শুরুতেই মনে পড়ে কি নাথানিয়েল হথর্ন কিংবা প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের গল্পের কথা যেখানে সমব্যঞ্জনায় “I don’t know”-র বাংলা “আমি জানিনা” করলে হেরে ভূত হয়ে যায়? এই দ্যাখো, হেরে গেছে হেরে গেছে বলে প্রবল শোরগোল ওঠে। ঠিক এরকম একটা অবস্থা বর্তমান করোনা-আক্রান্ত পৃথিবীতে বিজ্ঞানের জগতে এবং গণমানসিকতায় ঘটছে। একদল বলছে এই দ্যাখো হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন হেরে গেল, আরেকদল যেন বলছে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন জিতে গেল। বিজ্ঞান এবং চিকিৎসার দুনিয়ায় এরকম হার-জিৎ কি হয়? মানুষ প্রবলভাবে আর্ত, অসহায়, অনিশ্চয়তার আশঙ্কায় প্রহর গুণছে। ২৩০টি বা তার বেশি দেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়েছে। এখানে বিজ্ঞান ও চিকিৎসার জগৎ যৌথভাবে সন্ধান চায় একটি নিরাময়কারী কিংবা প্রতিরোধকারী ওষুধের, চায় মানুষকে মৃত্যুর করালগ্রাস থেকে জীবনের স্বপ্নময় বসন্তে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু বিক্ষত বাস্তব ভিন্ন কথা বলছে।
বিশ্বের রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক এবং ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের “বড়দাদা” আমেরিকা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার (৭.০৬.২০২০) খবর হল “New Cases Are In Over a Third of US States”। worldometer-এর দেওয়া ৭.০৬.২০২০-র হিসেব অনুযায়ী আমেরিকায় মোট আক্রান্ত ১,৯৮৮,৫৪৪ জন; মৃত্যু ঘটেছে ১১২,০৯৬ জনের; সুস্থ হয়েছে ৭৫১,৮৯৪ জন। সমগ্র পৃথিবীতে মৃত্যু হয়েছে ৩৯৩,০০০ জনের। আমাদের ভারতবর্ষে কনফার্মড করোনা পজিটিভ কেস ২৪৬,৬২২টি, মৃত্যু হয়েছে ৬,৯৪৬ জনের, সুস্থ হয়ে উঠেছে ১১৯,২৯৩ জন। এ যেন এক মৃত্যুমিছিল দেখছি আমরা। আর এখানেই অভাবনীয় গতিতে বিজ্ঞানী, চিকিৎসক এবং গবেষকেরা অক্লান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছেন কোন একটি নিরাময়ের সন্ধান পেতে, কোন একটি অমৃতকুম্ভের সন্ধানে পথ হাঁটছেন। দুর্ভাগ্যের হল “জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি”-র মতো একইসাথে পথ হাঁটছে কর্পোরেট পুঁজি – কতটা মুনাফা করা যায় মানুষের জন্য জীবনদায়ী ওষুধ আবিষ্কার করে এরকম এক অভ্রান্ত লক্ষ্য নিয়ে। এরকম এক আবিষ্কার-মুনাফা, জীবনের সন্ধান-লাভের সন্ধান দ্বৈততার মাঝে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বাজি হিসেবে উঠে এসেছে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন।
(১৭শ শতাব্দীর প্লেগ ডাক্তারের চিত্র। এখনকার মৃত্যুমিছিল আর পুঁজির মুনাফার খোঁজের সাথে মেলানো যায় কি?)
