সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯–২০০৩) ছবি: নাসির আলী মামুন, ফটোজিয়াম। সৌজন্য: প্রথম আলো, ঢাকা।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় ভারতের কবি কিন্তু ‘বাংলাদেশের ছেলে’। ‘বাংলাদেশের ছেলে’, কারণ তাঁর গ্রাম ছিল চুয়াডাঙা জেলার দর্শনার লোকনাথপুর। শৈশবের একটা বড়ো সময় কেটেছে বাংলাদেশের নওগাঁ জেলায়। আট-নয় বছর বয়সে সেখানে তিনি মাইনর স্কুলে ভরতি হন। জীবনের প্রথম কবিতাও লেখেন এই নওগাঁতেই। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের গারো পাহাড় থেকে চট্টগ্রাম, সিলেট থেকে যশোর-সাতক্ষীরা সব এলাকা ছিল সুভাষের চষা। অভিন্ন ভাষার কবি—এই সম্পর্কসূত্র বাদ দিলেও সুভাষ বাংলাদেশের কাছের মানুষ। সুভাষ মুখোপাধ্যায় সেই কবি যিনি পশ্চিমবাংলা আর বাংলাদেশের মাঝখানের কাঁটাতারকে কোনোদিনই পাত্তা-টাত্তা দেননি। বা বলা যায়, পরস্পরের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মাঝের পাহারাকে কিছুই মনে করতেন না। ১৯৫৭ সালেই ‘ফুল ফুটুক’ কাব্যগ্রন্থে তিনি উচ্চারণ করে রেখেছেন, ‘আমরা যেন বাংলাদেশের/চোখের দুটি তারা।/মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে/থাকুক গে পাহারা।/দুয়োরে খিল।/টান দিয়ে তাই/খুলে দিলাম জান্লা/ওপারে যে বাংলাদেশ/এপারেও সেই বাংলা।’
এই বলা শুধু ‘বাংলাদেশের ছেলে’র তীব্র আবেগী উচ্চারণ নয়। এর সাথে তাঁর বিশ্বমানব বিষয়ক রাজনৈতিক বিশ্বাসেরও হয়তো গভীর যোগ থেকে থাকতে পারে। উপরের উচ্চারণের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক যদি নাও থাকে বাংলাদেশের সাথে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক সম্পর্ক তো আছেই। যেমন আছে রবীন্দ্রনাথের সাথেও। কারণ, তাঁদের উভয়ের সৃষ্টিকর্মই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছে। ফলে, বাংলাদেশের সুভাষ আর পশ্চিমবাংলার সুভাষ আলাদা। সুভাষের নামের সাথে বাংলাদেশের রক্তের সম্পর্ক। বাংলাদেশের প্রথমা প্রকাশন থেকে প্রকাশিত মতিউর রহমান সম্পাদিত শতবর্ষে সুভাষ মুখোপাধ্যায়: বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রন্থটি সেই রক্তের ঋণস্বীকারের প্রচেষ্টা।
বলছিলাম, কলকাতা আর ঢাকার সঙ্গে সুভাষের পার্থক্যের কথা। এই পার্থক্যের আঁচ টের পাওয়া যাবে শতবর্ষে সুভাষ মুখোপাধ্যায়: বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রন্থের অধিকাংশ লেখার মধ্যে। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে আবুল হাসনাতের ‘কবির বিবেকি প্রতিকৃতি’ লেখাটি। সেখানে হাসনাত তাঁর এক স্মৃতির উল্লেখ করতে গিয়ে কলকাতার ‘মৃদু’ সুভাষ আর ঢাকার ‘অগ্নিঝরা’ ‘উদাত্ত আহ্বানের’ সুভাষকে আবিষ্কার করেছেন। পড়া যাক হাসনাতের লেখার সেই অংশটুকু, ‘১৯৭২ সালের এপ্রিলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় আমাদের প্রাণপ্রিয় বন্ধু গায়ক ইকবাল আহমেদের কণ্ঠে এ গানের [ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য] সুরে কেমন আবিষ্ট ও স্পন্দমান হয়েছিলেন, এ আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। কলকাতায় সংস্কৃতি সংসদের ১৮ জনের একটি দল গিয়েছিল মৈত্রমেলায়। রবীন্দ্রসদনের সম্মুখে খোলা মাঠে একটি অনুষ্ঠানেও এ গানটি গাওয়া হয়েছিল। কলকাতায় আবৃত্তি হত ঢিলে ও মন্দ্রলয়ে, স্বরের ওঠানামায় কোথায় যেন কোমল ভাব ছিল। আর লুৎফর রহমান সুরারোপিত গানে শুধু আবেগ নয় বা কবিতার তির্যক বাক্ভঙ্গিমা নয়, উদাত্ত আহ্বানের গমকে ভরে যেত শ্রোতার হৃদয়-মন। মুক্তিযুদ্ধ-পূর্বের সেই অগ্নি-ঝরা দিনগুলোতে ইকবাল আহমেদ কখনও একক কণ্ঠে, কখনও সম্মিলিত ভাবে এ গানটি গেয়েছেন ট্রাকে ও সংস্কৃতি সংসদের অনুষ্ঠানে।’ (পৃ ১০০-১০১) বোঝাই যাচ্ছে, সুভাষ মুখোপাধ্যায় দুই বাংলায় একই ভাবে পঠিত ও গৃহীত হন না।
বাংলাদেশের সাহিত্যসমাজ যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কাছের মানুষ মনে করেন তারই আবেগী প্রকাশ ঘটেছে শতবর্ষে সুভাষ মুখোপাধ্যায়: বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রন্থের প্রায় সব ক-টি লেখাতে। মফিদুল হকের ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়: বাংলাদেশের সালাম’ শিরোনামের লেখার কথাই ধরা যাক। ওই রচনায় তিনি বলেছেন, ‘একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সুভাষ মুখোপাধ্যায় নিবিড় ভাবে যুক্ত হলেন মুক্তিসংগ্রামী মানুষজনের সঙ্গে। জহির রায়হান থেকে শুরু করে অনতি তরুণ কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র-যুবা, মুক্তিযোদ্ধা কতজনের সঙ্গে যে তাঁর আত্মিক যোগ গড়ে উঠল সে হিসাব রাখাও দুঃসাধ্য।’ (পৃ. ১১২-১১৩) এমনকি বাংলাদেশ স্বাধীন হবার আগেই ৩ ডিসেম্বরের পরে সুভাষ মুখোপাধ্যায় যুদ্ধোন্মত্ত বাংলাদেশে ঢুকে পড়েন। যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরার বিচিত্র এলাকা ঘুরেছেন। মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে তাদের উদ্বুদ্ধ করতে পড়ে শুনিয়েছেন জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা কাব্যের বিচিত্র কবিতা। তিনি বাংলাদেশ বিষয়ে এত লিখেছেন যে, বাংলাদেশ বিষয়ক সুভাষের সব লেখা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ১৯৮৮ সালেই ‘বাংলা আমার, বাংলাদেশ’ নামে পূর্ণাঙ্গ বই বেরিয়েছে। এই গ্রন্থেই রণেশ দাশগুপ্তের ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা: কিছু কথা’ শিরোনামে একটি লেখা আছে। সেখানে সুভাষের কবিতার যে-আটটি বাঁকবদল নির্দেশিত হয়েছে তার একটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। রণেশের ভাষায়, ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন কবির মনে নতুন আশার বাতি জ্বেলেছে, তখন এখানে-সেখানে ছড়িয়ে থাকা সাথিদের ফিরে পাওয়ার জন্যে গভীর অপেক্ষা ও আগ্রহ নিয়ে লেখা এই কবিতাগুলি [ছেলে গেছে বনে কাব্যের কবিতাগুলি]।’ (পৃ. ২০) সনজীদা খাতুন তাঁর ‘যাত্রাসঙ্গী সুভাষ মুখোপাধ্যায়’ লেখায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা-ব্যাকুল সেসব যুদ্ধদিনে সুভাষ মুখোপাধ্যায় ওই গানটির [ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য] ভেতর দিয়ে আমাদের যাত্রাসঙ্গী হয়েছিলেন।’ (পৃ. ৩৪) আর এই গ্রন্থের সম্পাদক মতিউর রহমান তো তাঁর লেখার শিরোনামই দিয়েছেন ‘তিনি আমাদেরই লোক’। দারুণ উষ্ণ আবেগে মতিউর রহমান তাঁর স্মৃতিকথামূলক লেখাটিতে সুভাষের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের সূত্রগুলো উদ্ঘাটন করেছেন। শুধু তাই নয়, লেখাটিতে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে কবি আর মানুষ হিসেবে অঙ্কনের চেষ্টা করেছেন মতিউর রহমান। আলোচ্য গ্রন্থটিতে স্মৃতিচারণমূলক লেখা আছে পাঁচটি। আনিসুজ্জামানের ‘মুখুজ্যের সঙ্গে আমার আলাপ’, বেলাল চৌধুরীর ‘আমাদের কাছে সুভাষদা চিরসবুজই থাকবেন’, হায়াৎ মামুদের ‘সান্নিধ্যের সম্মোহন: সুভাষদা’, মতিউর রহমানের ‘তিনি আমাদেরই লোক’, আবুল হাসনাতের ‘কবির বিবেকি প্রতিকৃতি’। এর মধ্যে মতিউর রহমান আর আবুল হাসনাতের লেখায় সুভাষের কবি-স্বভাবের রেখাচিত্র আঁকার চেষ্টাও লক্ষ করা যায়। অন্যগুলো মূলত ব্যক্তিগত স্মৃতিরই আলেখ্য।
এগ্রন্থের মূল্যায়নমূলক লেখার মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ লেখা বোধকরি রণেশ দাশগুপ্তের ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা: কিছু কথা’। শুধু এই গ্রন্থের নয়, সুভাষের কবিতা সম্পর্কিত দুই বাংলার যাবতীয় মূল্যায়নের মধ্যে এই লেখাটি বিশেষ তাৎপর্যের দাবি রাখে। কারণ, তিনি সুভাষকে প্রথাগত ভাবে চল্লিশের সমাজতান্ত্রিক ধারার মধ্যে না দেখে আধুনিক বাংলা কবিতার অগ্রগতির ধাপ হিসেবে দেখেছেন। দৈশিক আর বৈশ্বিক পরিস্থিতির সাথে মিলিয়ে সুভাষকে এত সংক্ষিপ্ত পরিসরে বাংলা কবিতায় স্থাপন করার দ্বিতীয় দৃষ্টান্ত আছে কি না সন্দেহ। এই লেখাটি গ্রন্থভুক্ত শামসুর রাহমানের ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা’ লেখাটির ঠিক যেন বিপরীত। শামসুর রাহমান সুভাষকে পড়তে চান তাঁর রাজনীতিকে সরিয়ে রেখে। রাজনৈতিকতা তৃতীয় বিশ্বের কবিদের নিয়তির মতো বলে মেনে নিয়েও রাহমান বলেছেন, ‘কবিকে রাজনীতিবিদ গ্রাস করে ফেলে।’ তিনি সুভাষের যত দূরে যাই (১৯৬২)-এর আগের কবিতাগুলো সম্পর্কে বলেছেন, ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবির কলমটিকে পার্টি অফিসের দেরাজে তালাবন্দি করে রেখেছিলেন।’ (পৃ. ২৭) কিন্তু রাজনৈতিকতাকে বাদ দিয়ে সুভাষের কবিতা পড়াকে রণেশ দাশগুপ্ত ‘বিমূর্ত চেষ্টা’ বলে খোঁচা দিয়েছেন। সুভাষের কবিতার রাজনৈতিকতা সম্পর্কে রণেশ বলেছেন, ‘এটাকে চাপা দিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতার স্বাদ পাওয়ার যে-কোনো রকম বিমূর্ত চেষ্টা নখ তুলে দিয়ে সুন্দর হাতকে নরম করার চেষ্টা মাত্র।’ (পৃ. ২০) রণেশ দাশগুপ্ত আর শামসুর রাহমানের দুই মেরুবর্তী মূল্যায়নকে একমলাটে আবদ্ধ করে দুই ভিন্ন কাব্যতত্ত্বের আলোকে সুভাষকে দেখার যে-সুযোগ সম্পাদক মতিউর রহমান করে দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রসংশার দাবিদার। এর বাইরে গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত পিয়াস মজিদের ‘জাগুন জাগুন পাড়ায় আগুন’ লেখাটিতে সুভাষের কাব্যপ্রবাহের বাঁকগুলো ধরার চেষ্টা লক্ষ করা যায়।
অবশেষে, বইটির সম্পাদনা কর্মবিষয়ে কথা বলা জরুরি। কথাটা সরাসরিই বলা দরকার। আজকাল বই সম্পাদনা একটা গায়ের জোরে পরিণত হয়েছে। যার যা কাজ না তিনি তাই করে বসছেন। কিন্তু শতবর্ষে সুভাষমুখোপাধ্যায়: বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি বইটিতে সম্পাদকের নাম দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মনে হল, যাক এ-যাত্রায় সুভাষও রক্ষা পেলেন আর পাঠকও বোকা বনলেন না। কারণ, বইটি সম্পাদনা করেছেন মতিউর রহমান। তিনি সুভাষ-সম্পাদনার অধিকার রাখেন। সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের তিনি পরিচিত-ঘনিষ্ঠজন ছিলেন এজন্য অবশ্যই নয়। প্রথম কারণ এই যে, তিনি বাংলাদেশে সুভাষের রাজনীতির মানুষ। দ্বিতীয় কারণ, তিনি বাংলাদেশের বাম ঘরানার সাংস্কৃতিক চর্চার ইতিহাসের খুব কাছের মানুষ, সক্রিয় কুশীলবও বটে। ষাটের দশকের পাকিস্তান-বিরোধী বামপন্থী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন-সংগ্রামের তিনি সক্রিয় কর্মী ছিলেন। রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামে সুভাষের কবিতার তিনি সরাসরি মাঠপর্যায়ের ভোক্তা। শতবর্ষে সুভাষ মুখোপাধ্যায়: বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি বইটির ভূমিকায় মতিউর রহমান বলেছেন, ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায় ও তাঁর কবিতাকে আমরা জেনেছিলাম ষাটের দশকের শুরুতেই। সেসময়ে পাকিস্তানের সামরিকতন্ত্রের বিরুদ্ধে দেশবাসীর, বিশেষ করে ছাত্রসমাজের প্রবল আন্দোলনের পোস্টার, ব্যানার, গান আর আবৃত্তিতে সুকান্ত-সুভাষের কবিতার উজ্জ্বল পঙ্ক্তিগুলো স্থান পেয়েছিল। আজও মনে পড়ে সেইসময়ের একটি পোস্টারে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘ঘোষণা’ কবিতা থেকে নেওয়া স্লোগান, ‘এ দেশ আমার গর্ব/এ মাটি আমার চোখে সোনা’। কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে যে, সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে আরো গভীর মূল্যায়নধর্মী লেখা সমৃদ্ধ আরও ভালো গ্রন্থের সম্পাদনা এই সম্পাদকের হাত দিয়েই হতে পারে। শতবর্ষে সুভাষ মুখোপাধ্যায়: বাংলাদেশের শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রন্থটি যেন তারই আভাস।
ভালো লেগেছে ।
প্রিয় কবি সম্পর্কে আরো নতুন কিছু জানলাম ।
স্যার অনেক শুভকামনা রইলো আপনার জন্য।
সুভাষ মুখুজ্জে কে ঈর্ষা করি, হিংসা করি, ভালোবাসি। তাঁর পাঠ, পরাপাঠ আনন্দদায়ক। অনেক ধন্যবাদ, হুদা ভাই তুলনামূলক সুভাষ পাঠ উপস্থাপনের জন্য।