জীবনে বেশ কয়েকবার আকস্মিকতার মুখোমুখি হয়েছি। এগুলির মধ্যে কিছু-কিছু ঘটনা নিজেকে কেমন যেন বিপর্যস্ত করে দিয়েছিল। সাধারণ সব হিসেবপত্তর নিছকই অর্থহীন বলে মনে হয়েছিল তখন। এমন আরও একটি ঘটনার মুখোমুখি হলাম গত ১৫ মার্চ। যে সুস্থ, সবল মানুষটির সঙ্গে মাত্র দিনতিনেক আগে টেলিফোনে ঘণ্টাখানেক ধরে গল্প হয়েছে, তার হঠাৎ চলে যাওয়ার ঘটনাটি কী ভাবে মেনে নেওয়া যায়! ঘটনা ঘটেছিল সন্ধেয়, সেই রাতেই সাড়ে-আটটা ন-টা নাগাদ ইস্ক্রা পত্রিকার সম্পাদক প্রগতি মাইতি ফোন করে দুঃসংবাদটা দেয়। মৃত্যুর কারণ--কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট। পরদিন সকালে রমানাথের ছেলেকে ফোন করে বিস্তারিত সব জানলাম। আগের দিন রাতে রমানাথ একটু শারীরিক অস্বস্তি বোধ করেছিল, ভেবেছিল গ্যাসের কষ্ট। সেই কষ্ট কমাতে কিছু ওষুধপত্তরও খেয়েছিল। কিন্তু পরদিন সকালে অবস্থার অবনতি হয়। ডাক্তার ডাকা হয়েছিল, স্যালাইনের ব্যবস্থা করা হয় বাড়িতে। পরদিন সি টি স্ক্যান ইত্যাদি করার কথাছিল। কিন্তু সে সুযোগ আর পাওয়া যায়নি, সন্ধেতেই সব শেষ। সম্পূর্ণ সুস্থ, সৃষ্টিশীল একজন মানুষের এ ভাবে আচমকা চলে যাওয়ার ঘটনা মেনে নেওয়া বড়ো কষ্টের। দিনতিনেক আগে ওর সঙ্গে আমার টেলিফোনে বহুক্ষণ ধরে গল্প হয়েছিল। সেই গল্পে এই বিপর্যয়ের সামান্যতম আভাসও ছিল না। বরং ও সেদিন বেশ খোশমেজাজেই ছিল। খুশির বাড়তি কারণটি ছিল সাহিত্য সংক্রান্ত। বলেছিল—একটা ভালো খবর দিচ্ছি তোকে। একটা উপন্যাস শেষ করেছি, এটা কোনো পত্রিকাকে না দিয়ে সরাসরি প্রকাশককেই দিয়ে দিলাম। আমাদের গল্প সেদিন শেষ হয়েছিল এমন একটি জায়গায়, যেখান থেকে পরদিন আবার একটা বড়ো মাপের আড্ডা শুরু হতে পারে। কিন্তু তা আর হল না।
রমানাথ রায় (ডান দিকে) ও শেখর বসু
রমানাথের সঙ্গে আমার বন্ধুতার শুরু শেষকৈশোরে, কলেজজীবনে। সম্পর্কে কখনও ছেদ পড়েনি। একটানা বাষট্টি-তেষট্টি বছরের মেলামেশা শেষ হল অবশেষে। আমাদের আজীবনের অন্যতম প্রধান আড্ডাস্থল ছিল কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউস। আমরা দুজনেই মধ্য-উত্তর কলকাতার বাসিন্দা ছিলাম, সম্পর্ক নিবিড়তর হওয়ার সেটাও হয়তো একটা বাড়তি কারণ। তবে আমাদের বন্ধুতার প্রধান সূত্র ছিল সাহিত্য; সাহিত্যপাঠ ও সাহিত্যচর্চা। বন্ধুবৃত্ত বেশ বড়ো ছিল আমাদের। প্রথম যৌবনে আমাদের দু-ঝাঁক গল্পলেখক ও কবি কফিহাউসের দু-তিনটে টেবিলের চারপাশে অনেকগুলো চেয়ার টেনে এনে জড় হতাম। আড্ডা চলত দীর্ঘক্ষণ ধরে। ছয়ের দশকের কথা বলছি, তখন কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসের চেহারাটাই ছিল অন্যরকম। বেশির ভাগ টেবিলেই বসত অল্পবয়সী সৃষ্টিশীল সব মানুষজন। কেউ নাটকের, কেউ চলচ্চিত্রের, কেউ বা ছবি আঁকার জগতের। তবে কবি ও লেখকদের সংখ্যাই ছিল বেশি। বেশির ভাগ টেবিলেই থাকত ছোটো পত্রিকার দু-একজন সম্পাদক, তাদের হাতে হাতে ঘুরত তাদের সম্পাদিত পত্রিকার সাম্প্রতিক সংখ্যা। চমত্কার সেই দিনগুলির কথা এই কারণেই জানালাম যে, আমাদের আরও অনেকের মতো সেদিনের তরুণ লেখক রমানাথ রায়ও নিজেকে গড়ে তোলার আদর্শ একটি পরিমণ্ডল পেয়েছিল।
কম্পিউটার, ইন্টারনেট, সেলফোন তখন দূর ভবিষ্যতের গর্ভে; কিন্তু কলকাতায় বসেই আমরা সদ্যপ্রকাশিত বিস্তর বিদেশি বইপত্তর পেতাম। তখন ভারতীয় টাকার সঙ্গে ডলার, পাউন্ডের বিনিময় মূল্যের খুব একটা হেরফের ছিল না; তার ফলে মাত্র পাঁচ টাকা খরচ করেই আমরা পেঙ্গুইন, পেলিক্যান বা ফেবার অ্যান্ড ফেবারের ভালো-ভালো বই পেয়ে যেতাম এই শহরের দোকান থেকে। তখন অবশ্য পাঁচ টাকারও অনেক দাম।
কলকাতার গ্রন্থাগারগুলোর অবস্থা বেশ ভালো ছিল। বইপত্তরের অঢেল জোগান সব জায়গাতেই। এস এন ব্যানার্জি আর চৌরঙ্গি ক্রসিংয়ের মুখে মেট্রোপলিটন বিল্ডিংয়ে অবস্থিত মস্ত আমেরিকান লাইব্রেরি সর্বসাধারণের জন্য খোলা থাকত তখন। জঙ্গি আক্রমণের আশঙ্কা ছিল না সেই সময়, তার ফলে পাহারাদারির কড়াকড়ি ছিল না। যে-কেউ গ্রন্থাগারে ঢুকে বই ও পত্রপত্রিকা পড়ে আসতে পারত। বই ধার করতে হলে অবশ্য সদস্য হতে হত। এই লাইব্রেরিতেই জগদ্বিখ্যাত ‘এনকাউন্টার’, ‘ব্লাস্ট’, ‘ইগোয়িস্ট’, ‘শিকাগো পোয়েট্রি’ ইত্যাদি পত্রিকার সঙ্গে আমাদের প্রথম পরিচয়।
সেদিনের সেই কলকাতায় দেশবিদেশের শিল্পসাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার আয়োজনটি বেশ ভালোই ছিল। আমরা ‘এই দশক’ পত্রিকাকে কেন্দ্র করে আমাদের ‘শাস্ত্রবিরোধী গল্প আন্দোলন’ শুরু করি ১৯৬৬ সালে। আন্দোলন পূর্ণ গতিতে চলেছিল বছর-দশেক, তারপর অনিয়মিত ভাবে আরও তিন-চার বছর। প্রথম সংখ্যায় আমরা ছিলাম পাঁচজন সদস্য-লেখক—রমানাথ রায়, সুব্রত সেনগুপ্ত, আশিস ঘোষ, কল্যাণ সেন ও আমি। পরে আরও তিনজন যোগ দিয়েছিল। এরা হল অমল চন্দ, বলরাম বসাক এবং সুনীল জানা। প্রায় আড়াই দশক আগে অকালপ্রয়াত হয়েছে অমল চন্দ ও কল্যাণ সেন। এই সাহিত্যগোষ্ঠীর তৃতীয় সদস্য রমানাথও চলে গেল এবার। বাকি পাঁচজন আমরা আজও আছি, কাল কে চলে যাবে কে জানে!
রমানাথের কথা বলতে গেলে প্রথমেই ছোটো পত্রিকার কথা বলতে হবে, তারপর বলতে হবে সাহিত্য-আন্দোলনের কথা। বলা যেতে পারে, এই দুটি পর্বেই লেখক রমানাথের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য গড়ে উঠেছিল ধীরে ধীরে। তার স্বভাবধর্মও বিকশিত হওয়ার পথ খুঁজে পেয়েছিল ওই সময়েই।
আমাদের গল্প-আন্দোলন চলার সময়ই বড়ো পত্রপত্রিকায় লেখার ডাক পেয়েছিলাম আমরা। আস্তে আস্তে কলকাতার সব বড়ো পত্রিকার নিয়মিত লেখক হয়ে উঠেছিল ‘এই দশক’ পত্রিকাগোষ্ঠীর লেখকরা। কিন্তু এদের কেউই বহুলপ্রচারিত পত্রিকায় লিখতে এসে নিজেদের স্বভাবধর্ম বিসর্জন দেয়নি।
রমানাথের সাহিত্যজীবন চলেছে ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে। আনন্দের কথা, দীর্ঘ এই সাহিত্যজীবন ছিল ছেদহীন। জীবনে ওঠাপড়া সব মানুষের জীবনেই কমবেশি হয়ে থাকে। রমানাথও ব্যতিক্রম নয়, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ও সাহিত্য থেকে সরে আসেনি। সাহিত্যের প্রতি ওর ভালোবাসা ছিল নিখাদ, সাহিত্যকে ওর আশ্রয়স্থলও বলা যেতে পারে। বেঁচে থাকার, লড়াই করার রসদও ওকে জোগাত সাহিত্য। একান্তই সাহিত্যপ্রাণ মানুষ বলতে যা বোঝায়, তাই ছিল রমানাথ। আজীবন ও আদ্যোপান্ত একটি সাহিত্যজীবন যাপন করে গিয়েছে। লেখার ব্যাপারে রমানাথ খুব পরিশ্রমী ছিল বরাবরই। স্রোতের বিপরীত দিকে সাঁতার কাটার ঝোঁক সেই গল্প-আন্দোলনের যুগ থেকেই ছিল। গভীর ভাবে বিশ্বাস করত, একজন লেখককে অনুকারী হলে চলবে না। তাকে নিজস্ব পথ আবিষ্কার করতে হবে। স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর অর্জন করতে হবে। নিরন্তর অন্বেষণে নিজের আলাদা পথ খুঁজেও পেয়েছিল রমানাথ।
দীর্ঘকাল ধরে যে লেখক নিরলস ভাবে লিখে চলেছে, তার লেখায় পর্বান্তর আসবেই। সময়, অভিজ্ঞতা, মেলামেশা, সমাজজীবনের নানা তরঙ্গের ছাপ পড়ে তার লেখায়। রমানাথেরও পড়েছিল। কৌতুক, ব্যঙ্গ, বিদ্রুপের ওপর রমানাথের একটা স্বাভাবিক ঝোঁক ছিল লেখকজীবনের শুরু থেকেই; পরবর্তীকালে তা আরও গভীর, শাণিত ও তির্যক হয়ে উঠেছিল। তথাকথিত বাস্তবতা ও ফ্যান্টাসির ভেদরেখাও মানত না সব সময়। সম্পূর্ণ বিপরীত দুটি এলাকা কখনো-কখনো গল্পের প্রয়োজনে মিশে যেত একটি বিন্দুতে এসে।
