সাম্প্রতিক অসমের কোকরাঝাড়ে যে দাঙ্গা ঘটে গেল এবং ছড়িয়ে গেল পাশের বোড়োল্যান্ড টেরিটোরিয়াল কাউন্সিলের জেলাগুলিতে, তার পরিপ্রক্ষিতে আবার নতুন করে "বেআইনী অনুপ্রবেশ"এর হাওয়া উঠেছে বিভিন্ন বিতর্ক সভায়, এমন কি লোকসভাতেও।
ব্যাপারটা আরো ঘোরালো হয়ে পড়ল মুম্বাইতে "প্রতিবাদ"এর নামে যে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটল, আর কিছু "প্রতিহিংসার আক্রমণ" যার শিকার হল উত্তর পুর্বের কিছু বাসিন্দা। লজ্জাকরভাবে অজ্ঞ অথবা খোলাখুলিভাবে উদ্দেশ্যমূলক প্রচারেরও ঢেউ বয়ে গেল - ইলেকট্রনিক ও ছাপা সংবাদমাধ্যমে। এই সমস্ত বিতর্কের মুল যা প্রতিপাদ্য ছিলো সে হলো তিনটি বিষয়ঃ
প্রথমতঃ উত্তরপুর্ব ভারতে বাঙালী মুসলিমদের ক্রমাগত অনুপ্রবেশ, যার ফলে অসমের সীমান্ত অঞ্চলের জনসংখ্যায় একটি অস্বাভাবিক ঝোঁক এবং ফলাফলে অনেকগুলি জেলায় মুসলিম সংখ্যাধিক্য হয়ে যাওয়া।
দ্বিতীয়তঃ এইসব বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীরা স্থানীয় মানুষদের হটিয়ে তাদের জমি দখল করে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করছেন যে, যে কোনো সময়েই বড়সড় দাঙ্গা হাঙ্গামা ঘটে যেতেই পারে।
আর তৃতীয়তঃ, এই যে জাতিদাঙ্গা ঘটে গেল মুসলিম ও বোড়ো উপজাতি (হিন্দু বোড়ো, এটা খুব জোর দিয়ে বলেছেন ইলেকশন কমিশনার শ্রী এইচ এস ব্রহ্মা, যিনি ঐ সম্প্রদায়েরই মানুষ), সেটির মুলেও ঐ বাংলাদেশী মুসলমানেরাই। তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকায় তাদের স্পর্ধাও বাড়তে থাকে। তারাই শুরু করেছিল এই সংঘর্ষ। বা খুব কম করে বললেও ঐ অনুপ্রবেশকরীদের আগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে এবং ক্রমাগত জমি ও সম্পদ হারানো স্থানীয় মানুষদের এটি একটি স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফুর্ত প্রতিক্রিয়া মাত্র।
এই সব ধারণাগুলিই কিন্তু নিছক মিথ্যা রটনা। আর সেটা কেন, তা বুঝতে গেলে আমাদের আবার নতুন করে পরীক্ষা করে দেখতে হবে তথ্য সারণী। কেমন ভাবে এই ভুল ধারণাগুলি দানা বাঁধল এবং কী সব ভুল তথ্যের ভিত্তিতে এই অপপ্রচার চলল – এইসব।
তথ্য একঃ "বেআইনী অনুপ্রবেশ" নয়, পরিকল্পিত "দেশান্তর যাত্রা"ই এই মুসলিম জনসংখ্যার অস্বাভাবিক বৃদ্ধির কারণ।
হ্যাঁ, বাঙালী মুসলিম চাষীরা পুর্ব বাংলার থেকে অসমে গেছিলেন এবং তার ফলে সীমান্ত অঞ্চলের কয়েকটি জেলায় মুসলমান অধিবাসীদের সংখ্যা অনুপাতে অনেক বেশি বেড়ে যায়, এটি সত্যি ঘটনা। মিথ্যা রটনা যেটা হয়েছে সেটি এই যে বাংলাদেশ থেকে"বেআইনী অনুপ্রবেশ"এর ফলেই এই ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। আর এই রটনা শুধু একটি বিচ্যুতি নয়, এটি ইচ্ছাকৃত তথ্য বিকৃতি।
এই যে রটনা যে বাংলাদেশ থেকে একটানা ও প্রচুর অনুপ্রবেশের ফলেই সীমান্তের গ্রামে মুসলিমদের আনুপাতিক বৃদ্ধি এত বেশি হয়েছে সেটি হচ্ছে ১৯৫১ সাল থেকে ভারতীয় সেন্সাস এর দশকীয় তথ্য। নীচের সারণীটা দেখুন।
Table 1 |
||||||
Percentage Decadal Variation in Population since 1951 in India and Assam |
||||||
1951-61 |
1961-71 |
1971-81 |
1971-91 |
1991-01 |
01-2011 |
|
India |
21.64 |
24.80 |
24.66 |
54.41 |
21.54 |
17.64 |
Assam |
34.98 |
34.95 |
- |
53.26 |
18.92 |
16.93 |
Dhubri |
43.74 |
43.26 |
- |
45.65 |
22.97 |
24.40 |
Dhemaji |
75.21 |
103.42 |
- |
107.50 |
19.45 |
20.30 |
Karbi Anglong |
79.21 |
68.28 |
- |
74.72 |
22.72 |
18.69 |
Table 1: Percentage Decadal Variation in Population since 1951 in India and Assam
যদি আমরা আসামের মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আর সেই সময়ে পুরো ভারতবর্ষের সংখ্যাও দেখি এবং খেয়াল রাখি যে একমাত্র আসামেই ঐতিহাসিক কারণে বহু বছর ধরেই মুসলমান চাষিরা দেশান্তরী (মাইগ্রেট) হয়ে বসবাস করছেন, পার্টিশন হবার আগের থেকেই এবং মাথায় রাখি যে সেটা শুরু হয়েছিল বৃটিশ আমলে ১৮০০ সাল থেকে, তাহলে বুঝতে পারব এই একমুখী জনস্রোত প্রায় আবহমান কাল ধরেই চলে আসছে।
যেমন ধরুন, ধুবরি জেলা। এটি বাংলাদেশের গা ঘেঁষা। সর্বমোট ২৭টি জেলার মধ্যে ধুবরি জেলাতেই মুসলিমদের আনুপাতিক সংখ্যা সবথেকে বেশী (৭৪.৩%)। এটা দেখলে এই কথা ভাবা খুবই স্বাভাবিক যে এই সংখ্যাবৃদ্ধি ঘটেছে "বেআইনী অনুপ্রবেশ"এর জন্যেই। কিন্তু এই দশকীয় বৃদ্ধির হার কি সম্পুর্ণভাবে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকে একেবারে ১০০% সঠিক করে চিহ্নিত করে?
তার সাথে এটাও দেখুন যে ১৯৭১ সাল থেকেই এই বৃদ্ধির হার কিন্তু কমে এসেছে, এমন কি সর্বভারতীয় হারের থেকে এটি কম। আসাম অ্যাকর্ড অনুযায়ী শুধুমাত্র ১৯৮৫ সালের পরবর্তীকালে যারা আসামে ঢুকেছে তারাই "অনুপ্রবেশকারী' হিসেবে চিহ্নিত হবে। কিন্তু এই সারণী দেখে এটা কি পরিষ্কার নয় যে মুল ইনফ্লাক্স ঘটেছিলো ১৯৭১'র আগেই এবং সেই জন্যেই এটিকে বেআইনী অনুপ্রবেশ বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না।
যেমন ধরুন অসমের আরো দুটি জেলার দশকীয় জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার যদি দেখি তা হলে দেখবেন যে দুটি জেলায়, ধেমাজী আর কার্বি অ্যাংলং - এইখানে মুসলিম জনসংখ্যা বেড়েছে অসমের গড়ের থেকে প্রায় দুগুণ বেশি, এমন কি ধুবরির মতন "মুসলিম সংখ্যাধিক" সীমান্ত জেলার থেকেও বেশী। অথচ ঐ দুটি জেলায় মুসলিম জনসংখ্যা নামমাত্র (যথাক্রমে ১.৮ ও ২.২%)। অথচ এই দুই জেলাতেই মুসলিম সংখ্যা বৃদ্ধির দশকীয় হার - ধেমাজী জেলায় (১৯৬১-৭১) হছে ১০৩.৪% আর কার্বি জেলায় ১৯৫১-৬১ দশকে সেটি বেড়েছিলো ৭৯.২% হারে। তার মানে বোঝাই যাচ্ছে যে "অনুপ্রবেশ" ছাড়াও মুসলিম জনসংখ্যা বেড়ে যাবার আরো কারণ থাকতে পারে।
এইসব তথ্য বিশ্লেষণ করলেই এটা পরিষ্কার বোঝা যায় যে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে গেলেই অমনি সেটাকে বাংলাদেশী "অনুপ্রবেশ"এর ফলাফল বলে দাগিয়ে দেওয়া যায় না। এছাড়াও দেখুন অসম আর বাংলাদেশের কমন সীমান্ত এরকম জেলা আছে তিনটি আর অন্যদিকে মিজোরামের পাঁচটি জেলা বাংলাদেশের সীমান্তে, এবং সেখানে মুসলিম জনসংখ্যা সামান্য। বোঝাই যায় যে বাংলাদেশের সীমান্তে থাকলেই অমনি সেটি বাংলাদেশী 'অনুপ্রবেশ'এর শিকার হয়ে যায় না।
তাহলে কোনটা সত্য ?
