এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • এস. ওয়াজেদ আলি

    samarjit chakraborty লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১২ জুন ২০২০ | ৪৩২২ বার পঠিত
  • স্কুলে পড়ার সময়, সম্ভবত ক্লাস নাইনে পড়ার সময় এস. ওয়াজেদ আলির ‘ভারতবর্ষ’ শিরোনামে একটি রচনা পড়েছিলাম। ১৯৮৪ পর্যন্ত মাধ্যমিকের সিলেবাসে ছিল এই প্রবন্ধটি। উত্তরকালের কাছে তাঁর পরিচিতি এই ‘ভারতবর্ষ’ নামে বিখ্যাত রচনাটির জন্যেই বোধহয়। সেখানে একটি লাইন ছিল ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে, কোথাও তার পরিবর্ত্তন নেই’। বাক্যটি তাঁর জীবিতকালের মধ্যেই একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবাদ হিসাবে স্থান করে নিয়েছিল। তাঁর মৃত্যুর অর্ধশতাব্দী (৬৮ বছর) পরে আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। ইতিবাচক অর্থের পাশাপাশি এখন তা বিভিন্ন নেতিবাচক প্রসঙ্গেও আলোচিত হয়। অথচ ওয়াজেদ আলি সাহেব কিন্তু ইতিবাচক অর্থেই ব্যবহার করেছিলেন। বাংলার গ্রামীন সমাজে মানবিক মূল্যবোধ রক্ষার যে সার্বিক ঐতিহ্য, বলতে চেয়েছিলেন সেকথাই। ট্রাডিশন শব্দটির মাধ্যমে তিনি চিরস্থায়ী সভ্যতা ও মূল্যবোধকেই তুলে ধরতে চেয়েছেন। যা থেকে আসে সৃষ্টির নিবিড় প্রেরণা, অখ্যাত অবহেলিত সাধারণ মানুষের মনের ধ্যানধারনাকে নিবিড়ভাবে জানার ইচ্ছা।
    সেইসময়ে যাঁরা বলেছিলেন ধর্ম এবং রাষ্ট্র সম্পৃক্ত বা একে অপরের পরিপূরক, এস.ওয়াজেদ আলি সেই মৌলবাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেছিলেন, আর এর ফলে ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকার বিচারে সেরা মুসলিম সাহিত্যিকদের পঙক্তিতে তাঁর স্থান হয়নি। বর্তমানেও সেই একই বিভেদকামী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে সমাজে অস্থিরতার বাতাবরণ সৃষ্টি করতে চায়, তখনই মনে আসে মিথ হয়ে যাওয়া বাক্যটি, ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে’। এখানেই ওয়াজেদ আলি সার্থক। সার্থক তাঁর সমন্বয়ী দৃষ্টিভঙ্গী। হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের মধ্যে যে শুধু সহবস্থান নয়, দুতরফেরই সার্বিক মঙ্গলের জন্য পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতা একান্ত প্রয়োজন, সেকথাই তাঁর বাঁধনহীন কলমে লিখে গেছেন বারংবার। আর এরই নিদর্শন আমরা পাই ‘গুলিস্তা’ পত্রিকায়।
    এস. ওয়াজেদ আলি ‘গুলিস্তা’ নামে একটি সচিত্র মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকার প্রচ্ছদে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির আদর্শ হিসেবে উৎকীর্ণ থাকত ‘হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অগ্রদূত’। দ্বিধাহীন এই ঘোষণাকেই তিনি তাঁর গল্প ও প্রবন্ধে প্রতিধ্বনিত করেছেন বারবার।
    তাঁর লেখা প্রথম লেখা প্রবন্ধ ‘অতীতের বোঝা’ প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায়। সেখানে তিনি বলেছেন, “ আমাদের Nation – হিন্দু এবং মুসলমান, এই দুয়ে মিলে গঠিত। এই দুই সমাজই নিজেদের জীবনের মূল্য ভুলে গিয়ে প্রাচীন প্রথার অনুসরণের বৃথা চেষ্টায় জীবন অতিবাহিত করছে। এর ফল যে বিষময় হচ্ছে, সে বিষয়ে সন্দেহ করবার কোনো কারণ নেই।” প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘ভবিষ্যতের বাঙালী’-তে তিনি ‘ভবিষ্যতের বাঙালী’ শীর্ষক রচনায় বলেছেন, “রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মের কোনো অচ্ছেদ্য সম্বন্ধ আছে বলে আমি বিশ্বাস করি না। নিছক ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও সাধনার উপর ধর্মের পূর্তি ও পুষ্টি বলা যায়। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক না করলে ধর্মই থাকে না, বড় একটা ব্যবসায়ে পরিণত হয় এবং ধর্ম ব্যবসায়ে পরিণত হওয়া মানেই হল তার মৃত্যু। কেননা, সে অবস্থায় ধর্মের নামে যে সব জিগির ছাড়া হয়, সেগুলি প্রকৃতপক্ষে ধর্মের বুলি নয়, স্বার্থের উদ্বমন।” চারিদিকে তখন কানাঘুষো চলছে, দেশ ভাগ হবে। এই সময়ে তিনি আবার গর্জে উঠলেন, ওই একই গ্রন্থের ‘হিন্দু-মুসলমান’ শীর্ষক রচনায়, বললেন, “আমার মনে হয় ভারতীয় জাতীয়তাকে প্রাদেশিক জাতীয়তার ভিত্তির উপরেই গড়তে হবে। প্রত্যেক প্রদেশের ভাষাকে অবলম্বন করে সেই প্রদেশের হিন্দু ও মুসলমানকে তার সুনিবিড় সূত্রে গ্রথিত করতে হবে। প্রত্যেক প্রদেশের হিন্দু-মুসলমান যথা সময়ে তাহলে একটা জাতিতে (Nation) পরিণত হবে। আর সেই বিভিন্ন জাতিসমষ্টির পারস্পরিক মিলনে গড়ে উঠবে ভবিষ্যত ভারতের রাষ্ট্রসংঘ (Federation of States)।”
    ‘জীবনের শিল্প’ গ্রন্থতে তিনি বলেছেন, “বাঙ্গালার মঙ্গল হচ্ছে আমাদের আদর্শ। বাঙ্গালার গৌরব, বাঙ্গালার স্বাতন্ত্র্য বাঙ্গালার বিশেষত্ব হচ্ছে আমাদের সাধনার বিষয়। এ আদর্শ যেদিন প্রকৃতই আমাদের অন্তর অধিকার করবে, সেদিন হিন্দু মুসলমানের বিরোধেরও শেষ হবে। কেননা, হিন্দু ও মুসলমান, উভয়ের মঙ্গল ছাড়া বাঙ্গালার মঙ্গল হতে পারেনা আর হিন্দু ও মুসলমানের সম্প্রীতি ছাড়া বাঙ্গালার গৌরব মাথা তুলতে পারে না।”
    ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’ গ্রন্থটির মধ্যে ‘মসজিদ’ নামক একটি প্রবন্ধে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় জানিয়েছেন, “আমার মসজিদে কিন্তু সব ধর্মেরই প্রচার হয়, আর সব ধর্মগ্রন্থেরই ব্যাখ্যা হয়। খৃস্টান আমার আমার মসজিদে New Testament-এর ব্যাখ্যা করে, পারসিক এসে জেন্দাবেস্তার ব্যাখ্যা করে, হিন্দু এসে বেদ আর উপনিষদের ব্যাখ্যা করে, মুসলমান এসে কোরাণের ব্যাখ্যা করে, আর বৌদ্ধ এসে জাতকের ব্যাখ্যা করে। ...আমি সকলের কথাই ভক্তির সঙ্গে শুনি, আর সকলের প্রচারিত সত্যই শ্রদ্ধার সঙ্গে বিশ্বাস করি। ...আমার এই মসজিদ বিরাজ করে আমার অন্তরে।”
