“আমাদের অলংকারশাস্ত্রে নয় রসের উল্লেখ আছে, কিন্তু ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে যে রসটি পাওয়া যায়, তাহা শাস্ত্রোক্ত কোনো রসের অন্তর্গত নহে। সদ্যঃকর্ষণে মাটি হইতে যে সৌরভটি বাহির হয়, অথবা শিশুর নবনীতকোমল দেহের যে স্নেহোদ্বেলকর গন্ধ, তাহাকে পুষ্প চন্দন গোলাপ-জল আতর বা ধূপের সুগন্ধের সহিত এক শ্রেণীতে ভুক্ত করা যায় না। সমস্ত সুগন্ধের অপেক্ষা তাহার মধ্যে যেমন একটি অপূর্ব আদিমতা আছে, ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে তেমনি একটি আদিম সৌকুমার্য আছে--সেই মাধুর্যটিকে বাল্যরস নাম দেওয়া যাইতে পারে। তাহা তীব্র নহে, গাঢ় নহে, তাহা অত্যন্ত স্নিগ্ধ সরস এবং যুক্তিসংগতিহীন।”১
‘ছড়া’ আমাদের কাছে অতি পরিচিত একটি বিষয়। কিন্তু এই ছড়ার সংজ্ঞা নির্ণয় ততটা সোজা নয়। এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। যোগেশচন্দ্র রায় তাঁর ‘বাঙ্গালা শব্দকোষ’(২য় খণ্ড)-এ ‘ছড়া’ শব্দটির মূল নির্দেশ করেছেন সংস্কৃত ‘ছটা’ শব্দ থেকে, যার অর্থ ‘পরম্পরা’। আবার হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর “বঙ্গীয় শব্দকোষ” গ্রন্থে ছড়া সম্পর্কে বলেছেন-‘কোনো বিষয় লইয়া রচিত গ্রাম্য কবিতা।’ এরকম ভাবে দেখলে দেখা যাবে যে পণ্ডিতদের মধ্যে ছড়া সম্পর্কে মতভেদের শেষ নেই। তবে প্রায় সকলেই স্বীকার করেছেন যে ছড়া মূলত গ্রাম্য সাহিত্য, মানুষ তাদের বাচিক ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে ছন্দোবদ্ধ ভাবে কথা বা মনের ভাব প্রকাশ করে এই ছড়ার মাধ্যমে। আবার এই ছড়াগুলি পরম্পরায় প্রচলিত ও প্রচারিত। আঞ্চলিক প্রভাবের কারণে এইসব ছড়ার পাঠভেদও দেখা যায়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে এইসব ছড়া গুলি কে, কবে রচনা করলেন তা কেও জানে না, কিন্তু সমাজে এগুলি চিরকাল ধরে প্রচলিত। ব্যক্তিক সৃষ্টির এরকম সার্বিক স্বীকৃতি খুবই বিরল। এই ছড়ার রূপরেখা দেখলে বোঝা যায় প্রায় সব এলাকাতেই ছড়া মূলত দু’রকম- ছেলে ভুলানো ছড়া ও সর্বজনীন ছড়া। এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় ছেলে ভুলানো ছড়া, আরও নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় পুরুলিয়াতে প্রচলিত ছেলে ভুলানো ছড়া।
