এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • মহাকালীর বাচ্চা

    বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী
    আলোচনা | বিবিধ | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ | ১১০৩ বার পঠিত
  • এই সপ্তাহে মুখ চুলকানো খবরের অভাব নেই- টোটো কাপ হাতে বিশ্বজয়ী ভারত, রিজওয়ানুর রহস্যকান্ড ও পুলিশের অবৈধ জুলুমবাজি, রাহুল গান্ধীর রাজ্যাভিষেক, এবং কলিকাতা ডুবুডুবু, বঙ্গ ভেসে যায় রে। একের পর এক খবর, এক একটি খবর পরিশীলিত, অপরিশীলিত, লিবারেল, অ-লিবারেল, হুল্লোড়ে, গম্ভীর- যাবতীয় বৃত্ত, উপবৃত্ত, পরাবৃত্তের নিস্তরঙ্গ জীবনে এক একটি আধলা ইঁট। জলতরঙ্গ জন্মায়, জল বুজ্‌কুড়ি কাটে, তরঙ্গ মিলায় যায়, তরঙ্গ উঠে, তারপর ঘরে ফিরে নিরালা নি:ঝুম অন্ধকার। এর ফাঁকে কিছু খবর প্রাণপণে ভেসে ওঠার চেষ্টা করেও টুপ্‌ করে নিরালা নি:ঝুম অন্ধকারে কখন ডুবে যায় টের পাওয়াই মুশকিল। কিছুদিন আগে কাগজে এইরকমই একটি খবর ছিল। রেশন ডিলারদের দুর্নীতিতে ওষ্ঠাগত সোনামুখীর মানুষ বিক্ষোভ জানিয়েছে, পুলিশ গুলি চালিয়েছে। এর পরে বাঁকুড়া ও বীরভূমের অন্য কিছু অঞ্চল থেকেও এই একই রকমের খবর আসতে থাকে। সিপিএম নেতারা পরমাণু চুক্তির বিরোধিতা করে যে মিটিং করছিলেন সেখানেও জনতা চড়াও হয়। জনতার মূল অভিযোগ সর্বাপেক্ষা নিম্ন আয়ের মানুষজনের জন্য বরাদ্দ খাদ্য রেশন ডিলারেরা খোলা বাজারে বিক্রি করছে। কাজেই যার কাছে এই খাদ্যই জীবনের শেষ ভরসা, তার কাছে সেটুকুও পৌঁছাচ্ছে না।

    ছোটোবেলায় মায়ের হাত ধরে রেশন দোকানে চালডাল তুলতে যাওয়া আমাদের সাপ্তাহিক রুটিন ছিল। এখন মনে হয় না কলকাতার বেশির ভাগ মধ্যবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্ত রেশন দোকানের দিকে পা বাড়ান। বাড়ানো উচিতও নয় কারণ যাদের সঙ্গতি রয়েছে তারা গরীবের অন্ন কম পয়সায় কিনবেনই বা কেন? রেশন কার্ড আর একটা কাজে লাগত- নাগরিকত্বের পরিচয় হিসেবে। এখন পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স বা ভোটার আই ডি কার্ডের ঠেলায় রেশন কার্ড সে উপযোগিতাটুকুও বহন করে না। ভুয়ো রেশন কার্ডের যে গন্ডগোলের খবর শুনতে পাওয়া যায়, তার বেশির ভাগই আসে গ্রাম থেকে অথবা শহরের অনামা বস্তিগুলোর থেকে। রেশন দোকানের সাথে মধ্যবিত্তের এখন দুর্লঙ্ঘ্য বিচ্ছিন্নতা। কাজেই রেশন দোকানের খবর আমাদের কাছে আপাতত: একটি খবর, নিজের জীবনের সাথে অচ্ছেদ্য কোনো ঘটনা নয়। একমাত্র পুলিশের গুলি চালানো নিয়ে সামান্য মাথা ঘামাতে রাজি আছি, কারণ ঐ যে,- পুলিশ!

