২৩ শে মার্চ, ২০২০ অবধি ভারতে COVID19 এর ৪০২ টি নিশ্চিত ঘটনা রয়েছে এবং ৭ জন মারা গেছেন। নভেল করোনাভাইরাস যা ২৯,০,০০ এরও বেশি লোককে প্রভাবিত করেছে এবং বিশ্বব্যাপী ২,৯০০,০০০ এর ও বেশি মানুষ এর ওপর প্রভাব ফেলেছে, ১২,০০০ এরও বেশি মানুষের মৃত্যু -র কারণ হয়েছে। ১, ২ ।
ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রক এর নির্দেশিকা মেনে WHO দ্বারা অনুমোদিত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য COVID19 সনাক্তকরণ পদ্ধতি হল Reverse Transcription Polymerase Chain Reaction’ (RT-PCR) যা NABL (ন্যাশানাল অ্যাক্রেডিটাসন বোর্ড ফর টেস্টিং ক্যালিব্রেসন ল্যাবরেটরি) স্বীকৃত সরকারী এবং কিছু বেসরকারী ল্যাবরেটরি তেই করা হয়।
কাদের করতে হবে COVID19 সনক্তিকরণ পরীক্ষা?
প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে মোকাবিলা করতে ICMR (ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ) এর নির্দেশিকা অনুযায়ী নিম্নলিখিত সকলের জন্যে সনাক্তকরণ প্রক্রিয়া আবশ্যক। ৩
১) সকল রোগী যারা (জ্বর, কাশি এবং শ্বাসকষ্ট উপসর্গ আছে) গত ১৪ দিনের মধ্যে বিদেশ থেকে ফিরেছেন।
২) সকল মানুষ যারা সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন।
৩) সকল স্বাস্থ্যকর্মী যারা সরাসরি রোগীর সংস্পর্শে এসেছেন।
৪) সকল রোগী যারা গুরুতর অবস্থায়ে তীব্র শ্বাসযন্ত্রের অসুস্থতা (জ্বর এবং কাশি এবং / বা শ্বাসের-স্বল্পতা) সহ সমস্ত হাসপাতালে ভর্তি আছেন।
৫) উপসর্গহীন প্রত্যক্ষ এবং উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ যোগাযোগ, যিনি সরাসরি ভাবে COVID19 রুগীর সান্নিধ্যে এসেছেন তিনি যোগাযোগে আসবার ৫-১৪ দিনের মধ্যে একবার পরীক্ষা করণীয়।
প্রত্যক্ষ এবং উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ যোগাযোগ অন্তর্ভুক্ত হলেন, COVID19 রুগীর পরিজন যাঁরা রুগীর সঙ্গে গৃহবন্দি ছিলেন ও স্বাস্থ্যকর্মী যারা WHO নির্দেশিত পর্যাপ্ত সুরক্ষা অবলম্বন করে রুগীর শনাক্ত প্রক্রিয়া করেননি।
কোথায় করতে হবে COVID19 সনক্তিকরণ পরীক্ষা ?
বিভিন্ন বিমানবন্দর এবং দপ্তর এ যে তাপীয় স্ক্যানারগুলি লাগান হয়েছে তা দিয়ে শুধুমাত্র জ্বর হয়েছে কিনা তা সনাক্ত করা যায় তবে কারো করোন ভাইরাস আছে কিনা তা সনাক্তকরণের একমাত্র স্বীকৃত পদ্ধতি হল RTPCR। আর সমস্ত ভাইরাল সংক্রমিত অসুখের যেমন ইনফ্লুয়েঞ্জা এ, ইনফ্লুয়েঞ্জা বি, সার্স (SARS) এবং এইচ১এন১ (H1N1) মতনই COVID19 নিশ্চিত করতে সুচারু ভাবে সুনির্দিষ্ট ল্যাবরেটরি তেই রুগীর গলার পেছন থেকে সোয়াব, বা লালা নমুনা, এবং নিম্ন-শ্বাসনালী এর তরল নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়।
এই মুহূর্তে ভারতে ৭২ টি সরকারী ল্যাবরাটরি তে প্রতিদিন ৯,০০০ টি COVID19 আসঙ্কিত পরীক্ষা করবার সক্ষ্যমতা আছে 2। সিএসআইআর, ডিবিটি, ডিআরডিওর অধীনে সন্থা গুলিতে অতিরিক্ত ৪৯ ল্যাবগুলি এই সপ্তাহের শেষের দিকে সক্রিয় করা হবে।
ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের পরীক্ষা কেন্দ্র গুলির তালিকা (পিডিএফ) >>
কিভাবে COVID19 সনক্তিকরণ পরীক্ষা করা হয়?
