এই গবেষণার একদিকে জনহিতকর চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী সুপ্রভাবের সম্ভাবনা ও অন্যদিকে এ নিয়ে ওঠা নানা নৈতিক প্রশ্নের কথা ভেবে এ বিষয়ে দুটি আলোচনা রাখা হল। লিখছেন কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় ও সাগরময় ঘোষ।
বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে জীববিদ্যার একটি প্রধান গবেষণার দিক হল কীভাবে কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের জিনগত গঠন পরিবর্তন করা যায়। এই প্রচেষ্টার ভালো ও মন্দ উভয়দিকই সমান গুরুত্বপূর্ণ। ২০২০ সালের রসায়নের নোবেল পুরস্কার এই বিতর্ককে আবার নতুন করে উসকে দিয়েছে। শুরুতেই একটু দেখে নেওয়া যাক, ওনাদের আবিষ্কারটা আসলে ঠিক কী। খুব বৈজ্ঞানিক জটিলতার মধ্যে না গিয়ে বলা যায় যে-কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীর যে-কোনো জিনগত গঠন তিন ধরনের প্রক্রিয়ার সাহায্যে বদল করা যেতে পারে। এই প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে সহজতম হল CRISPR-Cas9, যেটিকে প্রয়োগোপযোগী করার জন্য এবারের নোবেল পুরস্কার পেলেন এমানুয়েল শারপেনতিয়ের ও জেনিফার ডাউডনা। যে তিন ধরনের প্রক্রিয়ার কথা বললাম, তার প্রত্যেকটিই কিন্তু কোনো না কোনো ভাবে এককোশী ব্যাকটেরিয়ার মধ্যে পাওয়া যায় এবং প্রত্যেকটিরই ছোটোখাটো কিছু অদলবদল করে তাকে বহুকোশী প্রাণী বা উদ্ভিদের জিনের পরিবর্তনের কাজে ব্যবহার করা হয়। এই দুই বিজ্ঞানীর প্রধান সাফল্য হল যে তাঁরা এই CRISPR-Cas9 পদ্ধতিটিকে এত সুন্দর ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, এটিকে এখন যে-কোনো প্রাণী বা উদ্ভিদের জিনের বদল করবার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রাসঙ্গিক ভাবে এটিও খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে ২০১৫ সালের রসায়নের নোবেল পুরস্কারও কিন্তু ক্রোমোজোমের মধ্যে অবস্থিত ডিএনএ অণুর মেরামতির পথনির্দেশকারী গবেষণার উপর দেওয়া হয়েছিল। আসলে এই দুটি কাজই কিন্তু একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং এত কম সময়ের মধ্যে এদের স্বীকৃতি, জীববিদ্যার গবেষণার নতুন দিশার সম্বন্ধে একটা নির্দিষ্ট ইঙ্গিত দেয়, এটা মনে করা যেতেই পারে।
এক দিক্পাল বিজ্ঞানী সিডনি ব্রেনার একবার বলেছিলেন, বিজ্ঞানের অগ্রগতির প্রয়োজনীয় শর্ত হল, যখন তিনটি ঘটনা এই নির্দিষ্ট ক্রমে ঘটে—নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন, নতুন আবিষ্কার ও নতুন চিন্তা। CRISPR-Cas9 প্রযুক্তির বিকাশ ইতিমধ্যেই কৃষি ও স্বাস্থ্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহুল আবিষ্কার ও চিন্তার সৃষ্টি করেছে ও আগামী দিনে আরও করবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি নতুন ধারণার কথা যার পোশাকি নাম হল ‘জিন ড্রাইভ’। এটি আসলে বেশ কয়েকটি জিনের সমষ্টি, যা CRISPR-Cas9 প্রক্রিয়ার সাহায্যে খুব সহজেই বিভিন্ন জীবের মধ্যে নিয়ে আসা যেতে পারে এবং এই জিন ড্রাইভ আস্তে আস্তে সেই প্রজাতির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়বে। এর ফলে যে-কোনো প্রাণী যার কাছে কোনোদিনই এই জিনগুলি ছিল না, তাদের মধ্যে এদের ঢুকিয়ে দেওয়া যেতে পারে। এই পদ্ধতির সাহায্যে পরীক্ষামূলক ভাবে মশার সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে এবং পৃথিবীর যে সমস্ত অংশে মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব রয়েছে, সেখানে অবশ্যই এর ফলে অনেক সহজে মশাবাহিত বহু রোগ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। অথবা ধরা যাক বিভিন্ন গবাদি পশুর কথা। এই জিন ড্রাইভ বা CRISPR-Cas9 প্রযুক্তির সাহায্যে কিন্তু এদের বেশি পেশিবহুল করা সম্ভব যা অর্থনৈতিক ভাবে খুবই প্রতিশ্রুতিজনক। বা ধরুন সয়াবিন, এর মধ্যে তৈলজাতীয় পদার্থের পরিমাণ এই পদ্ধতির সাহায্যে ইতিমধ্যেই বাড়ানো সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু মানুষের সভ্যতার অভিজ্ঞতা আসলে অন্য কথা বলে। স্বয়ং নোবেল সাহেবের বানানো ডিনামাইট বলুন বা পারমাণবিক শক্তি। অথবা ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ। কোনোটিই কিন্তু অসৎ উদ্দেশ্যে তৈরি হয়নি। এ ছাড়াও, আর্য রক্ত দিয়ে মানুষের মধ্যে ভেদাভেদ, অথবা একান্ত ভারতীয় ধারণার জাতি ও বর্ণভেদ, আমাদের মানবসভ্যতার ইতিহাস তো অনেক ক্ষেত্রেই খুব গৌরবজনক নয়। কাজেই সতর্ক ও সাবধান হওয়ার প্রয়োজন অবশ্যই আছে। একটা কথা মাথায় রাখবেন, প্রযুক্তি চলে এলে, তার পরবর্তী ধাপগুলো কিন্তু খালি সময়ের অপেক্ষা। কাজেই মূল প্রশ্ন হল, এই প্রযুক্তির ব্যবহার কোথায় হবে বা কীভাবে হবে, সেটা কে ঠিক করবে। এখনও এই CRISPR-Cas9 প্রযুক্তি মানুষের জন্য ব্যবহারোপযোগী হয়ে ওঠেনি, কিন্তু সামনের এক দশকের মধ্যে হয়তো হয়ে উঠবে। তখন কেউ যদি বলেন অ্যালঝাইমার, মাংসপেশির ভাঙন বা হান্টিংটন রোগের বিরুদ্ধে একে ব্যবহার করা হবে, কেউ আপত্তি করবেন না। কিন্তু যদি বলা হয়, আপনার উচ্চতা বা গাত্রবর্ণ, সেটাও CRISPR-Cas9 দিয়ে বদল করা হবে, তখন?
যে-কোনো চিকিৎসাপদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, যার চিকিৎসা হচ্ছে তিনি সেই পদ্ধতিতে সায় দিচ্ছেন কি না বা তিনি সেটিকে প্রয়োজনীয় মনে করছেন কিনা। আসলে জাতিগত প্রাধান্যের তত্ত্ব মানুষের মনে এমন গভীরভাবে প্রোথিত তাই এই প্রশ্নের অবতারণা। কোনো ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী বা জনজাতি যদি নিজেদের জিনের গঠন প্রকাশ্যে বা গোপনে পরিবর্তন করতে চায়, কে তাকে নিয়ন্ত্রণ করবে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হল, কোনো অর্থনৈতিক গোষ্ঠী এই প্রযুক্তির সুফল ভোগ করবে? আলোচনার খাতিরে ধরে নেওয়া যাক, ডায়াবেটিস রোগ নিরাময় CRISPR-Cas9 বা এই ধরনের জিন প্রযুক্তির সাহায্যে একদিন সম্ভব হল, কিন্তু সেই চিকিৎসা কি সাধারণ মানুষের আয়ত্তের মধ্যে থাকবে?
বর্তমানের ক্যানসার চিকিৎসার খরচের সঙ্গে তুলনা করলে বিষয়টি স্বচ্ছ হবে। খেয়াল করবেন, ক্যানসার চিকিৎসা কিন্তু এখন বহুমাত্রিক—একদল মানুষ নিজেদের ঘটিবাটি বেচে বা সরকারি অনুদানে সরকারি হাসপাতাল বা মাঝারি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করান। আর-এক দল অপেক্ষাকৃত বিত্তবান মানুষ একই ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য কিন্তু ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট কিছু হাসপাতাল বা সিঙ্গাপুর অথবা নিউইয়র্ক যান। কারণ কী? বিভিন্ন ক্যানসারের যে নতুন প্রজন্মের ওষুধ, তার খরচ এতটাই যে সেটি ভারতের জনসংখ্যার একটা স্বল্প ভগ্নাংশের মানুষই একমাত্র বহন করতে পারেন। মনে হতে পারে, জিন প্রযুক্তির আলোচনা করতে বসে এই শিবের গাজন কেন গাইছি। আসলে ভারতবর্ষের জনসংখ্যা এত বেশি যে তার মধ্যে এই স্বল্প ভগ্নাংশ উচ্চবিত্ত মানুষ, তার আসল সংখ্যাটা কিন্তু খোদ ইউরোপের জনসংখ্যার থেকে বেশি। এ ছাড়া, ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশ খুব তাড়াতাড়ি তাকে প্রথম বিশ্বের দেশ বানিয়ে ফেলছে, অথচ অন্যান্য প্রথম বিশ্বের দেশের মতো তার কাছে সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য উপযুক্ত নিরাপত্তা থাকছে না। ফলে জাতপাতভিত্তিক, আধাসামন্ততান্ত্রিক আমাদের সমাজে জিন প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার কিন্তু ভবিষ্যতে মারাত্মক এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে।
সমস্যার কিন্তু এখানেই শেষ নয়, এটা আসলে শুরু। যেটা একেবারেই দোরগোড়ায়, সেটা হল কৃষিক্ষেত্রে এই জিন প্রযুক্তির ব্যবহার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে জিন পরিবর্তিত (GMO) উদ্ভিদের ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক ও আইনি টানাপোড়েন অব্যাহত। ইউরোপীয় কোর্ট অফ জাস্টিস, ২০১৮ সালে তাদের রায়ে CRISPR-Cas9 দিয়ে পরিবর্তিত বিভিন্ন বীজের ক্ষেত্রে GMO-র ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সমস্ত নিয়মকানুন একইরকম ভাবে প্রযোজ্য হবে বলে রায় দিয়েছেন। এর ফলে সামগ্রিক ভাবে আজই এইসব বীজ বাজারে না এলেও CRISPR-Cas9 এর মতো শক্তিশালী প্রযুক্তির ব্যবহার অনেক তাড়াতাড়ি অনেক বেশি নতুন GMO বীজ তৈরি করবে। বর্তমানে CRISPR-Cas9 প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন শস্য কিন্তু অন্যান্য GMO তৈরিকারী প্রযুক্তির মতো বাইরের কোনো জিন নতুন প্রজাতির মধ্যে নিয়ে আসে না বরং সেই প্রজাতির কোনো জিনকে বাদ দেয় বা তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন ঘটায়। এই ঘটনাটি স্বাভাবিক ভাবেও ঘটতে পারত কিন্তু CRISPR-Cas9 সেই ঘটনাটিকে শুধুমাত্র ত্বরান্বিতই করেনি, তাকে একটি পূর্ব নির্দিষ্ট জায়গার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে। এর ফলে অন্যান্য GMO শস্যের পরিবেশগত প্রভাব নিয়ে যে বিতর্ক, সেটি এই ক্ষেত্রে অনেকটাই অপ্রযোজ্য। এখানে একটা কথা বলে রাখা প্রয়োজন, GMO শস্যের পরিবেশগত প্রভাব কিন্তু একটি বিতর্কিত বিষয়। যেখানে মূল আপত্তি, তা হল প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলোর অর্থগৃধ্নুতা ও তাদের সাধারণ কৃষিজীবীদের শোষণ করার মনোভাব। এ ছাড়াও শুধুমাত্র বাজারকেন্দ্রিক মানসিকতায় CRISPR-Cas9 প্রযুক্তির প্রয়োগ কিন্তু ভবিষ্যতে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর সঙ্গে অন্যান্য দেশের জীবনযাত্রার ও খাদ্যাভ্যাসের এক বিস্তর ফারাক তৈরি করবে।
উপরের আলোচনা থেকে একটা জিনিস খুব পরিষ্কার। জিনের গঠনের পরিবর্তনের যে বিজ্ঞান তা আজ মানুষের হাতের মুঠোয় কিন্তু মূল প্রশ্ন তার বাস্তব প্রয়োগ নিয়ে। কীভাবে নিরাপদ ও উপযুক্ত ভাবে এই প্রযুক্তি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, সেটাই আসল বিবেচ্য। দুর্ভাগ্যবশত বর্তমানে এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ ভাবেই বাজার নিয়ন্ত্রিত, যাদের আসল প্রয়োজন সেই সব মানুষের অবস্থান নিতান্তই গৌণ। আন্তর্জাতিক ভাবে এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য ঐকমত্য তৈরি না করতে পারলে জিন প্রযুক্তির অনৈতিক ব্যবহার অচিরেই অন্যান্য শক্তিশালী আবিষ্কারের মতো তার অপপ্রয়োগ অবশ্যম্ভাবী করে তুলবে।
আরও কিছু লিখুন এর বিষয়ে