোচনা অনেক বেশি করেছেন। জরা-ব্যাধি-মৃত্যুর স্বরূপ ও কারণশৃঙ্খলের ওপর আলোচনার পরিবর্তে অরিন্দম নানা দিক থেকে জরা-ব্যাধি-মৃত্যু সংক্রান্ত দার্শনিক সমস্যাগুলোর ওপর আলোকপাত করেছেন। উৎসাহী পাঠকের জন্য তাই ‘ব্যাধি-বিবেক’, ‘জরামর্শ’, ‘সৌন্দর্যের মৃত্যু, মৃত্যুর সৌন্দর্য’ শীর্ষক প্রবন্ধগুলো অবশ্য পাঠ্য।
জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলোর মধ্যে দর্শন চর্চায়, তত্ত্বগঠনে ও উদাহরণে প্রাধান্য পেয়ে এসেছে চোখ বা দর্শনেন্দ্রিয়। যদিও ভারতে বৈদিক যুগ থেকে শুরু করে শ্রবণ-নির্ভর শ্রুতির মর্যাদা স্বীকৃত, কেবলমাত্র বৈদিক কর্মকাণ্ডেই নয়, সংগীতের নান্দনিক ও দার্শনিক চর্চাও শ্রবণেন্দ্রিয়ের গুরুত্ব স্থাপন করেছে। সংগীত তত্ত্বে বহুবিবেচিত প্রশ্নগুলো আবর্তিত হয়েছে বাণী, সুর ও তালের পারস্পরিক সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। যেমন সংগীতের রসোপলব্ধিতে মুখ্য ভূমিকা পালন করে কে—সুর না বাণী? শুধু একটি বিবাদী স্বরের প্রয়োগ কীভাবে মন ছুঁয়ে যাওয়া অনুভূতির সৃষ্টি করে? শাস্ত্রীয় সংগীতের নিয়মাবলি কি সাংগীতিক সৃজনশীলতাকে মুক্তি দেয় না শৃঙ্খলিত করে? সুরের অর্থ আছে কি? থাকলে সেই অর্থ কত রকম? অরিন্দম প্রশ্ন তোলেন কার্যকারণাত্মক অর্থ, ভাবপ্রকাশক অর্থ, সামাজিক ঐতিহ্য স্মারক অনুষঙ্গ ছাড়াও স্বরের, সুরের, স্বরমালিকার অন্য কোনো মানে থাকে কি? না থাকলে রসনিষ্পত্তি হয় কীভাবে? লেখকের সিদ্ধান্ত—সুরের অর্থ আমাদের এক চেতনা থেকে অন্য চেতনায় নিয়ে যায়। অভিনবগুপ্তকে অনুসরণ করে অরিন্দম জানান, আমাদের প্রত্যেকের ভেতরে যে অভিন্ন, অদ্বৈত, চিৎস্বরূপ নটরাজ শিব আছেন তাঁর দুই শক্তি—প্রকাশ ও বিমর্শ। প্রকাশ বিষয়ের ওপর নিরপেক্ষ জ্ঞানের আলো ফেলে আর আমাদের অন্তরতর আমিকে বিবিধ কল্পনার সাহায্যে রসিয়ে, তলিয়ে আস্বাদন করে; বিমর্শ শক্তি আমাদের অন্তরের সুর-পাগল আমি-দের মাতিয়ে তোলে, মরণকে করে চির-জীবন-নির্ভর। (পৃ: ১২৫)
লোকসমাজে দার্শনিকদের অনেকেই বাস্তব-বুদ্ধিহীন বলে ভাবেন। তবে ‘মস্তক বিক্রয় ও বোঝার বোঝা’ প্রবন্ধে ক্ষীণপ্রাণ বুদ্ধিজীবীদের ক্ষমতার কাছে সাময়িকভাবে মাথা বিকানোর স্বপক্ষে অস্বস্তিজনক যুক্তি দুটি, বা ‘অনুষ্টুপ’-এর পাঠক যাতে ভুল না বোঝেন সেজন্য সংস্কৃত উদ্ধৃতি পারতপক্ষে না-দেওয়া, অথবা ঘর ছেড়ে ঘরে ফেরার বাস্তুদর্শন প্রসঙ্গে ঘরের এগারোটা লক্ষণের তালিকা দেওয়ার পর কঠিন সত্য সহজে বলা যে, “একবার ঘর ছেড়ে গেলে সেই ঘরে আর ফেরা যায় না” (পৃ: ১৮৩)—আক্ষরিক অর্থেও নয় দার্শনিক অর্থেও নয়—এ সবই অরিন্দমের প্রখর বাস্তববুদ্ধির পরিচায়ক।
যুক্তির ধার, বিচারের ভার, সাহিত্যের রস, কৌতুকের ছটা—সব মিলিয়ে বইটি নিঃসন্দেহে চিত্তাকর্ষক। তবে, বইয়ে ছাপার ভুল কিছু কম হলে আরও ভালো লাগত।