আমফানের পর পুরোনো একটি বিতর্ক আবার মাথাচাড়া দিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার যে সামান্য ১০০০ কোটি টাকা দিয়েছেন, তা কি দয়ার দান? অনুদান? ভিক্ষা? নাকি ন্যায্য পাওনার ভগ্নাংশ মাত্র? প্রশ্নটি যেহেতু উঠেইছে এই নিয়ে খুব ছোট্টো করে সংখ্যা এবং প্রশ্নোত্তরের মধ্যে দিয়ে পুরো চিত্রটি একবার দেখে নেওয়া হয়েছে এই নিবন্ধে। লেখক অর্থনীতিতে বিশেষজ্ঞ নন, 'বিশেষ' কোনো গুপ্ত তথ্যভান্ডারের চাবিকাঠি নেই তাঁর কাছে। তাই এখানে ব্যবহৃত সমস্ত তথ্যই উন্মুক্ত জায়গা থেকে নেওয়া। তথ্যসূত্র লেখার সঙ্গেই আছে।
১। ভারতবর্ষে রাজ্য এবং কেন্দ্রের করবাবদ উপার্জনের উৎস কী?
রাজ্য সরকার রাজ্যের অধিবাসীদের থেকে কিছু কর আদায় করে। একে বলে রাজ্যের নিজস্ব উপার্জন (করবাবদ)। এছাড়াও আছে কিছু কেন্দ্রীয় কর, যা কেন্দ্রীয় সরকার আদায় করে। এইভাবে তৈরি হয়, কেন্দ্রের নিজস্ব উপার্জন (করবাবদ)। কেন্দ্রের করবাবদ আয়ের একটি অংশ রাজ্যরা পায়। একে বলে 'কেন্দ্রীয় করে রাজ্যের অংশ'।
২। ভারতবর্ষের রাজ্যগুলির এবং কেন্দ্রীয় সরকারের করবাবদ উপার্জন কত?
২০১৮-১৯ সালের আনুমানিক মাপ অনুযায়ী ভারতের সমস্ত রাজ্যের প্রত্যক্ষ করবাবদ (আয়কর + কর্পোরেট কর) নিজস্ব উপার্জনের যোগফল ১৪৭১৯৪ কোটি টাকা। আর কেন্দ্রীয় সরকারের একার উপার্জন ১১৫০০০০ কোটি টাকা (১)। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ করবাবদ উপার্জনের প্রায় ৯০% একাই দখল করে কেন্দ্রীয় সরকার। বাকি ১০% এর সামান্য বেশি পায় সমস্ত রাজ্যগুলি মিলিতভাবে।
এর সঙ্গে অপ্রত্যক্ষ কর যোগ করলে, ২০১৮-১৯ এর আনুমানিক মাপ অনুযায়ী ভারতের সমস্ত রাজ্যের করবাবদ নিজস্ব উপার্জনের যোগফল ১২২২৮৬০ কোটি টাকা। আর কেন্দ্রীয় সরকারের একার উপার্জন ২২৭১২৪২ কোটি টাকা(২)। মোটা দাগের হিসেবে সমস্ত করের ২/৩ অংশই একা কেন্দ্রীয় সরকার দখল করে। বাকি ১/৩ অংশ পায় রাজ্যগুলি। ২০১৮-১৯ সালের সংখ্যাগুলি বাজেট অনুমান। কিন্তু তার আগের কয়েক বছরের পাকা হিসেবেও অনুপাতটি একই রকম। অর্থাৎ প্রত্যক্ষ করের মোটামুটি ৯০% কেন্দ্রীয় সরকারের উপার্জন। আর সামগ্রিক ভাবে করবাবদ রাজ্যগুলি সমবেতভাবে যা উপার্জন করে কেন্দ্রীয় সরকার উপার্জন করে তার দ্বিগুণ।
৩। করবাবদ পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব উপার্জন কত?
২০১৮-১৯ সালের হিসেবে করবাবদ পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব উপার্জন ৬১৬১ কোটি টাকা(৩)। গোটা দেশের সমস্ত রাজ্যগুলির নিজস্ব উপার্জনের মোটামুটি ৫% (৪.৯%) (৪)।
৪। পশ্চিমবঙ্গ থেকে করবাবদ কেন্দ্রীয় সরকার কত টাকা নিয়ে যায়?