ছেলে ভুলানো ছড়া সম্পর্কে লোকসংস্কৃতির চর্চায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ এ বিষয়ে বলেছেন-“ভালো করিয়া দেখিতে গেলে শিশুর মতো পুরাতন আর কিছুই নাই। দেশ-কাল শিক্ষা অনুসারে বয়স্ক মানুষের কত নূতন পরিবর্তন হইয়াছে, কিন্তু শিশু শত সহস্র বৎসর পূর্বে যেমন ছিল আজও তেমনি আছে; সেই অপরিবর্তনীয় পুরাতন বারংবার মানবের ঘরে শিশুমূর্তি ধরিয়া জন্মগ্রহণ করিতেছে...। তেমনি ছড়াগুলি শিশুসাহিত্য; তাহারা মানব মনে আপনি জন্মিয়াছে।”২ আসলে রবীন্দ্রনাথ যখন কোনো বিষয় সম্পর্কে তাঁর পরশমণিরূপী লেখনী স্পর্শ করান, তখন তা সোনা হতে আর দেরি লাগে না। এই ছেলেভুলানো ছড়াগুলি পাশ্চাত্যে ‘Nursery rhymes’ বা ‘Mother goose rhymes’ নামে পরিচিত। পাশ্চাত্যে এই ‘Mother goose rhymes’ এর প্রকাশ শুরু হয় অষ্টাদশ শতাব্দীর সময় এবং এর উনবিংশ শতাব্দী নাগাদ এর প্রচার ব্যপক মাত্রায় শুরু হয়। সেখানে এই ছড়াগুলির মধ্যে সমাজ, সংস্কৃতি ও ভাষাকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। পাশ্চাত্যে এই নিয়ে প্রথম লিখিত কাজ “Tommy Thumb’s song Book” (London copper,1744)। রবীন্দ্রনাথের “লোক সাহিত্য” গ্রন্থ প্রকাশিত হওয়ার পর মানুষ এই চর্চাকে আরও বাড়িয়েছে। তাহলে প্রশ্ন ওঠে- এই প্রবন্ধের কারণ কী? কারণ হল পুরুলিয়ায় প্রচলিত ছেলে ভুলানো ছড়া সম্পর্কে সেভাবে আলোচিত বোধহয় এর আগে হয়নি। ‘সীমান্তবাঙলার লোকযান’ গ্রন্থের শেষের দিকে মাত্র দুটি ছেলে ভুলানো ছড়া উল্লিখিত হয়েছে বা সংকলিত হয়েছে। সেই দুটি ছড়া এরকম—
“ ১। রাই রাই রাই
আমরা মুশুরী কলাই খাই।
ইন্দের কাকা বড় দুখ পায়
হাত ভাইঙল পা ভাইঙল
ভাইঙল মাথার খুলি
আর কখন চাইপব নারে
কাগ বাজারের ডুলি
কাগবাজারে বড় সুখ
কিলাইঁ কিলাইঁ ভাইঙব পাঁজরার বুক।
২। ঘু ঘু চ্চু—পাঁড়ুক চু
খাইট ভাইঙল ভুঁয়ে শু।
আঘন মাসে পেটের দুখ
ড্যাং ড্যাডেং ন্যাটেং—
ড্যাং ড্যাডেং ন্যাটেং।”৩
এই দুটি ছড়া ছাড়া আর কিছুই আলোচিত হয়নি সেখানে। এছাড়া দেবপ্রসাদ জানা সম্পাদিত ‘অহল্যাভূমি পুরুলিয়া’ গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্বে ‘মানভূমের খেলার ছড়া’ নামে একটি অংশ রয়েছে, কিন্তু ছেলেভুলানো ছড়া নিয়ে সেখানেও আলোচিত হয়নি।
যে এলাকার কথা বলা হচ্ছে তার খানিক পরিচয় নেওয়া যাক। “পশ্চিমবাঙলার পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলের গ্রাম নামসমূহের দিকে দৃষ্টিপাত করলেই উক্ত অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পটভূমিকায় অনার্যভাষী জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক স্বত:ই প্রতীয়মান হবে। মূল অস্ট্রিকভাষী সাঁওতাল, মুণ্ডা, হো, বিরহড়, মাহলী, কোড়া প্রভৃতি উপজাতির অন্তরঙ্গ ভূমি হিসাবেই এই অঞ্চলের অবস্থিতি। ভূমিজ, লোধা, খাড়িয়া এবং অন্যান্য বাঙলাভাষী উপজাতিদের সংখ্যা এ সব অঞ্চলে অল্প নয়।