নামী গবেষণা পত্রিকা সায়ান্স-এ প্রকাশিত (৫.০৬.২০২০) একটি সংবাদের শিরোনাম হল “The pandemic’s first major research scandal erupts”. এর আগে গার্ডিয়া্ন সংবাদপত্রে ধারাবাহিকভাবে পরপর কয়েকটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয় – “Questions raised over hydroxychloroquine study which caused WHO to halt trials for Covid-19” (28.05.2020), “Covid-19 sudy on hydroxychloroquine use questioned by 120 researchers and medical professionals” (29.05.2020), “The Lancet has made one of the biggest retractions in modern history. How could this happen?” (5.06.2020), “How were medical journals and WHO caught out over hydroxychloroquine?” (3.06.2020), “Retracted studies may have damaged public trust in science, top researchers fear” (5.06.2020)।
অস্যার্থ, কোভিড-১৯-এর চিকিৎসায় বহুল প্রচারিত হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহার নিয়ে ২০০ বছরের প্রাচীন সর্বমান্য জার্নাল ল্যান্সেট (একইসাথে উল্লেখ করতে হবে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিন তথা NEJM, নেচার, সায়ান্স অথবা জার্নাল অব আমেরিকান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন তথা JAMA-র মতো জার্নালগুলোর কথা) পত্রিকায় যে গবেষণাপত্র ছাপা হয়েছিল সেটি ভুল তথ্যের ওপরে ভিত্তি করে তৈরি হয়েছিল বলে জার্নালের তরফে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। আমাদের স্মরণে থাকবে প্রধানত ম্যালেরিয়ায় এবং রিউম্যাটয়েড আর্থ্রাইটিস এবং লুপাস (SLE) রোগে দীর্ঘদিন ধরে (প্রায় ৫০ বছর হবে) ওষুধ হিসেবে ক্লোরোকুইন এবং রাসায়নিকভাবে এর উন্নত যৌগ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহৃত হয়ে আসছে। রোগীরা কম ডোজে এ ওষুধ মাসের পরে মাস বা বছরের পরে বছর ধরে খায়। প্রধানত রেটিনার সমস্যা ছাড়া আর সেরকম কোন সমস্যা দেখা যায়না। বাকি কিছু সমস্যা অন্য অনেক ওষুধের মৃদু সাইড এফেক্টে যেমন হয় সেরকম ঘটে থাকে। আমার আলোচনায়, এতক্ষণ ধরে যে আলোচনা চলছে সে প্রেক্ষিতে, অনিবার্যভাবেই ভরকেন্দ্রে থাকবে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন। এখানে বলা দরকার যে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের অ্যান্টি-ম্যালেরিয়া চরিত্র ছাড়াও immunomodulator অর্থাৎ মানুষের শরীরের ইমিউন সিস্টেমকে প্রভাবিত করতে পারে। এটাই হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের প্রচারকদের প্রধান হাতিয়ার। এমনকি এতদূর অব্দি দাবী করাও হয়েছে যে কোভিড-১৯-এর চূড়ান্ত পর্যায়ে যে মারাত্মক উপসর্গ তৈরি হয় – cytokine strom – যখন আমাদের ইমিউন সিস্টেম এলোপাথারি আচরণ করতে যার পরিণতিতে রোগীকে বাঁচানো প্রায় দুঃসাধ্য সে দুর্যোগকেও নাকি প্রতিহত করার ক্ষমতা রাখে। যদিও আজ অব্দি কোন নির্ভরযোগ্য ট্রায়ালে এর প্রমাণ মেলেনি। পরে আসছি সেকথায়।
NEJM-এ “Drug Evaluation during the Covid-19 Pandemic” (১৪.০৪.২০২০) শিরোনামে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যালোচনায় বলা হয়েছিল – When very limited observational and anecdotal evidence raised the possibility that the antimalarial drugs chloroquine and hydroxychloroquine may have activity against SARS-CoV-2, President Donald Trump quickly began celebrating the promise of their widespread use, stating on national television that he had a “hunch” that such therapy was effective and that the drugs could be a “game changer”in addressing the pandemic. অর্থাৎ, যখন আমাদের কাছে খুব সামান্য কিছু চোখে দেখা এবং গল্পকথার মতো প্রমাণ (anecdotal evidence) হাতে ছিলো সেসময়েই ট্রাম্প (১৯.০৩.২০২০) হোয়াইটহাউসে তাঁর ষষ্ঠেন্দ্রিয়ের ক্ষমতায় (“hunch”) বুঝতে পেরেছিলেন যে এটা করোনা অতিমারির সাথে লড়াইয়ে “খেলা ঘুরিয়ে দেবার” মতো একটি ওষুধ। এরকম এক বিন্দু থেকে শুরু হল হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন এবং কোভিড-১৯ সংযোগের এক নতুন অধ্যায়। এই প্রেক্ষিতে সায়ান্স জার্নালে এবং গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোকে বিচার করতে হবে। সায়ান্স-এর পূর্বোক্ত প্রবন্ধেই স্পষ্ট করে বলা হয়েছে – The potential of hydroxychloroquine for treating COVID-19 has become a political flashpoint.
