একটা দীর্ঘ সাদা দন্ড আকাশটাকে বিদ্যুতের মতো চিরে দিল। পরক্ষণেই ছোঁ মারার মতো দ্রুত নেমে এল, হারিয়ে গেল জনতার মাঝখানে।এক মূহুর্ত মাত্র। তারপরেই সহস্র উন্মুখ চোখের ওপর দিয়ে রক্তলাল পতাকা কেঁপে উঠলো আকাশে বিরাট কোনো পাখির ছড়ানো ডানার মতো। অনেকগুলো হাত এসে জড়িয়ে ধরলো দন্ডটাকে। জনতা যেন ফুলেফেঁপে উঠেছে। তার মধ্যে মায়ের হাতও আছে।
যদিও অল্প কিছুক্ষণ পরেই একদল উজ্জ্বল-চোখ ছেলের ধাক্কায় সরে যেতেই হবে মা-কে। চেনে না মা এই ছেলেগুলোকে...
-পাভেল কা মাম্মি ?
ছেলেটা গল্প শুনতে শুনতে চোখ বড় করে শুধোয়। তারপর শুধু বলে,
-হায় রাম ! ফির ক্যা হুয়া ?
আমার ফ্ল্যাটের নীচে ঝাড়খন্ডের চারটি ছেলে এতোদিন আটকে ছিলো। ওরা নাকি সান্ত্রাসের কাজ (সেটা কী আমি ভাল জানি না) করে। লক ডাউনে ঘরে ফিরতে পারেনি।
রোজ বিকেলে টবে জল দিতে ছাদে যাই, দেখি ওদের মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি, হয়ত ১৭/১৮ বছর বয়স, ক্লাস ফাইভ অব্দি পড়েছে, একটা ছোট ট্র্যানজিসটর হাতে, গান শোনে। আমার আগেই সব গাছে জল দিয়ে রাখে।
ওর মধ্যে একটা অনুসন্ধিৎসু মন আছে, জানতে চায় এই বিশাল দেশের, গোটা পৃথিবীর হালহদিশ, যেটুকু পারে বুঝতে চায়। ওকেই বলছিলাম গোর্কির মায়ের টুকরো টুকরো গল্প। শুনছিলো না, হাঁ করে গিলছিলো। গল্প শুনতে শুনতে ওর জ্বলজ্বলে চোখ, উত্তেজিত ভাবভঙ্গী দেখে মনে ভাবি সুযোগ পেলে ভাল ছাত্র হতো।
কিন্তু গল্প শেষ হলো না, মে দিবসের মাত্র দুদিন আগে রাত আড়াইটে /তিনটে নাগাদ চার পরিযায়ী শ্রমিক সাইকেলে ঝাড়খন্ড রওনা দিল। চুপি চুপি, কাউকে কিছু না বলে। পরে জানা গেল সল্ট লেকের লাবণী, বিদ্যাসাগরে আটকে পড়া প্রচুর শ্রমিকের সাথী হয়েছে ওরা।
একটা রাতজাগা কোকিল ডাকছিল শুধু, কদিন ধরে কেন কে জানে রাস্তার বড় আলোগুলো জ্বলছে না। পাশের চারতলার ফ্ল্যাটের ছেলেটি দেখেছে, সেই অন্ধকারে সাইকেলের ক্যারিয়ারে তিন চারটে বোঁচকা নিয়ে পাজামা আর হাফহাতা শার্ট পরা লোকগুলো এদিক ওদিক চাইতে চাইতে সাঁ করে বেরিয়ে পড়ল। প্রথমে লাবণী সেখান থেকে উল্টোডাঙা, প্যাডেলে আরো চাপ, ওরা পৌঁছে গেল আরো বড় রাস্তায়, তারপর হয়তো আসানসোল, বরাকর নদের ঠান্ডা জলে একবার যদি পা ছোঁয়াতে পারে, তাহলে ওপারে সবুজ পাহাড়, পাকদন্ডী বেয়ে এগোলেই জাতীয় সড়ক, তারপর ছুট ছুট ছুট। সাইকেল হয়ে গেল পঙখীরাজ, ঘরে পৌঁছে বিশাল হাঁক,
- এ পুনিয়া কে মায়ি, কাঁহা গইলবা !
এতো সহজ যদি শেষটা হতো তাহলে ঝলমল করতো মে দিবস। যাদের দিন, তাদের ভগ্নাংশ শেষ অব্দি আইসোলেশনে গিয়ে পড়লেও, দিনটি কিছুটা সার্থক । ঘরের কাছে তো পৌঁছনো গেল !
কিন্তু এরকম হবার কথা নয়, হয়ও না। কাগজে পড়ি ঝাড়খণ্ড সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকছে 'গাইড'। টাকা হাতে গুঁজে দিলে জল জঙ্গল ভেদ করে মোটর সাইকেল পথ দেখাবে। বেগতিক দেখলে ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে যাওয়া। পরে মোটর বাইক ফিরে এলে আবার যাত্রা শুরু। মাথার ওপর রোদ,
রাস্তায় বন্য জন্তু এবং পুলিশের ভয়। পুঁটলিতে কতটা খাবার কেউ জানে না। সাইকেলে ঝাড়খণ্ড সীমান্ত কমসে কম আড়াইদিন।
কিন্তু ওরা এই ঝুঁকি নিয়ে যাচ্ছে কেন ! এই চার মূর্তির খাবারের অভাব তেমন না থাকলেও অন্যান্যদের সেটাই মূল। খাবার এবং কর্মহীনতা। এদের ক্ষেত্রে যেমন, হিসেব চুকিয়ে কন্ট্র্যাকটর বলে দিয়েছিল অবস্থা স্বাভাবিক না হলে, কাজ শুরু না হলে আর কিছু দিতে পারবে না। জমানো পুঁজি শেষ। কবে দুই রাজ্য মিলে ব্যবস্থা করবে, আর অন্যে দয়া করে চাল ডাল দিয়ে যাবে, সে আশায় বসে থাকে কে ! সাইকেল আছে, নয় তো পায়দল সে !
কারণ তো আরো আছে। ৬৫% শ্রমিক এখনো কোন সরকারি সাহায্য পায়নি। কাল খাবার মিলবে তো এই আশঙ্কায় কম খাচ্ছে বা একবেলা খাচ্ছে ৪৪%। জঘন্য বাসস্থান। তারপর মৃত্যুভয়। স্বজনের চোখের সামনে ঘটুক যা ঘটার এই বাসনা। ৩রা মে লক ডাউন না উঠলে মুম্বাই রিয়েল এস্টেটের ৮০০ শ্রমিক বিহারে নিজের ঘরে ফিরতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাদের একজন পিন্টু কুমার পন্ডিত এই 'নাকা ' ( যারা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ঠিকাদারের অপেক্ষা করে) শ্রমিকদের নেতা, ভিডিও করে পাঠিয়েছে রেডিফ নিউজে। তাতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে ছোট্ট কুঠুরিতে ৮ থেকে ১০ জন সোশ্যাল ডিস্ট্যাংসিংকে গুলি মেরে গাদাগাদি করে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। বেসরকারি ত্রাণ কদিন জুটবে কে জানে, কিন্তু ও পাড়ার সুলভ শৌচালয় এক এক বারের জন্য নিচ্ছে ৩ টাকা। ভিডিওতে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে, শ্রমিকদের কথা, এইভাবে থাকলে এমনিই করোনায় খাবে, তার চে' বরং নিজের গাঁও, নিজের লোকের মধ্যে শেষ নি:শ্বাস ফেলা ভালো।
এদের ভয় একেবারেই অমূলক নয়, কারণ আরো একটি ঘটনা ঘটছে যা মে দিবসে অতি প্রাসঙ্গিক। এই অতিমারী আর একটি কাজ তলে তলে সম্পন্ন করছে দ্রুত, তা হল বড়লোক গরীবের ভেদরেখা আরো গভীর করা। জেটলাইনারে করে আবির্ভূত এই রোগ প্রথমে ছড়াচ্ছিলো উচ্চবিত্তদের মধ্যেই। শুরুতে আমলাপুত্র নিয়ে মহা সোরগোল আমাদের অনেকেরই মনে থাকবে। কিন্তু সময় যতো গড়াতে লাগলো, ততই বেশি আক্রান্ত হতে লাগল গরীব মানুষ, বস্তিবাসী। একথা জেনে যে বড়মানুষদের ভয়ানক রাগ হবে তারা যেন আমার সঙ্গে ঝগড়া না করে দয়া করে গতকালের মুম্বাই মিররে এই সংক্রান্ত খবরে চোখ রাখেন।
মুম্বাই এটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। মার্চের শেষ হপ্তাতেও পজিটিভ কেস পাওয়া যাচ্ছিল কেবল উচ্চবিত্ত এবং মধ্যবিত্ত এলাকাগুলিতে। হয় তারা বিদেশ প্রত্যাগত বা বিদেশ থেকে আসা কারো সংস্পর্শদোষে দুষ্ট। কিন্তু এই একমাস বাদে ছবিটা সম্পূর্ণ পালটে গেছে। পশ এলাকা গুলিতে রোগী ক্রমশ কম, গরীব বেশি পজিটিভ। এখন ধারাভিতে ৩৪৪, কিন্তু বড়মানুষদের ওয়ার্ডগুলি থেকে মাত্র ৬৫ টি কেস রিপোর্টেড হয়েছে। বস্তিগুলির ঘর ছোট, গাদাগাদি বেশি, জল কম, কমন টয়লেট। করোনার মহা স্ফূর্তি। পরিস্থিতি এতোটাই খারাপ যে BMC পুলিশকে বেছে বেছে বস্তিগুলিকে সিল করে দিতে বলেছে।
আমি /আপনি হলে বাড়ি ফেরবার জন্য মরিয়া হয়ে পড়তাম না ? বসে থাকতাম কবে রাজ্য কেন্দ্রের নির্দেশে নোডাল অথরিটি গড়ে আটকে পড়াদের লিস্ট বানাবে, সেইজন্য ? বাসের রিকুইজিশন হবে, তাকে সংক্রমণমুক্ত করা হবে, দূরত্ববিধি মেনে বসার ব্যবস্থা হবে !! তবে তারা বাড়ি যাবে ! আরো ৩৮ দিনের ধাক্কা ! ভাত দেবার বেলায় নাই, সব কিল মারার গোঁসাই।
তাই ছেলেগুলোকে দোষ দিতে পারিনা। খোলা আকাশে নীচে নিজের গ্রামে নিজের লোকের মধ্যে বাঁচা অথবা মরা অনেক সহজ, অনেক কাম্য। ওরাও যে মানুষ।
কিন্তু যতোবারই ওদের ফোন করছি, দেখছি মোবাইল বন্ধ। হতে পারে ইচ্ছাকৃত। হতে পারে গাইডের নির্দেশে। হতে পারে বন্য জন্তু এবং আইনরক্ষকদের এড়ানোর জন্য। তবু গাছে জল দিতে ছাদে উঠলেই যেন দেখতে পাচ্ছি অসম্ভবকে সম্ভব করবে বলে দূর দিগন্তে চলেছে জেদি সাইকেলের মিছিল। ওর মধ্যে একজন, অন্তত একজন, মনের ভেতর পাভেল আর তার মায়ের কথা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে --
"- দুনিয়ার শ্রমিক জিন্দাবাদ !
পাভেল ধ্বনি তোলে। সহস্র বলিষ্ঠ নন্দিত কন্ঠ থেকে প্রান- মাতানো সাড়া জাগে।...
আমরা এক নতুন দেবতার নামে লড়াইয়ে নেমেছি। সে দেবতা আমাদের যুক্তি বিচার সত্যের দেবতা। আমাদের আসল লক্ষ্য এখনও বহুদূর।...
সত্যের জয় হবেই এতে যার বিশ্বাস নেই, সত্যের জন্য জান দেবার যার সাহস নেই, নিজের ওপর যার ভরসা নেই -- দুঃখকষ্টের ভয় যে পায় সে তফাত যাক। আমাদের জয়লাভে যার বিশ্বাস আছে, যারা আমাদের লক্ষ্য দেখতে পায় তারাই শুধু এগিয়ে আসুক।...
