এই গবেষণার একদিকে জনহিতকর চিকিৎসার ক্ষেত্রে সুদূরপ্রসারী সুপ্রভাবের সম্ভাবনা ও অন্যদিকে এ নিয়ে ওঠা নানা নৈতিক প্রশ্নের কথা ভেবে এ বিষয়ে দুটি আলোচনা রাখা হল। লিখছেন কাঞ্চন মুখোপাধ্যায় ও সাগরময় ঘোষ।
কথায় বলে, ললাট লিখন না যায় খণ্ডন। জীবনের প্রথম অধ্যায়েই নাকি বিধাতা স্বহস্তে সবার ভাগ্য লিখে দেন এবং তাহাই ধ্রুব। এমনটাই তো মিথ। রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমির মতে দুই বিজ্ঞানী জীবনের কোড নতুন করে লিখে ফেলেছেন। জিন মিউটেশন বা ডিএনএ ক্রমবিন্যাসে বিপর্যয়কে যদি বিধাতার ভ্রম বলে ধরে নেওয়া যায় তবে সে ভ্রান্তি এখন শোধরানো সম্ভব। আর সে পথই দেখিয়েছেন এই দুই মহিলা-বিজ্ঞানী।
ক্রিসপার (CRISPR—Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Sequence) যে নোবেল প্রাইজ আনবে সে নিয়ে বিজ্ঞানীমহলে গুঞ্জন ছিল অনেকদিনের। কিন্তু জানাছিল না কার ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে। ন্যায্য দাবিদারও ছিলেন অনেকে। শেষমেষ এমন দুজনের হাতে পুরস্কার উঠল যাঁরা নয়া প্রযুক্তিকে গবেষণাগারের ঘেরাটোপ থেকে উপরে এনে জনহিতে কাজে লাগাতে পেরেছেন। একজন মার্কিন নাগরিক জেনিফার ডাউডনা, বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত। অন্যজন ইমানুয়েল শারপেনতিয়ের, জন্মসূত্রে ফরাসি নাগরিক কিন্তু বর্তমান ঠিকানা বার্লিন।
প্রকৃতি থেকে শিক্ষা
ব্যাকটেরিয়া শব্দটা শুনলেই যদি ক্ষতিকারক রোগজীবাণুর কথা মনে পড়ে তাহলে এবার ধারণা পালটানোর সময় এসেছে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এই জীবাণুবর্গেরও শত্রু আছে। তাদেরও লড়াই করে বাঁচতে হয় ভাইরাসের বিরুদ্ধে। আর এই রণকৌশলই আজ আমাদের হাত শক্ত করেছে। ব্যাকটেরিয়ার প্রাকৃতিক রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার পোশাকি নাম CRSPR/Cas9 যার সফল প্রয়োগে নির্ভুলভাবে শুধু অণুজীব কেন, উদ্ভিদ বা প্রাণীশরীরের DNA-ও ইচ্ছামতো পালটে ফেলা যায়।
জিন প্রযুক্তি কোনো নতুন কথা নয়। চলে আসছে সেই ১৯৭০-এর দশক থেকে। অবশ্যই ধাপে ধাপে উন্নতির সাক্ষ্য রেখে। জেনিফার এবং ইম্যানুয়েলের যুগান্তকারী আবিষ্কার আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে জিন প্রযুক্তির সবচেয়ে ধারালো অস্ত্র। যাকে বাংলায় জিন-কাঁচিও (Genetic scissors) বলা যেতে পারে। এর প্রয়োগে একদিকে যেমন দুরারোগ্য ক্যানসার নিরাময়ের সম্ভাবনা অন্যদিকে বেশ কিছু বংশগত রোগ যেমন থ্যালাসেমিয়া, সিস্টিকফাইব্রোসিস ইত্যাদি রোগের হাত থেকেও হয়তো আমরা মুক্তি পেতে চলেছি।
শার্পেনতিয়ের এবং ডাউডনার বিশেষ অবদান
CRSPR/CAS9 নিয়ে গবেষণা চলেছে অনেক বছর ধরেই। তবে এই দুজনই প্রথম দেখাতে পেরেছেন পদ্ধতিটি প্রোগ্র্যামযোগ্য। অর্থাৎ কোন্ জিন মিউটেশনকে আমরা ‘কাট’ করব এবং কাকে ‘পেস্ট’ করব তা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আর এই বিশাল ক্ষমতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মানবকল্যাণের বিপুল সম্ভাবনা। একদিকে এই আবিষ্কার যেমন বুনিয়াদি বিজ্ঞানবোধের মূল ধরে নাড়িয়ে দেয়, ঠিক তেমনই হাজির হয় উন্নত ফসল, উন্নত চিকিৎসার রঙিন স্বপ্ন।
ইমানুয়েল শার্পেনতিয়ের কাজ করেছিলেন Streptococcus pyogenes নামে এক ব্যাকটেরিয়ার ওপর, যার নাম শুনলেই মানবশরীরে নানা রকম সংক্রমণের কথা মনে পড়ে। আজ থেকে বছর দশেক আগে এই ব্যাকটেরিয়ার উপর ইমানুয়েল আবিষ্কার করেছিলেন tracrRNA নামে এক সম্পূর্ণ নতুন অণুকণা যা ব্যাকটেরিয়ার সাবেক রোগ প্রতিরোধ পদ্ধতি CRISPR/Cas9-এরই একটি অংশ। এদের সম্মিলিত কার্যক্রমে হানাদার ভাইরাস হয়ে পড়ে অস্ত্রহীন, কারণ তার নিজস্ব DNA ভেঙে যায়।
CRISPR-Cas9 নামক ইমিউন সিস্টেমের দুটি অংশ। প্রথমটি হল একটি ছোট্ট RNA Sequence (tracrRNA) যা কিনা টার্গেট DNA মিউটেশনের সাথে লেপটে যায়। অন্য অংশটি হল Cas9 নামে একটি অনুঘটক যাকে এমন একটি আণবিক কাঁচি হিসাবে ভাবা যেতে পারে, যে ক্ষতিকারক মিউটেশনটিকে নিখুঁত ভাবে কেটে ফেলতে পারে। কর্তিত অংশে স্বাস্থ্যকর DNA অংশ কৃত্রিমভাবে বসিয়ে দেওয়া যেতে পারে অথবা প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে সেই ক্ষত সেরে ওঠে।
২০১১ সালে ইমানুয়েল জোট বাঁধলেন জেনিফার ডাউডনার সাথে। জেনিফার তখন অতলান্তিকের অপর পারে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্কলে ক্যাম্পাসে গবেষণারত বায়োকেমিস্ট। DNA-র তুতো-ভাই RNA সম্পর্কে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য। দুই অসামান্য বিজ্ঞানীর যৌথ প্রচেষ্টায় ব্যাকটেরিয়ার জিন-কাঁচি সরলীকৃত হয়ে স্থান পেল ল্যাবরেটরির টেস্টটিউবে। তাঁদের কালজয়ী গবেষণা প্রমাণ করল ব্যাকটেরিয়ার প্রাকৃতিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত ভাবে যে-কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীশরীরে পছন্দমতো প্রয়োগ করা সম্ভব। দিগন্ত প্রসারিত হল মৌলিক গবেষণার। আমরা পেলাম উন্নত গাছের চারা যা কীটপতঙ্গ, ছত্রাক এমনকি প্রবল খরা মোকাবিলাতেও সক্ষম। একটু ফিউচারিস্টিক শোনালেও জন্মান্ধতা, Huntington’s disease-এর মতো বংশগত স্নায়ুরোগ, অচিহ্নিত কারণে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা ইত্যাদির সমাধানও হয়তো আমরা পেতে চলেছি।
জিন থেরাপির নৈতিকতা
এরকম লোভনীয় আবিষ্কার নিয়ে ব্যবসায়ী এবং ব্যবহারকারী সবার মধ্যে হুড়োহুড়ি লেগে যাওয়াই স্বাভাবিক। এখানেও তাই। জিন এডিটিং-এর আরও কিছু পদ্ধতি বাজারে আছে যেমন জিংক ফিঙ্গার। কিন্তু তারা অনেক জটিল ও ব্যয়বহুল। নোবেলজয়ীদের আবিষ্কৃত জিন-কাঁচি তুলনায় অনেক সহজ সরল এবং খরচও অবিশ্বাস্য রকমের কম। বলা যায় জিন থেরাপির গণতন্ত্রীকরণ হল দুই মহিলা-বিজ্ঞানীর হাত ধরে। অবশ্য এত সুখবরের মধ্যেও সম্ভাব্য অপব্যবহারের চিন্তা এসে যায়। DIY (Do It Yourself)-এর যুগে যথাযথ নিয়ন্ত্রণ না থাকলে বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে প্রাকৃতিক ভারসাম্যে। হয়তো কোনোদিন অ্যামাজন, পতঞ্জলিকে অনলাইনে লাইফকোডও বিক্রি করতে দেখা যেতে পারে।
২০১৮-র নভেম্বর। হে জিয়ানকুই নামে এক জিন বিশেষজ্ঞ একজোড়া যমজ কন্যার জিন পালটে দিয়েছেন বলে শোনা গেল। জিয়ানকুই দাবি করেছিলেন CRISPR-Cas9-এর প্রয়োগে ভ্রূণ অবস্থায় তিনি এমন ‘জিন সার্জারি’ করতে সক্ষম হয়েছেন যার ফলে এই দুজনের কখনও HIV সংক্রমণ সম্ভব নয়। বাচ্চা দুটি অন্য সবদিক থেকে সুস্থ বলেও তিনি দাবি জানান। ঘটনার সত্যাসত্য খুব বেশি জানা যায়নি, কারণ ঘটনাস্থল যে চিনদেশ! তবে চাইনিজ এই বিজ্ঞানীর কপালে তিন বছরের কারাবাস জুটেছে বলে শোনা যায়।
‘ডলি দ্য ডিজাইনার শিপ’-এর গল্প মনে পড়ে গেল। ১৯৯৬ সালে স্কটল্যান্ডে ইয়ান উইলম্যাট আর কিথ ক্যাম্পবেল যখন বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত ভেড়ার সৃষ্টি করেন, বিশ্ব জুড়ে ক্লোনিং-এর নৈতিকতা নিয়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছিল। ডলি ছিল প্রথম ক্লোনড স্তন্যপায়ী প্রাণী। তারপর বিভিন্ন দেশে গবেষণা ও ক্লোনিং-এর সফল প্রয়োগ আরও বেড়েছে। যতদূর জানা আছে এখন অবধি হিউম্যান ক্লোনিং অবৈধ। তবে এই নোবেল পুরস্কারের পর প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে আমরা কি তাহলে ডিজাইনার বেবির দিকে আরও এককদম এগিয়ে গেলাম? ভবিষ্যতের স্বচ্ছল মা-বাবা ঠিক করবেন তাঁরা মেরিলিন মনরোর মতো মেয়ে নেবেন না জর্জ ক্লুনির মতো ছেলে। প্রযুক্তির কল্যাণকর প্রয়োগ মানে তো খোদার উপর খোদকারি নয়। দাঁড়ি তো কোথাও টানতে হবে। আশার কথা নোবেলজয়ী দুই বিজ্ঞানীই অপব্যবহার রোখার প্রশ্নে এককাট্টা। অন্তত পুরস্কার ঘোষণার পর তাঁরা যে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন সেখান থেকে তাই মনে হয়।
পুরস্কার প্রদানে পক্ষপাতিত্ব?
মেরি কুরি, মাদার টেরেসা, মালালা ইয়ুসফজায়ি-কে ধরে সমগ্র নোবেল প্রাপকের মাত্র পাঁচ শতাংশ মহিলা। এই পরিসংখ্যান কি কোনো বিশেষ বার্তা বহন করে? জানি না। তবে নোবেল কমিটির বিরুদ্ধে প্রচলিত সমালোচনাগুলোর মধ্যে নারীবঞ্চনার অভিযোগও বার বার উঠে আসে। দুই সুযোগ্যা মহিলার অসামান্য কৃতিত্বে হয়তো কমিটির কিঞ্চিৎ পাপক্ষালন হল।
CRISPR-এর পথিকৃত বলতে গেলে আরও কয়েক জনের নাম এসে যায় যেমন, ফেঙ ঝাং (এমআইটি), জর্জ চার্চ (হার্ভার্ড) বা ভিগিনিয়ুস সিক্সনিস (লিথুয়ানিয়া)। নোবেলের ঔজ্জ্বল্যে তাঁদের কৃতিত্ব যেন ঢাকা না পড়ে যায়। এবছর পুরস্কার প্রাপকের তালিকায় ফেং ঝাং-এর নাম না থাকাটা অনেককেই অবাক করেছে। আরও কয়েক বছর পিছিয়ে গেলে মনে হয় ফ্রান্সিসকো মহিকা না থাকলে হয়তো CRISPR শব্দটাই আমাদের কাছে অশ্রুত থেকে যেত। স্পেন দেশের এই মাইক্রোবায়োলজিস্ট ১৯৯৩ সালে হ্যালোফেরাক্স (Haloferax) নামে এক ধরনের জীবাণুর জিনে ডিএনএ-ক্রমের আয়না প্রতিবিম্বসম পুনঃসংগঠন (repetitive palindromic nature) দেখাতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং পরবর্তীকালে এই DNA ক্রম যে বহিরাক্রমণ রুখতে সাহায্য করে সে ব্যাপারেও আলোকপাত করেছিলেন। CRISPR (Clustered Regularly Interspaced Short Palindromic Sequence) শব্দবন্ধও তাঁরই আবিষ্কৃত। তবে নোবেল কমিটির দিকে বেশি আঙুল না তুলে ব্যাপারটাকে হোলিস্টিক ওয়েতেই দেখা ভালো। যে-কোনো বড়ো কাজ থেকে এক, দুই বা তিনজনকে আলাদা করে বেছে নেওয়া খুব কঠিন কাজ। এখানেও পুরস্কারপ্রাপকের দিকে বেশি না তাকিয়ে বিজ্ঞানের দিকেই বেশি তাকানো যাক।
শার্পেনতিয়ের-ডাউডনার কাজ উদ্বুদ্ধ করুক নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল প্রতিশ্রুতিমান গবেষককে। পুরস্কারের গুরুত্ব তো আছেই। আর তা শুধু অর্থ বা খ্যাতির অঙ্কে দেখলে হবে না। সমাজকল্যাণ নিয়ে অনেক কথা বলেছি। এবার বিজয়িনীর বিশেষ প্রাপ্তি নিয়ে বলি। ভার্চ্যুয়াল সংবর্ধনা সভায় ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যমহাশয়া ডাউডনারকে সেদিন একটি সংরক্ষিত কার পার্কিং স্পেস উপহার দিলেন। ১৮ বছর কাজ কারার পর অবশেষে ক্যাম্পাসের ভিতরে গাড়ি রাখতে পেরে তিনিও উল্লসিত!!
বাহারে! কি অপূর্ব সহজ ভাষায় সমগ্র জটিল বিষয়ের ব্যাখ্যা। কাঞ্চনের দ্যুতি আর কি!
জিংক ফিঙ্গার না জিন ফিঙ্গার? খটকা রয়ে গেলো।
জয়ন্তদার (ভট্টাচার্য) মূল্যবান মতামতের জন্য কৃতজ্ঞ।
একটু confusing শোনালেও ওটা Zinc Finger ই। https://en.m.wikipedia.org/wiki/Zinc_finger_nuclease
খুব সুন্দর প্রবন্ধ ।..কাঞ্চন কে অভিনন্দন !
Excellent writing of a complicated thing
Thank you Sir
জিঙ্ক আয়ন দিয়ে প্রোটিন ফোল্ড স্টেবিলাইজড হয় - সেখান থেকেই জিঙ্ক ফিঙ্গার।
চমৎকার লেখা। সাবলীল এবং গুরুত্বপূর্ণ লেখা।
ভালো হয়েছে। জানলাম অনেক কিছু।
লেখা ভালো লাগলো।
Osadharon. Very lucidly explained. I learnt a lot. Daru-un.
সুন্দর ও সহজ ভাবে বর্ণিত !
জটিল বিষয়ের মসৃণ চর্চা। খুব ভালো লাগলো।