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (আইসিএমআর), অনুদেশ অনুযায়ী COVID-19 সনাক্তকরণ সম্পর্কিত সমস্ত পরীক্ষা আইসিএমআর (ICMR) মনোনীত ল্যাবরেটরী গুলি তে রিয়েল-টাইম পলিমেরেজ চেইন রিয়াকসন (real time PCR) এর সাহায্যে নির্ণয় করা হয়ে থাকে।
COVID19 সংক্রমণকারী করোনা ভাইরাস হল একটি RNA ভাইরাস , যা একজন রুগীর গলা এবং নাক এর মধ্যে প্রথমে সংক্রমণ করে এবং ভাইরাস টির জিনগত উপাদান, RNA এর উপস্থিতি সব চেয়ে বেশি থাকে গলায় । এই ভাইরাস এর RNA কে চিন্হিত করণ পদ্ধতি হল RT-PCR.
রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমারেজ চেইন বিক্রিয়া (RT-PCR) হ'ল একটি পরীক্ষাগার কৌশল যা RNA থেকে রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেস প্রোটিন এর সাহায্যে cDNA বা পরিপূরক DNA সংশ্লেষ করা হয় এবং পলিমারেজ চেইন বিক্রিয়া (PCR) ব্যবহার করে সেই cDNA এর সংখ্যা বৃদ্ধি করা হয়। সংশ্লেষিত DNA পরিমাপ করতে ফ্লুরেসেন্স প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়। বিক্রিয়ার সময়ের সাথে সাথে RNA পরিমাপ এর পদ্ধতি হল real-time RTPCR. আধুনিক এবং প্রযুক্তিগত ভাবে উন্নত ল্যাবরেটরি গুলি তে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র এর সাহায্যে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই অনেক নমুনার একসাথে এই পদ্ধতির সহায়তায় ভাইরাস RNA সনাক্তকরণ ও রোগ নির্ণয় করা হয়।
পরীক্ষার বিভিন্ন ধাপ গুলি হল,
ধাপ ১ঃ নমুনা সংগ্রহ
গলা এবং অনুনাসিক রস (sputum and nasopharangyal swab) একটি নির্বীজিত (sterilized) swabs এর মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয়, এবং একটি ভাইরাস স্থানান্তর মাধ্যমের ( virus-transposing medium ) মধ্যে নমুনাটি ল্যাব এ প্রেরণ করা হয়।
ধাপ ২ঃ RNA পৃথকীকরণ
স্পুটাম বা অনুনাসিক রস থেকে মানব শরীর এর বিভিন্ন প্রোটিন, DNA প্রভৃতির মধ্যে থেকে অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন করে RNA পৃথকীকরণ করা হয়ে থাকে। আরএনএস (RNAse) প্রোটিন এর প্রতুলতা RNA কে অস্থিতিশীল করে তোলে। সঠিক উপকরণ এর উপস্থিতি তে সঠিক পদ্ধতি (ইনকিউবেসন ও সেন্ত্রিফুগ্যাশান), তেই RNA কে আলাদা করা যায়। এখন বিভিন্ন ফারমাসিউটিকল কম্পানি সহজে (কিছু সতর্কতা অবলম্বন করে) RNA পৃথকীকরণ এর কিট বিক্রয় করে থাকে। পৃথকীকৃৎ RNA এর একটি সল্প অংশ ই ভাইরাল RNA বাকি সবটাই মানব শরীরের RNA.
