এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • কণিকাদের ফোর-জি কানেক্‌শান

    অনিকেত পথিক লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ০৪ এপ্রিল ২০২০ | ২৪৭৪ বার পঠিত
  • নৃত্যের বশে সুন্দর হল বিদ্রোহী পরমাণু,
    পদযুগ ঘেরি জ্যোতিমঞ্জীরে বাজিল চন্দ্রভানু
    তব নৃত্যের প্রাণবেদনায়, বিবশ বিশ্ব জাগে চেতনায়
    যুগে যুগে কালে কালে সুরে সুরে তালে তালে
    সুখে দুখে হয় তরঙ্গময় তোমার পরমানন্দ হে।

    পরমাণু, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ ?

    আমাদের চারপাশে যা কিছু চোখে পড়ে সেসব আসলে কী দিয়ে তৈরী? এ প্রশ্ন মানুষ কবে প্রথম করেছিল তার কোনো হিসেব নেই, কিন্ত কে প্রথম তার উত্তর দিয়েছিলেন, সেখান থেকেই এই পরিক্রমা শুরু হতে পারে। এই প্রশ্নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হল ‘আসলে’। কাঠ দিয়ে তৈরী পুতুল, সোনা দিয়ে তৈরী গয়না এই সাদামাটা উত্তর পেরিয়ে যেদিন মানুষ বুঝতে পেরেছিল এহ বাহ্য, এর গভীরে আরো কিছু আছে, মানে এই সোনা-রুপো-কাঠ-পাথর যাইহোক তাকে ছোট থেকে আরো ছোট টুকরোয় ভেঙে চললে শেষ অবধি একটা অজানা কিছু বেরোবে, বিজ্ঞানের ইতিহাসে সে দিনটা বড় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়! এই উত্তর প্রথম যিনি দিয়েছিলেন, তিনি একজন ভারতীয় দার্শনিক, কণাদ। যে যুগের কথা বলছি তখন দর্শনই ছিল বিজ্ঞান। তখনকার বিজ্ঞানীদের সকলকেই আমরা দার্শনিক বলেই চিনি। সেই দার্শনিক বিজ্ঞানীই প্রথম বলেছিলেন, আমাদের চারপাশের সমস্ত জিনিস আলাদা আলাদা রকম ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরী, যাদের আর ভাঙা যায় না, দেখা যায় না, এমনকি মাপাও যায় না, এতই ছোট। কণাদ এই কণিকাদের নাম দিয়েছিলেন পরমাণু।

    কণা থেকেই কণাদ না উল্টোটা সে কূট প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে কণাদ কী করে পরমাণুর ধারণা করলেন সেটা বুঝে ওঠা অনেক বেশি জরুরী। ঠিক যে ভাবে জানা জিনিসকে কাজে লাগিয়ে, যে কোনো অজানা জিনিসকে খুঁজে বার করা হয়, সেইভাবে। চেনা জানা জিনিসকে কণাদ ছ'ভাগে ভাগ করলেন- দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ ও সমবায়। এরমধ্যে দ্রব্যকে বাছলেন প্রথমে। তাকে নয় ভাগে ভাগ করলেন- ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজঃ (আলো), মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ), দিশ (দিক), কাল (সময়), আত্মা ও মানস। এর মধ্যে বস্তুধর্ম যাদের আছে যেমন ক্ষিতি, অপ, তেজ ও বায়ু তাদের নিয়েই তাঁর চিন্তা শুরু হলো। কণাদ বললেন, এই দ্রব্যদের ধর্ম আলাদা, তাই এদের ভাঙতে থাকলে যেখানে এসে থামতে হবে, সেই ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য কণাই হলো পরমাণু। একেক দ্রব্যের পরমাণু এক একরকম। এবং এরা সকলেই গতিশীল। আবার একইরকম পরমাণু যোগ করলে দ্বিপরমাণুক, ত্রিপরমাণুক বা চতুর্পরমাণুক কণার উদ্ভব হতে পারে, এই ধারণাও দিলেছিলেন কণাদ। এই ২০১৮ সালে বসে মনে হয়, আহা এ আর এমন কী জ্ঞান, এ তো জানা কথাই যে ভাঙতে ভাঙতে একটা সময় আসবে যে আর ভাঙা যাবে না। কিন্তু সেই খ্রীষ্টপূর্ব আনুমানিক ৬০০ অব্দে, যখন ভাঙা বলতে ছিল আক্ষরিক অর্থেই হাতুড়ি মেরে ভাঙা, দেখা মানে শুধু চোখে দেখা, এইরকম সময়ে দেখা যায় না, ধরা যায় না (মানে ধরেছ কি ধর নাই বুঝিবে কেমনে!) এমন বস্তুবিষয়ে কণাদ স্রেফ ভেবে ভাবে এত কথা বার করেছেন, এটা ভাবলে শিহরিত হতে হয়।

    কণাদের আনুমানিক ২০০ বছর পর গ্রীক দার্শনিক, চিকিৎসক ও পদার্থবিদ এমপেডোক্লেস ও দার্শনিক পদার্থবিদ লিউসিপ্পাস আবার ‘কণা’দের কথা নিয়ে ভাবলেন এবং ‘কণাদে'র কথা মানলেন। লিউসিপ্পাসের ছাত্র ডেমোক্রিটাস (খ্রীষ্টপূর্ব ৪৭০-৪০০ অব্দ) আরও একধাপ এগিয়ে বললেন, এই বিশ্বে মহাশূন্য ছাড়া আর স্রেফ একটি জিনিসই সত্য, তা হলো পরমাণু যার গ্রীক নাম হলো ‘অ্যাটম’। স্বাদ, গন্ধ, শব্দ, আগুন এমনকি মৃত্যুকেও ব্যাখ্যা করা যাবে পরমাণু দিয়ে। কিন্তু এরপরই গ্রীসে শুরু হয়ে যায় সর্বকালের সেরা দার্শনিক অ্যারিস্টটলের জমানা (খ্রীষ্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২ অব্দ), যিনি বিশ্বাস করতেন জল, মাটি, বায়ু ও আগুন এই চারটি মৌলিক উপাদানের ধারণায়। যেহেতু নিজের কাজকর্ম দিয়ে অ্যারিস্টটল গ্রীকদের কাছে প্রায় দেবতুল্য মানুষে পরিণত হয়েছিলেন, তাই সবাই তাঁর কথাই বিশ্বাস করেছিল আর পরমাণুতত্ত্ব চাপা পড়ে গেছিল প্রায় দু’হাজার বছর।

    কণাদের ভবিষ্যতের পক্ষে ১৭৭৬ সাল খুব গুরুত্বপূর্ণ বছর। সেই বছর জন্ম নিলেন ব্রিটিশ পদার্থবিদ জন ডালটন। গবেষণা শুরু করলেন গ্যাসের চাপ ও দ্রাব্যতা নিয়ে। ১৮০১ সালে প্রকশিত হলো তাঁর আংশিক চাপের সূত্র। ১৮০৩ সালে ডালটনই আবার সামনে নিয়ে আসেন পরমাণু তত্ত্ব। কণাদ ও ডেমোক্রিটাসের কথা তো তিনি মানলেনই উপরন্তু মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ গঠনে ‘পরমাণুবাদ’ নামে একটা যুগান্তকারী মডেল দাঁড় করালেন। এই মতবাদ অনুসারে, প্রত্যেক মৌলিক ও যৌগিক পদার্থ পরমাণু নামের বহু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণার সমষ্টি যেসব কণাকে আর ভাগ করা যায় না। ডালটন মৌলিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার নাম দিলেন ‘মৌলিক পরমাণু’ এবং যৌগিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার নাম দিলেন ‘যৌগিক পরমাণু’। যৌগিক পরমাণুকে ভাঙলে মৌলিক পরমাণু পাওয়া যেতে পারে। কিন্তু এ তত্ত্ব মৌলিক ও যৌগিক পদার্থের ক্ষুদ্রতম কণার মধ্যে কোনো পার্থক্য তৈরি করতে পারেনি। পরবর্তীকালে তিনি পরমাণুর হাজার কথা নিয়ে লিখলেন একটা বই ‘এ নিউ সিস্টেম অফ কেমিক্যাল ফিলোজফি’। বললেন, কোনো মৌলের পরমাণু একসাথে মিশে কোনো যৌগ তৈরী করলে তার মধ্যে সবকটা মৌল সরল সংখ্যার অনুপাতে যুক্ত হবে। সরল গুণানুপাত সূত্র এসে গেল। কিন্তু পরমাণু অবিভাজ্য কিনা সে কথা ভাবার সময় তখনও আসেনি।
    সব কিছুরই একটা ইতিহাস থাকে। আবিষ্কারেরও। পরমাণু বিষয়ে ডালটন যেকথা বলেছিলেন তারও একটা ইতিহাস ছিল। আধুনিক বিজ্ঞানের জনক আইজাক নিউটনও যখন গ্যাসের প্রসারণ নিয়ে কাজ করেছিলেন, তখন এইরকম ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণিকার ধারণা করেছিলেন, যারা ভেসে বেড়াচ্ছে। আর গ্যাসের ক্ষেত্রে আয়তন বাড়া মানে তো কণিকাগুলো আরও দূরে দূরে চলে যাচ্ছে, বেশি বেশি করে ফাঁকা জায়গা দখল করছে। এইভাবে রিলে রেসের মত এক বিজ্ঞানী থেকে অন্য বিজ্ঞানীর হাতে হাতে এগিয়ে চলেছে পরমাণুর ব্যাটন। অতঃপর এবং পরপর এই ময়দানে চলে এলেন অ্যাভোগাড্রো, ম্যাক্সওয়েল, বোলৎজমান ও টমসন...

