এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • আধুনিক শিলংয়ের রূপকার খান বাহাদুর কশিমুদ্দিন

    samarjit chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৭ আগস্ট ২০২০ | ৩২১৮ বার পঠিত
  • গুয়াহাটি-শিলং যাত্রাপথ তখন কাঁচা রাস্তা। পায়ে হেঁটে যেতে সময় লাগে তিনদিন। অন্যথায় গরুর গাড়ি, সময় সেই তিনদিন। পথে দস্যুদের উৎপাত। সেই সময়ে এই পথে যাত্রার সময় একদিনে নামিয়ে আনলেন কশিমুদ্দিন। তাকেই এখন মনে করা হয় আধুনিক শিলংয়ের পথপ্রদর্শক। হাজি কশিমুদ্দিন মোল্লা জন্মগ্রহণ করেন ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের শেষ দিকে, জনাই হাটপুকুর অঞ্চলে। পিতা গোলাম হায়দার। জীবন ও জীবিকার সন্ধানে গোলাম হায়দার কিশোর পুত্র কশিমুদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে পূর্ববঙ্গের ছাতক (সিলেট) হয়ে জঙ্গলে ভরা দুর্গম পথ পায়ে হেঁটে পৌঁছন চেরাপুঞ্জিতে। ১৮৪৯ সালে। গোর্খা রেজিমেন্ট ও অসম রাইফেলসের বরাত জোগাড় করে শুরু করেন অর্ডার সাপ্লাইয়ের ব্যবসা। ১৮৬২ সালে গোলাম ব্যবসা সরিয়ে নিয়ে চলে আসেন শিলংয়ে। পুলিশ বাজারে ১৮৬৪ সালে খোলেন ‘গোলাম হায়দার এন্ড সন্স’ নামে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। ব্যবসা জমে ১৮৭৪ সালে।

    শিলংকে অসমের রাজধানী ঘোষণা করা হলে এই ব্যবসার হাল ধরে এগিয়ে আসেন কশিমুদ্দিন। বিচক্ষণতার প্রথম পরিচয় রাখেন ১৮৮৭ সালের নভেম্বরে। গুয়াহাটি থেকে শিলংয়ের যাতায়াত ব্যবস্থা সুগম করার জন্য ‘গোলাম হায়দার এন্ড সন্স’-র তত্ত্বাবধানে কশিমুদ্দিন চালু করলেন ঘোড়ায় টানা টাঙা সার্ভিস। নাম রাখলেন ‘দি শিলং ডেইলি প্যাসেঞ্জার সার্ভিস’। ৬৪ মাইল দীর্ঘ পথের যাত্রা সময় কমে এসে দাঁড়াল এক দিনে। সরকারি স্বীকৃতি পেলেন ১৮৮৮ সালে পয়লা (১) জুলাই। সঙ্গে ডাক-ব্যবস্থার গুরু দায়িত্ব।

    শিলং শহরে আজ যেখানে ‘বিজু সিনেমা’ হল, সেখানে ছিল ‘গোলাম হায়দার এন্ড সন্স’-র ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। এই স্টোরে ছিল টাঙা সার্ভিসের দফতর। ১৯০১-এ অসুস্থ স্বামী বিবেকানন্দ শিলংয়ে এসেছিলেন এই টাঙা সার্ভিসেই। সে সময়ে তিনি ছিলেন অসুস্থ। কশিমুদ্দিন তাঁকে নিয়ে গিয়েছিলেন পরম যত্নে।

    তারপর এসে গেল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ, ১৯০৬ সাল। ঘোড়ার গাড়ির যুগ পার করে মোটরগাড়ির যুগে। কলকাতা থেকে দুটো ‘অ্যালরিয়ন’ মডেলের গাড়ি নিয়ে গিয়ে নতুন যুগের সূচনা করলেন কশিমুদ্দিন। জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাস তাঁর ‘বঙ্গের বাহিরে বাঙালি’ (তৃতীয়)-তে লিখেছেন, “ গৌহাটি থেকে শিলং পাহাড় পর্যন্ত মোটর সার্ভিস সর্ব প্রথমে একজন বাঙালিই খুলে ছিলেন। তৎপূর্বে শিলং (৬৪৫০ ফুট উচ্চ) যাওয়া বড়ই কষ্টকর ছিল।” তিনি আরও লিখেছেন, “জনাই নিবাসী গোলাম হায়দার সাহেব ‘গোলাম হায়দার এন্ড সন্স’ নামে গৌহাটি থেকে শিলং পর্যন্ত টাঙা সার্ভিস প্রতিষ্ঠিত করেন। এই বাঙালি কোম্পানি অতঃপর মোটর সার্ভিস ও অয়েলম্যান স্টোর্স খোলেন।”