ধাপ ৩ ঃ সংশ্লেষণ –সম্প্রসারণ – নিরধারণ
রিভার্স ট্রান্সক্রিপসন বিক্রিয়া: cDNA বা পরিপূরক DNA সংশ্লেষণ
রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেস প্রোটিন (এনজাইম) এর উপস্থিতি তে, RNA এর ৩’ অন্তে oligo dT প্রাইমার কে সংযুক্ত করে, ডিঅক্সি নিউক্লিওটাইড সহায়তায় RNA থেকে cDNA বা পরিপূরক DNA সংশ্লেষ করা হয়। এখানেও মানব cDNA এর তুলনায় ভাইরাল cDNA এর সংখ্যা নগণ্য।
পিসিআর বিক্রিয়া: ভাইরাল cDNA সম্প্রসারণ
পিসিআর হল এমন একটি বিক্রিয়া যা নির্দিষ্ট ডিএনএ অংশ খুব দ্রুত সংখ্যায় বৃদ্ধি করে।
এই ধাপ এ পৃথাকিকৃত ভাইরাল cDNA তার পরিপূরক প্রাইমারে র উপস্থিতি তে, উপযুক্ত পরিমাণ ডিঅক্সি নিউক্লিওটাইড (যা ডিএনএ চেইন বানাবার উপকরণ) , ম্যাগনেসিয়াম লবণ, পলিমারেস প্রোটিন এনজাইম সহায়তায় সঠিক তাপমান চক্র বজায় থাকলে তবেই ভাইরাল cDNA সংখ্যা সম্প্রসারণ হয়। ৩০ থেকে ৪০ টি বিক্রিয়া চক্রের পরেই সেই সংখ্যক DNA তৈরি হয় যা পরবর্তী বিশ্লেষণ এ ব্যবহার করা যায়।
জেলইলেক্ট্রফোরেসিস এর সহায়তায় জানতে পারা যায় যে DNA এর সঙ্খ্যা সম্প্রসারণ হয়েছে সেটি ভাইরাল cDNA কিনা। বিক্রিয়া র সাথে সাথে ডিএনএ এর সংখ্যা নির্ণয় করা হয় ফ্লুরেসেন্স প্রযুক্তি র সাহায্যে। এর জন্যে ই এই প্রক্রিয়া কে রিয়াল টাইম পিসিআর বা rt PCR ও বলা হয়।
রিয়েল টাইম ফ্লুরেসেন্স আনালিসিস: ফলাফল এবং সিদ্ধান্ত
একবার পিসিআর মেশিনে পর্যাপ্ত পরিমানে ডিএনএ উদপাদিত হলে এটি সনাক্ত করার জন্য প্রস্তুত। এইবার পরীক্ষ্যা-নল বা টেস্ট-টিউবে একটি ফ্লুরেসেন্ট রঞ্জক (fluorescent dye) বা প্রোব যুক্ত করা হয়। যদি ডিএনএ উপস্থিত থাকে তবে ফ্লুরেসেন্ট রঞ্জক- টি ডিএনএ এর বিশেষ double helix সজ্জা র ভিতরে প্রবেশ করে প্রতিপ্রভা সৃষ্টি করে এবং -এটি আলোক বিচ্ছুরণ শুরু করে। ডিএনএর অনুলিপিগুলির সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে প্রতিপ্রভা আলোকের প্রবলতা ও বাড়তে থাকে। পিসিআর মেশিনে একটি বিশেষ শনাক্তকরণ পরিমাপ যন্ত্র এর সাহা্য্যে নমুনাগুলিতে ভাইরাস এর উপস্থিতি ও পরিমাণ নিরধারণ করা যায়।
সতর্কতা এবং নির্ভুলতা
উপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করলে তবেই ওপরের বিস্তারিত বিক্রিয়া গুলি থেকে নির্ভর যোগ্য ফলাফল পাওয়া যায়। আরএনএ একটি অস্থায়ী জেনেটিক উপাদান। সমস্ত উপকরণ থেকে আরএনএস এনজাইম বিতারন করা খুব জরুরি। এ ছাড়া নিয়মানুযায়ী সমস্ত উপকরন ও যন্ত্র নির্বীজ প্রক্রিয়ন তো আছেই। পিসিআর বিক্রিয়ার গুনগত মান নির্ণয় এর জন্যে ও উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণ বিক্রিয়ার নির্বাচন ও জরুরি।
কতক্ষণ লাগে COVID19 সনক্তিকরণ পরীক্ষা ফলাফল জানতে?
COVID19 সনক্তিকরণ ফলাফল জানতে ২৪ ঘণ্টা লেগে যায়। কেন এতক্ষন লাগে তা জানতে হলে জানা দরকার বিভিন্ন ধাপ গুলি করতে কতক্ষন লাগে।
যেকোনো আরএনএ ভাইরাস শনাক্তই-করণ এর প্রধান দুটি ধাপ হল (ক) আরএনএ থেকে রিভার্স ট্রান্সক্রিপটেস প্রোটিন এর সাহায্যে সিডিএনএ (cDNA) সংশ্লেষণ যা করতে ১-১.৫ ঘণ্টা লাগে। (খ) পিসিআর বিক্রিয়া র মাধ্যমে স্নতোষজনক পরিমাণে ডিএনএ সংখ্যা বৃদ্ধি করতে আরও ১.৫-২ ঘণ্টা। আরএনএ নিস্কাশন পদ্ধতি টিও করতে ৪৫ মিনিট সময় লাগে। আইসিএমআর এর প্রেস বিবৃতি অনুযায়ী এখন কার পরিস্থিতি তে ৪.৫ ঘণ্টায় ফলাফল জানা সম্ভব কিন্তু নমুনা পরিবহণ, পর্যাপ্ত সংখ্যা য় নমুনা সংগ্রহ এবং ফলাফল এর গুণগত মান বজায় রাখতে গেলে সময় বেড়ে যায়। কিন্তু এখন আরও অনেক কম সময়ে, ফলপ্রদ পরীক্ষার দরকার।
ভারতে বর্তমানে প্রতিদিন ১০,০০০ টি নমুনা পরীক্ষা করার ক্ষমতা রয়েছে এবং এখন পর্যন্ত প্রতিদিন প্রায় ৬০০-৭০০ নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
২ https://www.mohfw.gov.in/awareness.html
৩ https://www.wbhealth.gov.in/uploaded_files/corona/Dg.pdf
অসাধারণ ।
এটিকেই খুঁজছিলাম।
করোনা, ইমিউনিটি ও টিকে থাকার লড়াই
একটি ভাবনা
ডাঃ দেবাশিস বক্সী
এম.বি.বি.এস. (কল), আকুপাংচার বিশেষজ্ঞ(চীন)
ইন্ডিয়ান রিসার্চ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টিগ্রেটেড মেডিসিন(ইরিম), মৌরিগ্রাম, হাওড়া
মো: 98311-11317;
আকাশ এখন ঝকঝকে নীল, বাতাসে তেল ধোঁযার গন্ধ নেইI এরকম গ্রামাঞ্চলে কিছুটা থাকলেও শহরে নগরে কখনই দেখা যায় নিI চার তলা ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে সকাল পৌনে সাতটায় হাঁটতে গিয়ে দেখতাম আশেপাশের বাড়ীগুলো যেন হাল্কা ধোঁয়ার আবরণে ঢাকাI গায়ে রোদ লাগাবো বলে হাল্কা রোদ উঠতেই ছাদে চলে যেতামI কারণ কাজে যাওয়ার তাড়ায় এরপর আর দেরী করা যেত নাI সময়টা মার্চ এপ্রিল মাস, তাতেও রোদ পেতে এত দেরীI কিন্তু দিন দশেক হলো চিত্রটা বদলে গেছেI যবে থেকে লকডাউন শুরু হলো সকাল ছ’টা বাজতেই রোদের দেখা, আর সাড়ে ছ’টায় চারিদিক রোদে ঝলমল করছে, কি তার তেজI আশেপাশের বাড়ীগুলো সব পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কোন ধোঁয়ার আবরণ নেইI কথাগুলো বলছিল সুতপা, থাকে কলকাতা শহরেI পাঠক পাঠিকারা ভাববেন এই সব কথার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটির কি সম্পর্ক আর টিকে থাকার লড়াই কোথায় হলো? হ্যাঁ সম্পর্ক আছে, লড়াইও হচ্ছেI
‘ইমিউনিটি’, ‘লকডাউন’ এগুলো ইংরাজী শব্দ হলেও সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বারংবার ব্যবহারে আর বাংলা মানে করে বোঝাতে লাগে না| করোনা ভাইরাসের আক্রমনে সারা দেশ লকডাউন বা তালাবন্ধ, পৃথিবীও| কারণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই রোগকে বিশ্বমহামারী ঘোষনা করেছে| এর আগেও সার্স, মার্স, বার্ড ফ্লু, সোয়াইন ফ্লু ইত্যাদি ভাইরাসের আক্রমন