নবনীতা দেবসেনের মতো করে বলতে আর পারলুম কই – “হালের কাছে মাঝি আছে – এটা অস্থি-মজ্জায় জানি” (গৌরচন্দ্রিকা, ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহনে)? তাই প্রতিমুহূর্তের মৃত্যু জানান দেয় এখনো বেঁচে আছ। এমনটাই হয় হয়ত আমাদের সাধারণের ঘরকন্নার সাথে। যা নেই, তাই দিয়েই বুঝি কী ছিল। পায়েতে বেড়ি যতদিন না পড়ল, ততদিন ভুলেও ভাবিনি যে ছাড়া আছি। আজ যখন শারীরিক দূরত্বের সাথে সাথে মনে বাসা করেছে সন্দেহ, সংকোচ আর ভয়ের অগুণতি ঠাণ্ডা রক্তের পোকা, তখন বুঝতে পারলাম ভালোবাসার জন্য পড়েছিল এই অপার পৃথিবী। তবু তেমন করে ভালোবাসতে পারি নি।
এ দেওয়াল থেকে সে দেওয়াল, সে জানলার থেকে এ জানলা – ঘুরে মরি অলস দুপুরে, আর স্মৃতি হাঁটকাই। শ্রীমতী দেবসেনের কথা উঠল, তার কারণ লেখিকার প্রয়াণের পর পরই আমি গিয়েছিলাম হিমালয়ে – সুন্দরী কুমায়ুন। সে সময়ে লেখা ডাইরির একখান পাতা উঠে এল হাতে। ভ্রমণ-কাহিনি নয়, কেবল অনেক অনুভূতির পাঁচমিশেলি রান্না। হুবহু তেমনই তুলে দিলাম। মুক্ত ছিলাম সে কথা মনে করেই। আধখাঁচড়া রঙ মনে হলে, তাই সই। কখনো কখনো অপূর্ণতাই বুঝি সবচেয়ে জরুরি হয়ে পড়ে। -
“নবনীতা দেবসেনের মৃত্যু সংবাদ পাবার পর থেকেই কেন জানি না বারবার ‘ট্রাকবাহনে ম্যাকমাহন’ এর কথা মনে পড়ছে। তাঁর তিব্বত সীমান্ত ভ্রমণের সাথে আমার কুমায়ুনে তিব্বত বর্ডারের কাছাকাছি এসে পড়ার মধ্যে মিল কেবলমাত্র এই হিমালয়। নইলে কোথায় অরুণাচল, কোথায় এই মুন্সিয়ারি - কী জানি কতশত মাইল দূরে হবে? সঙ্গে বইটার একটা সফট কপিও আছে বটে, তবু পড়তে সাহস হচ্ছে না। মনে হয় বুঝি আর একবার পড়লেই আমার কাঁচা বয়সের বিস্ময় পাকাপোক্ত মনের জালে আটকা পড়ে ছটফটাবে। বরং হিমালয়ই দেখি - অটল, গম্ভীর, সুন্দর, ভয়ানক।
যাত্রাপথ নিঃসন্দেহে দীর্ঘ – আর পাঁচজন বাঙালীর মতোই এক নিঃশ্বাসে অনেকগুলো টুরিস্ট স্পট ছুঁয়ে ফেলে হাঁফাতে থাকা, - আর এখানে একছটাক, ওখানে একছটাক – সবকিছু ক্যামেরাবন্দি করে আমরাই ভ্রমণপিপাসু জাতি বলে গর্ব করা। এমনটাই চলছিল। কিন্তু দৃশ্য ক্রমাগত বদলাচ্ছিল। নৈনীতাল, ভীমতাল, আলমোড়ার মতো শৈল শহরগুলো ছাড়িয়ে যত এগোতে থাকি উত্তরে, জনবসতি তত হালকা হয়, পাহাড়ের উচ্চতা বাড়ে, আর সাথে সাথে কমে অচেনা সহযাত্রীদের সংখ্যা।
এই সরে সরে যাওয়া দৃশ্যপটের মাঝে দু-এক মুহূর্ত বুঝি বা চিরদিনের জন্য ফ্রেমে থেকে যায়। তাদের বয়স হয় না, তারা কখনো শেষ হয় না, তাই ক্যামেরায় তাদের ধরা যায় না, মনের চিলেকোঠায় অদরকারি নিঝুম দুপুরের জন্য লুকনো থাকে। সেটাই রসদ, সেটাই জমা আজীবনের। যেমন, রাস্তার পাশে লেবু বেচছিল যে ছেলেটা। বেচছিল বললে বোধহয় ঠিক হবে না – একটা প্যাকেটে কয়েকটা কমলালেবু নিয়ে শুনশান রাস্তার ধারে অপেক্ষা করছিল। কখনো সখনো দু-একটা গাড়ি আসা-যাওয়া করছে, যদি কেউ কেনে। আজ রোববার, স্কুল ছুটি। হাতে দরকার দু-চারটে কাঁচা পয়সা। তাই বোধহয় বাড়ির গাছ থেকে কয়েকটা লেবু পেড়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। গোটা দশেক কমলার দাম মাত্তর পঞ্চাশ টাকা। পঞ্চাশ টাকার নোটের সঙ্গে একটা চকোলেটের বার বাড়িয়ে দিতেই একটা অবাক ভাব ছুঁয়ে গেল তার চোখের খয়েরি তারায়। হাত বাড়িয়ে গম্ভীর মুখে চকোলেটটা নিয়ে বলল – থ্যাঙ্ক ইউ। ইস্কুলে শিখিয়েছে নিশ্চয়। ওই তো পার হয়ে এলাম একটা ছোট টিনের চালার স্কুল। সেখানেই পড়ে কি?
