দিনের এই সময়টায় যারা জেগে ওঠে তারাই শুধু শহরের কোলাহলের নীচে বুড়বুড়ি কাটা শব্দগুলো ছুঁতে পায়। মাঝে মধ্যে ইন্টেরস্টেট ধরে একটা দুটো রাতভোরের গাড়ি সাঁই সাঁই করে ছুটে যাচ্ছে ঠিকই। তবু অন্তর্বর্তী নিস্তব্ধতায় পোর্টিকো থেকে ঝোলানো পঞ্চাশ তারাওলা পতাকার সঙ্গে হাওয়ার খুনশুটি, ছাদের গ্যাবেলে ওক তুলে বিবেড়ালের বমি, শীতের হাওয়ায় পাতার অস্ফুট পতন শব্দ হয়ে ধরা দেয় কানে। মেঘনাদ শুধু শোনেন না। প্রতিটা শব্দ তাকে ভাবায়, তার কল্পনাবিলাসী মন চলে যায় প্রতিটা শব্দের পিছনের নানান সম্ভাবনায়।
এই রাত দুপুরে বিড়ালটা বমি করল কেন? কারো বাড়ি থেকে কিছু চুরি করে খেয়েছিল বুঝি? কিংবা ডেকের গ্রিলে ঝলসানো স্যামনের খসে পড়া টুকরো। পেটুক কোথাকার! হলদে ডোরা ছোঁচামার্কা একটা বিড়াল দেখছেন গত কদিন। এখানে এমন ইচ্ছেমত ঘোরা বিড়াল দেখা যায় না তেমন। ওটাই হবে নিশ্চয়।
একেকটা আওয়াজ শোনেন আর এমনি নানান ভাবনা মেঘনাদের মাথায় ডিগবাজি খায়। রোজকার ব্যাপার। তাই বলে মেঘনাদ নিজের ঘরের মধ্যেই কোন শব্দ শোনার জন্য তৈরী ছিলেন না। পিঠের দিক থেকে আসা খসখস আওয়াজে গল্প বোনার কোন সুযোগ না নিয়েই মাথা ঘুরিয়েছিলেন মেঘনাদ। যাকে পেলেন তাকে দেখাটা কল্পনাতেও ছিল না। আলগা শব্দটা এসেছিল মেয়েটার লুটনো আঁচল মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা নিউ ইয়র্কারের খোলা পাতার উপর দিয়ে টেনে আনার সময়। মেঘনাদ নিশ্চিত এই মেয়েকে জীবনে কোনদিন দেখেন নি, অথচ মেয়েটা আশ্চর্য রকমের চেনা। তার মনে প্রথম প্রশ্ন আসা উচিত ছিল মেয়েটা এইভাবে তার নিজের বাড়িতে, তার লেখার ঘরে ঢুকল কি রকম ভাবে। কিন্তু সেই জিজ্ঞাসা তার মাথায় উঁকি দেয় নি। কারন তিনি এটাও তো জানেন তার ঘরে ছাড়া মেয়েটার আর কোথাও থাকার সেরকম কোন উপায় নেই। শরীরের মধ্যে একটা হালকা কাঁপুনি এলো মেঘনাদের। ঘড়ঘড়ে শব্দ বেরোল গলা দিয়ে। তুমি এখানে কেন? কিভাবে?
মেয়েটার চোখের দৃষ্টি সুতীব্র। চোখের কোলে কাজল ধেবড়ে গেছে, জলে ভেসেছে যেন একটু আগেই। এখনো এক ফোঁটা জল চোখের পাতায় শিশির বিন্দুর মত টলটল করছে। চোখের কুচকুচে কালো মনিতে কিন্তু দুঃখের সঙ্গে একটা রাগ মিশে গেছে। সেইটুকু অচেনা লাগল মেঘনাদের। এমন রাগের প্রকাশ ছিল না তো মেয়েটার চরিত্রে। বরং বরাবরের কুণ্ঠিত মেয়েটার মধ্যে ছিল অনুতাপ। আর লজ্জা। কণ্ঠনালীতে বুদ্বুদ ফাটার মত হালকা ওঠানামা ওর গলায় বসে যাওয়া দাগ পেরিয়েও চোখে পড়ল মেঘনাদের। কিছু বলার অপেক্ষায় মেয়েটার ঠোঁট থিরথির করে কাঁপছে। এত কাছে এসে গেছে মেয়েটা, শরীর থেকে বাসি ঘামের গন্ধ উঠে আসছে। কিছু ভাবার আগেই মেয়েটা খপ করে ওর হাত মেঘনাদের কাঁধে রেখে ফ্যাসফেঁসে গলায় বলে উঠল, কেন মারলে আমায়? কেন?
অনুযোগ। কিন্তু কাতরতা নেই, যেটা মেয়েটার সঙ্গে বেশি মানাত। বেরিয়ে আসছে তেজ, তার উত্তাপ জ্বরো রুগীর নিশ্বাসের হলকার মত। পুড়িয়ে দিতে পারে।
আমি মারলাম, কিভাবে? তুমি তো নিজেই নিজেকে - আত্মহত্যা।
শ্লেষ ঝলসে উঠল মেয়েটার শুকনো ঠোঁটে। ভাতের উপর গরম ডাল ছড়িয়ে দেবার মত প্রতিটা শব্দে মনের বিষ উগড়ে দিল মেয়েটা। তুমি না মারলে আমি কেন আত্মহত্যা করতে যাবো?