    কশিমুদ্দিন গাড়ি দু’টির নাম রাখলেন ‘রানি’ ও ‘মহারানি’। শিলংয়ে সে সময়ে মোটরগাড়ি রেজিস্ট্রেশনের ব্যবস্থা না থাকায় গাড়ি দুটির কোনও নম্বর ছিল না। লোকে চিনত ‘রানি’ ও ‘মহারানি’ নামে। আসন সংখ্যা ছিল ৬টি (ছয়টি)। দরজা ছিল না। টায়ারগুলো ছিল নিরেট রাবারের। ক্রমে যাত্রীসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় আরও সাতটি গাড়ি পথে নামালেন কশিমুদ্দিন। প্রয়োজন হয়ে পড়ল রক্ষণাবেক্ষণের। পুলিশ বাজারে স্থাপন করলেন শিলংয়ের প্রথম গাড়ি মেরামতির কারখানা। শুধু তাই নয়, রাত-বিরেতে কাজের সুবিধার জন্য থেকে নিয়ে গেলেন বৈদ্যুতিক ডায়নামো। বিজলি বাতির প্রথম সূত্রপাত ঘটল সমগ্র উত্তর-পূর্ব ভারতে। কারখানার সঙ্গে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরও উদ্ভাসিত হত আলোকমালায়। সন্ধ্যা হলেই মানুষজন দূর থেকে এসে ভিড় জমাতো সেখানে।

    শিলং মানেই কশিমুদ্দিন। জড়িয়ে আছেন পরতে পরতে। প্রথম ব্যাঙ্ক, প্রথম প্রিন্টিং প্রেস, সোডাওয়াটার ফ্যাক্টরি, ঘি-মাখন তৈরির ফ্যাক্টরি, বেকারি, ‘ইম্পিরিয়াল ডেয়ারি’ নামে খ্যাত দুধের ডেয়ারি - নানা বর্ণের পালক ঝুলি থেকে একের পর এক বার করে সাজিয়েছেন রূপসী শিলংকে।

    ১৯০৫ সালে স্থাপন করেছিলেন মুসলিম ইউনিয়ন। ২০০৫ সালে শতবর্ষ উদ্‌যাপন করে সেই ইউনিয়ন। শিলংয়ে প্রথম মসজিদ নির্মাণের কৃতিত্বও তাঁর। শহরের থানা রোডে আজও যে মসজিদটি বর্তমান, সেটিও নির্মাণ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রতিভা, নানাবিধ কর্ম কৃতিত্ব ও শিলং শহরকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ইংরেজ সরকার তাঁকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন ১৯১৫ সালে। এত কিছু সত্ত্বেও জন্মভূমিকে ভোলেননি তিনি। কলকাতায় এলেই চলে আসতেন জনাইতে। একটি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন হাটপুকুরে। ১৮৯৫ সালে। জনাই কালীতলা থেকে কুমীরমোড়া মার্টিন রেলস্টেশন পর্যন্ত তৎকালীন জেলাশাসকের চার কিমি দীর্ঘ ‘বাটলি বার্ড রোড’ নামে একটি রাস্তা নির্মাণ করেছিলেন ১৯১৭ সালে। সুধীর কুমার মিত্র তাঁর ‘হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ’-এ লিখেছেন, “জনাইয়ের পশ্চিমাংশে হাটপুকুর পল্লি। হাটপুকুরে কয়েকটি মুসলমান বংশ বহু প্রাচীন ও সম্ভ্রান্ত। খ্যাতনামা হাজি কশিমুদ্দিন (কছিমুদ্দিন) খান বাহাদুর এই বংশেরই সন্তান। খান বাহাদুরের দানশীলতা ও লোকহিতকর সর্বজনবিদিত।’

    হপকিনসন সাহেবের হাতে ১৮৬৬ সালে শিলংয়ের জন্ম হলেও এর আসল রূপকার হলেন খান বাহাদুর হাজি কশিমুদ্দিন মোল্লা। মহতী এই বাঙালির জীবনকাল শেষ হয় ১৯৩৩ সালে।

    নমস্কার
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৭ আগস্ট ২০২০ | ৩২১৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • নির্মাল্য | 121.24.***.*** | ০৭ আগস্ট ২০২০ ২২:১৩96010
  • জেনে ভালো লাগল। শেয়ার করব।

  • সমিষ্পা রায়। | 150.129.***.*** | ২৪ জুন ২০২৩ ১৯:৩৭520685
  • পড়ে খুব ভাল লাগল। সমৃদ্ধ হলাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে মতামত দিন