এর রাজ্যওয়াড়ি আলাদা হিসেব রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সাইটে নেই। উন্মুক্ত ভাবে এই তথ্য একজায়গায় কোথাও রাখাও নেই। তবে নানা আলাদা-আলাদা সূত্র থেকে এর মোটামুটি একটা হিসেব পাওয়া যায়।
ক। প্রত্যক্ষ কর। ২০১৮-১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আদায় হওয়া প্রত্যক্ষ করের আনুমানিক পরিমান ৪৪৬৩৮ কোটি টাকা(৫)।
খ। কাস্টমস ও এক্সাইজ। ২০১৭-১৮ সালে কলকাতা অঞ্চল থেকে আদায় হওয়া শুল্কের পরিমান মোটামুটি ২৭০০০ কোটি টাকা (৬)। এটা ঠিক কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গের নিখুঁত হিসেব নয়, কলকাতা অঞ্চল বা জোনের হিসেব। তবে মোটামুটি হিসেবের জন্য ব্যবহারযোগ্য।
গ। সিজিএসটি। ২০১৮-১৯ এ পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ্যমাত্রা ১৮,০০০ কোটি টাকা (৭)।
এই তিনটি মূল উপার্জনের খাত যোগ করলে পাওয়া যায়, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য থেকে ২০১৮-১৯ সালে আনুমানিক ৯০০০০ কোটি টাকা উপার্জন করেছে। সংখ্যাটি আনুমানিক। এবং কমের দিকেই, কারণ এতে সমস্ত খুঁটিনাটি যোগ করা হয়নি।
৫। এই কেন্দ্রীয় করের কত অংশ পশ্চিমবঙ্গ পায়?
২০১৮-১৯ সালের হিসেব অনুযায়ী কেন্দ্রীয় করের অংশ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ পেয়েছে ৫৬১৮ কোটি টাকা (৮)। আনুমানিক হিসাবে কেন্দ্র যা আদায় করে, তার মাপ, ৯০০০০ কোটি টাকা। শতাংশের হিসেবে মোটামুটি ৭%। আর সংখ্যার হিসেবে ৮৪০০০ কোটি টাকা করবাবদ রাজ্যের বাইরে চলে যায়। সরাসরি ফেরত আসেনা। সহজ কথায়, দেনা-পাওনার হিসেবে করবাবদ পশ্চিমবঙ্গের নিজস্ব যা আয়, তার ১৪ গুণ বা তার চেয়েও বেশি টাকা রাজ্যের বাইরে যায়, সরাসরি ফেরত আসেনা। একে আমরা টাকা-চালান বলতে পারি।
৬। এই ফেরত না আসা টাকা যায় কোথায়?
এই টাকার ভগ্নাংশ পাওয়া ঐতিহাসিকভাবে কেন্দ্রীয় সরকারের বদান্যতার উপর নির্ভর করে এসেছে। কিছুটা কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি খরচা করে (সেটা নানা রাজ্যে রেলপ্রকল্প চালু করতেই হোক, বা অস্ত্র কিনতে কিংবা নানা রাজ্যের শিল্পপতিদের ভরতুকি দিতে বা এরকম নানা খাতে)। রাজ্যেও কিছু প্রকল্পে কিছু টাকা আসে। বিভিন্ন প্রকল্পে কতটুকু পাওয়া যাবে, তাকেই বলা হয় অনুদান। ১৯৯০ দশক পর্যন্ত বাম সরকারের মন্ত্রীরা, বিশেষ করে অশোক মিত্র যে অভিযোগগুলি করেছেন, তার মর্মার্থ একটিই, যে, এই রাজ্যের নিজস্ব উপার্জনের সমমূল্যের কাছাকাছি টাকাও টাকা রাজ্যে ফিরে আসেনা। এবং কেন্দ্রীয় সরকারি নীতিগুলি অন্য কিছু রাজ্যকে অর্থনৈতিক সুবিধা প্রদান করতেই তৈরি। যেমন মাশুল সমীকরণে লাভবান হয়েছিল উত্তর এবং পশ্চিম ভারত, পশ্চিমবঙ্গ চূড়ান্ত ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেলের প্রকল্পসমূহের পশ্চিমবঙ্গের ব্যয়বরাদ্দ ছিল বস্তুত শূন্যের কাছাকাছি। একে তাঁরা বঞ্চনা বলেছেন। অভিযোগ সত্যি হলে এই টাকা চালানকে ৫০ বছরের লুণ্ঠন বললেও অত্যুক্তি হয়না।
প্রসঙ্গত নতুন শতাব্দীতে অবস্থার কিছুটা উন্নতি হয়েছে। ২০০০ সাল থেকে অর্থ কমিশন কেন্দ্রের আয়ের একটি অংশকে সরাসরি রাজ্যের হাতে অনুদান হিসেবে ফেরত দেবার কথা জানায়। কতটুকু দেওয়া হবে, সেই ভগ্নাংশটি সময়ের সঙ্গে বদলেছে। মোটামুটি হিসেবটি এরকমঃ