    ধর্মের প্রতি অটুট বিশ্বাস রেখেও যে বাইরের জীবনে অসাম্প্রদায়িক ভাবে থাকা যায়, একথা তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। আর এই অসাম্প্রদায়িক ভাবটি ঘরোয়া জীবনেও যে বজায় থাকতে পারে বা বজায় রাখা যায়, তারও প্রচেষ্টা ছিল সবসময়। এই প্রচেষ্টা ছিল বলেই তিনি “তারা”-র মতন গল্প লিখতে পারেন। ধর্মসংস্কারকে অতিক্রম করে নিজের উপলব্ধিকে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য লিখে ফেলেন “পৌত্তলিক” নামে আরো একটি কাহিনী। এই কাহিনীর মুখ্য চরিত্র একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম। যিনি তাঁর অন্তরের মধ্যে এমনই এক দিব্য শক্তি অর্জন করেছিলেন, যার ফলে তিনি চোখের সামনে আর্বিভূত হতে দেখতেন স্বয়ং দেবী কালিকাকে। এই কারণে তাঁকে গোঁড়া এবং রক্ষণশীল মুসলিমরা কাফের বলে আখ্যা দেয়। সহ্য করতে হয় নানা উৎপীড়ন। তবু তিনি অন্তরের সারসত্য দর্পন মুক্তকণ্ঠে ব্যক্ত করতে দ্বিধা করেননি।
    আজকের এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছিনতা ও বিভেদকামী শক্তির প্রবল আস্ফালনের বিরুদ্ধে এস. ওয়াজেদ আলিকে ভীষণভাবে প্রয়োজন। অথচ কোথায় যেন বিস্মৃতির অন্ধকারে তিনি হারিয়ে গেছেন।
    শেখ বিলায়েৎ আলি ও খাদিজা বেগমের কোল করে রত্নগর্ভা হুগলী জেলার শ্রীরামপুর মহকুমার অন্তর্গত চন্ডীতলা ২ নং ব্লকের অধীনে পাঁচঘড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বড়তাজপুর গ্রামে এস.ওয়াজেদ আলি জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯০ খৃস্টাব্দে ৪ সেপ্টেম্বর। তাঁর শিক্ষাজীবন শুরু হয় পাশের গ্রাম ‘তিসা পাঠশালায়’। মাত্র ৭ বছর বয়সে ১৮৯৭ খৃস্টাব্দে তাঁর বিবাহ হয়ে যায়। ঘরে আসে প্রথমা স্ত্রী আয়েশা খাতুন। এরপর তিনি ১৮৯৮ খৃস্টাব্দে পিতার কাছে শিলংয়ে চলে যান। ভর্তি হন সেখানকার ‘মোখার হাইস্কুল’-এ।
    এস. ওয়াজেদ আলির ঠাকুর-দা (পিতামহ) শেখ জামাতুল্লা জীবন ও জীবিকার সন্ধানে শিলং শহরে যান ১৮৬৭ খৃস্টাব্দে। জলপথে শ্রীহট্ট হয়ে ছাতক। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে চেরাপুঞ্জি। চেরাপুঞ্জি থেকে শিলং। শিলং শহরে যখন বসতি শুরু হয় বা সদর দপ্তর ঘোষণা করা হয় তখন ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে জামাতুল্লা পুলিশ বাজার সহ অন্যান্য এলাকার বিস্তৃত অঞ্চল ৯৯ বছরের লিজে কিনে নেন। পুলিশ বাজার মোড়ে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘জামাতুল্লা এন্ড সন্স’ নামে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। এই স্টোরটি ছিল বর্তমানে যেখানে ‘টি.কে পান্তির ঘড়ির দোকান ও আংকেল শপ্‌ অবস্থিত সেখানে। জেল রোডে মিউনিসিপ্যালিটির জমিতে জামাতুল্লা একটি বেকারি ও ডেয়ারির কারখানাও স্থাপন করেছিলেন। পরবর্তীকালে এস. ওয়াজেদ আলির পিতা, জামাতুল্লার সুপুত্র বিলায়েৎ আলি এই ব্যবসার হাল ধরেছিলেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে।
    ১৯০৬ খৃস্টাব্দে ওয়াজেদ আলি এন্ট্রাস পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। প্রবেশ করেন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আলিগড় কলেজে। সেখান থেকে ১৯০৮ খৃস্টাব্দে আই.এ. পাশ করেন। ১৯১০ খৃস্টাব্দে এই কলেজ থেকেই পাশ করেন বি.এ। এরপর তিনি ফিরে আসেন তাঁর জন্মভূমি বড়তাজপুরে। জন্মগ্রহণ করে তাঁর প্রথম সন্তান লুৎফান্নেসা। হাসিখুশিতে গ্রাম্য-পরিবেশে দিন কেটে যাচ্ছিল তাঁর। এই সময় থেকেই তিনি বিলেত যাওয়ার জন্য পরিবারকে বোঝাতে শুরু করেন। এবং শেষপর্যন্ত সক্ষম হন। বার-অ্যাট-ল পড়ার জন্য ইংলন্ডে যাত্রা করেন ১৯১২ খৃস্টাব্দে। ১৯১৫ খৃস্টাব্দে কেমব্রিজ থেকে বি.এ ও বার-অ্যাট-ল পাশ করেন। কেম্ব্রিজে থাকাকালীন গুরুতরভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। সেই সময় তাঁকে সেবাশুশ্রূষা করার জন্য ব্রিস্টল থেকে আসেন মিস এলিয়ানর স্যাক্সবি (Eleanor Saxby)। স্যাক্সবির সেবাযত্নে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন ওয়াজেদ আলি। তারপরেই তাঁরা জড়িয়ে পড়েন গভীর প্রেমবন্ধনে। ওয়াজেদ আলি দ্বিতীয় বার বিবাহ করেন এলিয়ানর স্যাক্সবিকে। বিবাহের পর এলিয়ানরের নাম হয় নেলী ওয়াজেদ। প্রবল অশান্তির মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে প্রথমা স্ত্রী আয়েশা বেগমের সঙ্গে, যা ওয়াজেদ আলির পরিবারের কেউ মন থেকে মেনে নিতে পারেননি, তা সত্ত্বেও ওয়াজেদ আলি দেশে ফেরেন দ্বিতীয় স্ত্রী নেলী ওয়াজেদকে সঙ্গে নিয়ে। কর্মজীবন শুরু করেন কলকাতার মহামান্য হাইকোর্টে। এই সময়ে তিনি নেলী ওয়াজেদকে নিয়ে সুখী সংসার পাতেন মট লেন, রিপন স্ট্রিট ইত্যাদি স্থানে। নানা কারণে পারিবারিক ব্যবসায় নেমে আসে বিপর্যয়। মানসিক শান্তির লক্ষ্যে তিনি ঝুঁকে পড়েন পড়াশোনার দিকে। মনোনিবেশ করেন সাহিত্য সাধনায়। ১৯১৯ খৃস্টাব্দে তাঁর প্রথম লেখা প্রবন্ধ ‘অতীতের বোঝা’ প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত ‘সবুজপত্র’ পত্রিকায়।
    প্রথমা স্ত্রী আয়েশা বেগমের সঙ্গে পুনরায় বসবাস শুরু করেন ১৯২৩ খৃস্টাব্দে। কলকাতার ক্যানাল রোডে। এই সময়ে তিনি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে ডুবিয়ে দেন লেখালেখির মধ্যে। গল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদ, ও ভ্রমণ-কাহিনী একে একে জন্ম নেয় তাঁর কলমের তীক্ষ্ণ ডগা থেকে। ১৯২৫ খৃস্টাব্দে তাঁর ছোটগল্প ‘রাজা’ প্রকাশিত হয় ‘ইসলাম দর্শন’ পত্রিকায় এবং এই বছরেই তিনি ‘বঙ্গীয় ইসলাম সাহিত্য সমিতি’র সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯২৬-এও তিনি এই সমিতির সভাপতি হিসেবে পুনঃনির্বাচিত হন। কিন্তু মনোমালিন্যের জেরে সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দেন ১৯২৭ খৃস্টাব্দের মার্চ মাসে। তাঁর সঙ্গে সমিতি থেকে বেরিয়ে আসেন সম্পাদক গোলাম মোস্তাফা। ১৯২৭-য়েই প্রকাশিত হয় তাঁর গল্পগ্রন্থ ‘গুলদাঁস্তা’।
    এইরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, মাথার ওপর ভেঙে পড়ে আকাশ। আঘাত আসে তাঁর পরিবারের ভিতর থেকেই। তাঁরই আদরের ছোটভাই এস. সামশের আলির সঙ্গে ১৯২৮ খৃস্টাব্দে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী নেলী ওয়াজেদ। শুধু তাই নয়, তাঁর দুই পুত্র-কন্যা আহমেদ, আবদুল ও জেব-উন-নিসসা (Zeb-un-Nissa) তাঁকে ছেড়ে চলে যায় মায়ের সঙ্গে। পরিবার বিচ্ছেদের এই ঘটনায় তিনি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। ক্লান্ত রিক্ত ও নিঃসঙ্গতায় তিনি হয়ে পড়েন নাবিকহীন এক জাহাজ-যাত্রী। এই সময়ে সাহিত্যই তাঁকে নিবিড়ভাবে কাছে টেনে নেয়। তিনিও আঁকড়ে ধরেন সাহিত্যকে। একটু একটু করে অন্ধকারের করাল গহ্বর থেকে এগিয়ে যান উজ্জ্বল আলোকমালার দিকে।
    ১৯২৯ খৃস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। ওয়াজেদ আলি সেই সম্বর্ধনা কমিটির সভাপতি হন এবং অভিনন্দন পত্র পাঠ করে শোনান। এই বছরেই তিনি ‘আসাম মুসলিম ছাত্র সমিতি’র বাৎসরিক সম্মেলনে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন। আরো উল্লেখ্য, সঙ্গীহীন জীবনে আরো একবার জীবনসঙ্গী আনেন। তৃতীয় বিবাহ করেন চেঙ্গিস খাঁ বংশজাত এক বার্মিজ মহিলাকে। বিবাহের পর তাঁর ধর্মান্তরিত জীবনসঙ্গীনীর নাম হয় বদরুন্নেসা আলি। ১৯৩০ খৃস্টাব্দে এপ্রিল মাসে নোয়াখালি ইন্সটিটিউট-এর বার্ষিক অধিবেশনে অলঙ্কৃত করেন সভাপতির আসন। এ বছরেই প্রকাশিত হয় তাঁর ‘মাশুকের দরবার’ গল্পগ্রন্থ। ‘দরবেশের দরবার’ প্রকাশিত হয় ১৯৩১ খৃস্টাব্দে। এই ১৯৩১-য়েই তাঁর জীবনে নেমে আসে আরো একটি শোকের কালো দিন। কয়েকদিনের শিশুপুত্র শেখ বদরুদ্দিন আলিকে রেখে মারা যান বদরুন্নেসা আলি। তাঁর মৃতদেহ সমাধিস্থ করা হয় গোবরডাঙা কবরস্থানে।
    ১৯৩২ খৃস্টাব্দে তাঁর জীবনের অন্যতম মাইলস্টোন ‘হিন্দু-মুসলমানের মিলনের অগ্রদূত’ সচিত্র মাসিক পত্রিকা ‘গুলিস্তা’ প্রকাশ করেন। ‘গুলিস্তা’ স্বল্পায়ূ হলেও সম্পাদক হিসেবে ওয়াজেদ আলিকে বাংলা সাহিত্যজগতে অন্য এক আসনে প্রতিষ্ঠিত করে যায়। ‘গুলিস্তা’র উৎকর্ষতা কেমন ছিল তা তার লেখক সূচি দেখলেই অনুধাবন করা যায়। সেসময়ে ওয়াজেদ আলি থাকতেন ঝাউতলা রোডে। সেই বাড়িতেই ছিল ‘গুলিস্তা’র দপ্তর। সন্ধ্যেবেলা বসত জমাটি সাহিত্য-আড্ডা। নিয়মিত আসতেন কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আবদুল ওদুদ, প্রমথনাথ বিশী, কেদারনাথ চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, ডঃ মহম্মদ শহীদুল্লা, কবিশেখর কালিদাস রায়, শনিবারের চিঠি খ্যাত সজনীকান্ত দাস, অনুরূপা দেবী, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, ইন্দিরা দেবী চৌধুরানী, ধীরাজ ভট্টাচার্য, হুমায়ূন কবির, আব্বাসউদ্দিন আমেদ, ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, ‘নবযুগ’এর এ.কে. জয়নাল আবেদিন, কমরেড আবদুল আজিজ প্রমুখ।