মেদিনীপুর জেলার ঝাড়গ্রাম অঞ্চল, সিংভূমের ধলভূম পরগণা, পশ্চিমসীমান্ত বাঁকুড়া-বর্ধমান-বীরভূম, সাঁওতালপরগণার কিয়দংশ এবং সমগ্র মানভূম জেলা (পুরুলিয়া ও ধানবাদ) ভাষাতত্ত্বের বিচারে বাঙলাভাষী, কিন্তু সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডল রূপে বিশেষ স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী।”৪ এই মানভূমে বিশেষ করে পুরুলিয়াতে লোকসংস্কৃতিগত বৈচিত্র্যতা আমাদের ভাবাতে বাধ্য করে। এরপর আমরা এই অঞ্চলে প্রচলিত ছেলেভুলানো ছড়া নিয়ে খানিক আলোচনা করব।
এইসব ছড়া যেহেতু আপাতভাবে ছেলে ভুলানোর উপকরণ তাই অনেকসময় ‘প্রাপ্তবয়স্ক’ অনেক মানুষের এ বিষয়ে কিছু বিরূপ ভাবনা থাকে। তবে রবীন্দ্রনাথের কথা স্বীকার করেই আমারও বলতে ইচ্ছে হয় যে ছেলে ভুলানো ছড়া আলোচনা করতে গেলে শৈশব স্মৃতির আলোকে ছাড়া তা করা যায় না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই শৈশবের কিছু ছবি আলোচনা প্রসঙ্গে আসতে বাধ্য। এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের উক্তি- “ছেলেভুলানো ছড়ার মধ্যে আমি যে রসাস্বাদ করি ছেলেবেলাকার স্মৃতি হইতে তাহাকে বিচ্ছিন্ন করিয়া দেখা আমার পক্ষে অসম্ভব।... ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদে এল বান’ এই ছড়াটি বাল্যকালে আমার নিকট মোহমন্ত্রের মতো ছিল এবং সেই মোহ এখনো আমি ভুলিতে পারি নাই। আমি আমার সেই মনের মুগ্ধ অবস্থা স্মরণ করিয়া না দেখিলে স্পষ্ট বুঝিতে পারিব না ছড়ার মাধুর্য এবং উপযোগীতা কী।”৫
আমার ছোটবেলায় প্রায়ই যেসব ছড়াগুলো শুনতাম তার মধ্যে কয়েকটি এখনও মনে গেঁথে আছে। যেমন-
“না কাঁদ বাবু না কাঁদ রে, তর মাই যাইয়েছে বন
আইনে দিবেক পিয়াল পাকা ভুলাবেক তর মন।”
নিজের ছেলেকে পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের কাছে দিয়ে যে মা বনে যান কাঠ কেটে বোঝা তৈরি করে আনতে, তার অবর্তমানে সন্তানকে এভাবে ছড়া কেটে ভোলানো হতো। এই বিষয়টির মধ্যে একটি সামাজিক কাঠামোর ইঙ্গিতও আমরা পাচ্ছি। আমার নিজে দেখেছি আমাদের পাড়ার প্রায় সকল পরিবারের মহিলারা সক্কালে বেরিয়ে যেতেন বনের উদ্দেশ্যে, আর ছেলে-মেয়েদের দিয়ে যেতেন তাদের দাদু-দিদিমার কাছে। সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরিয়ে, খাইয়ে, গল্প শুনিয়েও ঠাকুরদা বা ঠাকুমা যখন পড়ন্ত বিকেলে