যেখান থেকে লেবু কিনলাম – তার খানিক নিচ দিয়ে বয়ে চলেছে পিণ্ডারী নদী। কৌশানী থেকে মুন্সিয়ারি আসার এই পথটা খুব সুপরিচিত নয়। হোটেলে আমাদের রাতভোরের পড়শির কাছ থেকে এই পথের খোঁজ পেয়েছি। তাঁদেরকে ধন্যবাদ জানিয়ে গাড়িতে উঠে খানিক চলার পর বুঝলাম এ পথ তুলনায় অনেক লম্বা, কিন্তু প্রকৃতি দুহাতে উজাড় করে দিয়েছে নিজেকে।
মুখোমুখি হতে হয় চারটে নদীর। প্রথমে গোম্তী, তারপর সরযূ, ক্রমে পিণ্ডারী, সবশেষে তেজমের কাছে এসে রামগঙ্গা। পিণ্ডারীর রঙ ঘন সবুজ – গভীর তার চলাচল। আর রামগঙ্গার বিস্তৃতি বহুদূর – অজস্র সাদা পাথর ছড়ানো নদীর দুপাশে, মাঝখানে – এত সাদা যে খালি চোখে ধাঁধাঁ লাগে। মধ্যে মধ্যে ছোট ছোট আরো অনেক নাম না জানা জলধারা এসে মিশেছে বড় নদীগুলোতে। সবগুলোই যে গ্লেসিয়ার থেকে আসছে তা নয়, কয়েকটার উৎস পাহাড়ী ঝর্ণাও।
এ পথে ঝর্ণাও প্রচুর। সবচেয়ে বড় ঝর্ণার নাম বিরথি। জল কমে গেছে – অত বিশাল ঝর্ণা তিরতির করে বইছে। ড্রাইভার বলল, দিন দশেক আগেও নাকি জল ছিল প্রচুর। আমাদের সারথির নাম ধীরু। বাড়ি এই অঞ্চলেই। তার গ্রামের ওপর দিয়েই তো এলাম। ছোট গাঁ, মাত্র কয়েকঘর মানুষের বাস। সেটাও ধীরু খুব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখাল – এই তার তাউ-এর ঘর, ঐ ওপরে বেড়ার পেরিয়ে তার নিজের ঘর, এই মাঠ – আরো কত কী।
ধীরুর বয়স অল্প হলে কী হবে, সে পুরোনো গল্প করতে ভালোবাসে। মাথা নেড়ে নেড়ে সে গ্রামের বুড়োদের মতো বলে চলে নদীর গল্প, পাহাড়ের গল্প। হিমালয়ের এই অঞ্চলে ওই সামনের পাহাড়টা পেরোলেই নাকি ব্রহ্মকমল মেলে। একখান কুণ্ড আছে সেখানে, তাতে ফোটে সে ফুল – দেবতার ফুল। বাইরের মানুষজনের যাবার অনুমতি নেই সেখানে। রাত নামলে অশরীরী আত্মারা ঘুরে বেড়ায় কুণ্ডের চারপাশে। কুণ্ডের জল ছুঁতে গেলে সরে যায় সে জল। উপবাস করে ব্রত করে তবে সেই ব্রহ্মকমল তুলে আনতে হয়। এপ্রিল মাসে পুজো হয় সে ফুল দিয়ে। সে এত সব জানে, কারণ তার বউ সেখান থেকেই এসেছে তো। ধীরু উদাস হয়ে যায়। কতদিন ঘরে ফেরে নি সে।
আর আমাদের মনের মাঝে রূপকথা আর বাস্তব মিশে যায় – মাঝের সীমারেখা মুছে যায়। শহরের ড্রয়িংরুমে বসে যেকথা যুক্তির নিক্তিতে মেপে কুসংস্কার বলে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিতে পারতাম, আজ – এই হিমালয়ের কোলে – পড়ন্ত বিকেলে পাইন আর দেওদারের ছায়ারা দীর্ঘ হয় যেখানে – সেখানে সব কথা সত্যি বলে ভাবতে বড় ইচ্ছে করে যে। এখানেই তো রাজকন্যা ঘুমিয়ে থাকে, এখানেই তো রাজপুত্র পক্ষীরাজ ঘোড়ায় করে রাক্ষসের প্রাণ-ভোমরা খুঁজে বেড়ায়।
ধীরু আরো গল্প বলে । এই তো এখানেই, ওই যে বাঁক দেখা যাচ্ছে, সেটা পেরোলেই একটা গ্রাম ছিল, আজ আর নেই। ২০০৯ এ মেঘ ফেটে পড়ল - আটচল্লিশ ঘরের গোটা গ্রামটা তলিয়ে গেল খাদে – একজনও বাঁচল না। সে কথা তো আগের রাতে সেই মেয়েটা স্বপ্ন দেখেছিল, ভবিষ্যৎবাণীও করেছিল।