    ২০০৫ সালে সেন্টার অফ মিডিয়া স্টাডিজ ভারতের বিভিন্ন জনপরিষেবায় দুর্নীতি নিয়ে একটি সার্ভে করেছিল। তার একটি ছিল ভারতের গণবন্টন ব্যবস্থায় দুর্নীতিবিষয়ক। ছোটো করে সেই সার্ভের মোদ্দা কথাগুলো তুলে দেওয়া যাক:
    গণবন্টন ব্যবস্থায় দুর্নীতির মোট আর্থিক মূল্য বাৎসরিক ৩৫৮ কোটি টাকা।
    - যে রাজ্যে দারিদ্র্য যত বেশি, সেইসব রাজ্যের রেশনব্যবস্থায় দুর্নীতি তত বেশি।
    - প্রায় ষাট শতাংশ পরিবার যারা এই ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল, তারা বলেছেন রেশন দোকানে খাদ্য পাওয়া যায় না। দরিদ্রতম রাজ্যগুলিতে এই অনুপাত প্রায় আশি ছুঁই ছুঁই।
    - গত এক বছরে দেড় কোটি পরিবারকে রেশন অফিসে ঘুষ দিতে হয়েছে।

    আমাদের জন্য আরও কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্য ছিল। এই বছর সাতই মার্চ মন্ত্রীমহাশয় সুবোধকান্ত সহায়ের রাজ্যসভায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই দেশে প্রায় ৫৮হাজার কোটি টাকা মূল্যের কৃষিজ খাদ্য স্রেফ নষ্ট হয়, যার মূল্য মোটামুটি হিসেবে ১২ বিলিয়ন ডলার। আর এক মন্ত্রী শ্রী শারদ পাওয়ারের দেওয়া তথ্য অনুসারে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলিতে পাঠানো গমের প্রায় ১০০ শতাংশ খোলা বাজারে বিক্রি হয়ে যায়। ১৭ই সেপ্টেম্বর টাইম্‌স্‌ অফ ইন্ডিয়াতে প্রকাশিত খবর থেকে জানতে পাচ্ছি গত তিন বছরে ৩১,৫৮৫.৯৮ কোটি টাকা মূল্যের কাদ্যদ্রব্য গণবন্টন ব্যবস্থা থেকে খালি বাজারে পাচার করা হয়েছে। এদের মধ্যে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে শুধু গম নয়, চালের মত নিত্যখাদ্যেরও প্রায় নব্বই শতাংশের বেশি খোলা বাজারে পাচার হয়ে যায়। আর আমরা প্রগতিশীল গরীবদরদী বাঙালী জনসাধারণ এই হরির লুটের বাজারে কি করছি? উত্তর-পুর্বের রাজ্যগুলি বাদ দিলে চাল ও গম চুরিতে আমাদের জায়গা ঠিক উত্তরপ্রদেশের পরেই গর্বিত রৌপ্যপদক গলায় ঝুলিয়ে। গত বছর পশ্চিমবঙ্গে ১,৯১৩.৭৬ কোটি টাকা মূল্যের চাল ও গম গণবন্টন ব্যবস্থা থেকে বের করে খোলা বাজারে চড়া দামে বিক্রি করা হয়েছে। এই সব তথ্য চমকপ্রদ হলেও অবিশ্বাস্য নয় কারণ এই তথ্যের যোগানদার ভারত সরকারেরই খাদ্য ও সরবরাহ দপ্তর। চোদ্দো রাজ্যে এই অপরাধের বিরুদ্ধে ভিজিলেন্স কমিটি গঠন করা হলেও পশ্চিমবঙ্গে হয় নি।