সার বেঁধে চলো বন্ধুগণ ! পয়লা মে জিন্দাবাদ! স্বাধীন মানুষের উৎসবের দিন জিন্দাবাদ ! "
(মা : ম্যাক্সিম গোর্কি)
মানুষের সবচেয়ে বেশি চাওয়া, সবচেয়ে বেশি পিপাসার বস্তুটির নাম স্বাধীনতা। সে কথা ভুলে গেলে চলে !
সান্তারাস জানতাম আমি। মানে উচ্চারণটা ওরকম শুনেছিলাম। একটা ফ্লোরিং-এর উপর নতুন একটা ফ্লোরিং করতে গেলে ওই যে পুরনোটা খুদলে খুদলে একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় যাতে ওই কেমিক্যাল টেমিক্যাল দিয়ে নতুনটা বসানো যায়, সেইটা এদের কাজ।
ঝট করে লেখাটা খুলে এটাই নজরে পড়ল। পরে পুরোটা পড়ব...
আমি ভেবেছি সান্ত্রাস লোহার শিক বাঁকানো বা টুকরো করে কাটার কাজ। ওদের সঙ্গে একবার আবছা কথা হয়েছিল যেন ! স্পষ্ট মনে নেই।
সানতারাস হল ফ্লোরিং বা দেওয়ালে প্লাসটার করার আগে যে খোদাই করা হয় সেই কাজ এমন কি নতুন করে প্যারিস বা পুট্টি করার আগেওএই খোদাই করা হয়। রাজমিস্ত্রী বা কন্ট্রাক্টর বা ডেভালপারদের আন্ডারে এরা কাজ করেন মুলতঃ।
সানতারাস হল ফ্লোরিং বা দেওয়ালে প্লাসটার করার আগে যে খোদাই করা হয় সেই কাজ এমন কি নতুন করে প্যারিস বা পুট্টি করার আগেওএই খোদাই করা হয়। রাজমিস্ত্রী বা কন্ট্রাক্টর বা ডেভালপারদের আন্ডারে এরা কাজ করেন মুলতঃ।
গতবছর পয়লা মে তোমার বাড়ি গেছিলাম।
এবার কী অবস্থা, পারমিতা!!
সানতারাস শ্রমিক আর পাভেলের মে দিবসের দৃপ্ত ডাকে এই গানটি মনে পড়লো,
কিসের ভয় সাহসী মন লাল ফৌজের? লাফিয়ে হই পার। থাকনা হাজার অযুত বাধা, দীর্ঘ দূরযাত্রার। কিসের ভয়? হাজার পাহাড়, লক্ষ নদী কিছুই নেই ভাবার...
সুদিন আসবেই। আরো লেখ দিদি।
পাভেলের মা আর ওই ঝারখন্দি পরিজায়ি ছেলেতার মা-- কেমন য়েন এক হয়ে গেছে। ঝাড়খন্দী কি পারবে পাভেল হতে? য়েন পারে কোনোদিন।
ছবির মত পরিষ্কার লেখা। বিবেককে একটা জোরাল নাড়া দিয়ে গেল।
এই লকডাউন পর্যায় পেরুলে চাইব অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রামিকরাও যেন সংগঠিত হন। তাদের অস্তিত্ব যেন সরকার থেকে শুরু করে এই আমরা, সবার মাথায় থাকে।
তারা ডিসপোজিবল নন।
গভীর পর্যন্ত ছুঁয়ে যায়।
অসাধারণ লেখা।
ট্রেন কম, মানুষ বেশি। পরিযায়ীরা ঘরে ফিরতে মরীয়া, কিন্তু ডিস্ট্যান্সিং এর কারণে বাদুড়ঝোলা হওয়া যাবে না। ট্রেণে এখন স্লিপারে ১৫% নেবে বলেছে, কিন্তু তার ব্যাখ্যা নিয়েও বিস্তর জলঘোলা হচ্ছে। যাত্রা চলাকালীন বারোঘন্টা অন্তর একবার খাদ্য। সব পরিযায়ী ফিরতে চেয়ে রাস্তায়।এখন চলছে পুলিশি নির্যাতন।
পরিযায়ী কি মানুষ, না রোবট ? যাদের ঘরে ফিরতে না দিলে মালিকের লাভ। কারণ অনেক কারখানা ইত্যাদি খুলে যাচ্ছে।