করোনা অতিমারির চেহারা নেবার পরে দিশেহারা মানুষ যখন কোন নির্ভরযোগ্য নিরাময়ের খোঁজ করছে তখন অর্থাৎ ২০২০-র মার্চ মাস থেকে শুরু হল হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের অনির্ভরযোগ্য বোলবোলাও। কারণ? উত্তরে যাবার আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখার উল্লেখ করি। NEJM-এ সম্পাদকীয় প্রকাশিত হল (১৮.০৩.২০২০) “Covid-19 – The Search for Effective Therapy”। বলা হল - Covid-19 is spreading rapidly through Europe and North America, but we have few specific tools to control the growing epidemic and treat those who are sick.
NEJM-এর আরেকটি সম্পাদকীয়তে (২৮.০২.২০২০) অনেকটা কাতর কণ্ঠে যেন জানানো হল - Therapy currently consists of supportive care while a variety of investigational approaches are being explored. Among these are the antiviral medication lopinavir–ritonavir, interferon-1β, the RNA polymerase inhibitor remdesivir, chloroquine, and a variety of traditional Chinese medicine products. অনেকটা খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথরের মতো। সম্ভাব্য সমস্ত চিকিৎসার মধ্যে চিনা ট্র্যাডিশনাল ভেষজও আছে, ক্লোরোকুইনও আছে। এর কারণ দুটো – (১) in vitro অর্থাৎ ল্যাবরেটরিতে কৃত্রিম পরিবেশে ক্লোরোকুইন/হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের কিছু ভাইরাস-প্রতিরোধী ক্ষমতা দেখা গেছে যদিও তা কখনই মানুষের শরীরে (in vivo) প্রমাণিত হয়নি, (২) International Journal of Antimicrobial Agents-এর মতো সুখ্যাত জার্নালে ২০ মার্চ, ২০২০-তে Didier Raoult এবং সহ-গবেষকদের একটি গবেশণাপত্র প্রকাশিত হয় “Hydroxychloroquine and azithromycin as a treatment of COVID-19: results of an open-label non-randomized clinical trial, এবং (৩) ট্রাম্পের সেই বিখ্যাত স্পর্ধিত উক্তি যে এ ওষুধগুলো হল “game changers” – কোভিডের অতিমারির খেলা ঘুরিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে। সাথে সাথে শুরু হয়ে গেল রাজনীতির কাছে বিজ্ঞানের নতজানু হবার নতুন অধ্যায় – medical-state-politics-industrial complex। আরেক অর্থে “game changers”-ও বটে। আমেরিকার FDA-র মতো স্বশাসিত, স্বাধীন সংস্থা হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনকে ইমার্জেন্সি ইউজ অথরাইজেশন (EUA) ছাড়পত্র দিয়ে দিল। অর্থাৎ, হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহার ছাড়পত্র পেয়ে গেলো। শুরু হয়ে গেলো একের পর এক ট্রায়াল। এর মধ্যে ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত একটি বড়ো ট্রায়াল নিয়েই বিতর্ক এবং গবেষণাপত্রের প্রত্যাহার।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে Didier Raoult-এর গবেষণাপত্র উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে পরে retracted তথা প্রত্যাহৃত হয়। কিন্তু ল্যান্সেট বা NEJM-এর মতো হুল্লোড় তৈরি হয়নি। এটা খানিকটা আশ্চর্যের তো বটেই। আরেকটি বিষয়ও আমরা নজর করবো। Didier Raoult যে ক্ষুদ্র পরীক্ষাটি করেছিলেন সেটা open-label non-randomized clinical trial – এখানে রোগী এবং ডাক্তার উভয়েই জানে যে কি ওষুধ দেওয়া হচ্ছে এবং কিভাবে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যে গবেষণাগুলো আন্তর্জাতিক স্তরে মান্যতা পায় সেগুলো সবই বৃহৎ (অনেক সংখ্যক রোগীকে নিয়ে) placebo-controlled, randomized controlled