হয়ত ধীরুর কথা সত্যি, হয়ত নয়। এই হয়তর ফারাকটুকু ঘন জঙ্গলে মিশে যায়, পাহাড় থেকে পাহাড়ের প্রতিধ্বনিতে হারিয়ে যায়। পথের পাশে বসে থাকে মানুষ, ওক গাছের ছায়ায়। এদের যেন তাড়া নেই, কোথাও যাবার নেই, কেবল ছবির মতো নিস্পন্দ বসে থাকে। এদের কাছেই বহু অনাবৃত রহস্য সরল বিশ্বাসে জমে থেকে – এক পুরুষ থেকে পরের পুরুষে চুঁইয়ে পড়ে।
মুন্সিয়ারি পৌঁছলাম যখন, তখন গোধূলী। লাল আঁচে পঞ্চচুল্লীতে আগুন লেগেছে। বরফের পাঁচটি চূড়া, নাম পঞ্চচুল্লী। দ্রৌপদী নাকি এই তাঁর পাঁচ স্বামীর জন্য এই পাঁচটি উনুনে রান্না করতেন। সবচেয়ে বড় চূড়ার নাম ভীম। বাকিগুলোর নাম জান গেল না। আবার সেই সংস্কার, কুসংস্কার, মিথ – সব গুলিয়ে যায়। ভারতের পরম্পরায় এপিকের চরিত্রগুলো আর কেবল চরিত্র থাকে না – বড় হতে হতে ছড়িয়ে পড়ে – আকার নেয় স্বাভাবিকের জীবনকে অতিক্রম করে। সেখানে তাদের স্থান কালের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ করে ফেলাতে ইতিহাস তৈরির চেষ্টা থাকতে পারে, কিন্তু সংস্কৃতি নেই। গল্প, সত্যি, অলীক, মায়া – সবকিছু নিয়েই তারা ঘোরাফেরা করে আমাদের চারপাশে। ঘেরাটোপ যত বেশি, পাহারা তত কড়া, মুক্তি তত দূর।
কয়েকটা ছবি তুললাম, কিন্তু ভাবছি এবার ক্যামেরাটাকে বাক্সবন্দি করে ফেলব। ছবি যা উঠছে তা একরকমের চিত্ররূপ বটে, কিন্তু তার ভেতরের কথোপকথনটা কোথাও অধরাই থেকে যাচ্ছে যেন। বরং দেখি – চোখ মেলে, চোখ বুজে।
সন্ধ্যা নামে ধীরে। এক কাপ কফি নিয়ে হোটেলের বারান্দায় দাঁড়াই। একা। হিমালয়ের সামনে – মুখোমুখি। একে একে ঘন কালো আকাশে অদৃশ্য হয় পঞ্চচুল্লী। ট্যাঁ ট্যাঁ করে উড়ে যায় রাত জাগা পাখি। আকাশে অনেক তারা – জ্বলছে, নিবছে। কাল কৌশানীতে তারা চেনার ক্লাশে ছিলাম। সেখানে আধুনিক টেলিস্কোপে চোখ রেখে তো কত তারাই দেখলাম, তার একটাও তো চিনতে পারি না এখানে। দুটো আকাশ কি আলাদা? দেখেছিলাম সবচেয়ে কাছের পড়শি নীহারিকাকে – নাম তার ভারি সুন্দর – দেবযানী – আঠাশ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে। কোথায় দেবযানীরা এই আকাশে? কে জানে - আছে হয়ত। থাকুক না আজ অচেনা। দিনের আলো বড় প্রকট – আর একটুক্ষণ নাহয় এই রহস্যটুকু জিইয়ে রাখি – যতক্ষণ পারি।
১৭/১১/২০১৯
মুন্সিয়ারি”
ডাইরি বন্ধ করলাম। এ লেখার আগেও কিছু নেই, পরেও না। এখানেও সন্ধ্যা নামছে – লকডাউনের নিস্তব্ধ সন্ধ্যা। কয়েক হাজার মাইল দূরেও কি কোলাহল-বিহীন সন্ধ্যা আসে? আজও কি লাল আঁচে পুড়েছে পঞ্চচুল্লী? ও ছেলে, তুই কেমন আছিস? তোরও তো ইস্কুল বন্ধ। কমলা কেনার পথিক পাস? ধীরুর রুটিরুজি চলছে কেমন করে? বেড়ি ভাঙ্গা কি এত কঠিণ হল? ব্রহ্মকমল, ফোট কি আর?
শুধু পর্যটকের দৃষ্টিসুখের মোহ নয়, মৃদু মানুষগুলোসহ অপূর্ব ভ্রমণ। লেখায় দু-একটি ছবি দিলে সোনায় সোহাগা হতো