স্বেচ্ছাবিরহ চলছে। ঘোষণাটা দিয়েছি আমি নিজেই। এর কারণ যথেষ্ট। আমাদের দীর্ঘ প্রেমে একবার, শুধুমাত্র একদিনের জন্যেও আমরা মুখচ্ছবি দর্শন বন্ধ করিনি। সেজন্যেই এ উদ্যোগ। কিন্তু তাই বলে তো আর এরকম বলা যায় না- যাও, কালকের দিনটা আমি তোমার চেহারা দেখবো না। একটা ছোটখাটো ঝগড়া বাঁধানো চাই অন্তত।
শুরুটা এভাবে করলাম। কেবল ওর কারণে আমার কত কথা সহ্য করা লাগে, কত বন্ধুবান্ধবের টিটকারি শুনতে হয়, মা বকেন, খোঁটা দেন প্রতিনিয়ত, আরও যে কত ক্ষতি হয়েছে শুধুমাত্র ওর জন্য- সবগুলো লিস্ট করলাম। পুরো তালিকা রিভাইস করতে গিয়ে দেখলাম একদম সত্যি সত্যিই আমার রাগ উঠে গেছে। রাগের মধ্যেই ভাবলাম, এইতো উন্নতি হচ্ছে! প্রথমে রাগ, রাগ থেকে বিতৃষ্ণা, এরপর খানিকটা ঘৃণা- এসবই তো বিরহসূচনা।
সবকিছু ঠিকঠাক মতোই করেছি। বিন্তু ফল হলো বিপরীত। সেদিনের পর থেকে দিনে চারবার করে দেখা করা আরম্ভ করে দিলাম। নাহলে চলবে না। ঠিক এরকম একটা কথাই দু'বছর আগে শুনেছিলাম মিলির মুখ থেকে। রাজীব একদিন যদি বিকেল পাঁচটায় আমাদের বাড়ির ধারের রোডটা ঘেষে না হেঁটে যায়, আমার খুব মেজাজ খারাপ হয়। রাগে-দুঃখে চোখে পানি এসে যায়। বলেছিলাম, "তুই তো দেখি সিনেমাশিক্ষণের বাস্তব প্রয়োগ দেখাচ্ছিস"।
ব্যাপারটা আন্তারাকে জানালাম। ভাবলাম ও বোধহয় সান্ত্বনাসূচক কিছু কথা বলবে। প্রেম জিনিসটা এরকমই রে-বলবে। কিছু কুয়োট উল্লেখ করবে (সে জ্ঞানী মানুষ)। আসলে আমার ইচ্ছে হচ্ছে কেউ আমাকে বলুক, করীষ, তুই একটা বিরাট প্রেমিক রে। কিন্তু না। আন্তারা সবকিছু হালকাভাবে নিলো। সুর করে গাইলো,
একদিন তোমাকে না দেখলে বড় কষ্ট হয়। টুরু টুরুট্টুরু টুরু (বাদ্যের বাজনা)
সেই দিনটাই যেন আমার পুরো-
ফোন কেটে দিলাম। ঠাট্টা সবসময় হাসাতে পারে না। আমি খুব সিরিয়াস।
ফোন রাখার সঙ্গে সঙ্গেই ম্যাসেজ পাঠালো। দেখবো না দেখবো না করেও দেখে ফেললাম। ম্যাসেজের ভাষ্য- অতিরিক্ত ভালোবাসা নাকি আমার আয়ু কমিয়ে দিচ্ছে। এধরনের কথা আগেও শুনেছি। কিন্তু এবারে ও অনেকগুলো প্রমাণ সঙ্গে দিয়েছে। সেখানে আছে আর্টিকেল, ভিডিও, অডিও ক্লিপ। সময় নিয়ে দেখলাম। সর্বসাধারণ ভ্যাজর ভ্যাজর নয়। প্রত্যেকটাই রোমহর্ষক। কঠিন যুক্তি আছে!