ছেলেকে ভোলাতে পারতেন না, তখন এরকম ছড়া কেটে, সুর করে তার সামনে উপস্থাপন করত। ছেলে-মেয়েরা যদি একদম কমবয়সী হয় তাহলে ছড়া শুনে চুপ হতো, আর যারা বয়সে একটু বড়, কথার মানে বুঝতে শিখেছে তারা চুপ হতো ছড়ার শেষ লাইনটা শুনে, যখন বুঝতে পারত যে মা এলেই সঙ্গে আসবে তার জন্য পিয়াল পাকা। আমাদের ক্ষেত্রেও এরকম ঘটেছে। সাধারণ পাঠকের বা স্রোতার কাছে ছড়াটি এখানেই শেষ হতে পারে কিন্তু বিশ্লেষণী পাঠকের কাছে ঠিক তা নয়। এই ছড়ার মধ্যেই তারা খুঁজে পান নারীর জয়গান। শুধু তাই নয়, একটি অর্থনৈতিক কাঠামোর সন্ধানও আমরা এই ছড়াটির মধ্যে খুঁজে পাই। গ্রামের অর্থনৈতিক কাঠামো, গ্রামের সেই মহিলারাও যে কর্মক্ষম, তারাও যে বনে গিয়ে কাঠ কেটে আনতে পারেন তার কথা তারা সহজেই খুঁজে নেন এই ছড়াতে। এই ছড়া যতবার মনে পড়ে সঙ্গে সঙ্গে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোটবেলায় দেখা সেই বোঝা মাথায় মহিলাদের সারি। দুলকি চালে তারা যেভাবে পথে হেঁটে যেতেন তা আজও স্পষ্ট মনেপড়ে।
এইসব ছড়াগুলি যে শুধু মা-বাবা ফিরে আসার আগে ছেলেদের ভোলানর জন্যই তা নয়। এর বিষয় বৈচিত্র্য আছে। যেমন ছেলেদের খাওয়ানোর জন্য, তেল মাখানোর জন্য, নীতিশিক্ষা দেওয়ার জন্য ইত্যাদি। আবার এই ছড়াগুলির মধ্যেই মাঝে মাঝে ফুটে উঠতে দেখি মায়ের যন্ত্রণার কথা, একাকীত্বের কথাও। যেমন ছেলে যখন খেতে চাইছে না তখন তাকে খাওয়ানোর জন্য ছড়া বলা হয় এভাবে-
“আয় আয় চাঁদো মামা খাইতে দিব দুধ ভাত,
হামদের বাবুই খায় নাই, খাইয়ে দিবি গাব গাব।”
এই ছড়া শুনে ‘চাঁদো মামা’ আসে না বটে, কিন্তু সেই ছেলে ঠিক বড় হাঁ করে খায়। ছোটবেলায় আমার মা-ঠাকুমারাও আমাকে এরকম করে কতদিন খাইয়েছেন। ছেলে খেতে চায় না? ঠিক আছে, তাকে ‘চাঁদো মামা’ দেখাও, বয়স কম হলে সে চাঁদ দেখতে ব্যস্ত থাকার ফাঁকে মুখে খাবার পুরে দাও, একই সঙ্গে বলো তুই যদি খাবি না, তাহলে আমি ‘চাঁদো মামা’কেই গব গব করে খাওয়াচ্ছি। আর যাই হোক, নিজের খাবারে অন্য কেও ভাগ বসাবে— তা কখনো শিশুরা হতে দেবে না, আবার সে(চাঁদ) এলে শুধু খাবারে ভাগ বসাবে না, মায়ের আদরেও ভাগ বসাবে। তার চেয়ে নিজেই খেয়ে নেওয়া ভালো। পল্লী অঞ্চলের এইসব মায়েরা শিশু মনস্তত্বের পাঠ নেননি কোথাও, কিন্তু কি আশ্চর্য! শিশুদের মনের কথা তারা ঠিকই বোঝেন।
শিশুদের তেল মাখানোর সময় যে ছড়া বলা হয় তাতে সেই কর্মঠ মানুষদের বোঝা বাঁধার কৌশল প্রকাশ পায়, যেমন-
“আট বাঁধো, পাত বাঁধো, কাঠ বাঁধো,
দাতুন বাঁধো- বাবুকে বাঁধো!
