অনেক চিন্তাবিদই প্রস্তাব করেছেন যে পৃথিবী আসলে একটা পরীক্ষাগার। খুব উন্নত কোনো সভ্যতা আড়াল থেকে, বহুদূর থেকে দেখছে ও লক্ষ্য রাখছে মানুষ বা মানব-সভ্যতা ঠিক কী-ভাবে পৃথিবীর সব রিসোর্সগুলি নিঃশেষিত করে ফ্যালে এবং ঠিক কোন পর্যায়ে গিয়ে শুক্রগ্রহের মতো বা তার থেকেও উত্তপ্ত একটি অগ্নি-গোলোকে রূপান্তরিত হয় সুজলা-সুফলা এই পৃথিবী! হাইপোথেটিক্যালি-ও যদি এরকম একটি পরীক্ষার ধারণা আমরা করি, আমার নিজের ধারণা আমরা এই 'পরীক্ষা'-র একদম শেষ পর্যায়ে আছি। ঠিক কত মিটার সমুদ্রের জল বাড়লে কলকাতা জলমগ্ন হয়ে যাবে, এ কথা অনেকেই জানেন। অনেকেই জানেন বঙ্গোপসাগরের জলতল সেই পরিমাণ বাড়তে এখনকার উষ্ণায়নের হারের ভিত্তিতে আর ঠিক কত সময়ের দরকার। পুজোর সময় সে সব অলুক্ষনে আলোচনায় আমি যাচ্ছি না। অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না সত্যি কিন্তু কিছুক্ষণ unaware থাকা যায় নিঃসন্দেহে। যাক এসব কথা, মূল প্রসঙ্গে আসি। যদি সত্যিই এমন কোনো এক্সপেরিমেন্ট হয়, তবে সেই প্রাণ বা বুদ্ধিমত্তা তো মানুষের থেকে অনেক উচ্চতর হবে সন্দেহ নেই। কিন্তু মানুষই যদি এরকমই একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে চায় মানুষের তুলনায় অনেকগুণ মনুষ্যেতর প্রাণীর উপর? ভাবনাটি যুগান্তকারী সন্দেহ নেই। অনেকেই বলবেন, এরকম কোনো পরীক্ষা যে মানুষের উপরে হচ্ছেই, পৃথিবীটাকে পরীক্ষাগার করে, তার তো নিশ্চিত কোনো প্রমাণ নেই। হ্যাঁ নেই, কিন্তু মানুষ যদি মনুষ্যেতর কোনো প্রাণীর জন্য একটা ইউটোপিয়ান পৃথিবী সৃষ্টি করে এবং অবজার্ভ করে, সেই স্টাডি অন্তত ‘আদর্শ’ পৃথিবীতে সামাজিক পতনের ব্যাখ্যার জন্য একটি মডেল হিসাবে ব্যবহৃত হতে পারে; ঠিক না?
এক্সপেরিমেন্ট "ইউনিভার্স ২৫"। তো এবার দেখা যাক, কী সেই এক্সপেরিমেন্টে। এক্সপেরিমেন্ট করা হয়েছিল ইঁদুরের উপর, বা বলা ভালো ইঁদুরের সমাজ-ব্যবস্থার উপর। করেছিলেন অ্যামেরিকার বিজ্ঞানী জন ক্যালহোন (John Calhoun)। পদ্ধতিগত দিক থেকে জন ক্যালহোনের এই এক্সপেরিমেন্ট ছিল অত্যন্ত সরল এবং বোধ্য।
উঁনি ইঁদুরের জন্য এক 'আদর্শ পৃথিবী' বা ‘রডেন্ট ইউটোপিয়া’ তৈরি করেছিলেন, যেখানে ইঁদুরেরা প্রজনন করবে এবং "lived happily ever after"। ইঁদুরের জন্য এ এমন এক ‘স্বর্গ’, যেখানে থাকবে অঢেল খাদ্য ও পাণিয় এবং উপযুক্ত পরিবেশ। থাকবে এমন তাপমাত্রা যা ইঁদুরের খুবই পছন্দ (+20 ° C) । প্রতি সপ্তাহে ট্যাঙ্কটি পরিষ্কার করার ব্যবস্থা হবে এবং প্রয়োজনীয় সমস্ত সুরক্ষা ব্যবস্থা নেওয়া হবে: ট্যাঙ্কে যাতে শিকারিদের উপস্থিতি বা ব্যাপক সংক্রমণের সম্ভাবনা দূর হয়। অর্থাৎ সম্পূর্ণ কন্ট্রোল্ড এনভায়রনমেন্ট কিন্তু 'মনুষ্যেতর' ইঁদুরের সে বিষয়ে কোন 'মাথা-ব্যথা' থাকবে না। ক্যালহোন একদম প্রথমে চার জোড়া ইঁদুর দম্পতিকে এই ইঁদুরের স্বর্গে রাখলেন এবং খুব স্বাভাবিক ভাবেই অল্প সময়ের মধ্যে এরা যথেচ্ছ পরিমাণে ও দ্রুতগতিতে প্রজনন শুরু করে দিল। উল্লেখযোগ্য ভাবে ৩১৫ দিন পর এদের প্রজননের হার হ্রাস পেতে শুরু করে। যখন ইঁদুরের সংখ্যা ৬০০-তে পৌঁছল, তখন এই ইঁদুরদের মধ্যে একটা হায়ারার্কি তৈরি হল এবং তথাকথিত 'দুঃখী-আত্মা' ইঁদুরের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেল। ক্রমে ধেড়ে ইঁদুরেরা দলের ছোট ইঁদুরগুলিকে আক্রমণ করতে শুরু করল। আর এভাবে প্রচুর পুরুষ ইঁদুর মারা পড়ল। পুরুষ ইঁদুরগুলি দ্রুত মারা যাবার ফলে, মেয়ে ইঁদুরগুলিও প্রথমে নার্ভাস ও পরে হিংস্র হয়ে উঠল এবং অল্পবয়সী ইঁদুরগুলিকে আক্রমণ করতে শুরু করল। এই সময় থেকেই মেয়েরা আরো প্রজননে অনুৎসাহী হয়ে পড়ল এবং ‘শিশুমৃত্যু’-র হার অত্যন্ত বৃদ্ধি পেল।
এখান থেকেই দুটি নতুন ইঁদুর-শ্রেণীর উদ্ভব হল, যাদেরকে আমরা বলতে পারি ‘সুদর্শন-পুরুষ’ ও ‘নিঃসঙ্গ-নারী’। ক্রমে দেখা গেল, এই ‘সুদর্শন-পুরুষ’ ইঁদুর আর যৌনমিলনে উৎসাহী নয়। এরা শুধুমাত্র খেতে আর ঘুমোতে আগ্রহী। মেয়েরাও ক্রমে আরও বেশি বিচ্ছিন্ন হতে শুরু করল নিজ নিজ গোষ্ঠীর ভিতর। জুভেনাইল-মর্টালিটির হার বেড়ে গেল ভীষণ ভাবে এবং ‘সুদর্শন-পুরুষ’ ও ‘নিঃসঙ্গ-নারী’-রাই সংখ্যাগুরু হয়ে উঠল। ফলে দ্রুত প্রজনন-ক্ষম ইঁদুরের সংখ্যা কমতে থাকল। এরপর একটা সময় এল, পুরো ক্লাস্টারটাই সম্পূর্ণ প্রজনন-শূন্য হয়ে পড়ল। আর জুভেনাইল মর্টালিটির হারও ১০০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছল। এই সময় এই ইঁদুর-প্যারাডাইসে হোমাসেক্সুয়ালিটি এবং খাদ্যের প্রাচুর্য সত্ত্বেও আশ্চর্যজনকভাবে ক্যানাবলিজমও লক্ষ্য করা গেল। প্রথম এক্সপেরিমেন্ট শুরু হবার ১৭৮০ দিন পর ‘ইঁদুর-স্বর্গ’-এর শেষ ইঁদুরটি মারা গেল।
যদিও প্রথম প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই ভীষণ ভাবে বিতর্কিত, ক্যালহোনের ‘ইউনিভার্স 25’ (বা "রডেন্ট ইউটোপিয়া প্রকল্প") তত্ত্বটি অন্তত সামাজিক বিপর্যয় ও অবশেষে মানব জাতির গতিপথ সম্পর্কে একটা রূপক হিসাবে কাজ করতেই পারে। যদিও ‘বিতর্কিত’ তবু এই সত্যি উপেক্ষা করা কঠিন, যে ক্যালহোন এই একই এক্সপেরিমেন্ট ২৫ বার করেছেন আর প্রত্যেকবার একই রেজাল্ট হয়েছে।