    ‘গুলিস্তা’র প্রথম সংখ্যা থেকেই ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে ওয়াজেদ আলির ‘ইকবালের পায়গাম’ গ্রন্থের প্রথম কিস্তি ‘একবালের পায়গাম’ শিরোনামে। ১৯৩৪ থেকে তাঁর লেখা ‘গ্রানাডার শেষ বীর’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু করে ‘গুলিস্তা’য়। ১৯৩৫ খৃস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত ‘নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সম্মিলনী’ অনুষ্ঠানে সভাপতির আসন অলঙ্কৃত করেন। এ বছরেরই অর্থাৎ ১৯৩৫-এর জুলাই মাসে তিনি ফিরে আসেন জন্মভূমি বড়তাজপুরে। সভাপতি হিসেবে যোগ দেন ‘তাজপুর ইন্সটিটিউট’-এর প্রথম বার্ষিক উৎসব অনুষ্ঠানে। ‘গ্রানাডার শেষ বীর’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৪০ খৃস্টাব্দে। ১৯৪১-এ প্রকাশিত হয় জীবনের শিল্প। ‘প্রাচ্য ও প্রতীচ্য’ এবং ‘ভবিষ্যতের বাঙালী’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ খৃস্টাব্দে। ‘গুলিস্তা’ পত্রিকার চতুর্থ বার্ষিক উৎসব অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৪ খৃস্টাব্দে। সেই সঙ্গে প্রকাশিত হয় দুটো গল্প গ্রন্থ ‘বাদশাহী গল্প’ ও ‘গল্পের মজলিশ’।
    ১৯৪৫ খৃস্টাব্দের ৩১ অক্টোবর ওয়াজেদ আলি কলকাতার তৃতীয় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন এবং পুনরায় স্বাধীনভাবে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯২৩ খৃস্টাব্দে তিনি তৃতীয় প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯২৩ খৃস্টাব্দে। ১৯৪৮ খৃস্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর ‘ সভ্যতা ও সাহিত্যে ইসলামের দান’ ও ‘পশ্চিম ভারতে’। ‘আকবরের রাষ্ট্র-সাধনা’, ‘মোটর যোগে রাঁচি সফর’। ‘ইবনে খালদুনের সমাজবিজ্ঞান’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৯-এ। এই ১৯৪৯-এর মাঝামাঝি সময়ে তিনি ‘সেরিব্রাল থম্বোসিসে আক্রান্ত হয়ে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। চিকিৎসার সমস্ত দায়ভার কাঁধে তুলে নেন এক জার্মান চিকিৎসক ডাঃ ট্রয় (Troy)। প্রায় একবছর দুরারোগ্য কঠিন যন্ত্রণাময় জীবন যাপন করে অবশেষে ১৯৫১ খৃস্টাব্দে ১০ জুন রবিবার সকাল ন’টায় ৪৮, ঝাউতলা রোড থেকে বেহেস্তের পথে যাত্রা করেন। তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় গোবরা কবরস্থানে তাঁর তৃতীয় স্ত্রী বদরুন্নেসা আলির পাশে। বদরুন্নেসার পাশে তিনি নিজের জন্য মাটির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন।
    বিলম্ব হলেও তাঁর জন্মভূমি বেগমপুর তাজপুর বাসিন্দাদের বোধদয় হয়, ৫২ বছর পর গঠিত হয় ‘এস. ওয়াজেদ আলি মেলা’ নামে একটি সংস্থা। ২০০২ খৃস্টাব্দ থেকে সেই সংস্থা তাঁকে স্মরণ করে একটি মিলন উৎসবের আয়োজন করে। ২০০৫ খৃস্টাব্দের পর বিবিধের মাঝে মহামিলনের সেই উৎসব হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যায়।
    আজকাল তো বিজ্ঞাপনদাতারাও তাদের পণ্যের গৌরব ও ঐতিহ্য স্মরণ করাতে গিয়ে শিরো-লাইনে ব্যবহার করে, ‘সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে...’। তাদের অনেকেই জানেন না এই প্রবচন বাক্যটির জনমদাতা কে!

    -নমস্কার-
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১২ জুন ২০২০ | ৪৩২২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে মতামত দিন