সত্যি সত্যিই চিন্তায় পড়ে গেলাম। ঠিক করলাম নতুন প্রকল্প শুরু করবো। এবার একদিন নয়, সাতদিনের।
প্রথমদিন:
সকালবেলা বই নিয়ে বসলাম। বইয়ের নাম মৃত্যুক্ষুধা। আন্তারা জোর করে ধরিয়ে দিয়েছে বইটা। একমাস ধরে চেষ্টা করছি, পড়তে পারছি না। নামটাই কত কঠিন। "মৃত্যুক্ষুধা"! বইয়ের চেহারা দেখলেই ঘুম পেয়ে যায়। তবু কিছুদিন পর পর প্রথম কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়ি। এরপর রেখে দিই। আবার যখন পড়তে যাই ভুলে যাই কতটুকু পড়েছিলাম। গোড়া থেকে আরম্ভ করা লাগে। আজও করেছি।
দশটা এগারোটার দিকে সব বন্ধু-বান্ধব মিলে ঘুরতে বেরুলাম। স্থান তুরাগ নদ। দলের সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। পানি ছিটিয়ে, ক্যামেরার দিকে না তাকিয়ে হাসবে- ঠিক সেই মূহুর্তটাই ক্যামেরা বন্দী করতে হবে। কেউ কেউ আবার ক্যামেরা ম্যানকে অভিযোগ করছে পানির ড্রপলেটস সুন্দর হয়নি। ছবিটা আরো কয়েক সেকেন্ড আগে ক্লিক করা উচিত ছিল।
আমিও এগিয়ে গেলাম। পোজ টোজ কিছু পারি না। কয়েকজন যা একটু শিখিয়ে দিলো, সেগুলোও করতে পারছি না ঠিকমতো। আন্তারা জ্বালাচ্ছে। দূরে বসে মুচকি মুচকি হাসছে। সে নিজে ছবি তুলবে না, অন্যদেরও তুলতে দিবে না। ও ছবি তুলছে না কারণ তুরাগের পানি নোংরা।
ওই পানিতেই পা ডুবিয়ে বসে আছি। -ডানদিকে ফের, -মাথা নিচু কর, - মুখে কি কেউ থাপ্পড় মেরেছে, -দাঁত কেলাচ্ছিস কেন আবার, চলছেই! কিছুক্ষণ পর ফট্গ্রোফার বিরক্ত হয়ে বললো, দূরে যা। আমি আন্তারার সঙ্গে যোগ দিলাম।
চুপচাপ বসে আছি। আন্তারার বকবক শুনছি।
-ধর, নৌকা ডুবে গেল। কী হবে জানিস? সবার আগে মরব আমি। কেননা সাঁতার জানিনা। ডুবে মরা নিয়ে আমার তেমন আপত্তি নেই। গা গুলাচ্ছে এই ভেবে যে আমাকে ওই ময়লা কালো পানি খেয়ে মরতে হবে।
-যদি কেউ বাঁচিয়ে ফেলে?
-বাঁচানো সম্ভব না। কারণ তখন মরব বমি করতে করতে। কোথায় যেন শুনেছিলাম, বমি করতে করতে মৃত্যু সবচেয়ে কষ্টকর মৃত্যু।
ঘরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। মুখে এক ঝাপটা পানি দিয়ে এসে বসলাম। আশেপাশের কোথায় যেন জোরে গান ছেড়েছে। টিভির আওয়াজ সে অনুপাতে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। মণি আর সবুর মা খিলখিলিয়ে হাসছে সেই দিকে চেয়ে। প্রেসার কুকার শিস দিচ্ছে। এত কোলাহলের মধ্যেও কি করে যেন ঘুমিয়ে পড়লাম।
দ্বিতীয়দিন:
প্রথমদিনটা খুব সহজেই কেঁটে গেছে। কিন্তু আজ আর কাজ খুঁজে পাচ্ছি না। যে করেই হোক নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে।
মৃত্যুক্ষুধা নিয়ে বসলাম, মন বসলো না। ভয়ে ভয়ে টিভি খুললাম। ভয়ের কারণ হলো ওকে দেখে ফেলার সম্ভাবনা আছে। গোটা কয়েক প্রোগ্রাম যেগুলো আছে, কেবল আমার সামনে এসেই পড়বে!
থ্রি ইডিয়টস মুভিটা হচ্ছে। দেখা আরম্ভ করে দিলাম। এ ছবি সহজে পুরনো হতে পারে না।
এরপর টম এন্ড জেরি। মা হঠাৎ এ ঘরে এসে হাসতে লাগলেন। হাসি থামিয়ে বললেন, তোর জন্য ভুলে গেছি কিজন্য এসেছিলাম। কিছুক্ষণ পর এসে বললেন, গুঁড়া মরিচ শেষ। এনে দিতে পারবি?