trial (RCT) – এর অর্থ হল এখানে রোগী এবং চিকিৎসক কেউই জানেনা কি ওষুধ কিভাবে এবং কাকে দেওয়া হচ্ছে। ধরা যাক ১০০ জন রোগীকে নিয়ে পরীক্ষাটি হচ্ছে। সেখানে ৫০ জন রোগী যে ওষুধের পরীক্ষা হচ্ছে তা পাবেনা এবং জানবেওনা, এমনকি ডাক্তারেরাও নয়। অন্য ৫০ জনকে পরীক্ষাধীন ওষুধটি দেওয়া হবে। এরপরে একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে দেখা হবে ওষুধ দিয়ে যে যে ফলাফল চাওয়া হচ্ছিল তার কতোটা লক্ষ্যপূরণ হল, এবং ওষুধ যারা পায়নি তাদের ক্ষেত্রে কি ঘটলো। এভাবেই একটি ওষুধ বা প্রযুক্তির গুণমান যাচাই করা হয়। এভাবেই অর্থনীতির ক্ষেত্রেও randomized controlled trial-এর ব্যবহার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সহযোগীরা অর্থনীতিতে নোবেল প্রাইজ পান।
এবার আমরা ল্যান্সেট এবং NEJM-এ এবং অন্যান্য মান্য জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলোর বিচার করতে পারি। এখানে ঊল্লেখ করা প্রয়োজন, নেচার পত্রিকায় (২৭.০৪.২০২০) “Pseudoscience and COVID-19 — we’ve had enough already” শিরোনামে একটি প্রতিবেদনে বড়ো আক্ষেপ করে বলা হয়েছিল – “Cow urine, bleach and cocaine have all been recommended as COVID-19 cures — all guff. The pandemic has been cast as a leaked bioweapon, a byproduct of 5G wireless technology and a political hoax — all poppycock. And countless wellness gurus and alternative-medicine practitioners have pushed unproven potions, pills and practices as ways to ‘boost’ the immune system.” অর্থাৎ, গোমূত্র থেকে কোকেন সবকিছুই এখন চিকিৎসার নামে চলছে। বড্ডো অসহায় এবং ধ্বস্ত বর্তমানের অতিবাহিত এ সময়। অবদমিত আতঙ্ক এবং ভয়াবহ মৃত্যুভয়ের সামনে মানুষ খড়কুটোর মতো চিকিৎসা বলে যা কিছু দাবী করা হচ্ছে তাকেই আঁকড়ে ধরতে চাইছে। এখানেই আমাদের যুক্তি বনাম আবেগ, নির্মোহ বিজ্ঞান বনাম মানুষের সংস্কার এগুলোর সাথে সংঘাত। এখানেই কঠোর যুক্তিনিষ্ঠ প্রক্রিয়ায় যাচাই করে নিতে হবে চিকিৎসা বলে যা দাবী করা হচ্ছে তার সঠিক গুণমান। এখানে medical-state-politics-industrial complex বা বৃহৎ রাষ্ট্র বা পুঁজির চাপকে অতিক্রম করে যা ট্রুথ বা সত্য তাকে খুঁজে নিতে হবে। এখানে স্মরণে রাখবো, আমেরিকার CDC (Centers for Disease Control and Prevention)-র মতো স্বশাসিত, বিশ্বের সর্বত্র মান্য ও গ্রাহ্য প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ট্র্যাম্পের ষষ্ঠেন্দ্রিয় দিয়ে আবিষ্কারের পরে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে পোস্ট করা হয়, যদিও পরে সেটা মুছে দেওয়া হয় – The Centers for Disease Control and Prevention (CDC) went so far as to publish doses of chloroquine and hydroxychloroquine for use in patients with Covid-19, though it later removed them from its website. (“Drug Evaluation during the Covid-19 Pandemic”)
NEJM (২৯.০৪.২০২০)-এ প্রকাশিত প্রবন্ধটি (Covid-19 – A Reminder to Reason) আমাদের আগেই সতর্ক করেহিল – In a time when the rational–emotional scale is tipping to the emotional side, we begin relying more heavily on anecdotes, particularly personal experiences that may carry inordinate weight in our minds. Journalists use the power of stories to connect with readers and tug at their emotions. Physicians, trained as scientists, are expected to follow a