    সব অসুখেরই ডাক্তার থাকে। একদল ডাক্তার আছেন যারা রুগীর মাথাব্যথা করলে মাথাটাকেই কেটে ফেলার হুকুম দেন। তাদের বলা হয় বাজারপন্থী মৌলবাদী। অর্থাৎ, সরকার গণবন্টন ব্যবস্থা চালাতে না পারলে ব্যবস্থাটাকেই তুলে দাও। আর এক দল আছেন যারা নিজের মাথাব্যথা লুকিয়ে রেখে অন্যের মাথাব্যথার ডাক্তারি করে বেড়ান। তাদের বলা হয় বামফ্রন্ট। গণবন্টন ব্যবস্থা দৃঢ়তর করার দাবীতে আন্দোলনের শেষ নেই, এবং পশ্চিমবঙ্গে ১৯১৩.৭৬ কোটি টাকার কোনো হিসেব নেই। তৃতীয় দল ব্যাং প্রস্রাব করলেও মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবী করেন। অথচ এই বিপুল অপচয়ের বিরুদ্ধে এবং গরীবের মুখে অন্ন পৌঁছে দেবার দাবীতে দীর্ঘমেয়াদী জন আন্দোলন গড়ে তোলার প্রক্রিয়া নিয়ে সাধারণত: স্পিকটি নট হয়ে থাকেন। তাদের বলা হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর এই আমরা? মানবাধিকারবাদী, নারীবাদী, পরিবেশবাদী, সংখ্যালঘু অধিকারবাদী এই আমরা?

    শেষ কবে পয়সার অভাবে না খেতে পাওয়ার জ্বালায় ভুগেছি? সেই আদি ও অকৃত্রিম খিদের কথাই বলছি। যখন পেটটা আপনা থেকেই কুঁকড়ে আসে, হাত পাগুলো অবশ হয়ে ঠান্ডা মেরে যায়, খিঁচ ধরে, সেই অবস্থায় জল খেলে পেট মোচড় দিয়ে বমি বমি ভাব? অথচ জানি না কিভাবে কোথায় দুমুঠো চাল গম পাওয়া যায়? শেষ কবে? অথবা কোনোদিনও কি? বালাই ষাট, পরম শত্রুরও যেন এই দশা না ঘটে। যেন মানিক, তারাশঙ্কর, সোমনাথ হোড়, চিত্তপ্রসাদ,- এঁরাই আমাদের ক্ষুধার গল্পকথা শুনিয়ে চলেন, দেখিয়ে চলেন। ক্ষুধাও যেন স্রেফ ঐতিহাসিক দু:স্বপ্ন হয়ে থাকে। কিন্তু গোল বাধাচ্ছে এই বেটা মহাকালীর বাচ্চা। এ হতচ্ছাড়ার কথা আগে বলাই হয় নি। মোহিতবাবু সাতাত্তর সালে একখান পালা বেঁধেছিলেন, পালার নাম মহাকালীর বাচ্চা। জাগ্রত কালীমা জমিদারকে দৈবস্বপ্ন দিলেন তিনি এবার সত্যি সত্যি মা হবেন। সেই মায়ের পেটে যে বাচ্চাটা জন্ম নিল সে এক ভয়ংকর বাচ্চা। মায়ের পেট থেকে পড়েই মানুষের মাংস খুবলে খায়। সারা গ্রাম তোলপাড়- মহাকালীর বাচ্চা নাকি মানুষ কামড়ে খেয়েছে। আবার আলো নিভু নিভু হয়ে গেলে কেউ গায়- ছেলেটা খেতে না পেয়ে যা পেয়েছে খেয়েছে। চাল গমখেকো বাচ্চাদের বদলে এই সব মাংসখেকো বাচ্চা জন্মালে কিন্তু সাড়ে সর্বনাশ স্যার। গায়ের মাংস কেউ ইন্স্যুরেন্সও করে না। তাই ভাবনায় আছি- এ ব্যাটা যেন স্রেফ একটা নাটকীয় দু:স্বপ্ন হয়েই থাকে। ভাগ্যিস মোহিতবাবুর এই নাটকে গ্রামের নাম ছিল সোনাকুঠি!

    সেপ্টেম্বর ৩০, ২০০৭
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০০৭ | ১১০৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন