এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • আমার এই অক্ষমতা

    বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী
    আলোচনা | বিবিধ | ১২ এপ্রিল ২০০৭ | ১২৮০ বার পঠিত
  • আমি পুরুষ বলিয়া আমার একটি লিঙ্গ আছে। এবং একটি লিঙ্গ আছে বলিয়া আমি পুরুষ। এই দুইটি বাক্যের আপেক্ষিক সত্যাসত্য সম্পর্কে কূটতর্কে না গিয়া বলা যাইতে পারে মূলত: লিঙ্গের ব্যবহার দ্বিবিধ- প্রস্রাবত্যাগ এবং বীর্যক্ষরণ। এই প্রকৃতিদত্ত একনলা বন্দুকটিকে সুরক্ষিত রাখা আমাদের জন্মগত অভ্যাস। সর্বপ্রকার আচ্ছাদন খুলিলেও লিঙ্গের ক্ষেত্রে আমরা এ মোহ আবরণ খুলিতে কুন্ঠিতবোধ করি। নান্দনিকতার প্রশ্রয় বিনাও ইহা স্বাভাবিক কারণ ইহা আমার আত্মপরিচয়। নারীগণের যোনি আবরণ সম্পর্কেও একই কথা প্রযোজ্য। তবুও আক্রান্তের সুরক্ষা এবং অস্ত্রের সুরক্ষার মধ্যে যৎকিঞ্চিৎ পার্থক্য করিলে ক্ষতি নাই।

    এই বিশেষ প্রত্যঙ্গ আমার শরীরকে একটি সুনির্দিষ্ট বর্গের অংশ করিয়া তুলিয়াছে। আজন্ম আমি সেই বর্গের একজন সদস্যরূপে আমার শরীর, স্বভাব এবং মননকে গঠন করিয়াছি। আমার মস্তিষ্ক এবং তজ্জাত যাবতীয় অনুভূতি এবং চিন্তাসমূহ এই শরীরটিরই অংশবিশেষ। এই বোধ জন্মকালে প্রাপ্ত কোনো বোধ নহে। গত দশকগুলির জীবনচর্যায় এই বোধ পরিপালিত, পরিবর্ধিত এবং রূপান্তরিত হইয়াছে। কিন্তু ইহাও অতীব সত্য যে জন্মসূত্রে এই প্রত্যঙ্গটি আমার শরীরে যুক্ত না হইলে আমার বোধশক্তির বিকাশের পথ পৃথক হইত। অতএব আমার শরীর হইতে আমি পৃথক হইতে পারি না। পৃথক হইতে পারি না বলিয়াই অন্যবর্গের শরীরের লাঞ্ছনার বোধকে নিজের শরীরে ধারণ করিতে পারি না।

    আমার একটি কন্যাসন্তান আছে যাহাকে আমি শিশুকাল হইতে নিজহস্তে স্নান করাইয়াছি। অথচ এই সন্তান যখন আরও বড় হইয়া উঠিবে তখন স্বাভাবিকভাবেই সে পিতা হইতে শারীরিকভাবে বিযুক্ত। আমি যখন বড় হইয়া উঠিতেছি তখন আমার পিতৃদেব আমার সম্মুখে বেশবাস পরিবর্তন করিতে পারিলেও আমার মা তাহা পারিতেন না। পবিত্রতম সম্পর্কের ভিত্তিতেও এক অচ্ছেদ্য আত্মপরিচয় অবিরত আমাদের নিয়ন্ত্রণ করে- কেহ কেহ নারী, কেহ কেহ পুরুষ। এই আত্মপরিচয়ের তাগিদেই নারীকে তাঁর একান্ত আপন পুরুষদের নিকট হইতেও আত্মরক্ষার বর্ম পরিধান করিতে হয়। পিতার দ্বারা কন্যাধর্ষণ বিরলশ্রুত নয়, মাতার দ্বারা পুত্রধর্ষণ মানবেতিহাসের বিরলতম দুর্ঘটনারূপে স্বীকৃত হইবে।

    বস্তুত: পুরুষ যখন ধর্ষিত হয় সেই ধর্ষকদের ৯৭%-৯৮% শতাংশই পুরুষ। নারী কি পুরুষকে আদৌ ধর্ষণ করিতে পারে? নিজের শরীরের অনুভবেও তাহা অসম্ভব বলিয়া বোধ হয়। ইহা কোনো তত্ত্বপুস্তকপঠনসঞ্জাত প্রজ্ঞা নহে। ইহা আপন রক্তমাংসমথন করিয়া উঠিয়া আসা একটি বোধ যাহা আমাদের বাল্যশিক্ষার সুশীলতাকে ধ্বস্ত করে। অতএব ধর্ষণের স্মৃতি আমার শরীরের অংশ নহে। বাসেট্রামে প্রত্যহ কনুইগুঁতা, রাস্তাঘাটে উল্লসিত খিস্তি ও সিটিধ্বনির অনুভব আমাদের পুরুষকৌমের নিজস্ব অনুভবের অংশ নহে। আমাদের প্রেমিকা-স্ত্রী-মা-কন্যাদের ইতিহাসে একটি নির্জন অন্দরমহল রহিয়াছে যাহা যাবতীয় অণু-ইতিহাসের ( Alltagsgeschichte ) পঠনপাঠন সত্ত্বেও পুরুষের অগম্য থাকিয়া যাইবে।