• ২০০০-২০০৫ঃ ২৯.৫%
• ২০০৫-২০১০ঃ ৩০.৫%
• ২০১০-২০১৫ঃ ৩২%
• ২০১৫-২০২০ঃ ৪২%
সূত্রঃ অর্থ কমিশনের রিপোর্ট (৯)।
এর কতটা কোন রাজ্য পাবে সে নিয়েও নানা জটিল হিসেব আছে। কিন্তু সহজ করে যদি সব রাজ্য সমান পায় ধরে নেওয়া যায়, সেক্ষেত্রেও পশ্চিমবঙ্গের দেনা-পাওনার হিসেব সমান-সমান হয়না। খুব মোটা হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের পাওনার হিসেবে এর পরেও অন্তত ৫০০০০ কোটি টাকার ঘাটতি থাকে। হিসেবটি আনুমানিক এবং ২০১৮-১৯ সালের। মনে রাখতে হবে, অবস্থার উন্নতির পরে, হিসেবটি এরকম। স্বাধীনতার পরের পঞ্চাশ বছর যখন কেন্দ্রীয় সরকারের অধিকার ছিল একচ্ছত্র, সে সময় অভিযোগানুসারে এ ঘাটতি অনুপাতের হিসেবে অনেক বেশিই ছিল। এবং এখনও, এর বাইরের সমস্ত খরচই কেন্দ্রীয় সরকারের একচেটিয়া অধিকারে। এর কতটুকু 'অনুদান' এবং 'প্রকল্প' হিসেবে আসে বা আসবে, তার কোনো মাপকাঠি নেই।
৭। অর্থনীতিবিদরা কী বলছেন?
দুঃখজনকভাবে অশোক মিত্রের পর অর্থনীতিবিদরা প্রসঙ্গটি এড়িয়ে গেছেন। উদাহরণস্বরূপ, দিল্লি আইএসআই এবং অর্থ কমিশনের উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গের আর্থিক সমীক্ষার একটি প্রতিবেদনে পশ্চিমবঙ্গের বাজেটে কেন্দ্রীয় 'অনুদান'এর শতাংশ বৃদ্ধিতে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে, এবং রাজ্যের 'নিজস্ব' উপার্জন বৃদ্ধির নিদান দেওয়া হয়েছে (১০)। হিসেব-নিকেশে সেখানে কোনো গোলমাল নেই, কিন্তু মূল উপপাদ্যেই গোলযোগ, যে, কেন্দ্রীয় 'অনুদান' আসলে কোনো দান নয়, রাজ্যের টাকা রাজ্যে ফেরত আসা মাত্র। বেশিরভাগগ অংশটি ঠিকঠাক ফেরত না এলে, সেটিই বরং উদ্বেগের বিষয়। বিকল্প হিসেবে 'নিজস্ব' উপার্জন বাড়ানো কোনো স্থায়ী প্রতিষেধক নয়। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় সব টাকাই আসলে রাজ্যের, কেন্দ্রীয় টাকা রাজ্যগুলির একটি যৌথ ভান্ডার মাত্র, সেখান থেকে সর্বভারতীয় প্রকল্পে খরচ করা যেতে পারে, যাতে সকলের উপকার হয় -- যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রাথমিক নীতিমালাটিকে মূলত উপেক্ষা করা হচ্ছে, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক প্রতিবেদনে। বস্তুত আমফানের গুরুত্ব 'সর্বভারতীয়' মাধ্যমে যতটুকু, পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক মূল্যও 'সর্বভারতীয়' আর্থিক প্রতিবেদনে তেমনই। পশ্চিমবঙ্গ থেকে টাকা বাইরে যাবে, বিপুলাংশই ফিরবেনা, এবং একই সঙ্গে 'সর্বভারতীয়' নীতিমালা নির্মিত হবে পশ্চিমবঙ্গকে অগ্রাহ্য করে, এটিই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই দৃষ্টিভঙ্গী প্রকৃত যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর সম্পূর্ণ পরিপন্থী।
এই দৃষ্টিভঙ্গীর কারণেই 'অনুদান' হয়ে দাঁড়িয়েছে ভিক্ষার নামান্তর। আমফানের মতো তুমুল দুর্যোগের কারণে নিজের টাকা নিজে ফেরত পেতে হলেও, হাত পেতে দাঁড়াতে হয় বঙ্গবাসীকে। এবং কেন্দ্রীয় মনসবদাররা কিছু টাকা ছুঁড়ে দিয়ে মহত্বের দাবীদার হয়ে যান।