    পরমাণুর পরে... : প্রথম প্রজন্ম
    ইলেক্‌ট্রন
    এইসময় ইংল্যান্ড ও জার্মানী বিজ্ঞান গবেষণায় দুই দৈত্য। নিউটন ও ডালটনকে ঘিরে ইংল্যান্ডের বিজ্ঞান মহল আবার জার্মানীতে আর্নস্ট ম্যাককে ঘিরে তাঁর অনুরাগীরা। ইংল্যান্ডে এই সময়ে নিউটনের ভাবনাকে স্মরণে রেখে দুজন বিজ্ঞানী কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। একজন লাডভিগ বোলৎ্সম্যান (১৮৪৪), অন্যজন ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (১৮৩১)। কয়েকটি মৌলিক অঙ্গীকারের (Assumptions) ভিত্তিতে গ্যাসের গতীয় তত্ত্ব (Kinetic Theory of Gas) ও অণুগুলির গতিবেগ বিতরণ সূত্র (Law of Distribution of Molecular Velocities) গড়ে উঠল, যার মূলে নিউটনের আণবিক বিশৃঙ্খলা নীতি (Principle of Molecular Chaos) ধারণা। কিন্তু তাঁদের গবেষণা মূলত ছিল তাত্ত্বিক বা দার্শনিক, পরীক্ষানির্ভর ছিল না।

    জার্মানরা কিন্তু এত সহজে পরমাণুর ধারণা মেনে নিলেন না। তাঁদের মতে পরমাণু কি দেখা যায়? যদি নাই দেখা গেল তাহলে তা নিয়ে মাথা ঘামাবো কেন! কথাটা ফেলে দেওয়ার মতন নয়। বিজ্ঞানচর্চা তাত্ত্বিক না পরীক্ষানির্ভর, তত্ত্বে মিলে গেলেই খুশি হব, না পরীক্ষালব্ধ তথ্য চাইব, এই নিয়ে ভাবনা শুরু হয় বিজ্ঞান মহলে। এই ভাবনা ও তার ফলের মধ্যবর্তী সময় খুব কম নয়। ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডে বিজ্ঞানী হেন্‌রী ক্যাভেন্ডিসের নামে সূচনা হয়েছে ক্যাভেন্ডিস গবেষণাগার, যার ভার নিয়ে কাজে যোগদান করলেন আঠাশ বছরের যুবক জে জে টমসন। ততদিনে ফ্যারাডের তড়িৎবিশ্লেষণ (১৮৩৩), উইলসনের ক্লাউড চেম্বার আর ক্রুক্সের ক্যাথোড রশ্মি (১৮৭০) আবিষ্কার হয়ে গেছে। অর্থাৎ ফ্যারাডে বুঝে ফেলেছেন যে পরিবাহীর মধ্যে দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহ আসলে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণিকারই স্রোত। আবার খুব অল্প বায়ুচাপে উচ্চ বিভব প্রভেদে ক্যাথোড থেকে অ্যানোডের দিকে এক অজানা রশ্মির প্রবাহ দেখা গেছে, যা আসলে একরকম কণিকার স্রোত। সেই রশ্মি/কণা-র চরিত্র ক্যাথোডের উপাদান নির্ভর কিনা তাই নিয়ে নানারকম কথান্তরও চলছে। সুতরাং ক্যাভেনডিশ গবেষণাগারে যোগ দিয়ে টমসন যে ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে মেতে উঠবেন, ক্যাথোড রশ্মিকণার আধান(e) ও ভর(m)এর অনুপাত বের করতে ব্যস্ত হয়ে পড়বেন এ আর আশ্চর্য কী! তিনি ‘ডিসচার্জ টিউবে’ (তড়িৎদ্বার লাগানো কাচের নল, যার মধ্যে ক্যাথোড রশ্মি তৈরী হয়) নানারকম গ্যাস ব্যবহার করলেন। আধান (চার্জ) ও ভরের অনুপাত (e/m) মাপলেন এবং সিদ্ধান্তে এলেন, ক্যাথোড রশ্মি যে কণা দিয়ে তৈরী, সেই কণা সকল মৌলেরই উপাদান। এই পরীক্ষায় তাঁর সঙ্গী ছিলেন টাউনসেল্ড ও উইলসন। মানে এতদিন পরমাণু ছিল পদার্থের ক্ষুদ্রতম অবিভাজ্য কণিকা, এই প্রথম তার অন্দরমহলে খুব কম ভর (হাইড্রোজেন পরমাণুর প্রায় ২০০০ ভাগ), আধান ঋণাত্মক (নেগেটিভ) এমন কিছু কণার সন্ধান পাওয়া গেল, যার নাম দেওয়া হলো ইলেকট্রন (১৮৯৭)। ধীরে ধীরে তার আধান, ভর, গতিবেগ সব বার করা হলো। এই গোটা ব্যাপারটায় টমসনের সঙ্গে আরও দুজনের নাম করে রাখা দরকার। এক কাউফম্যান, দুই মিলিকান যিনি বিখ্যাত তাঁর তৈলবিন্দু পরীক্ষা ব্যবস্থার জন্য (১৯০৯); এই পরীক্ষায় ইলেক্‌ট্রনের আধান সরাসরি বার করা গেছিল।
    এসে গেল ঋণাত্মক আধানের ইলেকট্রন। আর সেই সঙ্গেই বিজ্ঞানীদের মনে চিন্তা ও প্রশ্ন এল, তাহলে পরমাণুর ভেতরে ধনাত্মক (পজিটিভ) আধানও কোথাও নিশ্চয়ই থাকবে! কিন্তু কোথায় থাকবে আর পরমাণুর গঠনই বা ঠিক কী হবে, সেই উত্তরের খোঁজে শুরু হলো পরমাণু ভাঙার খেলা...

    প্রোটন
    টমসন ইলেকট্রন আবিষ্কার করার পর যখন তার ঋণাত্মক আধানকে প্রশমিত করতে হিমসিম খাচ্ছেন, তার ঠিক আগের বছর ইউজেন গোল্ডস্টাইন ক্যাথোড রশ্মি নিয়ে গবেষণা করার সময় ছাকনির মতন ফুটো করা অ্যানোড ব্যবহার করলেন আর সেই ফুটোর মধ্য দিয়ে একদল ধনাত্মক কণার স্রোত বেরিয়ে এল (১৮৯৬)। সেই রশ্মির নাম দেওয়া হল ‘অ্যানোড রশ্মি’। কিন্তু ইলেক্‌ট্রনের মত সেই কণাদের ভর ও আধানের অনুপাত সর্বদা একই রকম না হওয়ায় এদের একটি বিশেষ কণিকা হিসেবে চিহ্নিত করা গেল না। অর্থাৎ এই পরীক্ষায় পরমাণুর ভেতরে ধনাত্মক কণা যে আছে সেটা নিশ্চিত হওয়া গেল কিন্তু তারা পরমাণুর মধ্যে ঠিক কীভাবে রয়েছে, সেটা জানা গেল না। এক একজন এক একরকমের মডেল দিচ্ছেন, কিন্তু কোনোটাই ঠিকঠাক মিলছে না। যেমন টমসন বললেন, পরমাণুর মডেলটা কেকের মতন; কেকের মধ্যে যেমন ছড়িয়ে থাকে বাদাম সেরকমই পরমাণুতে ছড়িয়ে আছে ইলেকট্রন। বড় কেক হলে বেশি বাদাম, ছোট হলে কম, সেই নিয়মেই ইলেকট্রনের সংখ্যা বাড়ে, কমে। কিন্তু ধনাত্মক কণারা তাহলে কোথায় থাকে! সেই সময় জাপানি বিজ্ঞানী হান্তারো নাগাওকা শনির বলয় বা সৌরজগতের কথাও বলেছিলেন। মডেল হিসেবে চমৎকার কিন্তু সেও তো শুধু কল্পনা, প্রমাণ ছাড়া অন্ততঃপক্ষে জোরালো যুক্তি ছাড়া তো একটা মডেলকে মেনে নেওয়া যায় না! তাই শুধুই হাতড়ে বেড়ানো কারণ জিগ্‌শ পাজ্‌লের সব টুকরোগুলো হাতে আসতে তখনও অনেক দেরি।

    ঠিক এইসময় হেনরি বেকারেল তেজস্ক্রিয়তার সন্ধান পেলেন। তিনি ও কুরী দম্পতি বিস্তারিত গবেষণায় দেখালেন, কোনো কোনো পদার্থ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই বেরিয়ে আসে তীব্র রশ্মি। সেই গবেষণা নোবেল পুরস্কার পাওয়ার (১৯০৩) আগেই মঞ্চে এলেন আর্নেস্ট রাদারফোর্ড। মানুষটি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। হার্ৎজ রেডিও তরঙ্গ আবিষ্কার করছেন আবার রেডিও তরঙ্গের গ্রাহকযন্ত্র বানিয়ে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। ১৮৯৫ সালে রাদারফোর্ড ক্যাভেনডিশ গবেষণাগারে টমসনের অধীনে কাজে যোগ দিলেন।

    আর সেই ১৮৯৫ সালেই উইলহেম কনরাড রন্টজেন এক্স-রশ্মি আবিষ্কার করলেন যে আবিস্কার নোবেল পাবে ১৯০১ সালে। রাদারফোর্ড এক্স-রশ্মি ও তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। দেখতে লাগলেন তেজস্ক্রিয় রশ্মির দস্যুকণাগুলো গ্যাসের অণু পরমাণুতে ঠোক্কর মেরে কীভাবে ইলেকট্রন বের করে আনে। বেরিয়ে আসা ইলেকট্রনগুলো কী হয় ইত্যাদি। তেজস্ক্রিয় ইউরেনিয়ামের রশ্মি বিশ্লেষণ করে রাদারফোর্ড বুঝতে পারলেন, সব তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে একইরকম রশ্মি বেরোয় না; যে রশ্মি নির্গত হয়, উপাদানের ভিত্তিতে তার তিনরকম শ্রেণীবিভাগ হয়, গ্রীক অক্ষরমালার প্রথম তিনটি অক্ষর আলফা, বিটা, গামা দিয়ে যাদের নির্দেশ করা হলো। আলফা রশ্মিকে বিশ্লেষণ করে ১৮৯৯ সালেই রাদারফোর্ড আবিষ্কার করলেন, ধনাত্মক আলফা কণা, যা আদতে হিলিয়াম নিউক্লিয়াস। কিন্তু নিউক্লিয়াস তখন কোথায়? প্রোটনই তো আসেনি তখনও!

    এরপর রাদারফোর্ডের সহযোগী হলেন উইলহেম গিগার ও আর্নেস্ট মার্সডেন। তাঁরা খুব পাতলা সোনার পাতের ভেতর দিয়ে রেডিয়াম থেকে বেরোনো আলফা রশ্মি পাঠালেন। কয়েকদিন পর গিগার জানালেন, বেশির ভাগ আলফা কণা সোনার পাত ভেদ করে বেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কয়েকটা কণা ফেরত আসছে (চিত্র ১)।

    বিদ্যুৎ খেলে গেল রাদারফোর্ডের মাথায়। তার মানে পরমাণুর বেশির ভাগ জায়গা ফাঁকা আর কোথাও একটা ধনাত্মক আধান জমা আছে, যেখানে ধাক্কা খেলে সম আধানের আলফা কণা ছিটকে ফেরৎ আসে।

    এই ফলফলের ওপর ভিত্তি করে রাদারফোর্ড একটি লম্বা গবেষণাপত্র লিখলেন, তখনকার বিখ্যাত গবেষণাপত্রিকা ‘ফিলোসফিক্যাল ম্যাগাজিন’এ (যদিও বিজ্ঞান ততদিনে দর্শনের আওতা থেকে বেরিয়ে স্বাধীন, সাবালক হয়েছে, তবু জার্নালের নামে রয়ে গেছে দর্শনের ছোঁয়া)। ‘দি স্ক্যাটারিং অফ আলফা অ্যান্ড বিটা পার্টিকলস বাই ম্যাটার অ্যান্ড দ্য স্ট্রাকচার অফ দি অ্যাটম’। একটি পরমাণুতে নিউক্লিয়াস কোথায় থাকে, ইলেকট্রণ কোথায় থাকে, সেটা পরিষ্কার করে বোঝালেন। তেজস্ক্রিয় বিভাজনের নিয়ম ব্যাখ্যা করার জন্য ১৯০৮ সালে রাদারফোর্ড নোবেল পুরস্কার পেলেন। আলফা কণা নিয়ে এতটাই পসেসিভ ছিলেন রাদারফোর্ড যে তাকে মাঝেমাঝে ‘মাই পার্টিকেল’ বলতেন। নিউক্লিয়াসকে ঘিরে সৌরজগতের মত ইলেক্‌ট্রনের গতিপথের ধারণা দিলেন রাদারফোর্ড। কিন্তু এই মডেলেরও অনেক ত্রুটি ছিল, সেসব সংশোধন করে নীলস বোর যে মডেলটি খাড়া করলেন (১৯১৩) হাইস্কুলে এখনো আমরা সেই মডেলই পড়ি। এই মডেল অনুসারে যাবতীয় ধনাত্মক আধান পরমাণুর কেন্দ্রে ছোট্ট পরিসরে সন্নিবদ্ধ, যার নাম দেওয়া হল নিউক্লিয়াস আর ইলেক্ট্রনগুলো তার চারপাশে বিভিন্ন কক্ষপথে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ধনাত্মক আধানবাহী কণিকাটির বিষয়ে অনেক কিছু জানা থাকা সত্ত্বেও তার ভর, আধান সব বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা হতে আরও কয়েক বছর, আরও কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার জল বইল।

    বিজ্ঞানে কিছু কিছু হঠাৎ আবিষ্কার হয়, হাতে কলমে পাওয়া ফলাফল থেকে যার সূচনা, আবার কিছু আবিষ্কার পরীক্ষামূলক প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আগে অনেক চিন্তা- ভাবনা-ধারণার সিঁড়ি ভেঙে আসে। পরমাণুর ধারণার সূচনাপর্বে (১৮১৫) উইলিয়াম প্রাউট নামে একজন বিজ্ঞানী (বা দার্শনিক) মৌলিক পদার্থের ভরের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে একটা ভাসা ভাসা ধারণা দিয়েছিলেন যে, সব মৌলিক পরমাণুই হাইড্রোজেন পরমাণু দিয়ে তৈরী, যাদের তিনি ‘প্রোটাইল’ নাম দিয়েছিলেন। তারপর দীর্ঘ নীরবতার পর অ্যানোড রশ্মি ও ইলেক্‌ট্রন আবিষ্কারেরও পর উইলিহেম উইয়েন বিভিন্ন গ্যাস নিয়ে পরীক্ষা করে (১৮৯৮) দেখালেন, হাইড্রোজেন আয়ন কণিকার আধান ও ভরের অনুপাত (e/m) সবচেয়ে বেশি। আর নিউক্লিয়াসের ধারণা আসার পরে অ্যান্থোনিও ভন দ্য ব্রেক এটাও প্রমাণ করলেন যে পরমাণুর রাসায়নিক ধর্ম এবং পর্যায় সারণীতে তার অবস্থান তার নিউক্লিয়াসে মোট ধনাত্মক আধানের ওপর (তার মানেই ইলেক্ট্রনের সংখ্যা ও মোট আধান) নির্ভর করে। মানে, এদিক ওদিক থেকে পরোক্ষে নানারকম ধারণা তৈরী হচ্ছে কিন্তু ধনাত্মক কণাটির ভর ও আধান নিয়ে স্পষ্ট ধারণা কিছুতেই হচ্ছে না। অবশেষে হাল ধরলেন রাদারফোর্ড, ধারাবাহিক পরীক্ষায় প্রথমে দেখলেন নাইট্রোজেন গ্যাসের মধ্যে আলফা রশ্মি পাঠালে, হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস পাওয়া যায়। আরো ভালো করে বললে নাইট্রোজেন পরমাণুকে আলফা কণা দিয়ে আঘাত করলে একটা অক্সিজেন (১৭) পরমাণু আর একটা হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস উৎপন্ন হয়, অর্থাৎ হাইড্রজেন নিউক্লিয়াসটা নাইট্রোজেন পরমাণুর মধ্যেই ছিল। রাসায়নিক ভাষায় লিখলে সমীকরণটা এইরকম হবে (বিশ্বের প্রথম নিউক্লিয় সমীকরণ)
    14N + α → 17O + p
    এই পরীক্ষা ১৯১৭ সালের, প্রকাশিত হল ১৯১৯ সালে। তার মানে একশ’ বছরেরও বেশি সময় পরে প্রাউটের তত্ত্বই যেন প্রতিষ্ঠিত হলো। তবে রাদারফোর্ড এটা বুঝলেন যে, এটা আসলে একটা আলাদা কণা, যা হাইড্রোজেন পরমাণুর নিউক্লিয়াসে একটা থাকে, আর অন্যান্য নিউক্লিয়াসে বেশি সংখ্যায় থেকে তার ভর ও ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করে। প্রাউটের প্রায় নির্ভুল ধারণাকে স্বীকৃতি দিতে একে ‘প্রাউটন’ বা ‘প্রোটন’ যে কোনো একটি নামে ডাকার প্রস্তাবনা করলেন। প্রোটন নামটাই বহাল থাকল; ১৯২০ সালে ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রথম প্রোটন নাম ব্যবহার করে প্রবন্ধ ছাপা হলো।

    নিউট্রন
    সেই ১৯২০ সালেই রাদারফোর্ড অনুমান করেছিলেন, নিউক্লিয়াসে এমন কণা থাকতে পারে যার ভর প্রোটনের সমান কিন্তু আধান বলতে কিছু নেই। নামও দিয়েছিলেন নিউট্রন। তাঁর ধারণা ছিল একটা প্রোটন আর একটা ইলেকট্রন যোগ হলে একটা নিউট্রন পাওয়া যায়, যারা নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সঙ্গে ঠাসাঠাসি করে থেকে যায়। কিন্তু এর স্বপক্ষে কোনো পরীক্ষালব্ধ প্রমাণ হাজির করতে পারেন নি।
    গোটা বিশের দশক কেটে গেল এইরকম ‘নিউক্লিয়ার ইলেকট্রনের’ ধারণায়, যদিও অনেকগুলো খটকার দরুণ ধারাণাটা বিজ্ঞানীদের মোটেই যুৎসই লাগছিল না। পরীক্ষা-নিরীক্ষা অবশ্য চলতেই থাকল। ১৯৩১ সালে ওয়াল্টার বথে আর হারবার্ট বেকার দেখলেন, তেজস্ক্রিয় পোলোনিয়াম থেকে নিঃসৃত বিকিরণকে বেরিলিয়াম, বোরন কিম্বা লিথিয়াম পাতের ওপর ফেললে একটা অস্বাভাবিক শক্তিশালী ভেদন ক্ষমতা সম্পন্ন বিকিরণ নির্গত হয়, যেটার ওপর বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের প্রভাব পড়ে না। তাঁরা বললেন, ওটা নিশ্চই গামা রশ্মি। ফ্রান্সে এইসময় দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন ফ্রেডরিক জোলিও আর আইরিন জোলিও কুরি। ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে রাদারফোর্ড ও তাঁর ছাত্র জেম্‌স, শ্যাডউইক। তাঁরা কেউই এই ‘গামা রশ্মি’র ব্যাখ্যায় খুশি হলেন না, বরং চুপচাপ নিজের নিজের মত পরীক্ষা চালাতে লাগলেন। যেমন কুরী দম্পতি বেরিলিয়াম থেকে নিঃসৃত রশ্মিকে একটি পাতলা মোমের তৈরি দেয়ালের দিকে পাঠিয়ে দেখলেন হাইড্রোজেন আছে এমন কোনো যৌগের ওপর এই রশ্মি পড়লেই উচ্চগতিসম্পন্ন প্রোটনের স্রোত পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁরা কোনো নতুন কণার উল্লেখ করলেন না। কিন্তু তাঁদের কাজের ফলাফল দেখে শ্যাডউইক উইলসন ক্লাউড চেম্বার নাইট্রোজেনে ভর্তি করে পরীক্ষা শুরু করলেন। আবারও ধারাবাহিক পরীক্ষায় দেখা গেল এই অজানা রশ্মি আসলে প্রোটনের সমান ভরবিশিষ্ট ও আধানহীন কণিকার প্রবাহ, যে কণিকা নিউক্লিয়াসে প্রোটনের সঙ্গে ঘর ভাগাভাগি করে থাকে। নতুন করে এর নামই দেওয়া হলো নিউট্রন আর এইভাবেই ১৯৩২ সালে নিউট্রন নতুন করে আবিষ্কার হলো। আর এই আবিষ্কারের জন্য ১৯৩৫ সালে স্যাডউইক নোবেল পুরস্কার পেলেন। সুতরাং বলতে গেলে কুরী দম্পতির হাতের নোবেল চলে গেল শ্যাডউইকের হাতে। তাতে কুরীদের কিছু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সইতে হলো। এতর ম্যজারানা জোলিও দম্পতিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “Oh, look at the idiots; they have discovered the neutral proton, and they don't even recognize it”। কিন্তু জোলিও দম্পতি মুক্ত মনেই অভিনন্দন জানালেন শ্যাডউইককে। আসলে নোবেল পাওয়াটা তাঁদের কাছে কীই আর এমন ব্যাপার!

    তাহলে নিউক্লিয়াসের মধ্যে প্রোটন আর নিউট্রন আর বাইরে বিভিন্ন কক্ষপথে ইলেকট্রন, এযাবৎ এই দাঁড়ালো পরমাণুর গঠন। এভাবেই শেষ হলো পরমাণু জিজ্ঞাসার প্রথম পর্যায়। এই পর্যন্ত পাওয়া কণিকাদের আমরা প্রথম প্রজন্মের কণিকা বলতে পারি, কারণ এরা সবাই স্থায়ী, এদের স্বাধীন অস্তিত্ব আছে এবং এদের সরাসরি পরীক্ষায় ধরতে পারা গেছে।

    নিউট্রিনো ও বিপরীত কণিকারা : দ্বিতীয় প্রজন্ম

    এতক্ষণের আলোচনা থেকে এটা কিন্তু পরিষ্কার যে পরমাণুর ভেতরমহলের কথা জানতে বা অতিপারমাণবিক কণিকার চরিত্র মির্মাণে তেজস্ক্রিয়তার একটা বিরাট ভূমিকা ছিল। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের আলফা কণিকাকে এই আলোচনায় আমরা বার বার আসতে দেখেছি। বিটা রশ্মিও কিন্তু পিছিয়ে নেই। বিটা রশ্মির উপাদান হিসেবে প্রথমে কিছুদিন বিটা কণিকার কথা উল্লেখ করা হলেও অবিলম্বেই জানা গেল ইহা প্রকৃত পক্ষে ইলেকট্রন। অর্থাৎ বিটা তেজস্ক্রিয়তা আছে এমন পদার্থের নিউক্লিয়াস স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বিয়োজিত হয়ে অন্য একটি নিউক্লিয়াস ও একটি ইলেক্‌ট্রন উৎপন্ন করে। খুব স্বাভাবিক নিয়মেই একটি বিশেষ তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে নির্গত সমস্ত বিটা ইলে্‌ট্রনের গতিবেগই সমান হাওয়া উচিৎ, শক্তির নিত্যতা সূত্র তাই বলে। কিন্তু বাস্তবে কোনো বিটা তেজস্ক্রিয় পদার্থ থেকে পাওয়া ইলেক্‌ট্রনের গতিবেগ মেপে শ্যাডউইক (১৯১৪) দেখলেন তাদের বিচিত্ররকম গতিবেগের মান পাওয়া যাচ্ছে। এ ব্যাপারটা বিজ্ঞানীদের বিশেষ ভাবিয়ে তুলল। তাহলে যেসব ইলেক্‌ট্রনের গতিবেগ কম, তাদের শক্তিটা কোথায় যাচ্ছে! সমস্যার সমাধানে গ্রহণযোগ্য একটা ব্যাখ্যা দিলেন বিজ্ঞানী ভোল্‌ফ্‌গাং পাউলি; তাঁর মতে, বিটা রশ্মিতে ইলেক্‌ট্রনের সঙ্গে মিশে আছে আরো একটি আধানহীন হাল্কা কণিকা যাকে ধরতে পারা যাচ্ছে না কিন্তু তার শক্তি, ভরবেগ সব মিলেই নিত্যতা সূত্র বজায় থাকছে। এর অস্তিত্ব মেনে নিলে শ্যাডউইকের ফলাফল ব্যাখ্যা করতেও আর অসুবিধে থাকে না। পাউলি এই কণিকার নাম দিয়েছিলেন নিউট্রন (হ্যাঁ, আসল নিউট্রন তো তখনো আবিষ্কার হয়নি)। পরে এন্‌রিকো ফের্মি পাউলির তত্ত্বকে আরো একটু সুসংহত রূপ দিলেন এবং বলতে চাইলেন আলোর কণিকা ফোটনের মত কিছু বস্তুকণিকাও জন্মায় ও ধ্বংস হয়, নিউট্রন এইরকমই এক কণিকা। পরে ১৯৩২ সালে আধানহীন ভারী কণিকাকে ‘নিউট্রন’ নাম দেওয়ার পর ফের্মিই এই হাল্কা কণিকার নাম বদলে ‘ছোট নিউট্রন’ বা ‘নিউট্রিনো’ (ইতালীয় ভাষায় ইনো মানে ছোট) রাখলেন।

    তারে ধরি ধরি মনে করি…
    কিন্তু নিউট্রিনো বিষয়ে যেসব তথ্য পাওয়া গেল, সবই পরোক্ষ। তাকে পরীক্ষায় ধরা তত সহজ ছিল না। কারণ এই হাল্কা ও আধানহীন কণিকা প্রায় সব মাধ্যম ভেদ করে চলে যায়, কোনো সঙ্ঘর্ষ না করে, কোনো চিহ্ন না রেখে। তাহলে একে শনাক্ত করা যাবে কী করে! একমাত্র উপায় হলো অনেক বেশি সংখ্যক নিউট্রিনোকে যদি চালানো যায় শনাক্তকারক যন্ত্রের ভেতর দিয়ে, তবেই তাদের কেউ না কেউ ধরা দেবে। এই ‘অনেক’ শব্দটার সীমা বুঝতে গেলে আমাদের কল্পনার মাত্রাটা এখানে একটু বাড়াতে হবে। এই ‘অনেক’ নিউট্রিনো পাওয়া সম্ভব একমাত্র পারমাণবিক চুল্লীতে, যেখানে নিউক্লিয় বিক্রিয়ায় প্রতি সেকেন্ডে গড়ে ১০২০ (!) টা কণিকা উৎপন্ন হয়। সেই উৎসকে কাজে লাগিয়ে ফ্রেডরিক রাইনেস আর ক্লাইড কাওয়ান এবং তাঁদের দলের আরো তিনজন বিজ্ঞানী নিউট্রিনোকে শনাক্ত করলেন ১৯৫৬ সালে। সেও কিছুটা পরোক্ষ প্রমাণ, তবে জোরালো। এই পরীক্ষা পাউলির অসামান্য অন্তর্দৃষ্টি, ফের্মির সুচিন্তিত তত্ত্বরূপকে প্রমাণ করল পরীক্ষার কষ্টিপাথরে। এই কাজও নোবেল পুরস্কার পেল, তবে ঊনচল্লিশ বছর পরে, যখন কাওয়ান পরলোকে। পুরস্কার পেলেন একা রাইনেস।

    এর মধ্যে কিন্তু কণাদের জগতে তাত্ত্বিকভাবে অনেকরকম অদল বদল ঘটে গেছে। যে বদলের হোতা একজন নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী পল ডিরাক। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব ও কোয়ান্টাম বলবিদ্যার মধ্যে সমন্বয় করে কাজ করতে করতে তিনি ধারণা করলেন, প্রত্যেক কণার একটি বিপরীত কণা থাকে, যার আধান ওই কণাটির ঠিক বিপরীত, যাকে ওই কণার অ্যান্টিকণা বলা যায়। এমন একটি কণা আছে যার ভর ইলেকট্রনের মতনই কিন্তু আধান ধনাত্মক। অ্যান্টি ইলেকট্রন না বলে তাকে বলা হলো পজিট্রন (১৯২৭)। তখন মহাজাগতিক রশ্মি নিয়ে কাজ করছিলেন কার্ল অ্যান্ডারসন। এই রশ্মিকে ক্লাউড চেম্বারে পাঠিয়ে আয়নিত কণার আলোকচিত্র গ্রহণ করলেন। এখান থেকে যে কণা পাওয়া গেল তারা আধানে ধনাত্মক এবং ভর ইলেকট্রনের সমান (১৯৩২)। পজিট্রন। তবে এই কণা সচারচর দেখা যায় না, মহাজাগতিক রশ্মিতে ধরা পড়ে, সুপারনোভাতে দেখা যায়। ডিরাক বললেন, নিউট্রিনোরও বিপরীত কণিকা আছে, অ্যান্টি-নিউট্রিনো। রাইনেস আর কাওয়ানের পরীক্ষায় এই অ্যান্টি-নিউট্রিনোকেই কাজে লাগানো হয়েছিল। তবে এঁদের পরীক্ষার মাত্র একবছরের মধ্যেই জানা গেল নিউট্রিনোও একরকমের নয়।

    নিউক্লিয়ার রহস্য ঃ মেসন
    এখানে একটা মৌলিক সমস্যার কথা টেনে আনা যেতে পারে। যতদূর জানা গেছে, পরমাণুর নিউক্লিয়াসে প্রোটন আর নিউট্রন ঠাসাঠাসি করে থাকে; নিউট্রনের না হয় আধান নেই, প্রোটনগুলোর তো পুরো এক একক আধান রয়েছে, আর সম তড়িতের বিকর্ষণ ধর্ম অনুসারে এদের মধ্যে ভয়ানক বিকর্ষণে নিউক্লিয়াস ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু তা তো হচ্ছেই না, উপরন্তু নিউক্লিয়াস এতই কঠিন যে বাইরে থেকে তাকে ভাঙতে গেলে বিপুল পরিমাণ শক্তি লাগে। আর এও দেখা গেছে যে দুটি প্রোটনের মধ্যে আকর্ষণ বল ইলেক্‌ট্রন-প্রোটন আকর্ষণ বলের একশো গুণ, যদিও তার কার্যকর থাকার সীমা খুবই কম। তার মানে নিউক্লিয়াসের অন্দরমহলেও আরও কিছু হচ্ছে, যা সাদা চোখে দেখা যাচ্ছে না (পরমাণু পর্যায়ের কোনোকিছুই অবশ্য সাদা চোখে দেখা যায় না!)। মহাকর্ষ বল ও তড়িৎ-চুম্বকীয় বলের পর এই একটা নতুন বলের সন্ধান পাওয়া গেল, যাকে বলা হলো দৃঢ় বা তীব্রবল। এই বলের উৎস সন্ধান করতে গিয়ে বিজ্ঞানী হিদেকি ইউকাওয়া একটি নতুন কণার সংযোজন করলেন। আধানযুক্ত, ভারী এই কণার নাম দিলেন মেসন, যে কণাটি প্রতিমুহূর্তে প্রোটন আর নিউট্রনের মধ্যে বিনিময় হয়ে চলে আর এই বিনিময় থেকেই নিউক্লিয়াসে প্রোটন-নিউট্রন তীব্র আকর্ষণ বলের উৎপত্তি হয়। মেসন কথার অর্থ মাঝারি। এই নতুন কণার ভর ইলেকট্রনের চেয়ে বেশি কিন্তু প্রোটনের চেয়ে কম। হিসেব কষে দেখা গেল ইলেকট্রনের চেয়ে ২৭৬ গুণ ভারী এই মেসন কিন্তু অস্থায়ী। এর জীবনকাল ১/১০০০০০০ সেকেন্ড। নিউক্লিয়াসের মৃদু বল যা বিটা নিঃসরণ ঘটায়, তার মূলেও এই রকম একটি কণিকার ধারণা দিয়েছিলেন তিনি। এই ধারণার হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া গেল প্রায় ১০ বছর পরে। সেই উইলস-ক্লাউড চেম্বার। প্রমাণ দিলেন স্বয়ং উইলসনের ছাত্র বিজ্ঞানী সেসিল ফ্র্যাঙ্ক পাওয়েল। ক্লাউড চেম্বারে কণা সনাক্তকরণে তিনি আলোকচিত্রের সার্থক ব্যবহার উদ্ভাবন করেন। আর তা থেকেই যে কণা পাওয়া গেল তা ইলেকট্রনের চেয়ে ২৭৬ গুণ ভারী কিন্তু অস্থায়ী (মানে কণিকাটি ক্ষণিকাও বটে!)। সুতরাং ইউকাওয়ার অনুমান সত্যি বলে প্রমাণিত হলো। এও জানা গেল মেসন কণা আসলে একটি শ্রেণী, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি কণাকে রাখা যায়। ভারী মেসন কণার নাম দেওয়া হলো পাই-মেসন আর হাল্কা কণার নাম হলো মিউ-মেসন (এদের বিষয়ে পরে আরো একটু জানা যাবে)। গ্রীক বর্ণমালার বর্ণ পাই ও মিউ অনুসারে এখন এদের যথাক্রমে পাইয়ন ও মিউওন বলে ডাকা হয়। ১৯৫০ সালে পাওয়েল নোবেল পুরস্কার পান।

    থ্রী কোয়ার্কস ফর মাস্টার মার্ক !

    কিন্তু কণিকা ও তার প্রতিকণিকা, যেমন ইলেক্‌ট্রন আর পজিট্রন যদি পস্পরের কাছাকাছি আসে তাহলে কী হবে? তারা পরস্পরকে যদি ধ্বংস করতে পারে তাহলে তাদের ভর কোথায় যাবে? ভরের নিত্যতা সূত্র কি তবে লঙ্ঘিত হবে এ ক্ষেত্রে? তাছাড়া নিউক্লিয়াসের ভরও নিউক্লিওনগুলোর (প্রোটন + নিউট্রন) মোট ভরের থেকে কিছুটা কম, সেই গরমিলটাই বা হচ্ছে কী করে! এই ধাঁধার সমাধানে কিন্তু কাজে লাগল কোয়ান্টাম তত্ত্বের ধারণা আর ত্বরণযন্ত্র বা অ্যাক্‌সিলারেটরের প্রয়োগ। কোয়ান্টাম তত্ত্ব আমাদের একটা অন্য জগতের সন্ধান দেয়, যেখানকার নিয়মকানুন আমাদের রোজকার জীবনের থেকে অনেকটা আলাদা। সেই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের নিয়ম বিচার করে প্রথম প্রশ্নের উত্তর হলো পজিট্রন আর ইলেকট্রন একে অপরের গায়ে গিয়ে পড়লে ফোটন, অর্থাৎ শক্তিকে পাওয়া যায়। আর নিউক্লিয়নের ভরের সঙ্গে নিউক্লিয়াসের ভরের ওই যে সামান্য তফাৎ, ওই ভরটুকু আইনস্টাইনের E=mc2 সমীকরণ মেনে বিপুল শক্তিতে পরিণত হয়, যা হলো নিউক্লিয় বল। নিউক্লিয়াসকে বাইরে থেকে ভাঙতে গেলেও তাই বিপুল শক্তি প্রয়োগ করতে হয়।
    অ্যাক্‌সিলারেটর হলো সেই যন্ত্র যাতে উচ্চ বিভব প্রভেদ ও চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করে কণাদের সরলরৈখিক বা বৃত্তাকার পথে দৌড় করিয়ে তাদের গতিবেগ ক্রমাগত বাড়িয়ে প্রায় আলোর বেগের কাছাকাছি আনা হয় (ঠিক যেমন ওয়াসিম আক্রাম অনেকটা দৌড়ে এসে বল ছোঁড়েন)। তারপর এইরকম দুই বিপরীতমুখী কণিকার স্রোতকে মুখোমুখি ধাক্কা খাওয়ানো হয়, যাতে পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা লেগে কণাগুলো ভেঙে যায় এবং বেরিয়ে আসে প্রচুর শক্তি। প্রথম অ্যাকসেলারেটর যন্ত্র তৈরী করেছিলেন নোবেল জয়ী বিজ্ঞানী আর্নেস্ট লরেন্স। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মিলটন স্ট্যানলি ও লিভিংস্টোন। কীভাবে এবং কোন পথে কণারা শক্তি অর্জন করবে তার ভিত্তিতে অ্যাকসিলারেটরকে মূলত তিন শ্রেণীতে ভাগ করা যায়।
    ১) একসঙ্গে শক্তি অর্জন করে ও সরলরেখায় চলে এমন যন্ত্রঃ কক্রফট-ওয়াল-টন বিভব পরিবর্ধক (Voltage multiplier) যন্ত্র বা ভ্যান-ডে-গ্রাফ উৎপাদক (Van de Graaff generator) শ্রেণীর অন্তর্গত


    (চিত্র ২)
    ২) ধাপে ধাপে শক্তি অর্জন করে কিন্তু সরলরেখায় চলে রৈখিক ত্বরণযন্ত্র (Linear accelerator)

    ৩) ধাপে ধাপে শক্তি অর্জন করে সর্পিল (Spiral) বা বৃত্তাকার(Circular) পথে চলে। (চিত্র ৩)
    https://encrypted-tbn0.gstatic.com/images?q=tbn%3AANd9GcTPy5jxzPUPVTx3sMwAMpe_3S6VqufIkDSLbdBw39RFjodhz-OV&usqp=

    http://universe-review.ca/I15-27-synchrotron.জেপিজি (চিত্র ৩, সাইক্লোট্রন ও সিঙ্কোট্রন)

    ত্বরণযন্ত্রের শক্তি কীভাবে বেড়েছে তার একটা হিসেব দেখা যাক; ১৯৩১ সালে বার্কলের ত্বরণযন্ত্রে যে গতিশক্তি ১.০ মেগা ইলেক্‌ট্রন ভোল্ট (MeV) থেকে শুরু হয়েছিল, তা ২০০৮ সালে সার্নে লার্জ হ্যাড্রন কলাইডারের গতিশক্তি ২.৭৬ টেরা ইলেক্‌ট্রন ভোল্ট (TeV) তে এসে দাঁড়িয়েছে। এটাই প্রযুক্তির অগ্রগতি যা মৌলিক বিজ্ঞানের গবেষণাকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। যাইহোক এই ঠোকাঠুকি ও ভাঙাভাঙির ফলে অনেক মৌলিক কণিকার অন্দরমহলের খবর পাওয়া গেল।

    দেখা গেল ইলেক্‌ট্রন একটি মৌলিক কণিকা কারণ তার মধ্যে আর অন্য কোনো কণিকার বসবাস নেই, কিন্তু প্রোটন আর নিউট্রন কেউই আসলে মৌলিক কণিকা নয়। তাদের উপাদান আরো সূক্ষ্ম একদল কণিকা, যাদের একসঙ্গে নাম দেওয়া হলো কোয়ার্ক। প্রোটন ও নিউট্রনের উপাদান দু’রকমের কোয়ার্ক, এদের একটিকে বলে আপ (u) অন্যটিকে বলে ডাউন (d)। আপ-এর আধান প্রোটনের ২/৩ অংশ আর ডাউনের আধান প্রোটনের ১/৩ অংশ কিন্তু ঋণাত্মক। প্রোটনের উপাদান দুটো u, একটা d আর নিউট্রনের উপাদান একটা u, দুটো d। মানে প্রোটন যদি হয় uud, মোট আধান +১, নিউট্রন হলো udd, মোট আধান শূন্য (০)। ১৯৬৪ সালে এইসব জটিল তথ্য আবিষ্কার করলেন মারে গেলম্যান যা ১৯৬৯ সালে তাঁকে নোবেল পুরস্কার এনে দিল। কোয়ার্ক নামটাও তাঁরই দেওয়া। জেম্‌স জয়েসের উপন্যাস ‘ফিনেগান্‌স ওয়েক’ এর একটা লাইন ‘থ্রী কোয়ার্কস্‌ ফর মাস্টার মার্ক’ এর সঙ্গে তিনজোড়া কোয়ার্কের অস্তিত্বের তুলনা করে তিনি এই নাম রাখেন। তবে পরবর্তীকালে জানা গেছে কোয়ার্ক মোট তিনজোড়া, আপ-ডাউন, টপ-বটম, স্ট্রেঞ্জ-চার্ম, যারা অনেকদিন ধরে ধীরে ধীরে আবিষ্কৃত হয়েছে।
    ইলেক্‌ট্রন অতিমাত্রায় হাল্কা বলে তার বিলয়ে আর অন্য কণা পাওয়া যায় না, তাই তা স্থায়ী। কিন্তু ভারী কণিকারা সবাই আসলে যৌগিক কণিকা, যারা বিভিন্ন হাল্কা কণিকায় ক্রমাগত ভেঙ্গে যেতে থাকে। মেসন শ্রেণির কণিকারা (এর মধ্যে পাই, মিউ, সাই, ইটা অনেক কণিকাই পড়ে যায়) একজোড়া কোয়ার্কে গঠিত আর ব্যারিওন শ্রেণির কণিকারা (প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি) তিনটে কোয়ার্কে গঠিত। পাইওন আবার দু’তিন রকমের হয় ধনাত্মক, ঋণাত্মক, আধানহীন যারা আবার মিউওন আর মিউওন নিউট্রিনোতে ভেঙে যায়। মিউওনের বিলয়ে পাওয়া যায় একটি ইলেক্‌ট্রন, একটি নিউট্রিনো আর একটি অ্যান্টিনিউট্রিনো। আর প্রতিটি পরীক্ষায় কলাইডারে যাকে ধরা যায় সে হলো শেষ পর্যায়ের কণিকা, তার উপস্থিতি থেকে শুরু করে ধাপে ধাপে পিছিয়ে গিয়ে অনেক সময় আসল কণিকাটিকে শনাক্ত করা হয়।

    ততদিনে অবশ্য আবিষ্কার হয়েছে প্রোটনের প্রতিকণা অ্যান্টিপ্রোটন (১৯৫৫)। বিভাট্রন নামক অ্যাকসিলারেটরে প্রোটনকে ৬.২ GeV শক্তি দিয়ে উত্তেজিত করে লক্ষ্যবস্তু তামার নিউক্লিয়াসে ছুঁড়ে মারা হলো। সেই উত্তেজিত প্রোটন তামার নিউক্লিয়াসের নিউট্রনকে ভেঙে দু’টুকরো করে দিল এবং তার ভেতর প্রোটনের সমান ভরের ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট কণিকাকে বার করে আনতে পারল। প্রায় দু’লক্ষ প্রোটন ব্যবহার করে মাত্র ৩৮টা এইরকম অ্যান্টিপ্রোটন শনাক্ত করা গেল। এই কাজের জন্য আবিষ্কর্তা এমিলিও সেগ্রে আর ওয়েন চেম্বারলেন ১৯৫৯ সালে নোবেল পুরস্কার পেলেন।

    লেপ্টনঃ বোসন না ফের্মিয়ন?

    পায়ে পায়ে আমরা চলে এসেছি অনেকদূর। দু’পা এগিয়েছি, আবার এক’পা পিছিয়ে গিয়ে মিলিয়ে দেখে এসেছি আগেকার ফলাফল। বিজ্ঞান এভাবেই এগোয়। এই পর্যন্ত যা যা পাওয়া গেল তা এবার একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। জেনে নেওয়া যাক কণিকার সন্ধানে এই নিরন্তর অভিযান আসলে কী ও কেন! একটা সময় অবধি প্রকৃতিতে দু’রকম বলের কথা জানা ছিল - মহাকর্ষ বল আর তড়িচ্চুম্বকীয় বল। কিন্তু পরমাণুর গঠন যত সামনে আসতে লাগল, ততই আরও দু’টি বলের অস্তিত্ব বোঝা যেতে লাগল, যারা খুব কম দূরত্বের মধ্যে কাজ করে। একটি হলো শক্তিশালী বা দৃঢ় বল (strong interaction) যে প্রোটন ও নিউট্রনকে নিউক্লিয়াসে আটকে রাখে আর একটি হলো মৃদুবল (weak interaction) যা তেজস্ক্রিয় পদার্থের নিউক্লিয়াস থেকে বিটা রশ্মি বেরোতে সাহায্য করে। আসলে নিউট্রনকে একটা প্রোটনে ও একটা ইলেকট্রনে ভেঙ্গে দেয়। তাহলে এখন আমাদের হাতে এসে গেল অনেকগুলো কণা এবং চারটি বল, যথাক্রমে মহাকর্ষীয় বল, তড়িৎচুম্বকীয় বল, দৃঢ়বল আর মৃদুবল। আরো দু’একটি কণার কথা সংক্ষেপে বলে নেওয়া যাক। ১৯৬১ সালে লেওন লেডারম্যান ও সহকর্মীরা দেখালেন যে বিক্রিয়াতেই মিউওন থাকে তাতেই থাকে অন্য এক রকমের নিউট্রিনো। বিটা তেজস্ক্রিয়তায় পাওয়া নিউট্রিনোকে বলা হয়েছিল ই-নিউট্রিনো আর এই নতুন কণাকে নাম দেওয়া হল মিউ-নিউট্রিনো, যার ধর্ম সবই ই-নিউট্রিনোর মত। তাহলে মিউওনের বিলয়ে তৈরী হলো ইলেক্‌ট্রন, মিউ-নিউট্রিনো আর ই-অ্যান্টিনিউট্রিনো। প্রোটন ও নিউট্রনের উপাদান যেমন কোয়ার্ক, তেমনি এই ইলেক্‌ট্রন, মিউওন আর তাদের সঙ্গী নিউট্রিনোরাও একসঙ্গে একটা শ্রেণি গঠন করে, যার নাম দেওয়া হলো লেপ্টন। এই কাজ নোবেল পুরস্কার পেল ১৯৮৮ সালে। এইপর্যন্ত আবিস্কৃত কণিকাদের বলা যায় দ্বিতীয় প্রজন্মের কণিকা। এদের নিয়ে গবেষণা এগিয়ে চলল, নতুন কণিকার স্রোত কিন্তু বন্ধ হলো না।

    ১৯৭৫ সালে মার্টিন পল ও কয়েকজন বিজ্ঞানী ইলেক্‌ট্রন ও পজিট্রনের স্রোত নিয়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে রৈখিক ত্বরণযন্ত্র (Linear accelerator)এ একটা নতুন কণার খোঁজ পেলেন যেটা মিউয়নের চেয়ে সতেরোগুণ ভারী। এর নাম দেওয়া হলো টাওয়ন। ইলেকট্রন, মিউয়ন, টাওয়ন এবং প্রত্যেকের সঙ্গে যুক্ত হলো নিউট্রিনো। অর্থাৎ ইলেকট্রন-নিউট্রিনো, মিউয়ন-নিউট্রিনো ও টাওয়ন-নিউট্রিনো। মোট ছয় জন মিলে লেপ্টন পরিবার। এই কণিকারা বেশির ভাগই স্থায়ী নয়, অনেকেই শুধুমাত্র কোলাইডারেই ধরা দেয়, তবু অনেক রহস্য জড়িয়ে আছে তাদের সঙ্গে। কেউ ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি রহস্যের সমাধানে আলোকপাত করে, কেউ কোনো না কোনো বাস্তব ঘটনাকে ব্যাখ্যা করে।

    সারণী ১ : কণিকারা কে কোথায়...
    ক। সাধারণ পদার্থের উপাদান যে সব কণা (মোট চার রকম): আপ, ডাউন (কোয়ার্ক), ইলেক্‌ট্রন, ইলেক্‌ট্রন-নিউট্রিনো (লেপ্টন)
    খ। যারা দেখা দেয় শুধু মহাজাগতিক রশ্মি ও অ্যাক্‌সিলারেটরে (মোট আট রকম) : চার্ম, স্ট্রেঞ্জ, টপ ও বটম (কোয়ার্ক), মিউওনও মিউওন-নিউট্রিনো, টাউ ও টাউ-নিউট্রিনো (লেপ্টন)
    গ। বোসন কণা যারা যে বলের ক্রিয়ার জন্য দায়ী ঃ ফোটন (তড়িৎ-চুম্বকীয় বল) গ্লুওন (দৃঢ়বল ) W, জ (মৃদুবল বাহক), গ্র্যাভিটন (মহাকর্ষ বল ), হিগ্‌স বোসন (পদার্থের ভর)
    ঘ। প্রতি-কণা ঃ সবক’টি কণারই বিপরীত কণা বা প্রতি-কণা আছে
    (সারণী হিসেবে দেওয়া গেল না বলে সরাসরি লেখা হল)
    কিন্তু সে কথায় আসার আগে কণিকাদের চরিত্র বিষয়ে কিছু মৌলিক বিষয় জেনে নেওয়া দরকার। এতক্ষণের আলোচনায় কোথাও কোনো কণিকার ঘূর্ণন বা স্পিন-এর কথা আসেনি। কিন্তু এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ ধর্মটির কথা এবার আলোচনায় না আনলে সব কিছু বোঝানো যাবে না। কণাদের ঘূর্ণনটা ঠিক লাট্টুর মত পাক খাওয়া না হলেও (কারণ কোয়ান্টাম জগতে কোনো কণাই তো ঠিক চেনা জগতের কণার মত নয়, তাদের কিছুটা তরঙ্গ ধর্মও থাকে) একরকমের পাক খাওয়াই বটে যার দরুণ তারা বারবার একই অবস্থানে ঘুরে আসতে পারে এবং তাদের মধ্যে কৌণিক ভরবেগ দেখা যায়। ক’বার বা কীভাবে পাক খেলে প্রথম অবস্থায় পৌঁছবে তার ওপর নির্ভর করে কণাদের ঘূর্ণন সংখ্যা ১/২, ৩/২, ৫/২, ১, ২, ৩ ইত্যাদি হতে পারে। যে কণাদের এই ‘স্পিন’টা পূর্ণ সংখ্যা তারা ‘বোস-আইনস্টাইন’ সংখ্যাতত্ত্ব মেনে চলে, এদের একসঙ্গে বলা হয় ‘বোসন’। আর যাদের স্পিন ভগ্নাংশ, তারা ফের্মি-ডিরাক তত্ত্ব মেনে চলে, তাদের বলা হয় ‘ফের্মিওন’। আমাদের দেখাশোনার মধ্যে ফোটন বাদের প্রায় সব বস্তুকণাই ফের্মিওন। এদের মধ্যে যারা দৃঢ় বলের নিয়ন্ত্রণাধীন হয় তারা হলো হ্যাড্রন (আর সব হ্যাড্রনই যে জিনিস দিয়ে তৈরি তা হলো কোয়ার্ক)। যেরকম নিউট্রন, প্রোটন। কিন্তু ইলেকট্রন বা নিউট্রিনো নয়, কারণ তারা মৃদুবলের অধীন। দিনে দিনে যেভাবে নতুন নতুন হ্যাড্রনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে মনে হচ্ছে নামকরণের জন্য গ্রীক বর্ণমালা ফুরিয়ে যাবে। প্রোটন ও নিউট্রনের পর পাই, কাই, ল্যামডা, সিগমা, জাই, ওমেগা সবই ইতিমধ্যে ব্যবহৃত হয়ে গেছে।

    বটম ও টপ কোয়ার্ক : তৃতীয় প্রজন্ম

    শুধু কোয়ার্কের ক্ষেত্রে আপ-ডাউন যদি হয় প্রথম প্রজন্ম, স্ট্রেঞ্জ-চার্ম তাহলে দ্বিতীয় প্রজন্ম। কিন্তু ১৯৭৩ সালে দুজন জাপানি বিজ্ঞানী বলেছিলেন তৃতীয় প্রজন্মের কোয়ার্কের কথাও। পার্লদের পরীক্ষায় সেই সম্ভাবনাও জেগে উঠল। সেকথা মাথায় রেখেই স্ট্যানফোর্ডের কণা ত্বরণযন্ত্র তৈরী হলো। বিজ্ঞানী লেডারম্যানের নেতৃত্বে সেই যন্ত্রে কাজ করে ১৯৭৭ সালে পাওয়া গেল এক নতুন কোয়ার্ক কণিকা, যার নাম দেওয়া হলো ‘বটম্‌’ এবং ১৯৯৪ সালে তার জুড়িটি পাওয়া গেল, যার নাম অনিবার্যভাবেই হলো ‘টপ’। এই টপ কোয়ার্কের দেখা পাওয়াটা এতটাই নিশ্চিত ছিল যেন জিগ্‌স পাজ্‌লের ওই একটা টুকরোর হিসেবই মেলা বাকি ছিল, মনে হয়েছিল যেন একে দিয়েই কণিকা অভিযান শেষ হয়ে গেল।

    কিন্তু ব্যাপারটা তেমন হলো না। টপ কোয়ার্ক প্রোটনের তুলনায় প্রায় ২০০ গুণ ভারী, প্রায় একটা সোনার পরমাণুর মত তার ওজন। কোথা থেকে এল এত ভর? প্রশ্নটা খুব সঙ্গত ভাবেই উঠে এল। কারণ কণারাজ্যে ভর একটা বিরাট রহস্য। দৃঢ়বলের কার্যকারিতার ব্যাখ্যায় যেমন কোয়ান্টাম বিজ্ঞাননির্ভর তত্ত্ব ‘কোয়ান্টাম ইলেক্‌ট্রোডাইনামিক্‌স’ বা QED, মৃদুবলের জন্যও তেমনি একটা তত্ত্ব থাকা উচিৎ। সেইরকম একটা তত্ত্বের রূপরেখা দিয়েছিলেন মার্কিনপদার্থবিদ শেল্‌ডন গ্লাসো (১৯৬০)। কিন্তু সেই তত্ত্ব কাজ করতে গেলে ব্রহ্মান্ডের সকল কণিকাকে ভরশূন্য হতে হয়। কিন্তু মৌলকণা তো প্রায় কেউই ভরশূণ্য নয়, তাহলে কী করে তত্ত্বটার মূল কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখেও মৌলকণাদের ভরের ব্যাখ্যা দেওয়া যাবে!

    ওহ্‌ গড! : চতুর্থ প্রজন্ম

    মেলাবেন তিনি মেলাবেন, বলে বসে থাকলে বিজ্ঞানীদের চলে না। তাই কাজ চলল। অর্থাৎ একদিকে যখন কোলাইডারে একের পর এক কণা আবিষ্কার হয়ে চলেছে, অন্যদিকে তখন বিভিন্ন পদার্থবিদের কাজের সমন্বয় করে ভরের ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা হচ্ছে। এ কাজের মুখ্য হোতা ছিলেন পিটার হিগ্‌স। স্ট্যান্ডার্ড মডেলের এক জায়গায় তিনি এক বিচিত্র বোসন কণার সন্ধান দিলেন যা ভরের ক্রিয়ার জন্য দায়ী। সেটা বুঝতে গেলে আগে দেখা যাক ভর জিনিসটা কী! ভর হলো সেই ধর্ম যা বলের ক্রিয়ায় বস্তুর গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। যে বস্তুর ভর যত বেশি, বলের ক্রিয়ায় তার গতি তত কম হবে। তাহলে এমন একটি কণা যদি বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডে ছড়িয়ে থাকে যার নিজস্ব ভর আছে এবং সে যদি শূন্যের মধ্যে কিছুটা শক্তি ছড়িয়ে রাখে, সেই শক্তির (E=mc2 অনুসারে শক্তি আর ভর তো আসলে একই জিনিসের দুটি রূপ) বিপরীতে গতি পেতে গেলে সব কণিকার মধ্যেই ভরের সঞ্চার হবে। এই কণিকাই আমাদের বহু আলোচিত ‘হিগ্‌স্‌ বোসন’ বা ‘গড পার্টিক্‌ল’। ব্যাপারটা হলো, আদতে সব মৌলকণিকাই ভরহীন থাকে, হিগ্‌স বোসনের সমুদ্রে সাঁতার কাটতে কাটতে তারা ভর লাভ করে। কিন্তু ফোটনএভাবে ভর পায় না, কারণ তার কোনো আধান নেই; তাই আধানহীন হিগ্‌স বোসনের ছেড়ে রাখা শক্তির সঙ্গে তার কোনো সঙ্ঘাত হয় না, সে ভরহীনই থেকে যায়। এই হিগ্‌স বোসন কণিকাকে খুঁজে পাওয়াই ছিল জিগ্‌স পাজলের শেষ টুকরো। মজার কথা হলো আমরা যাকে আজ ‘হিগস-বোসন’ বলি, পিটার হিগস নিজে তাকে বারবার ‘স্কেলার বোসন’ বলে অভিহিত করতে চেয়েছিলেন। মিতভাষী বিজ্ঞানী নিজের নামটি জড়াতে চাননি কোনোদিন।

    অ্যাকসিলারেটারের ক্রমাগত উন্নতির ফলে অবশেষে ২০০৮ সালে সার্ন (ইউরোপীয়ান অর্গানাইজেশান ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ) একটি যন্ত্র খাড়া করল, নাম লার্জ হ্যান্ড্রন কলাইডার। এই যন্ত্রে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয় কণাদের মধ্যে। এই যন্ত্রের জন্য পৃথিবীতে সাতভাগে ভাগ হয়ে বিজ্ঞানীরা কাজ করেছেন এবং এখনও করছেন। মৃদু বলের তত্ত্বে যা যা ভবিষ্যদ্‌বাণী ছিল, এক এক করে সবই মিলে গেল। ২০১১ সালের ২৪মে বিজ্ঞানীরা জানালেন, ‘কোয়ার্ক-গ্লুয়ন-প্লাজমার’ অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। কৃষ্ণ গহ্বরের মতোই তার খুব বেশি ঘনত্ব। বিগ ব্যাং থিওরির স্বপক্ষে একটি যুৎসই প্রমাণ হাতে এল। অবশেষে ২০১২ সালের ৪ঠা জুলাই জেনেভার লার্জ হ্যাড্রন কোলাইডারে পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে ঘোষণা করা হলো ১২৫-১২৬ MeV ভরের হিগস-বোসন কণার অস্তিত্ব। তার পরের দিন সমস্ত সংবাদপত্রের শিরোনাম হয়েছিল যে সব লাইন, তার মধ্যে একটিই মাত্র ছিল সঠিক, যদিও সেটাই সবচেয়ে কম প্রচারিত ঃ এতদ্দ্বারা সমস্ত মৌলকণার ভরের অস্তিত্ব ব্যাখ্যা করা গেল। পরের বছরই (২০১৩) এই হিগ্‌স বোসন কণার প্রথম তাত্ত্বিক ধারণা দেওয়ার জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেন পিটার হিগ্‌স ও ফ্র্যাঙ্কোয়স এঙ্গলার। এ ভাবেই কণিকাদের চারটি প্রজন্মের (ফোর-জি) পরিচয় সম্পূর্ণ হলো।

    কিন্তু এরমধ্যে ‘ঈশ্বর’ বা ‘গড’ কী করে এলেন? উত্তর হলো, আসেননি তো! ওটা একেবারেই অপব্যাখ্যা বা ভুল। ১৯৯৩ সালে নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লিও লেডারম্যান তাঁর একটি জনপ্রিয় বিজ্ঞানের বইয়ের পান্ডুলিপি নিয়ে যান প্রকাশকের কাছে। বইয়ের নাম দিয়েছিলেন ‘দি গডড্যাম্‌ পার্টিকেল : ইফ দি ইউনিভার্স ইজ দি আন্সার, হোয়াট ইজ দ্য কোশ্চেন?’ গডড্যাম্‌ কথাটা ঠিক শিষ্টাচারসম্মত নয় বলে প্রকাশক নামটা একটু বদলে রাখলেন ‘দি গড পার্টিকেল’। সর্বনাশটা ওখানেই হলো, বিশ্বজোড়া মানুষ হিগ্‌স বোসনকে চিনল ঈশ্বর-কণিকা নামে। নানারকম বিভ্রান্তিরও জন্ম নিল সেখান থেকে। কণিকা অভিযানকে গুলিয়ে ফেলা হল ঈশ্বর অনুসন্ধানের সঙ্গে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী পিটার হিগসকে প্রশ্ন করা হলে, বিনয়ী হিগস বলেছিলেন, “বড় অস্বস্তিকর এইসব নাম। আমি নিরশ্বরবাদী, আমার কথা ছেড়ে দিন। যারা বিশ্বাস রাখেন ঈশ্বরে, তারা নামের অপব্যবহার দেখে কেমন দুঃখ পাবেন সে কথাটাই ভাবছি"।
    সদ্যপ্রয়াত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংও বলেছেন, “সায়েন্স মেকস্‌ গড আননেসেসারি...”

    উপসংহার

    সুতরাং ১৮১২ থেকে ২০১২, এই মোটের ওপর দু’শো বছরকে যদি পরমাণু বিজ্ঞানের একদিনের সঙ্গে তুলনা করে একটা ঘড়ির কথা ভাবি, তো দেখা যাবে, রাত বারোটা থেকে পরের দিন দুপুর ১১-৩০ অবধি প্রায় কিছুই ঘটে নি; কিন্তু তার পর থেকে ঘন ঘন বেজেছে আবিষ্কারের ঘন্টা, কখনও মিনিটে মিনিটে। আর প্রায় সব আবিষ্কারই নোবেল পেয়েছে। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়, কারণ প্রতিটি বড় বড় আবিষ্কারের মাঝে মাঝে রয়ে গেছে অজস্র ছোট ছোট পরীক্ষা-পর্যবেক্ষণ-গণনা-সিদ্ধান্ত। এভাবেই বিজ্ঞান এগোয়, যা আসলে কিছু বিচ্ছিন্ন আবিষ্কার নয়, একটা ধারাবাহিক প্রশ্ন-উত্তরের খেলা। একটা প্রশ্নের উত্তর পেতে গিয়ে আরেকটা প্রশ্ন জেগে ওঠে, কখনো অত্যাশ্চর্য আবিষ্কারে সম্পূর্ণ নতুন ভাবনার দিগন্ত খুলে যায়। ফেলে দেওয়া তথ্য (ডাটা), বাতিল হয়ে যাওয়া তত্ত্বও নতুন করে ফিরে আসে। তার মধ্যে বিজ্ঞানীতে বিজ্ঞানীতে তর্ক-বিতর্ক-ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-ঠ্যাং টানাটানি-পিঠ চাপড়ানো সবই চলে। শর্ত একটাই, যুক্তি। খোলা মনে গ্রহণ করতে হবে যে কোনো পরিবর্তন যদি তা যুক্তিতে না আটকায়। বিশ্বাসে কিচ্ছু মেলাবে না! পরমাণু অভিযানকে সেই নানারকম জিজ্ঞাসা আর উত্তরের মধ্য দিয়ে কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে এই লেখায়। এখানে উল্লেখ করা কাজগুলোর মধ্যে নোবেল পুরস্কারের বহর দেখেই বোঝা যাবে কোন উচ্চতার গবেষণাকে ধরার চেষ্টা হয়েছে। যেসব কণিকার কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার বাইরেও রয়ে গেছে অজস্র কণিকা। মুখ্য আবিস্কারগুলোর কথাই এখানে বলা হয়েছে। আর কণিকাদের প্রজন্মের যে শ্রেনীবিভাগ করা হয়েছে, তাও একান্তই লেখকের বিচার অনুযায়ী, বুঝবার ও বোঝাবার সুবিধের কথা ভেবে, বিজ্ঞানীদের যুক্তি মেনে নয়। পরমাণু অনুসন্ধানের মূল সুরটুকু যদি ধরা পড়ে থাকে, তা হলেই এই লেখা সার্থক বলে মনে করা যাবে। এই লেখার সমস্ত তথ্য বিভিন্ন বইপত্র, ইন্টারনেটের নানারককম তথ্যসূত্র এবং প্রকাশিত বিভিন্ন প্রবন্ধ থেকে নেওয়া। তার মধ্যে অধ্যাপক পলাশবরন পাল (তিন প্রজন্মের কণিকা ঃ দেশ) ও আমার বন্ধু অরিন্দম চক্রবর্তীর (আমাদের চারপাশে কণাদের কথা ঃ বাংলালাইভ, মজলিশ, ২০১৩) কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

    সারণী ২ ঃ কণিকা অভিযানের মাইলফলক

    সাল আবিস্কার
    ১৮৯৭ইলেক্ট্রন, জে জে টম্ সন

    ১৮৯৯আলফা কণিকা, রাদারফোর্ড
    ১৯১১নিউক্লিয়াস, রাদারফোর্ড, গিগার, মার্সডেন
    ১৯১৯প্রোটন, রাদারফোর্ড
    ১৯২৭-২৮অ্যান্টি-ইলেক্ট্রন তত্ত্ব, পল ডিরাক, এত্যর মাজোরানা

    ১৯৩২নিউট্রন, শ্যাডউইক
    ১৯৩২অ্যান্টি-ইলেক্ট্রন প্রমাণ, কার্ল অ্যান্ডারসন ও সহকর্মীরা

    ১৯৩৭মিউওন, কার্ল অ্যান্ডারসন ও সহকর্মীরা
    ১৯৪৭পাইওন, ফ্রাঙ্ক পাওয়েল ও সহকর্মীরা
    ১৯৫৫অ্যান্টিপ্রোটন, আওয়েন চেম্বারলিন, এমিলিও সেগ্রে
    ১৯৬২মিউওন নিউট্রিনো, লিওঁ লেডারম্যান
    ১৯৬৪আপ-ডাউন-স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক, মারে গেলম্যান, জর্জ জুইগ
    ১৯৬৯আপ-ডাউন-স্ট্রেঞ্জ কোয়ার্ক, প্রমাণ, এস-এল-এ-সি পরীক্ষারত বিজ্ঞানীরা
    ১৯৭৩টাউ বা টাউওন, মার্টিন পার্ল
    ১৯৭৫-৭৭ আপসিলন মেসন, বটম কোয়ার্ক, প্রস্তাবনা কোবায়াসি ও মাস্কাওইন, প্রমাণ ফের্মিল্যাবের বিজ্ঞানীরা
    ১৯৯৫টপ কোয়ার্ক, ফের্মিল্যাবের বিজ্ঞানীরা
    ২০১১কোয়ার্ক-গ্লুওন প্লাজমা, সার্নের বিজ্ঞানীরা
    ২০১২হিগ্‌স বোসন প্রমাণ, সার্নের বিজ্ঞানীরা, প্রস্তাবনা পিটার হিগ্‌স (১৯৬৪)

    লেখক ঃ রূপালী গঙ্গোপাধ্যায়
    প্রথম প্রকাশ ঃ কালিমাটি ১০৫, বিষয় 'সৃষ্টি', পৌষ, ১৪২৫
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৪ এপ্রিল ২০২০ | ২৪৭৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Rajkumar Raychaudhuri | ০৪ এপ্রিল ২০২০ ১৭:২৭92010
  • অনেক ধন্যবাদ। সহজ সরল করে লেখার জন্য। এই লেখা আমার পরবর্তী লেখা লিখতে সাহাজ্য করবে

  • একলহমা | ০৫ এপ্রিল ২০২০ ০৯:৪৭92025
  • প্রথমবারের পাঠ শেষ করলাম। আরো বার দুয়েক পড়তে হবে মনে হচ্ছে। অসুবিধা নেই কারণ লেখার গুণে পড়তে ভালো লাগছে।
  • স্বাতী রায় | 162.158.***.*** | ০৫ এপ্রিল ২০২০ ২০:১৩92047
  • ভালো লাগল। আরও কয়েক বার পড়ব।
  • | ০৬ এপ্রিল ২০২০ ১৫:৫৯92065
  • দুদিন ধরে একটু একটু করে পড়লাম।
    ভাল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। কল্পনাতীত প্রতিক্রিয়া দিন