দাই দোলো দাই দোলো দাই দোলো
ষষ্ঠী মাকে নম করো, মামাঘর দেখো।”
গ্রামে শিশুদের তেল মাখানোর একটি বিশেষ পদ্ধতি আছে। প্রথমে ঠাকুমা মাটিতে বসে তার পা দুটি সামনের দিকে প্রসারিত করেন। তারপর তার পায়ের ওপর শিশুটিকে শুইয়ে দেন। তার পর তেল মাখাতে মাখাতে এই ছড়া কাটেন। লম্বালম্বিভাবে শুয়ে থাকা শিশুটি যদি বোঝা হয়, তাহলে তার ওপরের দিকের হাত দুটি ও নীচে পা দুটি বোঝা বাঁধার দুদিকের দুটি দড়ি। হাত দুটিকে দুইপাশ থেকে টেনে এনে মাঝখানে বাঝ দিয়ে, আবার পা দুটিকেও এভাবে এনে বলা হয় প্রথম লাইন। অর্থাৎ বোঝা বাঁধার সময় দুদিক থেকে দড়িকে টেনে শক্ত করে বাঁধতে হয়। আবার এখানে পাতা ও দাতুন বাঁধার কথাও বর্ণিত। কিন্তু শুধু বোঝা বাঁধার কৌশল বললে শিশুর কি লাভ? তাই পরক্ষণেই তার একটি হাত ও একটি পা ধরে তুলে তাকে দোল খাওয়ানো হয়। আর মামাঘর যেহেতু সবার ক্ষেত্রেই আবদারের শ্রেষ্ঠ জায়গা, তাই হয়ত তাকে শেষে মামাঘর দেখানোর কথা বলা হয়। আবার ছেলেদের হাসিখুশি রাখার দায়িত্ব মা ষষ্ঠীর। তাই প্রকারান্তে তাকে প্রণাম করার প্রসঙ্গও এখানে আছে। ছোট্ট ছেলেকে শেখানো হচ্ছে মা ষষ্ঠীকে প্রণাম করতে। এভাবে ছেলে হাসতে হাসতে কখনই তার তেল মাখানো হয়ে যায়, আবার তার অস্থির বিকাশের জন্য, সচলতার জন্য যা দরকার তাও হয়ে যায়। মজার কথা এরা কিন্তু বিজ্ঞানের বই পড়ে এসব কাজ করেন না। বরং তাদের এসব কাজের মধ্য দিয়ে আমরা বিজ্ঞানের কথা খুঁজে পাই। একই সঙ্গে কাজের পদ্ধতি বলা, কবিত্ব করা ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিশুর শরীরচর্চা করা- সবই আছে এখানে। এসবই তাঁদের বিচক্ষণতার পরিচয়বাহী।
মায়েদের হতাশা, যন্ত্রণা প্রকাশ পায় অনেক ছড়ায়। তারা তাদের মনের কথা বেবুঝ ছেলেকে বলেই একটু শান্তি পাওয়ার চেষ্টা করেন। যেমন-
“আকাশ কাঁদে বাসাত কাঁদে কাঁদে বনের লতা
তুঁই কিরে বুঝবি নুনু হামার মনের ব্যথা।”
একজন মা তার ছেলেকে ভোলানর বাহানায় নিজের মনকেও খানিক ভুলিয়ে নেন নিজেরই অজান্তে। তার নিজের যন্ত্রণার কথা তার ছেলে বা মেয়ে বুঝবে না তা তিনি জানেন, তবু এরকম করে বলেন। আসলে নিজের কথাটা খানিক অবুঝ ছেলেকে বলেই তিনি মনকে সঙ্গীহীনতার ভাবনা থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করেন খানিক। নিঃসঙ্গ জীবনে তাই তার কথাসঙ্গী হয়ে ওঠে তারই ছেলে বা মেয়ে।
চিরাচরিত ননদ-শাশুড়ির অত্যাচারের কথাও ফুটে ওঠে কোথাও এসব ছড়ায়। যেমন—
“ছেইল্যা কাঁদে অরল-গরল, গহাইলে গবর ভরল, কিনা করব একা?
শাশুড়ি ননদী রং দেখে, কিনা করব একা?”