hypothesis-driven, rational, evidence- based approach to clinical decision making, but we, too, can be swayed by stories under the pressures of a crisis. আমাদের সংকটের সময়ে নানারকম গল্পকথায় বিশ্বাস করি, যুক্তিবোধের চাইতে আবেগের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়ি। এমনকি চিকিৎসকেরাও যাদের প্রকল্প-নির্ভর যুক্তিকাঠামোর ওপরে ভিত্তি করে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেবার কথা তাঁরাও সংকটের চাপে এসব অতিকথনে ভেসে যেতে পারেন। NEJM-এ এরকম মন্তব্য করার পরে আমাদের মন্তব্য নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করবো যে একটি দেশে প্রতি ১০ লক্ষ মানুষে কতসংখ্যক RT-PCR বা কে করোনা আক্রান্ত সেটা বোঝার জন্য জরুরী। কারণ টেস্ট, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, আইসোলেশন এবং প্রয়োজনে কোয়ারেন্টাইন এগুলো ছাড়া সংক্রমণ কার্যকরীভাবে রুখবার আর কোন পরীক্ষিত রাস্তা নেই। এর পরে আসে ওষুধের প্রশ্ন। এ প্রসঙ্গে আগ্রহী পাঠকদের গুরুচণ্ডালীতে ১৯ মে-তে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ “স্বাস্থ্যবৈষম্যের প্রকটতা, মানুষী অস্তিত্বের আতঙ্ক ও সংকট এবং করোনা” প্রবন্ধটি দেখে নিতে পারেন।
হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে আরও কিছু কথা
২২.০৫.২০২০-তে ল্যান্সেট-এ প্রকাশিত গবেষণাপত্রের (যা নিয়ে এত হুল্লোড় এবং পরে প্রত্যাহৃত হয়) ছিল – Hydroxychloroquine or chloroquine with or without a macrolide for treatment of COVID-19: a multinational registry analysis. এতে Surgisphere নামে বস্টনের একটি অখ্যাত কোম্পানির দেওয়া ডেটা তথা তথ্য ব্যবহার করা হয়েছিল – একই ঘটনা ঘটেছিল NEJM-এ প্রকাশিত এবং পরে প্রত্যাহৃত প্রবন্ধের ক্ষেত্রেও – যে তথ্য পরে মারাত্মক রকমের ভ্রান্তিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়। এই গবেষণাপত্রটি প্রত্যাহৃত হলেও এর মূল যে বক্তব্য – “We were unable to to confirm a benefit of hydroxychloorquine or chloorquine when used alone or with a macrolide, on in-hospital outcomes for COVID-19” – নাকচ হয়ে যায়নি। এটা আশর্যের এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা আমাদের মাথা রাখতে হবে।
২২মে, ২০২০-তে ল্যান্সেট-এর প্রবন্ধ প্রকাশিত হবার পরেই দিন দুয়েকের মধ্যে প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ জন বিজ্ঞানীর স্বাক্ষর সহ একটি চিঠি “Concerns regarding the statistical analysis and data integrity” ল্যান্সেট-এর সম্পাদক রিচার্ড হর্টনকে পাঠান। উল্লেখযোগ্য যে স্বাক্ষরকারীর তালিকায় আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, ইতালি, জার্মানি ছাড়াও কেনিয়া, নেপাল, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, কেনিয়া, লাওসের মতো দেশের নাম থাকলেও ভারতীয় কোন বিজ্ঞানীর নাম আমি খুঁজে পাইনি।
বস্টন রিভিউ পত্রিকায় (৪.০৫.২০২০) পত্রিকায় একটি নিবন্ধে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন সংক্রান্ত ঘটনাক্রমকে সময়ানুক্রমে পরপর এভাবে বলা হয় – ১১.০৩.২০২০-তে চিনে বসবাসকারী এক অস্ট্রেলিয়ান উদ্যোগপতি একজন Bittcoin investor-কে টুইট করেন – “chloroquine would keep most people out of hospital.” ১৬ মার্চ এলন মাস্ক নামে এক ব্যবসায়ী এবার একের পরে এক টুইট এবং রিটুইট করতে থাকেন। ১৯ মার্চ Tucker Carlson এ খবর ফক্স নিউজের একটি সেগমেন্টে নিয়ে যান। একই দিনে (১৯.