    কিন্তু আমাদের শরীরের এই বোধ নারীর উপর অত্যাচারের বিপক্ষে প্রতিবাদী হইতে আমাকে বাধা দেয় না। তাহার কারণ দ্বিবিধ। প্রথমত:, সুশীল সমাজের একজন সুশীল সদস্যরূপে সর্বপ্রকার অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বধর্মরূপে গ্রহণ করিয়াছি। দ্বিতীয়ত:, আজন্ম আমি বিভিন্ন নারীর সহিত শ্রদ্ধা-প্রেম-স্নেহের সূত্রে আবদ্ধ। অতএব, নারী অত্যাচারের সংবাদ শুনিলেই নিজ স্ত্রী-কন্যার উপর এইরূপ অত্যাচার হইলে কি হইত ভাবিয়া যুগপৎ আশঙ্কিত এবং ক্রুদ্ধ হইয়া উঠি। আক্রান্তা নারীর পুরুষ স্বজনদের হৃদয়বেদনার সহিত আমাদের আশঙ্কা ও ক্রোধকে মিলাইয়া লইতে পারি। অতএব যুগপৎ আমাদের শিক্ষালব্ধ মানবিকতা এবং নিজগৃহের নারীদের সুরক্ষার স্পৃহা পুরুষচিহ্ন বহন সত্ত্বেও আমাদের প্রতিবাদী করিয়া তুলে।

    এই প্রতিবাদের ভাষা আক্রান্তা নারীটির সহমর্মী পিতা-ভ্রাতা-পুত্রসন্তানের ভাষা। এই পিতা-ভ্রাতা-পুত্রসন্তানেরা আজন্ম শরীর লইয়া বিব্রত কুন্ঠায় বাড়িয়া উঠার ভাষা শিখেন নাই। নিজশরীরের প্রতি সমাজের কৌতুহলী, ক্ষেত্রান্তরে আগ্রাসী দৃষ্টি হইতে আত্মরক্ষার ভাষা শিখেন নাই। অবশ্যই একটি তৃতীয় ভাষার অস্তিত্ব আছে যাহা সাহিত্যের ভাষা। সাহিত্য হইল ব্যক্তি অবস্থানের রূপান্তরের খেলা। অর্থাৎ চরিত্রের মধ্যে নিজেকে বসাইয়া এক নূতন অবস্থান হইতে পৃথিবীকে দেখিবার মায়াদর্পণ। সেই মায়াদর্পণে পুরুষলেখনীতে নারীর একান্ত ভাষা প্রতিফলনের সম্ভাবনা শূন্য নহে। তবুও সেই ভাষা এক মায়াপ্রক্রিয়ার ভাষা যাহা আমার বাস্তবিক রক্তমাংসকে কোনো নবতর শারীরিক বোধে উত্তীর্ণ করে না।

    জীবিকাচ্যুত শ্রমিক অথবা ভূমিচ্যুত কৃষকের পক্ষাবলম্বনের মধ্যবিত্ত ভাষা স্ববিরোধিতাপূর্ণ হইলেও সেই ভাষা আমার নিকট দুর্বোধ্য নহে। আমাদের যৌথ চেতনা দেশত্যাগ এবং বাস্তুচ্যুতিজনিত অসহনীয় দারিদ্র্যের স্মৃতিকে ভুলিতে দেয় নাই। বিশ্বায়িত মধ্যবিত্তশ্রেণীর সদ্যোপার্জিত আর্থিক স্বচ্ছলতাসত্ত্বেও পিতা-পিতৃব্য-মাতুলদের আর্থিক সংগ্রামের আবাল্যশ্রুত কাহিনী আমাকে ভুলিতে দেওয়া হয় নাই। কিন্তু আমাকে জন্মদানের ক্ষণে আমার মাতার গর্ভযন্ত্রণার ভাষা আমার নিকট দুরধিগম্য রহিয়া গিয়াছে। দারিদ্র্যের সহিত আজীবন যুঝিয়া যাওয়া আমার বিধবা মাতামহীর সদাহাস্য মুখের সন্দর্ভ আমি আবিষ্কার করিতে পারি নাই। আমি সন্তানলাভের তাড়নায় একটি নারীর গণিকাবৃত্তিগ্রহণের যৌক্তিকতা অনুভব করিতে পারি নাই।*

    এই অক্ষমতা আমার পুরুষজন্মের অক্ষমতা যাহা স্বীকার করিতে বিন্দুমাত্র অগৌরব বোধ করি না। এই অক্ষমতা এবং অসম্পূর্ণতার বোধ আমাদের বিনম্র এবং জিজ্ঞাসু হইতে সহায়তা করে। এই অক্ষমতা আমাদের সর্বজ্ঞবোধের বিভ্রান্ত আত্মবিশ্বাস হইতে মুক্তি দেয়। এই অক্ষমতা অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অক্ষমতা নহে, নিজের অর্ধজীবন নারীকে উৎসর্গ করার অক্ষমতা নহে। এই অক্ষমতার পর্বান্তরে যে অহিংসার ইতিহাস রচিত হইতে থাকে তাহা আমাদের জন্য আমাদের মাতাদের এবং আমাদের সন্তানের জন্য আমাদের জায়াদের গর্ভযন্ত্রণার স্বীকৃতির ইতিহাস।

    --------------------------------------------------------------------

    *চলমান যৌনকর্মী ১- সুবোধ দাস, দোয়েল প্রকাশন
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১২ এপ্রিল ২০০৭ | ১২৮০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন