নিউ ইয়ার্স ইভে যখন সারা বিশ্ব নতুন বছরকে স্বাগত জানাচ্ছে তখনও কেউ কি ভাবতে পেরেছে এই দুই হাজার বিশ এতটা বিষময় হয়ে উঠবে? সামাজিক জীব হিসেবে নিজের পরিচয় স্থির করা মানুষই বাধ্যত শিখে ফেলেছে সামাজিক দূরত্ব। কর্মক্ষম মানুষের একটা অংশ এখন ওয়ার্কিং ফ্রম হোম।
যাঁদের ক্ষেত্রে সেই ফর্মুলা প্রযোজ্য নয় তাঁরা কীভাবে চালাচ্ছেন বেঁচে থাকার লড়াই? বাড়িতে বসে আমরা যারা বিনোদন খুঁজে নিচ্ছি টিভি সিরিয়াল কিংবা সিনেমায়, কেমন কাটছে সেই বিনোদন জগতের সঙ্গে যুক্ত মানুষদের কর্মজীবন?
স্বাস্থ্যবিধি মেনে নতুন করে শুটিং শুরু হবার পর ইউনিট এর সদস্য সংখ্যা কমেছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে কর্মহানিও। গত আঠারো কুড়ি বছর ধরে জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে টলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন বিজন পোদ্দার। কুসুমদোলা, চোখের তারা তুই, রানী রাসমণি, লোকনাথ বাবার মতো একাধিক সিরিয়াল ছাড়াও বস টু, হামি, সুলতানের মত বেশ কিছু ছবিতে জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে অভিনয় করেছেন। গত ছ'মাস ধরে তিনি বাড়িতে বসে। বললেন, “এখন নতুন নিয়ম অনুযায়ী ইউনিট এর সদস্য সংখ্যা বেঁধে দিয়েছে। আর্টিস্ট, জুনিয়র আর্টিস্ট, টেকনিশিয়ান লাইট ম্যান, আর্ট ডিপার্টমেন্ট, ম্যানেজার, ক্যামেরা ম্যান, ড্রেসার, প্রোগ্রামার সব মিলিয়ে ৩৫-৪০ জন। সেখানে আমাদের কল নেই বললেই চলে। আমি গত ছ'মাসে একটামাত্র কল পেয়েছিলাম। এখন খাওয়া-দাওয়ার কোনও ব্যবস্থা নেই সবটাই বাড়ি থেকে নিয়ে যেতে হচ্ছে আমাদের।” কিছুটা একই সুর শোনা গেল ইন্ডাস্ট্রির আরেক জুনিয়র আর্টিস্ট প্রশান্ত মাইতির গলায়ও। গত নয় বছর ধরে জুনিয়র আর্টিস্ট হিসেবে ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করছেন প্রশান্ত মাইতি। তিনি জানালেন, “এই কাজের উপর ভর করেই আমাদের সংসার চলত। গত পাঁচ মাস কোনও কাজ নেই। একবার শুধু ৫০০ টাকার কুপন দিয়েছিল। এখন যা পরিস্থিতি তাতে ছেলেমেয়ের পড়াশোনার খরচ, ইলেকট্রিক বিল পর্যন্ত দিতে পারছি না। ভেবেছিলাম ভদ্র সভ্য লাইন, রুজি-রোজগার টাও ভালই হতো। এখন পুরোপুরি বাড়িতে বসে আছি। অন্য কোনও ধরনের কাজ যে করব তারও উপায় নেই।”
একই ভাবে কাজ কমলেও অন্য পেশায় যাওয়ার কথা ভাবতেই পারছেন না টালিগঞ্জের ইলেকট্রিশিয়ান পলাশ বন্দ্যোপাধ্যায় এর মত মানুষেরাও। গত কুড়ি বছর ধরে টলিউডের এই পেশার সঙ্গে যুক্ত আছেন তিনি। জানালেন, “আগে মাসে গড়ে ২২-২৫ দিন কাজ থাকত। এখন সেটা ১০-১১ দিনে এসে দাঁড়িয়েছে। ফেডারেশনের তরফ থেকে একবার সাহায্য করা হয়েছিল। আমাদের মেম্বারও তো প্রচুর। এখন ওয়েব সিরিজ, টেলিভিশনের কাজই করছি।” প্রোডাকশন অ্যাসিস্ট্যান্ট গোপাল বর্মন বললেন, “করোনার জন্য এখন কাজের বাজার ডাউন। হল খুলছে না। সিনেমার কাজ হচ্ছে না। টেকনিশিয়ানদের ভরসা কেবল মেগা সিরিয়াল, কিছু অনলাইন প্রোগ্রাম আর ওয়েব সিরিজ। বিজ্ঞাপনের কাজও তেমন নেই।”
পড়ুন, শুধু কি লকডাউনের জন্যই সাংবাদিক ছাঁটাই?
টালিগঞ্জের এক জনপ্রিয় অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টরের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল লকডাউনের পর ইন্ডাস্ট্রি চালু হওয়ার সময়ে গিল্ডের তরফ থেকে বিশেষ নোটিশ জারি হয়েছে। সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে এই করোনা পরিস্থিতিতে প্রোডাকশনের অনুমতি ছাড়া শুটিংয়ের কাজকর্ম সংক্রান্ত কোনওরকম তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। এমনকী প্রকাশ করা যাবে না নিজের নামও। তিনি জানালেন আগের তুলনায় কাজের চাপ অনেকটাই বেড়েছে এখন। অল্প সময়ে বেশি ফুটেজ দিতে হচ্ছে।
গত বছর ডিসেম্বরে কলকাতায় শুটিং হয়েছিল অজয় দেবগন অভিনীত ময়দান সিনেমার। ছবির অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ছিলেন জ্যোতির্ময় চক্রবর্তী। এর আগে অংশুমানের ছবি, এক ফালি রোদ, গোয়েন্দা গোগোল এর মত বেশ কিছু ছবিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। জানালেন, “এই লকডাউনে মাত্র চারদিন কাজ করেছি। লকডাউন সংক্রান্ত একটি টেলিফিল্মের কাজ ছিল। তবে কাজ করতে গিয়ে যেটা মনে হয়েছে, সোশ্যাল ডিসট্যান্স সেভাবে থাকে না। এই যেমন আমি মনিটরে বসে কন্টিনিউটি দেখছি। হঠাৎ করে অ্যাসিস্ট্যান্ট ক্যামেরাম্যান এসে আমার পাশে বসে পড়ে ফোকাসটা দেখবে বলে। আমি তো তাকে বলতে পারব না তুমি সরে যাও। কারণ সে তার কাজ করছে আমি আমার কাজ করছি। তবু তার মধ্যেও বারবার করে স্যানিটাইজ করা চলছে। সবাই কিন্তু সচেতন। প্রোডাকশনের তরফ থেকে স্যানিটাইজার তো দেওয়াই রয়েছে তা ছাড়াও দেখলাম প্রত্যেকের পকেট ছোট স্যানিটাইজার রয়েছে। আমাদের চার দিনের শুটিংয়ে ১৫ লিটার স্যানিটাইজার খরচ হয়েছিল। এখন কাজ কমেছে কারণ অনেক প্রযোজকরাই ইনভেস্ট করতে ভয় পাচ্ছেন। ছবি আদৌ মুক্তি পাবে কিনা তারই তো নিশ্চয়তা নেই।”
এখন নিয়ম হয়ে গিয়েছে শুটিংয়ের কাজ করলে টেকনিশিয়ানদের বিমার ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সে বিমা এক-দুই বা তিন মাসের হতে পারে। কিন্তু তারও খরচ বহন করতে হচ্ছে প্রযোজকদের।
নাম প্রকাশে অপারগ টলিপাড়ার অন্যতম এক চিত্রনাট্যকার জানালেন কীভাবে করোনার কথা মাথায় রেখে পাল্টে যাচ্ছে গল্প বলার ধরনও। “১০ বছরের কম বয়সী বাচ্চাদের তো আমরা ব্যবহার করতে পারলাম না। একটা ক্ষেত্রে খুব সমস্যা হচ্ছিল। বাচ্চাটাই যেহেতু মুখ্য চরিত্র। সেখানে একটা লিপ নিয়ে বাচ্চাটাকে বড় করে দেখানো হল।"
ষাটোর্ধ্ব শিল্পীদের বিষয়ের বিধিনিষেধের ফলে সমস্যা হল একটা পরিবারে দাদু ঠাম্মা ছিলেন। সিরিয়াল যখন নতুন করে শুরু হল হঠাৎ করে তাঁদের চরিত্রগুলোই আর নেই।
পড়ুন, কেমন করে টিকে আছেন প্রাইভেট টিউটররা?
মাস্ক এখন মাস্ট। প্রযোজন, পরিচালক, কার্যনির্বাহী প্রযোজক, সকলেই সচেতন কারণ একটা প্রোডাকশনে কোনও একজনের যদি সংক্রমণ ধরা পড়ে, সেক্ষেত্রে পুরো কাজটাই বন্ধ হয়ে যাবে।
কিন্তু শুটিংয়ের সময় অভিনেতা-অভিনেত্রীরা তো আর মাস্ক পরতে পারছেন না, তাঁদের ক্ষেত্রে ঝুঁকিটা থেকেই যাচ্ছে। সেই ঝুঁকি নিয়েই শুটিং ফ্লোরে নিয়মিত নিজের সেরাটা দিয়ে চলেছেন সুস্মিতা রায় চক্রবর্তীর মত অভিনেত্রীরা। কৃষ্ণকলি, সর্বমঙ্গলা-র মতো জনপ্রিয় মেগাসিরিয়ালে নিজের অভিনয় দর্শকদের মুগ্ধ করেছেন। তিনি বললেন, “শুরুতে খুবই সমস্যা হচ্ছিল। আমরা ভাবতেই পারছিলাম না কীভাবে দূরত্ব বজায় রেখে এত সেফটি প্রটোকল মেনে কাজ করা সম্ভব।এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি অনেকটা। তবে এই করোনা পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমি নিজেকে অনেকটা ভাগ্যবান মনে করছি কারণ এই পরিস্থিতিতেও আমি কাজ করছি। এমন অনেক আর্টিস্ট আছেন যাঁরা কাজ পাননি। এই লকডাউনে আমাদের শুটিংয়ের সময় অনেকটা কমে এসেছে। রাত ৮ টার পরে শুটিং করা যাচ্ছে না। সেই ভাবেই চিত্রনাট্যে লেখা হচ্ছে। আগে যেরকম কুড়ি-পঁচিশ দিন শুটিং ডেট থাকতো সেটা কমে হয়তো দশ পনেরো দিন হয়ে যাচ্ছে। যেসব আর্টিস্টরা দূরে থাকেন, বাসে ট্রেনে বা মেট্রো করে যাতায়াত করতেন, তাঁদের ওলা-উবের করে আসতে হচ্ছে। সেখানেও একটা বড় খরচ হচ্ছে।"
অভিনেতা রজতাভ দত্ত জানালেন, “সিনেমার কাজ এখনও সেভাবে শুরুই হয়নি। কিছু টেলিভিশনের কাজ হচ্ছে। একটা বছরের অর্ধেক সময় যদি কাজ আটকে থাকে, আর পাঁচটা ইন্ডাস্ট্রিতে যেমন সেটা দুঃসময়, সেটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বা থিয়েটার ইন্ডাস্ট্রির ক্ষেত্রেও সত্যি। আর এতদিন কাজ না হওয়া মানেই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অভিনেতা-অভিনেত্রীই শুধু নন, টেকনিশিয়ান, মেকআপ আর্টিস্ট সকলেরই আর্থিক লেনদেন বন্ধ। এঁদের সঙ্গে আরও যে ১০ টা মানুষ জড়িয়ে আছে তাদের উপর এর প্রভাব পড়ছে। অনেকেই খুব খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে রয়েছেন। আমি আমার এক টেকনিশিয়ান বন্ধুকে জানি, যিনি ইলেকট্রিশিয়ান ছিলেন তিনি বাড়ি বাড়ি মুদির জিনিস ডেলিভারি দিচ্ছেন, কেউ হয়তো সবজি বিক্রি করছেন। এটা সবার জন্যই একটা বড় অর্থনৈতিক চাপ, এবং কবে মিটবে তা বোঝা যাচ্ছে না। সারা বিশ্ব জুড়ে একটা আর্থিক ডিপ্রেশনের মধ্যে রয়েছি আমরা সবাই। সেটা হয়তো চলবে এখন দুই আড়াই বছর ধরে। রতন টাটা যে বলেছেন এখন এগজিস্ট করে যাওয়াটাই সবচেয়ে শক্ত ব্যাপার, সেটাই মনে হয় সবচেয়ে জরুরি। আমার নিজের দু তিনটে ছবির শুটিং শেষ কিন্তু ডাবিং বাকি। সেগুলো হল খুললে রিলিজ করবে। খান পাঁচেক থিয়েটার করতাম সেগুলোও হচ্ছে না।”
পড়ুন, বাংলাদেশের এক বন্ধ খাবারের দোকানের অন্দরের কথা
কিছুদিন আগে এই করোনা আবহের মধ্যেই সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে গ্লোবাল ভিলেজ ইন্ডিয়া ফিল্ম উইক সেকশনে ভার্চুয়াল স্ক্রিনিং হয়েছিল গৌতম ঘোষ পরিচালিত রাহাগীর ছবিটির। সমালোচক মহলে তা প্রশংসিতও হয়েছে। এই মে-জুন মাস নাগাদ সর্বসাধারণের জন্য মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল। পরিচালক গৌতম ঘোষ বললেন, “বিনোদন জগতের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন অসংখ্য মানুষ। আমরা নিজেরাও কিন্তু ফ্রিল্যান্সার। সরকারি চাকরি করি না। একজন পরিচালক থেকে শুরু করে স্পট বয়, ইলেকট্রিশিয়ান কিংবা থিয়েটার শিল্পীরা বা সংগীতজগতের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা সকলেই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন। তাঁদের কোনও উপার্জন নেই। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত প্রচুর মানুষ পেটের জ্বালায় অন্য কিছু করছেন। কেউ ছোটখাটো দোকান দিয়ে বসেছেন। একটা অকল্পনীয় অবস্থা।”
গৌতম একটি ইন্দো ইটালিয়ান প্রোডাকশন শুরু করেছিলেন। ইতালিতে ছবির শুটিং হয় জানুয়ারি মাসে। তার ৭০ ভাগ অংশের শুটিং হওয়ার কথা ছিল ভারতে। সেটা সম্পূর্ণ থমকে।
গৌতম ঘোষের কথায়, “স্বাস্থ্যবিধি মেনে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করা খুব শক্ত। সংক্রমণ যাতে বৃদ্ধি না পায় সেই কারণে স্বাস্থ্য দফতর বলবেই নিয়ম মানতে। কিন্তু বাস্তবত তা কতটা সম্ভব সে কথা সত্যিই ভাবার বিষয়। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি কতদিন চলবে তা কেউ জানে না। এর আগে আমরা দেখেছি প্লেগের সময়ে, স্প্যানিস ফ্লুয়ের সময়ে একই ভাবে মানুষ মাস্ক পরে ঘুরেছেন, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল থিয়েটারগুলো। আবার কিন্তু সেই হলগুলো খুলেছে। মানুষ থিয়েটারমুখী হয়েছেন। ধৈর্য রাখতে হবে।”
সত্যি কথা টা সোজা সুজিত বলা।