গল্প তো শেষই হয়ে যাচ্ছিল, তারপরে তুমি তো এমনিতেই আর থাকতে না। এই আবশ্যিক সত্যটা বিনা চেষ্টায় প্রকাশ করতে পারলেন মেঘনাদ।
আমি বেঁচে থাকতাম। আমার গলায় এই দড়ির দাগ থাকত না। আমার গলার আওয়াজ এরকম ফ্যাসফেঁসে হত না। কথা বলতে সত্যিই কষ্ট হচ্ছিল মেয়েটার, তবু বলছিল।
গল্প শুরু হওয়ার আগে যেমন তোমার কোন জীবন ছিল না, শেষ হয়ে যাওয়ার পর তেমনি গল্পের চরিত্র ওখানেই আটকে যায়। আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই, থাকে না। একরকমের মরে যাওয়া সেটাও। বলতে বলতে একটা তৃপ্তি খেলা করছিল মেঘনাদের গলায়। সে যেন ঈশ্বর।
থাকতাম নয় আটকে। কিন্তু বেঁচে তো থাকতে পারতাম আমি। পাঠকের মনে। কেউ ভাবত না আমি সত্যি সত্যি শেষ হয়ে গেছি। হেরে গেছি।
মেঘনাদের এই নতুন গল্পটা ‘সরমা যেভাবে সিঁড়ি বেয়ে নেবে গেল’ বেরিয়েছে দুইবাংলা ওয়েবজিনের মার্চ ইস্যুতে। ওদের পাঠক মন্দ নয়, তার ওপর মেঘনাদের লেখা। অন্তত হাজার কয়েক লোক তো পড়েছেই। তাদের কাছে সরমা মৃত। আত্মহত্যা করেছে। সেই নিশ্চিন্ত বিশ্বাসে এ আর এমন কি ব্যাপার গোছের নির্লিপ্তি গলায় ঢেলে মেঘনাদ বললেন, তুমি শেষ হয়ে যেতে চাইলে আমি কী করতে পারি বলো তো? বলতে গিয়ে দুই হাত উলটে নাড়ুও পাকিয়েছিলেন হাওয়ায়। ভয় ব্যাপারটা মেঘনাদের বরাবরই কম। তা না হলে নিজের গল্পের জলজ্যান্ত হয়ে ওঠা এক চরিত্রের সঙ্গে এরকম বচসা জুড়তে পারে কেউ?
আমি চাইলাম, কীভাবে?
একটা চরিত্রে একবার প্রাণ প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলে আমি কি আর লিখি? ওরাই আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নিয়ে যায়। তারা যেভাবে কথা বলে আমি লিখে দিই। তাদের যখন যেমন আচরণ, আমি তার বর্ননা করি মাত্র।
ভেঙ্গিয়ে উঠল মেয়েটা। মিথ্যা কথা বলো না। আমি জানি তুমি নিজে ওইভাবে শেষ করতে চেয়েছিলে। ওর সাহস দেখে হতবাক হতে হল অকুতোভয় মেঘনাদকেও। ওর আঙ্গুল এতক্ষণে শক্ত করে মেঘনাদের কাঁধে চেপে বসেছিল। আমি তো কোন অন্যায় করি নি, কোন পাপবোধ ছিল না আমার। হ্যাঁ বোকামি করে থাকতে পারি। তাই বলে তুমি আমায় হারিয়ে দিলে?
শেষের পাতাটা বেশ ভালই মনে আছে মেঘনাদের –
সরমা ঘরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিল। এক পা বাড়িয়ে আবার ফিরে গিয়ে আঁট করল দরজার ছিটকিনি। অনাবশ্যক, কারণ গোটা বাড়িতে আর কেউ তো নেই। টাবুদির বিয়েতে গেছে সবাই। সামনে সরমার পরীক্ষা তাই ওর না যাওয়াই সাব্যস্ত হয়েছিল। সরমা অবশ্য এতসব কিছু ভাবছিল না, একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে এখনো। তার মধ্যেই দক্ষিণের জানালায় এসে জংলাসবুজ পর্দার স্প্রিং টেনে নাবিয়ে দেখল একবার বাইরেটা। আকাশে বেশ রং ধরেছে এখন, এই সময়টাকেই কি গোধূলি বলে? দূরে দূরে অনেক আলো জ্বলতে শুরু করেছে যদিও। সরমার চোখ গেল হাঁদুলের চায়ের দোকানে। ওরা কি এদিকেই তাকিয়ে আছে? এর পর কি প্যাঁচ কষবে তার হিসাব নিকাশ করছে? সরমা কি ভুল করল এইভাবে রিয়াক্ট করে? ওরা তো সবাইকে বলবে সাধন বাবুর মেয়ের খুব বাড় বেড়েছে। কী এমন বলা হয়েছিল যে রাস্তার মাঝখানে এমন সিন ক্রিয়েট করতে হল? এত সাহস কী করে হয় একটা মেয়ের? সরমা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিল কাল সকালে বাবা যখন কাজে যাবে ওরা ঘিরে ধরবে রাস্তায়, কাকু তোমার মেয়ে এটা কি করল? বাবা থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করবে কেন, কেন কি করেছে সরমা? ওদের সম্মিলিত হাসি বিদ্ধ করবে সরমার বাবাকে। কাকু , বলো কী করেনি। এলাকায় আমাদের মান ইজ্জত একেবারে লুটিয়ে দিল, স্বপ্ননীলদার মত লোককে বেইজ্জত করে দিল এমন? স্বপ্ননীলদা? সরমার বাবা এই কথায় একেবারে গুটিয়ে যাবে এইখানে। স্বপ্ননীল শুধু পাড়ার হোতা ইন্দ্রনীল ঘোষালের ছেলেই নয়, এলাকার নক্ষত্র। যে কোন দিন বিদেশে চলে যাবে টাইপ। সরমা জানে বাবা কিছুতেই সরমার হয়ে কিছু বলে উঠতে পারবে না। ত ত করে জিজ্ঞেস করবে কেন কী করেছিল সরমা? একবারও জিজ্ঞেস করবে না , কেন কী করেছিল স্বপ্ননীল? অবশ্য এই প্রশ্ন যদি করেও তাতে আখেরে সরমার কোন লাভ হত না। কারণ স্বপ্ননীল কিছুই করেনি। আজ। চায়ের দোকানে বসে কেউ শিষ দিয়েছিল, পথচলতি সরমা চোখ তুলে দেখেছিল স্বপ্ননীলকে। মাথা ঠিক রাখতে পারেনি , সোজা গিয়ে ঠাস করে এক চড় মেরেছিল ছেলেটার গালে। কেন মেরেছিল? না চড় মারার জন্য কোন ক্ষোভ হচ্ছিল না সরমার। কিন্তু এইখানে কেন? মারতেই যদি হত তাহলে দৌড়ের রাস্তায় যখন পিছন পিছন বুগবুগ আওয়াজ তুলে আসত ছেলেটা, তখন কেন ছেড়ে দিল? কিংবা প্র্যাকটিসের সময় ব্যাডমিন্টান কোর্টের বাইরে থেকে চোখ দিয়ে মাপত তার শরীর, সেই সময় কেন পারে নি?
ধাপে ধাপে এইভাবেই গেছিল গল্পটা, অনিবার্য সমাপ্তির পথে। বেশ মনে আছে মেঘনাদের। সেই ভাবনা থেকেই বললেন, তোমার ওইভাবেই রিয়াক্ট করার কথা, করেছো। দ্যাট ওয়জ দ্য পয়েন্ট অব দিজ স্টোরি। কিভাবে ধীরে ধীরে একটা মানসিক চাপ ভিতরে বিল্ড আপ করে আর খুব সামান্য কারণে সেটা যখন বাইরে লাভার মত ছিটকে পড়ে, কার্য আর কারণে সমীকরণ হয় না।
কীভাবে জানলে তুমি? তুমি কি ঈশ্বর?
ঈশ্বর মেঘনাদ নন। কিন্তু দেখেছেন এরকম। আসলে অনেকরকমই তো দেখেছেন। মনের মধ্যে সেইসব ঘটনা যে কিভাবে ঘোঁট পাকিয়ে একটা গল্পে এসে দাঁড়ায়। যেমন এই গল্পটার ভাবনা প্রথম এসেছিল সেরেনাকে দেখে। মানে সেরেনা উইলিয়ামস। সত্যিই তাই! সেরেনাকে টেনিস র্যাকেট ছুঁড়ে চেয়ার আম্পায়ারের সঙ্গে ঝগড়া করতে দেখে মনে পড়ে গিয়েছিল দীপালির কথা। তারপর গল্প গড়াতে গড়াতে কখন পূর্ণিমায় এসে ঠেকল। সেও তো এই অবস্থায় আত্মহত্যা করেছিল। নিজের কল্পনার অলিগলি থেকে একটা তৃপ্তি বোধ করলেন মেঘনাদ। কানেক্টিং দ্য ডটস। ভাল পারেন সেটা। সেই ভরাট বিশ্বাসের জায়গা থেকেই বললেন পূর্ণিমার কথা। আত্মহত্যা করেছিল মেয়েটা, বুঝলে সরমা। গল্প তো এমনি তৈরি হয় না। বাস্তবে যা ঘটে সেটাই অন্যভাবে ফিরে আসে।
তার মানে আমি পূর্ণিমা? তাকে নিয়েই এই গল্প? তাহলে আমার নাম সরমা রাখলে কেন?
আহা পুরোপুরি পূর্ণিমা তো নও। আমি কি খবরের কাগজের প্রতিবেদন লিখছি নাকি? এটা একটা গল্প। অনেক ভাবনায়, কৌশলে তিলে তিলে তিলোত্তমা হয়। যেমন সরমার চরিত্র, সামাজিক অবস্থান আর এই যে স্ট্রাগলটা - সে সব অনেকটাই মেলে দীপালির সঙ্গে। অথচ মরে যাওয়ার ঘটনাটা ঘটেছিল পূর্ণিমার সঙ্গে। সেটাই বলছি।
পূর্ণিমা আত্মহত্যা করেছিল? গলায় দড়ি দিয়ে?
হ্যাঁ। সে আমার ছোটবেলায় দেখা।
মানুষের মনে সময়ের ছবি কিভাবে কোন কোটরে গিয়ে যে লুকিয়ে থাকে! অদ্ভুত একটা অ্যালবাম যার পাতা নিজে থেকে খুলে দেখা যায় না, হঠাত হঠাত একটা পাতা খুলে যায়। যেমন আজ। এমন কি লেখার সময়ও এরকমভাবে স্পষ্ট হয়ে আসেনি ওর ছবিটা।
মেঘনাদ একেবারে মিথ্যে বলছিলেন তা নয় । গল্প যেমন গড়াতে থাকে গল্পের চরিত্ররা নিজের অজান্তেই তার মনের ভিতর থেকে কোন লুকোন বিকেল, ভুলে যাওয়া মানুষ, হারিয়ে যাওয়া স্পর্শসুখ টেনে বের করে এনে নিজেদের জীবন সাজায়। গল্পে সরমা যখন দিশেহারা, কি করবে, কোথায় মুখ লুকাবে বুঝতে পারছে না, মেঘনাদের মাথা থেকে ছোটবেলায় সিঁড়ি দিয়ে ছাদের ঘরে ওঠার সময় খোলা জানালা দিয়ে দেখা ঝুলন্ত পূর্ণিমাদির চেহারাটাই বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু তার কল্পনায় তখন সরমার মুখ, পূর্ণিমা তার সম্পূর্ণ অবয়ব নিয়ে মনের কোথাও জায়গা করতে পারেনি। তিনি যে পূর্ণিমার কড়িকাঠ থেকে ঝোলাটা লেখায় তুলে আনছেন সেটা ঘটেছে অবচেতনে। কিন্তু আজ সেটাই সচেতনভাবে মনে ঘাই মারল। আচমকা ছোটবেলার সবসময়ের কাজের মেয়ে পূর্ণিমাদিকে তার পড়ার টেবিলের পাশে দুধ হাতে দেখতে পেলেন মেঘনাদ।
চট করে খেয়ে নাও ছোড়দা। বৌদিমুনি এক্ষুণি এসে যাবেনি।
বয়সে বড় পূর্ণিমাদি কেন তাকে ছোড়দা বলত কে জানে। সারাদিন কাজের পরে পূর্ণিমাদির শরীরে তখন শুকনো ঘাম। মেঘনাদ নাক সিঁটকে ছিল, তোমার গায়ে গন্ধ, আমি খাবো না তোমার আনা দুধ। সত্যি কেমন আঁশটে ভ্যাপসা গন্ধ থাকত পূর্ণিমাদির গায়ে। স্নান করার জন্য যে নামহীন বল সাবানটা পেতো তাতে নোংরা হয়তো যায়, কিন্তু সুরভিত করে না।
মেঘনাদ পূর্ণিমাদির ভাবনায় ডুবে যাচ্ছিল। কিন্তু সরমা স্মৃতির চিলেকোঠা থেকে এক ঝটকায় তাকে বের করে আনল।
কী হল বললে না তো, পূর্ণিমা আত্মহত্যা করল কেন?
সরমার ব্যবহারে চমকে চমকে উঠছিল মেঘনাদ। কী সাহস মেয়েটার! তাকে যেন ধমকাচ্ছে, চোখ রাঙ্গানোটাই শুধু যা বাকি। এত তেজ তো ছিল না সরমার, এমন রুক্ষতা! সরমার এই দিকটা ফুটিয়ে তুলতে গল্পে একটা শব্দও খরচ করেছেন বলে অন্তত মেঘনাদের মনে পড়ছিল না। একটু ইতস্তত করে বললেন, আমি কী করে জানব?
কেন, এই যে বললে পূর্ণিমার আত্মহত্যা দেখে আমাকেও অমনিভাবে মারলে। একটা বিদ্রূপ ঝলসে উঠল সরমার গলায়।
কিন্তু ওর মনের কথা আমি কী করে বুঝব! কেন মরল, কী হয়েছিল-
ক্যানো নিজির চোকে দ্যাকো নি তুমি?
মেঘনাদ জোরের সঙ্গে বলতে গেলেন, পূর্ণিমা মরে থাকার পরে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলতে দেখেছি – কিন্তু বলতে বলতেই মনে হল এই প্রশ্নটা তো সরমা করেনি! এসেছেও ঘরের উল্টোদিক থেকে। পিছন ফিরে দেখার আগেই অবশ্য বুঝে গেছিলেন মেঘনাদ। অবিশ্বাস্য ব্যাপার একবার ঘটতে শুরু করলে চমকানোর ক্ষমতাটা ভোঁতা হয়ে যায়। তা না হলে এতক্ষণে চেয়ার থেকে মাটিতে পড়ে যাওয়ার কথা ছিল মেঘনাদের। তার বদলে ধীরে ধীরে নিজের সুইভেল চেয়ারটাকে একশো আশি ডিগ্রী ঘুরিয়ে পূর্ণিমাদির মুখোমুখি হলেন।
কি ইবার যে বাক্যি হরি গেল ছোড়দা তুমার? নাকি এখনো বইলবে যে চিনতি পারতেছ না। সরমার সঙ্গে চেহারায় তেমন কোন সাদৃশ্য তো নেই পূর্ণিমার, শুধু গলার ফ্যাঁসফ্যাঁসে আওয়াজের মিলটুকু ছাড়া। আর এমন টাসটাস করে কথা, এমনভাবে পূর্ণিমা কোনদিন কথা বলেনি তার ছোড়দার সঙ্গে। না হলে এক্কেবারে সেই চেহারা। শেষ দিনের অমনি হলদের উপর সবুজ ডুরে নোংরা শাড়িটা – বহু বছর আগের কথা তবু যেন স্পষ্ট মনে পড়ে যাচ্ছে। তেমনি বাসি ঘামের গন্ধ, ধক করে নাকে লাগল মেঘনাদের। খুব ধীরে ধীরে প্রতিটা শব্দকে ছুঁতে ছুঁতে বললেন মেঘনাদ, চিনতে পেরেছি গো পূর্ণিমাদি – এইটুকু বলেই থমকে গেলেন মেঘনাদ। পূর্ণিমা যখন তাকে ছোড়দা বলত সে ছিল পাঁচ কি ছয় বছরের আর পূর্ণিমাদির কি বয়েস ছিল তখন কে জানে। সামনের উসকোখুসকো চেহারার মেয়েটার ভরন্ত শরীর দেখে মনে হচ্ছে কুড়ি একুশের বেশি হবে না মোটেই। পঞ্চাশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে গলায় দড়ির দাগবসা কচি মেয়েটাকে পূর্ণিমাদি সম্বোধন করতে কেমন অদ্ভুত লাগল মেঘনাদের।
কী হল, মুখে কুলুপ আঁটলে ক্যানো? দ্যাকো নি তুমি আমারে?
কী দেখবো? এবার গলাটা একটু কাঁপল মেঘনাদের।
আমারে বিছনায় ফেইলে তুমার বাপ যখন ধামসাইছিল, জানালায় উঁকি মেইরে দ্যাকো নাই?
অ্যালবামের আরেকটা পাতা খুলে গেল এবার। বাগানে খেলতে খেলতে ক্যাম্বিস বলটা বাবা মার শোবার ঘরের জানালার ঠিক নিচে দোপাটি ফুলের গাছগুলোর নিচে গড়িয়ে গিয়েছিল। কুড়াতে এসে ঘরের মধ্যে থেকে অদ্ভুত আওয়াজ পেয়ে জানালার ফেলে দেওয়া ভারি পর্দা সরিয়ে উঁকি দিয়েছিল মেঘনাদ। দেখল পূর্ণিমা আর বাবা বিছানার উপর জটাপটি করছে কুস্তির প্যাঁচ মারার মত। পূর্ণিমা যদিও নিচে, কিন্তু এক হাতে ওর বাবার চুলের মুঠি ধরে ঝাঁকাচ্ছে আর অন্য হাতে পিঠের উপর আঁচড়ে দিতে দিতে কি বিশ্রি ভাষায় বাবাকে ধমকাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে মেয়েটার সঙ্গে চোখাচোখি হয়েছিল মেঘনাদের। কী দেখেছিলেন সেই চোখে? সে কি আক্রান্তের চোখ ছিল না আক্রমনকারীর? পূর্ণিমা কি বাবাকে মারছিল না কি এই কুস্তিতে তারও সম্মতি ছিল? তখন ভাবেন নি এটা, বোঝেনও নি এর মানে। মনে হয়েছিল বাবাকে মারছে, প্রচণ্ড ভয় পেয়ে দৌড়ে গিয়ে সে চড়ে বসেছিল বাগানের পেয়ারা গাছের ডালে। কিন্তু কাউকে কিছু বলেননি, কারুক্কে না।
কবে ঘটেছিল এই ঘটনাটা? যদিও তার পরের কদিন একটু ভয়ে ভয়ে ছিল মেঘনাদ, পূর্ণিমাদি সামনে এলেই কেমন সিঁটিয়ে যেতো ভয়ে। যদি বকে, বাবার মত তাকেও যদি মারে চুলির মুঠি ধরে। কিন্তু কিছুই করেনি। তারপর ভুলেই গেছিল শিশু মেঘনাদ। কিংবা সত্যিই কি ভুলেছিল? না কি জোর করে মনের মধ্যে ধামাচাপা দিয়ে রেখেছিল? হয় এরকম, যা জানতে চাইনা, জানলে বিপদ বেশি, মন সেটাকে অচেতনভাবে বর্জন করে থাকতে পারে। পূর্ণিমাদি মারা গেছিল এর মাস ছয়েক বাদে। গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলার সঙ্গে যে এর কোন সম্পর্ক থাকতে পারে সেটা মনেও হয়নি মেঘনাদের। ছোটদের মন বহতা নদীর মত, ছমাস আগের এক লহমার কোন দৃশ্যের সঙ্গে জোড়ার ক্ষমতা ছিল না। কিংবা ছিল, অন্তত এখন তো সেটাই মনে হচ্ছে। বিড়বিড় করে বললেন মেঘনাদ, হ্যাঁ দেখেছিলাম, মনে পড়েছে এখন।
লিভিং রুমের দেওয়ালে টাঙ্গানো বাবা মার ছবিটা হুড়মুড়িয়ে মাথায় এলো। মনে হল একটা কবেকার মরে যাওয়া ছোটলোক মেয়ের কথায় তাদের নস্যাৎ করে দিতে পারেন না মেঘনাদ। তাই যতটা সম্ভব জোরের সঙ্গে বললেন, আমি কী করে জানবো তোমার সঙ্গে কী হয়েছে, তোমার হয়তো সায় ছিল। সেসব কি আমার জানার কথা? জানা শব্দটার উপর খুব জোর দিলেন মেঘনাদ, আঁকড়ে ধরলেনও বলা যায়। আর তুমি গলায় দড়ি দিয়েছিলে তার অনেক পরে। তোমাকে দেখে তো মনেও হয়নি কিছু হয়েছে বলে।
সেটা সত্যি, হুড়হুড় করে বেনোজলের মত আরও অনেক ছবি ঢূকে যাচ্ছিল মেঘনাদের অন্তপুরে। এসব যে তার মনে জমা থাকতে পারে সেটাই আশ্চর্যের! বিশ্বকর্মা পুজার দিন বাবার সঙ্গে ঘুড়ি উড়াচ্ছিল, ছাদে কাপড় মেলতে এসে পূর্ণিমাদি চড়াই দিয়ে দিল। মুখে রোদ নিয়ে দাঁড়ান সেদিনের পূর্ণিমাদিকে বেশ হাসি খুশিই তো লাগছিল। ছাদময় দৌড়ে বেড়াচ্ছিল খরগোশের মত! খরগোশের কথা ভাবতেই জিওগ্রাফিক চ্যানেলে দেখা একটা ডকুমেন্টারির কথা মনে পড়ে গেল মেঘনাদের। ওখানে বলছিল খরগোশ নাকি অসুস্থ হলেও কিচ্ছু বুঝতে দেয়না। দুর্বল দেখালেই শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। তাই এমন ভান করে যেন একদম তন্দুরস্ত। ওইভাবেই হঠাত একদিন সেই খরগোশটা পট করে মরে যায়। দেখলে মনে হবে এমন সুস্থ জলজ্যান্ত প্রাণটা হঠাৎ বুঁজে গেল কেন? বাইরে থেকে ক্ষয়টা ধরা যায়না। গল্পের সূত্র হতে পারে ভেবে এই তথ্যটা লিখে রেখেছিলেন। এখন এইভাবে মাথায় ফিরে এলো। তবে কি পূর্ণিমাও বাইরে কিছু বুঝতে দিচ্ছিল না, অথচ ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে যাচ্ছিল? সেদিন বাগান থেকে যেটা দেখেছিল সেটা কি হঠাত কোন একদিনের ব্যাপার নয়? এমন কি মাঝে মাঝেই হত? তাহলে পূর্ণিমাও কি আসলে দীপালির মতন?
আমাকে নিয়ে সেই যদি গল্প লিখলি, সেটা কি হেরে যাওয়ার গল্প হতে হয় রে মেঘা?
দীপালিকে মুখোমুখি চেয়ারে বসে থাকতে দেখে একটুও অবাক হলেন না মেঘনাদ। এতক্ষণে মেনে নিয়েছেন এরকমই হওয়ার কথা। আজকের রাতটা অন্যরকম। কিরকম একটা সময়ের ফাটলে পড়ে গেছেন। এইভাবেই তাকে জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু তিনি কোন অন্যায় করেন নি, গল্প সাজান ছাড়া। এটা কোন অন্যায় হতে পারে না। তিনি স্রষ্টা, তাঁকে তৈরি করতে হয়। অনেক ভাবনা জড়ো করেন একেকটা লেখার জন্য, তাকে মালা গাঁথার মতন করে একটু একটু করে গেঁথে তোলেন। লেখার পরে সেটা পাঠকের, কে কী ভাবল তার দায় কেন নেবেন মেঘনাদ? তবু কী কপাল, আজ তিনি কাঠগড়ায়।
দীপা আমি কী করে বোঝাবো এই গল্পটা তোর কিংবা পূর্ণিমার কথা বলার জন্যে নয়। এটা একটা ভাবনা, একটা থট প্রসেস থেকে আসা। সেই ভাবনাকে নোঙ্গর ফেলাতে তোদের জীবন থেকে নেওয়া কিছু ঘটনাকে জোড়া লাগানো হয়েছে মাত্র।
কীসের ভাবনা? শুনি একটু সেইটা। এক্সপ্লেন! দীপালি মাস্টারি করতে গেছিল, সেটা মনে আছে মেঘনাদের। হয়তো এখনো করে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা, পরনে আকাশি নীল বুটিদার তাঁতের শাড়ি, কানের কাছে চুলে পাক ধরেছে যা ঢাকার কোন চেষ্টা নেই। চেহারাটা শেষবার দেখা হওয়াতেই আটকে আছে, বলার ভঙ্গিতেও সেইরকম টান। যেন মেঘনাদ তার ছাত্র, বলছে উঠে দাঁড়াও হে মেঘনাদ। এই উপপাদ্যটি ক্লাসের সবাইকে বুঝিয়ে বলো।
ক্লাসই বটে। বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে দীপালি, পায়ের গোছ অবধি কাপড় তুলে দেওয়ালে হেলান দিয়ে পূর্ণিমা আর বাদী পক্ষের উকিলের মত দাঁড়িয়ে আছে সরমা। তবে দীপালির সঙ্গে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করলেন মেঘনাদ। মাস্টারনি যখন, গল্পটার ভিতরকার থিওরিটা বুঝতে পারবে হয়তো। কোথা থেকে শুরু করবেন ভাবছিলেন। একবার মনে হল সেরেনা উইলিয়ামসের ইউ এস ওপেন ফাইনাল থেকে শুরু করেন। কিন্তু সেটা না করে জিজ্ঞেস করলেন, জন হেনরিজম কথাটা শুনেছিস কখনো?
ওকে নিয়েই তো গাইতাম রে আমরা, হেমাঙ্গ বিশ্বাসের। মনে নেই মে দিবসে?
সেই গানের কথা খুব মনে আছে মেঘনাদের। তাদের সেই মিছিলে সবার আগে আগে থাকতো দীপালি। বেতের মত টানটান শরীর, পাথর কোঁদা মুখের ঘামে জ্যোতস্না বানাত গনগনে সূর্য, নিরাভরণ হাত সামনে বাড়ানো, মুষ্টিবদ্ধ। সেই দৃপ্ত ভঙ্গী দেখার মত ছিল! গাইতও গলা ছেড়ে। মেঘনাদরা পেছন থেকে ধুয়ো দিত।
জন হেনরি! জন হেনরি!
নাম তার ছিল জন হেনরি।
ছিল যেন জীবন্ত ইঞ্জিন,
হাতুড়ির তালে তালে গান গেয়ে শিষ দিয়ে খুশি মনে করে কাজ করে রাত দিন।
হো হো হো হো খুশি মনে করে কাজ করে রাত দিন।
মনে আছে রে দীপা, কিন্তু এ সেই জন হেনরি না। আমি বলছি জন হেনরি মারটিনের কথা। জানিস তো এই দেশে কালোদের সঙ্গে কী হয়? উঠতে বসতে সোজাসুজি কি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নানা রকমভাবে হ্যাটা করা হয়। হাতাহাতি খুনোখুনি তো হয়ই, যদি না হয় তখনো এর একটা চাপ আছে কিন্তু, রাইট?
সেটা কি আমাকে বুঝিয়ে দিতে হবে? আমাদের দেশে চাপ নেই?
না , না সেটা তো বটেই। এই চাপ বয়ে বেড়ানোর অনেক রকম রিয়াকশান থাকে, তারই নাম জন হেনরিসম।
খুব মন দিয়ে শুনছিল দীপালি, ওর চোখ দেখেই বুঝতে পারছিল সেটা। ভাল ছাত্র পেলে কেমন বিশদ করে বলার ইচ্ছাটা আরও বেড়ে যায়, তাও আবার দীপালিকে। মেঘনাদ একটা তৃপ্তি অনুভব করছিল।
এই জন হেনরি মারটিন লোকটা ছিল নর্থ ক্যারোলিনায়, বাবা ভাগচাষী। জীবনের চলার পথ থেকে এক একটা পাহাড় সরিয়ে এগিয়ে গেছে লোকটা, একশো একর জমি করে ফেলেছিল নিজের। কিন্তু চলার পথে জুটেছে শুধু অবজ্ঞা, অপমান। পাহাড় তো সরেছে কিন্তু তারপরে জীবনের আর কিছু বাকি থাকে না।
আমার বাড়িটা তোর মনে আছে মেঘা?
হ্যাঁ, একবার গেছিলাম তো তোদের পাড়ায়। মনে আছে মেঘনাদের, বাড়িতে খুব ধোলাই হয়েছিল পরে। দীপালিরা জাতে ডোম, ওরা যেদিকটায় থাকতো সেটার নামই ছিল ডোমপাড়া। সেখানকার বাড়িগুলো কাঁচা, মাথায় টালি কিংবা হোগলার চাল। বেশ নোংরাই লেগেছিল মেঘনাদের। মাঝখানে দীপালিদের বাড়িটা খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। গোবর নিকোন উঠোন, বেড়ার জানালায় সবুজ পর্দা। মেঘনাদকে দেখে কি খুশি যে হয়েছিল দীপালি! লাল রিবনে বাঁধা দুই বেনুনি দুলিয়ে লাফাতে লাফাতে বেরিয়েছিল এক ডাকে। শ্যামলঘন মুখে চকচক করা চোখদুটো ভেসে থাকতো সবসময়। সেদিনও মেঘনাদকে দেখে ঝিকমিক করে উঠেছিল। স্কুলের কেউ আসত না তো ওদের বাড়ি।
তোর জন হেনরির কথা শুনে বাপটার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে রে খুব। নিজে মড়া পোড়ানো আর নারকেল গাছ থেকে নারকেলের কাঁদি নাবানো ছাড়া আর কিছু জানত না। চালচুলো ছিল না কোন। সারা দিন মুখ গুঁজে খাটত আর আমাদের নিয়ম করে স্কুলে পাঠাত। গায়ে গতরে খেটে হোগলা পাতার বাড়ি পাকা করেছিল আমার বাপ, অথচ নিজে ভোগ করতে পারেনি বেশি। ওই যে বললি জন হেনরিজম, ওটা তো শুধু তোদের আমেরিকার কালোদের অসুখ নারে মেঘা। কত গালি, চড়চাপড় খেতে খেতে বড় হওয়া আমাদের মত ছোটজাতের লোকেদের, আর মেয়ে হলে তো কথাই নেই।
এতক্ষণ বাদে মেঘনাদের মনে হল অবস্থাটা যেন একটু হলেও তার আয়ত্তে এসেছে। নিজের গলায় বিশ্বাস ফিরে পেতে পেতে বলল – কারেক্ট, আর সেই জন্যেই আমি এই গল্পটা আমাদের দেশের পটভূমিকায় লিখেছি।
সরমা এতক্ষণ চুপচাপ শুনছিল। এখন আবার ঝেঁঝে উঠল। মেঘনাদ যে জ্ঞানের বেলুনটা ফুলিয়েছিল তাকে এক ঝটকায় ফুটো করে দিল। তোমার ব্যাখ্যান তো অনেক শুনলাম, কিন্তু এতে আত্মহত্যা করার কথা কোনখানে আসছে শুনি? তোমার হেনরিজম ফলাতে হলে আমার ব্লাড প্রেশার বাড়াতে পারতে, আলসার, জন্ডিস যা তোমার কলমে আসে। আমাকে আত্মহত্যা করাতে হল কেন? আমি মেয়ে বলে?
পূর্ণিমাও খরখর করে উঠল আবার। অনেক বড় বড় কথা বলছ দিকিন ছোড়দা। অতোশত আমি হদিশ পাই না। তবে এইটুকুন বলি একটা লোক অন্যায্য করে, তার সঙ্গে আরও দশটা লোক তাল দেয়। সেটা হলি মানুষের আর বেঁচে থাকার খ্যামতা থাকে না।
কী বলতে চাইছ তুমি? আমি তখন ছোট, কীভাবে তাল দিলাম?
তুমি দাওনি যদি তোমার মা দিয়েছে, তুমার মামারে ডেইকে তম্বি করল আমার উপর। ওরা কি জানত না আমার পেট কেন হল? কে করল এমন?
সরমা অধৈর্য হয়ে উঠছিল। আহা পূর্ণিমা, সে যা হয়েছে হয়েছে। ছোট বয়সে সেটা আটকানো ওর হাতে ছিল না। কিন্তু গল্পে আমাকে মারা কিংবা না মারাটা সম্পূর্ণ ওর হাতে।
না, না। দুটোর মধ্যে যোগ আছে সরমা। দীপালি নড়ে চড়ে বসল। লেখক কে, কী লেখে সে? তার অভিজ্ঞতা, জীবনকে দেখার ধরণ। সে তাই ঘটাতে চায়, যেটা ঘটালে তার অবস্থান বজায় থাকে। সে গল্পেই হোক, কিংবা জীবনে। মেঘনাদ প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল, এক ঝটকায় থামিয়ে দিল দীপালি। চুপ কর মেঘা, আমি সব জানি। সবকিছু শুনছিলাম। পূর্ণিমার সময় না হয় তুই ছোট ছিলি। মায়ের কাছে বাবার হারামিপনা ফাঁস করতে পারিস নি, কিন্তু আমাকে যখন সবাই কোণঠাসা করে দিল তখন তুই কিছু বলতে পারিস নি? তখন কেন মুখে কুলুপ এঁটেছিলি?
কখন কুলুপ আটলাম? কোন ঘটনার পরে?
বারবার, অনেকবার।
কোন কোন ঘটনার পরে দীপা?
মনে আছে ক্লাসে একদিন টিফিন পিরিয়ডে, অতনুর টিফিন বাক্সে আমার হাত লেগে গিয়েছিল, তাও বাইরে থেকে। ও খ্যাক খ্যাক করে উঠল, বলল দিলি তো আমার খাবারটা নষ্ট করে। তারপর সবার সামনে খাবারের বাক্সটা দেখিয়ে দেখিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দিল। কেউ কিছু বলল না, তুইও না।
দীপালি এসব পঞ্চাশ বছর আগের কথা, লোকের এসব ছোঁয়াছুয়ির বাতিক ছিল তখনো। তাছাড়া আমি নিজে তো এরকম করতাম না, বরং আমি তোর বাড়িতেও গেছি।
সেটাই তো আরও যন্ত্রণার মেঘা। আর কেউ কিছু না বললে কম আসে যায় মানুষের। কিন্তু যাদের প্রতিবাদ করার কথা তারা যখন চুপ করে থাকে গায়ে বাজে বেশি। তবু আমি এই ঘটনায় দোষ দিইনি তোকে। শুধু বললাম, তোর মধ্যে প্রতিবাদ করার শক্তির অভাব বোঝাতে। তুই আসলে কনফরমিস্ট। প্রতিবাদী কণ্ঠ নেই তোর, লেখায় সেটাই তো আসবে।
এই একটা ছোট ঘটনা থেকে এত বড় কনক্লুসন টেনে ফেললি। কটা লেখা পড়েছিস আমার? উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিল মেঘনাদের গলা।
তাই, এটা একটা ঘটনা? আচ্ছা মেঘা, আমাকে যখন শুভাশিষ স্যার ক্লাসে পড়া না পারলে বলত, আচ্ছা আচ্ছা তোমার না জানলেও চলবে, মড়া পোড়ানোর জন্য কি আর এইসব পড়তে লাগে – তোর মনে হয়নি প্রতিবাদ করার দরকার?
আমাদের সময়ে আমরা ক্লাসে স্যারদের মুখের উপর কিছু বলতাম না।
আর প্রশান্ত যখন বলত, তোদের তো অনেক কোটা আছে, না পড়লেও চলে। আমাদের শালা এই পইতে জুটেছে একটা, একেবারে হাতে হ্যারিকেন। না পারি ছিঁড়তে, পা পারি ফয়দা তুলতে। তখন কেন বলতে পারিস নি, প্রশান্ত তোরও কোটা আছে, বংশানুক্রমে পেয়েছিস সেটা। তাই তুই তিনটে প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে যাস তোর বাপ প্রফেসার হওয়া সত্ত্বেও। আর দীপালির না আছে বাড়িতে কেউ দেখাবার, না মুরোদ আছে মাস্টার রেখে পড়ার। বলতে পারতিস না এটা?
এইসব বলে কী লাভ হত বল, গায়ে না মাখলেই হল। অনেক সময় উপেক্ষা করাটাই বড় অস্ত্র।
আর উপেক্ষা করতে না পারলে, যন্ত্রণা সহ্য করতে না পারলে মরে যাওয়াটা। তাই না? ঘৃণায় ঠোঁটটা বেকে গেল দীপালির। এই যে কলেজের জি এস তারাপদ আমাকে ব্যবহার করল, ভোটে জিতল আর তারপর সবার সামনে আমাকে যাচ্ছেতাই- সেখানেও কিছু বলার ছিল না তোর?
কীভাবে ব্যবহার করল? তোকে ভোটের প্রচারে রেখেছিল। তুই একজন অ্যাক্টিভ মেম্বার ছিলি।
হ্যাঁ প্রচারের জন্য, আমি একটা মুখ ছিলাম। একটা সিম্বল। কিন্তু যখন রাহুলরা আমার নামে কেচ্ছা করল, তখন কেমন হাত গুটিয়ে নিল? তুইও?
রাহুলের সঙ্গে কী হয়েছিল সেটা তোর ব্যক্তিগত ব্যাপার ছিল। সেটা সামনে এসে যাওয়ায় ছাত্র ইউনিয়ানের বদনাম হচ্ছিল –
সমস্তটা বানানো ছিল, তুই জানিস সেটা। রাহুল জানত আমার জন্য তারাপদরা অনেক ভোট টেনেছে। আমাকে শেষ করে দিতে চাইল, আমার পিছনে লাগল। হয়তো আমি কিছু বোকামি করেছিলাম, বয়েসটা কম ছিল তো। কিন্তু আমার কি তকমা জুটল? ওদের জাতের মধ্যে এমনটা চলে, ওরা এরকমই- কি জাত আমার? মানুষ জাতের বাইরে হয়ে গেলাম আমি?
কিন্তু তুই তো এসবে পাত্তা দিস নি, আমাকে দরকার ছিল না তোর।
কে বলেছে আমার দরকার ছিল না? দিনের পর দিন নিজের সঙ্গে লড়াই করেছি। লড়াই করার ক্ষমতা ছিল, মরে যাইনি। আমার কথাই যদি লিখবি সেই লড়াইয়ের কথাটা লিখতে পারতিস। আমি হয়তো জিতিনি সেদিন, কিন্তু হারিও নি। অন্তত তোর লেখায় জিতিয়ে দিতে পারতিস!