০৩.২০২০) ট্রাম্পের সেই বিখ্যাত উক্তি। প্রবন্ধটিতে মন্তব্য করা হয় – Over the following weeks, the question of whether hydroxychloroquine is a safe and effective treatment for COVID-19 became a locus for political tribalism and polarization. Trump supporters on social media share evidence, often anecdotal or clinical, that hydroxychloroquine is effective; Trump’s critics share evidence that it is not and argue there are significant costs to promoting an unproven drug. ব্যাপারটা এতদূর পৌঁছয় যে দক্ষিণপন্থী সংবাদপত্র ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের সুফল নিয়ে কয়েকজন ডাক্তারের অভিমত ছাপে। উল্টো দিকে বাম-ঘেঁষা সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট অন্য বেশ কিছু ডাক্তারের অভিমত ছাপে যে কোভিড-১৯-এর চিকিৎসার জন্য হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহার “বিপজ্জনক পরিণতি”-র জন্ম দেবে। এর সামগ্রিক পরিণতি হল হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে একদিকে মেরুকৃত বিশ্বাস (polarized beliefs), অন্যদিকে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিজে একটি রাজনৈতিক আইডেন্টিটির জন্ম দিল। প্রবন্ধটির মন্তব্য – “with COVID-19, it is often the case that the different groups only trust one of the extremes. Extremity bias can thus amplify polarization, especially in an already factionalized environment.”
এখানে উল্লেখ করা দরকার, মাইক্রোসফট নিউজ (৪.০৬২০২০) অনুযায়ী “Major Producer of Hydroxychloroquine Once Paid Michael Cohen Hefty Sum for Access to Trump”। ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ বহুজাতিক সংস্থা Mylan হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন বিক্রি নিয়ে ১৫ মিলিয়ন ডলার লাভের আশা করছে। Novo Nordisk এবং Bayer সংস্থা ৫ কোটির বেশি হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন পিল/ট্যাবলেট সরবারহ করছে। বিনা মুনাফায়? ফিল্যান্থ্রপি করার জন্য?
বিভিন্ন ট্রায়ালগুলো কি বলে?
JAMA-তে (১.০৫.২০২০) “Hydroxychloroquine, Coronavirus Disease 2019, and QT Prolongation” শিরোনামের সম্পাদকীয়তে বলা হল – “Among possible therapies, hydroxychloroquine has been advocated and even politicized as a promising therapy because of its anti-inflammatory and potential antiviral properties.” সর্বশেষ মন্তব্য করা হল – “Whether signals of potential benefit outweigh signals of harm is unknown until well-controlled clinical trials are completed for the treatment o rprevention of COVID-19 infections.” অর্থাৎ, বড়ো প্লাসেবো-কন্ট্রোল্ড, ডাব্ল-ব্লাইন্ড ট্রায়াল ছাড়া হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের উপযোগিতা নিয়ে কোন সদর্থক মন্তব্য করা যাবেনা।
এর আগে JAMA-তে (২৪.০৪.২০২০) একটি ট্রায়াল রিপোর্ট “Effect of High vs Low Doses of Chloroquine Diphosphate as Adjunctive Therapy for Patients Hospitalized With Severe Acute Respiratory Syndrome Coronavirus 2 (SARS-CoV-2) Infection - A Randomized Clinical Trial” প্রকাশিত হয়েছিল। এ গবেষণাপত্রে পরিষ্কারভাবে বলা হল – “The preliminary findings of this study suggest that the higher CQ dosage should not be recommended for critically ill patients with COVID-19 because of its potential safety hazards, especially when taken concurrently with azithromycin and oseltamivir. These findings cannot be extrapolated to patients with nonsevere COVID-19.” কি দাঁড়ালো? হাসপাতালে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ব্যবহার বারণ করা হল।
অ্যানালস অব ইন্টার্নাল মেডিসিন-এ (২৭.০৫.২০২০) একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল - Hydroxychloroquine or Chloroquine for Treatment or Prophylaxis of COVID-19: A Living Systematic Review. এখানে সিদ্ধান্ত হিসেবে জানানো হল – “Evidence on the benefits and harms of using hydroxychloroquine or chloroquine to treat COVID-19 is very weak and conflicting.” এতই দুর্বল পরস্পর-বিরোধী সব ডেটা পাওয়া যাচ্ছে যে এগুলো দিয়ে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের সুফল নিয়ে কিছুই বলা যাবেনা।
NEJM-এ সর্বশেষ ৮২১ জন রোগীকে নিয়ে “randomized, double-blind, placebo-controlled trial across the United States and parts of Canada testing hydroxychloroquine as postexposure prophylaxis” প্রকাশিত হয়েছে “A Randomized Trial of Hydroxychloroquine as Postexposure Prophylaxis for Covid-19” শিরোনামে (৩.০৬.২০২০)। নজরে রাখবো এটা আমেরিকা এবং কানাডার কিছু অংশ জুড়ে আপাতত সর্ববৃহৎ randomized, double-blind, placebo-controlled trial। কি জন্য? কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে (আক্রান্ত হয়ে যাবার পরে) পোস্ট-এক্সপোজার প্রোফাইল্যক্সিস (প্রতিহত করা) হিসেবে কাজ করে কিনা সেটা বোঝার জন্য। কি দেখা গেল? দেখা গেল – “After high-risk or moderate-risk exposure to Covid-19, hydroxychloroquine did not prevent illness compatible with Covid-19 or confirmed infection when used as postexposure prophylaxis within 4 days after exposure.” অর্থাৎ, সংক্রমণ হয়ে গেলে (Postexposure Prophylaxis) এ ওষুধটির কোন ভূমিকা নেই। উল্লেখ করতে হবে, যাঁরা এই ট্রায়ালটি দিয়েছেন তাঁরাই আবার Preexposure Prophylaxis-এর ক্ষেত্রে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের আদৌ কোন ভূমিকা আছে এ নিয়ে নতুন ট্রায়াল রিক্রুটমেন্ট শুরু করেছেন। আমরা ফলাফলের অপেক্ষায় থাকবো। আগাম বলে দেবোনা যে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন একটি ধন্বন্তরি-সুলভ ওষুধ। এ ওষুধ ব্যবহার না করলে মেরে ফেলার হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে ব্রাজিলে - Death threats after a trial on chloroquine for COVID-19 (ল্যান্সেট, জুন ২০২০)।
NEJM-এর এ সংখ্যাতেই সম্পাদকীয়তে বলা হল – “So, what are we to do with the results of this trial? The advocacy and widespread use of hydroxychloroquine seem to reflect a reasonable fear of SARS-CoV-2 infection. However, it would appear that to some extent the media and social forces — rather than medical evidence — are driving clinical decisions and the global Covid-19 research agenda.” মেডিক্যাল এভিডেন্সের বাইরে মিডিয়া এবং সামাজিক শক্তি হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইনের ভূমিকা নির্ধারণ করছে। খুবই দুর্ভাগ্যজনক এক সময়! চিকিৎসাকে নিয়ন্ত্রণ করছে চিকিৎসার জ্ঞান এবং বিচারবোধ নয়। এসব্র অতিরিক্ত একাধিক শক্তি। রাজনীতি এবং নির্মিত গণমানসিকতা কাছে চিকিৎসার নতজানু হবার করুণ অধ্যায় – medical-state-politics-industrial complex।
শেষ কথা
আমি এখানে ভারতে ICMR এ ওষুধটির ব্যাপারে যে বিধান দিয়েছেন তা নিয়ে আলোচনা করছিনা। কারণ, যে বৃহৎ এবং কঠোর randomized, double-blind, placebo-controlled trial হবার কথা ওষুধ ব্যবহারবিধি নির্দিষ্ট করার জন্য সেরকম কোন তথ্য ICMR-এর ওয়েবসাইট থেকে পাইনি। তাই আপাতত বিরত থাকছি।
ইংল্যান্ডে ১১,০০০ রোগীকে নিয়ে RECOVERY (Randomised Evaluation of COVid-19 thERapY) ট্রায়াল শুরু হয়েছিল মার্চ মাস থেকে ১৭৫টি NHS হাসপাতালকে যুক্ত করে। দুদিন আগে ৫.০৬.২০২০ তারিখে এ ট্রায়াল বন্ধ করে দেওয়া হয়, কারণ প্রাথমিক যে ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে সেগুলো মোটেই সন্তোষজনক নয়। ইনভেস্টিগেটরদের ভাষায় – “ The RECOVERY trial has shown that hydroxychloroquine is not an effective treatment in patients hospitalised with COVID-19. Although it is disappointing that this treatment has been shown to be ineffective, it does allow us to focus care and research on more promising drugs.” আরও বলা হয়েছে – “ Today’s preliminary results from the RECOVERY trial are quite clear – hydroxychloroquine does not reduce the risk of death among hospitalised patients with this new disease. This result should change medical practice worldwide and demonstrates the importance of large, randomised trials to inform decisions about both the efficacy and the safety of treatments.”
এটাই আশার কথা। আমাদের কাজ করে যেতে হবে। কাম্যুর প্লেগ Dr. Rieux এক জায়গায় বলছেন – “have no idea what’s awaiting me, or what will happen when this all ends”। কিন্তু তবুও “For the moment I know this: there are sick people and they need curing.”
আর্ত, আক্রান্ত, অসহায় মানুষের জন্য চিকিৎসক হিসেবে এটাইতো আমাদের বার্তা!
এই অসময়ে বেশীরভাগ লেখাই যেখানে লেখার আগেই কোন দিকে ঝুকে বসে আছে সেই সময়ে এইরকম একটি তথ্যনিষ্ঠ প্রতিবেদন যেন আমাদেরকে মনে করিয়ে দিল বিজ্ঞানচর্চার সঠিক প্রণালী৷ এই ধরনের লেখাই আমাদেরকে সঠিক দিশা দেখায়, সমৃদ্ধ করে৷
সমৃদ্ধ লেখা। তবে পূঁজিবাদে কর্পোরেট পূঁজির তৎপরতা/অপতৎপরতা থাকবেই। রাষ্ট্রও কর্পোরেট পূঁজির কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। যখন কর্পোরেট পূঁজির মালিকবৃন্দ আইনসভার বেশিরভাগ আসন দখল করে ফেলে।
ধন্যবাদ ডঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্যকে এই বিশ্লেষণমুখী লেখাটার জন্য। অবশ্য ওঁনার লেখা এমনই।
রাষ্ট্রযন্ত্রের আচরণ জ্ঞানপাপীদের মত। ওষুধ ব্যবসার পুঁজিপতিরাই বিভিন্ন দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার দখল পাকা করে নিয়েছে।
সাধারণ মানুষের কথা তো দূরের কথা, বিশেষজ্ঞদের কথাই কেউ শুনছে না।
ICMR নিয়ে না বলে ভালোই হয়েছে - কেঁচো খুঁড়তে সাপ বেরোতো
রাজনীতির গ্রাসে অন্যান্য ব্যবস্থার মত স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও যে ঢুকবে সেটা আমার মত অর্ধ শিক্ষিত লোকের ও বুঝতে অসুবিধা হয় না আজকাল। তবে আশার আলো "আমাদের কাজ করে যেতে হবে"এই শব্দবন্ধ টাই আমাদের উৎসাহিত করে। তোমাদের মত মানুষের আছে বলেই আজ ও আমরা একটু শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। বিশ্বাসযোগ্য পরিষেবা নিতে পারছি।