প্রথম যৌবনে প্রকাশিত প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ক্ষত এবং অন্যান্য গল্প’-তে রমানাথ নিজের শ্রেণির আভাস দিতে পেরেছিল। ওর প্রকৃত আত্মপ্রকাশ হয়েছে বলা যেতে পারে ‘বলার আছে’ গল্পসংকলন থেকে। এই সংকলনটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘শাস্ত্রবিরোধী গল্প-আন্দোলন’ চলার সাত-আট বছরের মাথায়। ওর লেখকজীবনের আরও একটি পর্বের সূত্রপাত হয়, বলা যেতে পারে, ‘ছবির সঙ্গে দেখা’ উপন্যাসটির রচনাকাল থেকে।
সাম্প্রতিক কালের রচনায় রমানাথ ‘আখ্যায়িকা’কে নতুন ভাবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল। ডিটেলসের ব্যবহার নামমাত্র। তার ফলে মাত্র দুটি বা তিনটি বাক্যের মধ্যে ঘটনাক্রম অনেকখানি এগিয়ে যেত। সঙ্গে ছিল ওর স্বাভাবিক কৌতুকপ্রবণতা, প্রয়োজনে সেখানে মিশত ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ; লিখনভঙ্গিও হয়ে উঠত তির্যকও সহজ-সরল। সহমর্মিতাও ছিল ওর গল্প,উপন্যাসের একটি বড়ো সম্পদ।
রমানাথের গল্পসংখ্যা প্রায় আড়াইশো, উপন্যাস লিখেছে গোটা-পনেরো, সাহিত্যবিষয়ক প্রবন্ধও আছে বেশ কিছু। আছে ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’, ‘গল্পসমগ্র’ এবং অন্যান্য বইপত্র। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সহৃদয় পাঠকদের ভালোবাসা পাবে রমানাথ দীর্ঘদিন, এবং বাংলাসাহিত্যও এই লেখককে মনে রাখবে।
কিছুদিন আগেই রমানাথ রায়ের নিজের একটি লেখায় রেমঁ কনোর লেখা এক্সারসাইজ ইন স্টাইল বইটির কথা জানলাম। বইটিতে একটি অকিঞ্চিতকর ঘটনাকে ৯৯ রকম ভাবে বর্ণনা করেছেন কনো।
ঐ লেখাতে রমানাথ রায় লিখেছেন, " অর্থাৎ একটা ঘটনা কেবল একই রূপের মাধ্যমে বেরিয়ে আসতে পারে তা নয়। নানা রূপে তাকে প্রকাশ করা যায়। এই শিক্ষাটি অন্তত আমাদের এখানে দরকার। কারণ আমাদের এখানে লেখকেরা মনে করেন যে, যেটা একবার লেখা হয়ে গেল সেটাই একমাত্র রূপ, সেটাই চুড়ান্ত রূপ। "
লেখাটি পড়ার পর রমানাথ রায়ের লেখার দর্শন খানিক উপলব্ধি করেছি মনে হয়।
-শেখর বসুর এই লেখাটি পড়তে গিয়ে মনে এল।
চূড়ান্ত
রমানাথ রায়ের গদ্যের সঙ্গে পরিচয় প্রায় পাঁচ দশক। তিনি যে অন্যদের থেকে 'আলাদা', সেটা অনুচ্য মহিমায় সারা লেখা জুড়ে ছড়িয়ে থাকতো। নতুন কলমচি'দের তাঁর গদ্যের গড়ন থেকে শেখার আছে বহু কিছু। সংক্ষিপ্ত, কিন্তু মনোগ্রাহী লেখাটির জন্য শেখরদাকে অনেক ধন্যবাদ।