আমিই বাজারে গেলাম, ঘরে আর কেউ নেই তাই।
আমাদের বাসা থেকে একটা গলি হয়ে সহজেই এলাকার দোকানগুলোতে পৌছানো যায়। কিন্তু তা না করে ঘুরা পথে পা ফেললাম। নইলে মৌবাগ চত্বরের ডানদিকে তাকাতে ইচ্ছে করবে। সেটা করা যাবে না।
ঘরে ফিরে এসে দিলাম ঘুম। ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যার পর। মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো। মণি বললো হিমুর থিওরি প্রয়োগ করতে। থিওরিটা এরকম- খুব বেশী ঘুমালে মাথা ধরে যায়। সেই যন্ত্রণা সারাতে হলে আবার ঘুমানো প্রয়োজন।
আমি সত্যি সত্যিই আবার ঘুমাতে গেলাম। তবে তার আগে মা'র সাথে গ্রামের বাড়ির জমিজমা বিষয়ে পরামর্শ করলাম (আমার দেয়া আইডিয়া মা মানুক বা না মানুক)। নূরকে বকাবকি করলাম। ডিকশনারির ছেঁড়া মলাটটায় কচস্টেপ লাগালাম। খুব চিন্তা ভাবনা করে মণিকে তিনটা রঙের নাম বললাম।
তৃতীয়দিন:
ঘুড়ি ওড়ানোর চেষ্টা করলাম। পারলাম না। সেই ছোট্টবেলা থেকে দু'টা জিনিস কখনো করতে পারিনি। ঘুরি ওড়ানো তার মধ্যে একটা। অন্যটা হলো লাটিম ঘুড়ানো।
স্পষ্ট মনে আছে, রিতার বড় বোন সুমনা আপাও লাটিম ঘুরাতে পারতো না। কিন্তু একদিন কেমন করে যেন দড়িতে একটা টান দিল লাটিম ভই ভই করে ঘুরতে শুরু করলো। অনেকক্ষণ ঘুরলো। এর পরদিন থেকে আমি উঠে পড়ে লাগলাম। তবে লাটিম ঘুরানো শেখার জন্যে নয়, সুমনা আপার মতো কোইনসিডেন্স ঘটানোর জন্যে। হলোই না।
নভেল হাতে নিলাম পড়তে পারলাম না। চোখদু'টা ঝাপসা হয়ে আসছে বারবার। মণি ওর কলেজের ঘটনা বলা আরম্ভ করলো। বললাম, তোর গলা খুব কানে লাহছে রে।
কিছুক্ষণ পর হজ্জ্বফেরত বাড়িওয়ালা চাচি এলেন। এসেই গল্প শুরু করলেন। একটু আগে মণির কথা শুনতে চাইনি। এখন ঠিকই দীর্ঘ কাহিনী শুনতে হলো, এ ঘর থেকে উঠে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
চাচী জমজম কুয়ার মিষ্টি পানির বোতল এগিয়ে দিলেন। মুখে দিতেই তিতকুটে লাগলো। মণি বললো ওর কাছে নাকি নরমাল পানির মতোই লাগছে। তিতা না, মিষ্টিও না।
বিকেলবেলা। ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে আছি। চোখ বন্ধ। একটা গান দিয়েছি।
বাধন যখন বাঁধতে আসে
ভাগ্য আমার তখন হা-সে হা-সে হা-সে
মা এসে বললেন, কিরে কি হয়েছে তোর। সারাদিন ঝিম মেরে থাকিস।
কপালে হাত রেখে দেখলেন গা গরম কিনা। মা'রা অযথাই চিন্তা করেন।
গান শুনতে শুনতে কখন যে চোখটা লেগে গেছে বুঝিনি। কিসের একটা গোলমালে উঠে বসে দেখি সাতটা বেজে গেছে। সর্বনাাশ! রাতে আর ঘুম হবে না। মা'র ওপর মেজাজ খারাপ হলো। একটু ডেকে তুললেন না। হয়তো ভেবেছেন আমি অসুস্থ।
বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বসার ঘরে বসেছি। ভাবছি, সারাটা রাত ধরে কী কী করা যেতে পারে।
-করীষাপু
কণ্ঠটা মণির। ডাকার সূরের মধ্যে খুশির ঝিলিক উপচে পড়ছে। চোখ খুলে তাকালাম। মণির পিছে আন্তারা। দুজনের মুখেই হাসি। আন্তারাকে বললাম, কখন এলি?
- তোর নাগরকে নিয়ে এলাম।
মনে মনে ভাবলাম, আন্তারাটা যত ঠাট্টা ফজলামি করুক না কেন, আমার feeling ঠিকই অনুমান করতে পারে।
গদগদ হয়ে বললাম, কোন রুপে? বাঙালী, ওয়েস্টার্ন, চাইনিজ, কোরিয়ান, ইন্দো-চাইনিজ নাকি কিটো?
-কোনোটাই না। এবারে সম্পূর্ণ নতুন সাজ।
শরবতের বড় গ্লাস ভরা হলদে রঙের ঘন তরল। সঙ্গে আবার স্ট্র।
বদমাশটা কী করেছে জানেন? মৌবাগ চত্বরের ফুচকা এনেছে ঠিকই। তবে সেটা ব্ল্যান্ড করে ফেলেছে। গ্লাসটা ছুঁতে গিয়ে খেয়াল করলাম, মণির হাতে ক্যামেরা। চোখে চোখেই কষে একটা থাপ্পড় লাগালাম ওর গালে।
আন্তারা বললো, শুরু কর।
দু'চুমুক দিয়ে বমির মতো করে ফেলে দিলাম। এরপর এলো সাদা তরল। ঘ্রাণ শুনে বোঝা গেল মা'র পায়েস। এটা ব্ল্যান্ড করার দরকার কি ছিল! এতক্ষণে বুঝলাম কিসের শব্দে ঘুম ভেঙেছে!
খুব ভালো হয়েছে পায়েসটা, বরাবরের মতোই।
গ্লাস খালি করে একটা ঢেকুর তুললাম। বললাম, আর কই?
সবাই হেসে ফেললো। কিন্তু আমি হাসতে গিয়েই ঝামেলা বাঁধিয়ে ফেললাম। বমি আরম্ভ করলাম। খারাপ লাগছে খুব। নাড়িভুড়ি উল্টে যাচ্ছে একদম। এর মধ্যেও খেয়াল করে দেখলাম আন্তারার মুখটা। বেচারীর চাঁদমুখে একটা অপরাধী অপরাধী ভাব চলে এসেছে। বেশ জোরেশোরে হেসে ফেললাম।
শেষপর্ব:
বিরহের ফল খুব মিষ্টি হয়েছে। ডাক্তার বলেছে আলসারের মতো হয়ে গেছে। পেট খালি রাখা যাবে না।খাদ্যনালীতে সমস্যা হয়েছে সঙ্গে কিডনীতেও ছোটখাটো একটা ইফেক্ট পড়েছে।
কথাগুলো শুনে আমার হাসি পেল খুব। হাসির কারণ গুঢ়। তবে চেহারার মধ্যে মন খারাপ ভাব ফুটিয়ে রাখলাম। সবাই কেমন চুপচাপ হয়ে গেছে। পারিপার্শিকের সাথে তাল মেলানো উচিত! আন্তারা হঠাৎ বলে উঠলো,
যাক, প্রমাণ হয়ে গেল যে সত্যিকারের ভালোবাসা কোনো বাঁধা মানে না!
সবাই হেসে ফেললো। আমিও হাসলাম। তবে হাসির একপর্যায়ে হেচকির মতো হয়ে গেল। শব্দটা বিকৃত হয়ে অনেকটা গোঙানীর মতো শোনা যাচ্ছিল। রুমের সবার দৃষ্টি ফিরলো আমার দিকে।
আন্তারা হুড়মুড় করে উঠে এলো। সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে আমাকে কিল মারা আরম্ভ করে দিলো।
দোষ হলো, আন্তারার ঐ অপরাধী চেহারাটা আবার একটু দেখতে চেয়েছিলাম। পাপ হলো, মেয়ে হয়ে মেয়েদের অন্তর্দৃষ্টির কথা ভুলে গেছিলাম।
লেখাটা প্রায় দু'বছর আগের।
এটা মাঝে মধ্যে একটু জটিল হয়ে পড়েছে - যেমন, "ঘ্রাণ শুনে"
শেষ লাইন দুটো ও থাকা উচিত কি না বুঝতে পারছি না!
ইনি কি অন্য নামে প্রচুর সরল কিন্তু অসরল প্রেমের গপ্পো লিখতেন? নেহাতই প্রশ্ন।
মজার তো।।।
"ব্ল্যান্ড করা" মানে কী?
বেশ পাকা হাতের লেখা। সন্দিপনী ঘোর আছে
ধন্যবাদ বিপ্লব দাদা। উৎসাহ পেলাম খুব!
অন্যদেরও ধন্যবাদ। ব্যাপারগুলো মাথায় রইল। পরবর্তী লেখায় খেয়াল রাখবো।