একদম ঠিক কথা। আমি মরতে যাবো কেন? আমি তার বদলে জোর গলায় চেঁচাতে পারতাম, মুখোশ খুলে দিতাম অন্তত আরও দুটো লোকের। সেটা করতে গিয়ে আমার আলসার, জন্ডিস কিংবা হার্টের ব্যামো হত না হয়। সরমা আবার গলা তুলল।
মেঘনাদের এবার নিজেকে কোণঠাসা লাগছিল। আহা, আমি তো একটা দিক বললাম। গল্পের কারবার তো মন নিয়ে। প্রতিবাদটা মুখ্য ব্যাপার ছিল না। গল্পটার মোদ্দা ব্যাপার ছিল শরীর কিভাবে স্মৃতিধারণ করে। অপমান গালাগালি, উপেক্ষার মুহূর্তগুলো কেমনভাবে শরীরে স্মৃতিচিহ্ন রেখে যায়। জন হেনরিজম একটা শারীরিক দিক, এর একটা মানসিক দিকও তো আছে। অপমানের স্মৃতি বয়ে বেড়াতে বেড়াতে একদিন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। যে ঘটাচ্ছে সে তখন আর নিয়ন্ত্রণে নেই। তাই কোন খাতে যে বইবে সেটা সে নিজেই কি জানে? যেমন গল্পে তুমি স্বপ্ননীলকে যখন চড় মারলে দশটা লোকের সামনে, কী হল? তারা দেখল ছেলেটা তেমন কিছুই করেনি, অথচ তুমি এত ভাল একটা ছেলেকে এমনভাবে অপমান করলে। তারা তো জানে না, সবার অগোচরে সে তোমাকে এতদিন বিরক্ত করেছে। তোমার দৌড়াবার রাস্তায় পিছন পিছন মোটর সাইকেল গুটগুটিয়ে এসেছে। কিন্তু তুমি সেই সময় দাঁতে দাঁত চেপে সেটা মেনে নিয়েছ। কিংবা ভয় পেয়েছ সামনে আর কেউ নেই, এই সময়ে মুখের উপর কিছু বললে যদি আরও খারাপ কিছু করে? কিন্তু তোমার মনে এটা চাপা ছিল। বেরিয়ে এলো কখন? যখন তোমার মনে হল এতদিন যেটা আড়ালে করত, এখন ছেলেটা সবার সামনে করছে। তুমি ফেটে পড়লে, দুম করে চড় মেরে বসলে। কারণ তোমার শরীরে মনে আগেকার অপমানের স্মৃতি কাজ করছিল। তারপর যখন এটা করে ফেললে, অথচ কেন করলে সেটা বোঝাবার কোন অবকাশ রইল না, তুমি দেখলে তোমার আর কোন রাস্তা খোলা নেই-
নিজের গল্পের চরিত্রের মনের কথা এমন হুবহু পড়া যায়। কিংবা বলতে পারিস লেখক নিজের মত করে বানিয়ে নিতে পারে, থিওরি ঝাড়তে পারে তারপর। কিন্তু সত্যিই কি জানিস তুই এই রকম সময়ে কোণঠাসা মানুষ কিভাবে রিয়াক্ট করে। আত্মহত্যার রাস্তাটাই কেন খোলা থাকবে শুধু সরমার জন্য?
সবাই একভাবে করে না নিশ্চয়। সেটা মানি আমি। যেমন যেই ব্যাপারটা থেকে আমার মনে গল্পটার শুরু, সেরেনা উইলিয়ামসের ইউ এস ওপেন ফাইনাল। কিভাবে আগের একেকটা ম্যাচে ওর এগেন্সটে একটার পর একটা ভুল সিদ্ধান্ত –
খুব একচোট হাসল এবার দীপালি। এই গল্প তোকে টিভিতে সেরেনা উইলিয়ামসের খেলা দেখে ভাবতে হল? চোখ খোলা ছিল না তোর যখন আমাকে নিয়ে কলেজে হুজ্জৎ হয়েছিল?
অসহায় বোধ করছিল মেঘনাদ।
ঠিক আছে সেরেনাকেই দ্যাখ। ও তো টেনিস র্যাকেট ছুঁড়ল। আর আমি? আমি তোদের কলেজ থেকে ট্র্যান্সফার নিয়ে চলে গেলাম। আর ওই যে তোর জন মারটিন না কে, তার শরীরে হরেক দোষ দেখা দিল। তাই তো? কিন্তু সরমার জন্য তোর মনে ধরল পূর্ণিমার আত্মহত্যার ঘটনাটা। বেশ গলা তুলেই হাসল এবার দীপালি। কেন সেটা ভেবে দেখেছিস একবারও?
না, ভাবিনি। গল্পের চরিত্র যেভাবে এগোতে চেয়েছে –
নিকুচি করেছে তোর গল্পের চরিত্রের। কে এই চরিত্র? তুই, বুঝলি তুই। দীপালি তর্জনীটা প্রায় মেঘনাদের বুকে ঠেকিয়ে দিয়েছিল। তোর দেখার চোখ, তোর সামাজিক অবস্থান। সেখানে তুই মেয়েদের দুর্বল দেখতে বেশি স্বচ্ছন্দ, তারা লড়াই করে না, আত্মহত্যা করে। পূর্ণিমা তোর সেই ভাবনায় খুব স্যুট করে। আমি করি না। সরমারা আত্মহত্যা করলে তোর পূজ্যনীয় পিতাজীর ছবিতে মালা ঝোলাতে সুবিধা হয়।
অভিমন্যুকে সপ্তরথী ঘিরে ধরেছিল। মেঘনাদকে শুধু তিন জন। তবু খুব অস্বস্তি হচ্ছিল সাহিত্যিক মেঘনাদ বসাকের। কেমন একটা ন্যাংটো ন্যাংটো লাগছিল নিজেকে।
ভাল লাগল....
ভাল লাগল।
ঠিক, সরমারা আত্মহত্যা করলে লেখকের সবদিক রক্ষা হয় - একটা ছাড়া - উলঙ্গ হয়ে পড়ার হাত থকে বাঁচা যায়না। তাতে অবশ্য অসুবিধা হয় না, সয়ে যায় যে। তা ছাড়া, লেখক এও জানেন, তার গল্পের পাঠকরাও তার-ই মত।
অসাধারণ গল্প। আর এই গল্পের বয়নও অতি আধুনিক । বিষয়টি লেখক এবং পাঠক, এই সমাজের গালেও একটি চড়। এমন আত্মবীক্ষণ জরুরি। আমাদের পরের প্রজন্ম তাদের কন্ঠস্বর খুঁজে পেয়েছে, আঘাত করতেও জেনেছে।
খুব ভালো গল্প।ভাবনার জটিল স্তরগুলি একটু একটু করে যেভাবে উন্মোচন করেছেন গল্পকার, তাতে পাঠককে হাজির হতে হবে নিজস্ব উপলব্ধির উঠোনে।
ভালো লাগলো গল্পটি।