একজন অসহায় গৃহবধূর চিত্র এখানে ফুটে উঠতে দেখি। গোয়ালের গোবর সকালে মাথায় করে মা-কাকিমাদের বাইরে ফেলতে যেতে দেখেছি আমরা, এখনও দেখি। কিন্তু ঠিক সকালেই ছেলেটিরও ঘুম যদি ভাঙে, সে তো মাকে ছাড়তে চায়না। তার তখন আদর খাওয়ার সময়। অথচ মায়ের এত সময় নেই। একদিকে ছেলে কাঁদছে, অন্যদিকে গোয়ালে গোবর অপেক্ষা করছে। মা তো একটাই, কোনদিকে যাবনে? সামনে শাশুড়ি ও ননদ আছে বটে, কিন্তু তারা কাজে বৌমাকে সাহায্য করতে আগ্রহ প্রকাশ করেন না, বরং মায়ের এই অসহায়তা তাদের কাছে মজার ব্যাপার। তারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রঙ্গ দেখেন। চিরকাল এরকম গ্রামবাংলায় পুত্রবধূদের ওপর শাশুড়িদের প্রভাব দেখা যায়। বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এও এরকম দেখা যায়। রাধা তার শাশুড়ির অত্যাচারের কথা বড়াইকে বলেছে-
“আহ্মার সাসুড়ী বড়ায়ি বড় খরতর।
সব খন রাখে মোরে ঘরের ভিতর।।”৬
আবার ‘চণ্ডীমঙ্গলে’ও এরকম দৃষ্টান্ত পাওয়া যায়। যখন কালকেতু ফুল্লরাকে জিজ্ঞেস করেন
“সাসুড়ি ননদি নাঞি নাঞি তোর সতা
কা সনে কন্দল করি চক্ষু কৈলে রাতা।”[1]*
তোমার তো শাশুড়ি-ননদ নেই, তাহলে কার সঙ্গে ঝগড়া করে চক্ষু লাল করেছো? অর্থাৎ পুত্রবধূর ওপর শাশুড়িদের এরকম শাসন হামেশায় দেখা যায়। এই ছড়াতেও আমরা তাই লক্ষ্য করছি।
এইভাবে আলোচনা করলে দেখা যাবে পুরুলিয়াতে প্রচলিত ছেলেভুলানো ছড়াগুলিতে সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা, কবিত্ব, শিশুমনস্তত্ত্ব, একাকীত্বের যন্ত্রণা সবই যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে। আগেই বলেছি এসব ছড়ার অঞ্চলভেদে পাঠান্তর থাকতেই পারে। কারণ এগুলি প্রথমত যেমন মৌখিক সাহিত্য, তেমনি এগুলিতে স্থানীয় প্রভাব বা আঞ্চলিক ছাপ পড়তে বাধ্য। অনেক ছড়ার বিশ্লেষণ প্রকাশের কথা মাথায় রেখে করা গেল না, আবার অনেক ছড়া হয়ত এখনও সমাজে লুকিয়ে আছে। হয়ত তারা কোনো আগ্রহীর সংগ্রহের অপেক্ষায়। আবার অনেক ছড়া যে কালের স্রোতে তলিয়ে যায়নি এমনটা নয়। আসলে সময় ও সভ্যতার সঙ্গে পাল্লা দিতে দিতে মানুষ এখন এসব কথা প্রায় ভুলেই থাকে। আমার ছোটবেলায় যেসব ছড়া অহরহ বলা হত সেগুলি আজ কেও বলে না। আবার দাদু-দিদিমার কাছে গল্পশোনার রীতিও অনেকাংশে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। আসলে এগুলি লোক সাহিত্যের, বিশেষত মৌখিক সাহিত্যের অনিবার্য ভবিষ্যৎ।
বেশ ভাল লাগলো লেখাটা। ছড়া কেবল ছেলেভুলানোই নয়, বরং কতো তাৎপর্যময়!
অনেক তথ্যসমৃদ্ধ লেখা, পড়ে খুব ভালো লাগলো।