হয়েছে, বহু প্রাণ শেষ হয়ে গেছে| আর এখন করোনা ভাইরাসের আক্রমনে সারা পৃথিবী জুড়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে| আশা করা যায়, কিছুদিন পর এই তান্ডব থেমে যাবে| মানুষ আবার স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে আসবে| কিন্তু মানব সভ্যতা ঠিক এইভাবেই চললে ভবিষ্যতে যে আবার কোন ভয়ঙ্কর ভাইরাসের মহামারী আক্রমন হবে না তা কেউ বা কোন সংস্থা নিশ্চিত করে বলতে পারে না| তার মানে আবার মৃত্যুমিছিল, মহামারী, লকডাউন অর্থাত্ এখন যা ঘটছে তার পুনরাবৃত্তি হতেই পারে|
আর এই বিপদগ্রস্ত অবস্থার মধ্য দিয়ে সমগ্র পৃথিবী চলছে| একজন মানুষের নিজের যেমন সার্বিক ভারসাম্য নষ্ট হলে অসুখ হয়, তেমনই পৃথিবীর ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে বরং বলা ভালো আমরাই যুগ যুগ ধরে এই ক্ষতি করে চলেছি| দিনের পর দিন লকডাউন চলছে, সারা পৃথিবী তালাবন্ধ, আমরা কেউ জানিনা আরও কত দিন এই বন্ধ দশা চলবে| সুতরাং এই পুনরাবৃত্তি না হওয়ার লড়াইযে যে জিতবে সেই বেঁচে যাবে, টিকে থাকবে|
কিন্তু এই টিকে থাকার লড়াই তো একদিনের নয় বা নির্দিষ্ট কিছুদিনেরও নয়| এই লড়াই হ’ল সবারই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার লড়াই| তার জন্য প্রতিদিন কিছু সুস্থ অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে| অর্থাত নিজেকে সুস্থ রাখার জন্য বা যতদিন বাঁচব ততদিন দৈহিক, মানসিক ও সামাজিক সবরকমের সুঅভ্যাস চর্চা করতে হবে, তা যেমন প্রতিটি ব্যক্তির তেমনি সামাজিক|
তাই টিকে থাকার লড়াইয়ে কেবল নিজেকে বা নিজের পরিবারকে নিয়ে ভাবলে হবে না, প্রকৃতিকেও টিকিয়ে রাখতে হবে| প্রকৃতি আমাদের থাকতে দিয়েছে, সুতরাং ধ্বংস করে নয়, বরং তাকে সুরক্ষিত রেখে, ভারসাম্য বজায় রেখে তারই সম্পদ যেমন সূর্যের আলো, বাতাস, জল, মাটি ব্যবহার করে আমরা সুস্থ থাকতে পারি|
আসুন কয়েকটা অতি সাধারণ কাজ আজই শুরু করি যেমন:
সকালে গায়ে হাল্কা রোদ লাগিয়ে আধঘন্টা হাঁটা বিশেষ উপকারী| এতে শরীরে ভিটামিন ডি তৈরী হয়, যা হাড়গুলোকে মজবুত করে| এটা অনেকেই জানে এমনকি ছোটরাও বায়োলজি বা শরীর বিজ্ঞানের বইতে পড়ে| কিন্তু বইপড়া জ্ঞানকে বাস্তবে নিজের জীবনে কাজে না লাগালে কী লাভ হ’ল| আধুনিক জীবনে এইসব অভ্যাস তো নেই বললেই চলে| হাঁটা, ব্যায়াম, যোগাসন, মাঠে খেলাধুলা বা দৌড়ঝাঁপ, স্কিপিং, সাঁতার কাটা ইত্যাদি প্রতিদিনের রুটিনে আনতে হবে| আর এই শরীর চর্চা ছোট বয়স থেকেই শুরু করতে হবে| বেশীরভাগ মা বাবা সন্তানদের এই দিকটায় কোন গুরুত্বই দেন না, তাদের কেরিয়ার গঠনের জন্যই মনোনিবেশ করেন| ফলে তাদের ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা উপযুক্তভাবে গড়ে ওঠে না| তাই ঋতু পরিবর্তন বা পরিবেশে ঠান্ডা গরমের সামান্য তারতম্যে সর্দি কাশি জ্বর হয়, আসলে প্রথম আঘাতটাই আসে শ্বাসতন্ত্রের ওপর কারণ শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে সরাসরি পরিবেশ থেকে বাতাস নেওয়া ছাড়ার কাজ চলে| তাই নিয়মিত শরীর চর্চা ও প্রাণায়াম বা শ্বাসের ব্যায়াম করতে পারলে শ্বাসতন্ত্র ও তার প্রধান অঙ্গ ফুসফুস শক্তিশালী হবে| বর্তমান পরিস্থিতিতে এই করোনা ভাইরাস প্রথমে কিন্তু শ্বাসতন্ত্রের ওপরের অংশেই আক্রমন করে| সুতরাং এই আক্রমনের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে হলে শ্বাসতন্ত্রকে বেশ শক্তিশালী হতে হবে| ভবিষ্যতে চরিত্র বদল করে আরও নতুন নতুন ভাইরাস আক্রমন ঘটাতেই পারে, তার বিরুদ্ধে নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হলে এই সমস্ত অভ্যাসগুলো নিয়মিত চর্চা করতেই হবে| এটাই হ’ল টিকে থাকার লড়াই| আর এই সচেতনতা বোধ বড়দের মধ্যে প্রথমে জাগরিত হওয়া দরকার, তবেই ছোটরা শিখবে| এতক্ষণে নিশ্চয়ই লেখার শুরুতেই সুতপার কথাগুলোর সঙ্গে লেখার টাইটেল বা হেডিং এর সম্পর্ক বোঝা গেছে|
এবারে আসি রোজকার খাওয়া দাওয়ার অভ্যাসে| জাঙ্ক ফুড ও ফাস্ট ফুড নিয়ে বিস্তারিত বলছি না| কারণ ছোট বয়স থেকেই এইসব খাওয়ার অভ্যাস আছে বলে সকলেই এই বিষয়ে খুব ভালো জানেন| মানুষ বোঝেন নেশার বস্তু কত ক্ষতি করে, তাও তো নেশা করেন| এই জাঙ্ক ফুড ফাস্ট ফুডও তাই, এক নেশার বস্তু| সুতরাং না সচেতন হলে তার ক্ষতিকর ফল ভোগ করতেই হবে| বরং ইতিবাচক দিকটায় আলোকপাত করাই ভালো| এই ‘করোনা’ পর্বে বিভিন্ন আলোচনায় শুনছি পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, ইমিউনিটি বাড়ানোর খাবার খেতে হবে| হ্যাঁ, কথাটা ঠিক, কিন্তু তা তো রাতারাতি হবে না| ইমিউনিটি একদিনে বা কয়েকটা দিনে তৈরী হয়না| এটা একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে চলে| অর্থাত আবার সেই প্রতিদিনকার খাদ্য তালিকার রুটিনে উপকারী বা পুষ্টিকর ইমিউনিটি বৃদ্ধিকারী খাবারগুলোর জায়গা দিতে হবে| কিছু উদাহরণ দিই, যেমন এক টুকরো কাঁচা হলুদ, একমুঠো অঙ্কুরিত গোটামুগ বা ছোলা, ছাতুর সরবত, সময়ের ফল ও শাক সব্জী, ভৌগোলিক ক্ষেত্রবিশেষে উপকারী শস্যদানা যেমন চিঁড়ে, মুড়ি, ডালিয়া, মিলেট, ওট ইত্যাদি| ভাত, আটার রুটি, ডাল, আমিষ নিরামিষ প্রোটিন জাতীয় খাবারের নিয়মিত তালিকায় এইগুলোর সংযোজন করা দরকার| যত বেশি প্রাকৃতিক, সম্ভবহলে জৈব পদ্ধতিতে উত্পন্ন, খাবার খাওয়া যায় ততই স্বাস্থ্যের পক্ষে উত্তম, আর ক্ষতিকর খাবারগুলো যতটা সম্ভব বর্জন করাই ভালো| প্রাণীজ প্রোটিন বেশি বেশি করে খাওয়াও (বিশেষ করে অর্ধ সিদ্ধ বা অর্ধ পুড়িয়ে) আজকের সভ্যতার একটা ঝোঁক- তাতেও উপকার থেকে অপকার বেশি|
আগেই বলেছি নিজেকে সুস্থ রাখতে হলে পরিবেশকেও নিরাপদে রাখতে হবে| যত বেশি আমরা পরিবেশের দুষণ করব, ততই নিজেদের বিপদ ডেকে আনবো| সুতরাং জীবনধারণের ন্যূনতম চাহিদা বা প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিয়ে অল্পতেই সন্তুষ্ট থাকাই ভালো| এখানে নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, তাতে মন ভালই থাকবে, আর মন ভালো থাকলে তো শরীরও ভালো থাকবে| প্রতিটি বিষয় পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত, কোনোটিই একক ভাবে স্বয়ংসম্পুর্ণ নয়|
সুস্থতা বজায় রাখার জন্য আরো কিছু উপায়:
ওষুধবিহীন রোগ প্রতিরোধমূলক চিকিত্সাপদ্ধতি অবলম্বন করা যায় যেমন, শরীরে নির্দিষ্ট কিছু জায়গায় যেগুলো আকু বিন্দু বলে পরিচিত সেগুলোতে নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে চাপ দেওয়া বা এক ধরনের ভেষজ (যা মক্সা নামে পরিচিত)-এর মাধ্যমে তাপ প্রয়োগ করা ইত্যাদি| এগুলো হ’ল পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াহীন, খুবই সামান্য খরচে সহজে শিক্ষনীয় চিকিত্সাপদ্ধতি| এগুলো শিখে নিয়ে নির্দিষ্ট নিয়মে করতে পারলে রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতা তথা ইমিউনিটি বাড়বে, ফলে টিকে থাকার লড়াইয়ে ধাপে ধাপে এগোনো যাবে| আকুপাংচার চিকিত্সা শাস্ত্রে রোগ প্রতিরোধমূলক চিকিত্সার বহু উল্লেখ আছে যা ইতিমধ্যে বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত এবং সাম্প্রতিককালে বিশেষভাবে আলোচিত|
এই প্রসঙ্গে দুটো উদাহরণের কথা বলি| যুবক বয়সে একজন টিউবারকিউলোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন, উপসর্গহীন থাকায় প্রথমে ধরা পড়েনি, পরে কাশির সঙ্গে রক্ত পড়ায় উপযুক্ত পরীক্ষায় রোগ নির্ণয় হয়| বুকের এক্সরেতে ফুসফুসে ক্ষত দেখা যায়| টি.বি.-এর ওষুধপত্রের সঙ্গে আকুপাংচার চিকিত্সা শুরু হয়| ওষুধের কাজের নির্দিষ্ট সময়সীমার আগেই উনি দ্রুত সেরে ওঠেন| পুনরায় এক্সরেতে দেখা যায় ফুসফুসে ক্ষত মাত্র কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভালো হয়ে গেছে|
এক মাঝবয়সী ভদ্রমহিলার ব্রেস্ট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার পর অপারেশনের পরে রুটিনমাফিক কেমোথেরাপি ও রেডিয়েশন চিকিত্সা হয়| প্রথম থেকেই এর পাশাপাশি আকুপাংচার ও অন্যান্য প্রকৃতিমুখী চিকিত্সাও শুরু করে দেওয়া হয়| কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই সব কটি চিকিত্সার সম্পূর্ণ কোর্স নিতে তিনি সক্ষম হ’ন|
উভয়ক্ষেত্রেই দেখা গেছে, ইমিউনিটি বাড়ার পরে রোগ নিরাময় দ্রুত হয়েছে, ওষুধ ভিত্তিক চিকিতসার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া প্রায় হয়নি, পুনরাক্রমন হয়নি|
এইরকম আরও অনেক রকম রোগে আকুপাংচার সহ অন্যান্য প্রকৃতিমুখী চিকিতসার উপকারিতা তথা রোগ প্রতিরোধী ও সারিয়ে তলার ক্ষমতা কার্যক্ষেত্রে প্রচুর দেখেছি|
করোনা ভাইরাসের মহামারী আক্রমণ দিয়ে প্রকৃতি আমাদের সতর্ক করলো, বুঝিয়ে দিল তার ভারসাম্য নষ্ট করে তাকে অসুস্থ করে তুললে আরও ভয়ানক বিপদ ঘনিয়ে আসবে| সুতরাং অসুস্থ প্রতিযোগিতা, মারামারি হানাহানি না করে প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভালোবেসে মিলেমিশে সহাবস্থান করাই শ্রেয়| এতে সামগ্রিক ভারসাম্য বজায় থাকবে আর মানবজাতিও টিকে থাকার লড়াইয়ে অস্তিত্ব বজায় রাখবে|
১৬ এপ্রিল, ২০২০