সেই ১৮০০ সাল থেকেই বাঙালি মুসলমানেরা অসমে চলে আসছিল আস্তানা গাড়তে। ১৮২৬ সালে বার্মাকে যুদ্ধে হারিয়ে ইয়ান্দাবু চুক্তি হয় ও অসম বৃটিশ ভারতের অধীনে আসে। বেঙ্গলে এই বৃটিশ রাজ যে ক্ষতিকর আইনকানুন চালু করছিলেন যেমন "চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত" - তার ফলে জমিদারী শোষণ নীতি আরো জোরালো হল আর ছোটো কারিগর আর হস্তশিল্পীরাও দেউলে হয়ে পড়ল। অর্থনীতির একটি সার্বিক পতন ঘটলো। যে অঞ্চলটি অসমের সীমান্তবর্ত্তী ছিলো সেগুলিতে লোকজন অল্পই ছিল, জমিও ছিল প্রচুর আর জমিদারীপ্রথাও ছিল অনুপস্থিত। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এই হয়রান হয়ে যাওয়া মানুষের দেশান্তরগমন নিতান্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়া ছোটো ধারার থেকে একেবারে জনস্রোতে পরিণত হল। এটাতে বৃটিশরাজেরও কিছুটা মদত ছিল। এই বিশাল অঞ্চলে আবাদ হলে তাদেরও রাজস্ব বাড়ে। এবং ঐ এলাকায় এমনিতে শ্রমিকের অভাব, সেই সমস্যার সমাধানও হয়। এই কারণে এই অভিবাসীদের কিন্তু অসমের জমির মালিকেরাও বেশ উৎসাহ নিয়েই অভ্যর্থনা করেছিল।
কিন্তু বিংশ শতকের মাঝামাঝি এসে ছবিটা বদলে যেতে থাকল। এই একটানা একমুখী জনস্রোত একটা আশঙ্কার পরিস্থিতি তৈরী করছিল। ফলে সীমান্ত জেলা, যেমন নওঁগা, কামরূপ আর গোয়ালপাড়াতে একটি "লাইন সিস্টেম" চালু হল। স্থানীয় জমিতে আস্তানা বাঁধবার একটা সীমারেখা করে দেওয়া হল আঞ্চলিক মানুষদের মালিকানার ভিত্তিতে। এই ব্যবস্থার ফলে এই তিন জেলায় এক বিশাল ভুখন্ড জুড়ে বিপুল সংখ্যক বাঙালী মুসলমান স্থায়ী ডেরা বাঁধে পার্টিশন বা স্বাধীনতার অনেক আগেই।
এই দেশান্তরযাত্রার এক একটি পর্বে নতুন নতুন করে বাধা নিষেধ বসতে থাকল। আর যথেচ্ছ আবাদী জমি দেওয়া হচ্ছিল না এদের। তার বদলে জলা জমি বা ব্রহ্মপুত্র নদের চরজমিতে (চাপোরি), বা বাৎসরিক বানভাসি এলাকায় এদের বসবাসের অনুমতি দেওয়া হল। আর সেই সময় থেকে আজ প্রায় কয়েকশো বছর কেটে গেছে, সেই আদি অভিবাসীদের বর্তমান প্রজন্মের বহু মানুষ এখনো ঐ সব অঞ্চলেই রয়ে গেছেন। বন্যায় চর ভাঙে আবার নতুন করে ওঠে, পাড়ের জমি তলিয়ে যায় নদীতে, বন্যায় প্রতিবছর ডুবে যায় পাড়ের বসবাস। এ ভাবেই একেবারে একবারে নিয়মিত ভাবে ঘরছাড়া হন এই মুসলমান দেশান্তরীরা। তখন জীবন চালাতে এরা পৌঁছে যান শহর অঞ্চলে, কাজ নেন মিস্ত্রি বা রিক্সাচালকের, তরিতরকারির ছোট দোকানে। ঘিঞ্জি বস্তিতে থাকেন। আর শহরের লোকের চোখে এক একটি অনুপ্রবেশকারী আপদের মুর্তি হয়ে ওঠেন। নাগরিক বিত্তবানদের কাছ থেকে জোটে না কোনো সহানুভুতি বা কোনো বুঝবার প্রচেষ্টা যে কীভাবে কোন তাড়নায় এরা শহরে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
Table 2 |
||||||
Population in Percentage as per Religion and Language in Districts of Assam with Substantial Muslim Population as per Census of India 2001 |
||||||
Religion |
Language |
Decadal Growth Rate |
Population Density per SqKm |
|||
Muslim |
Hindu |
Assamese |
Bengali |
|||
Assam |
30.92 |
64.89 |
48.80 |
27.54 |
18.92 |
397 |
Dhubri |
74.29 |
24.73 |
70.07 |
24.15 |
22.97 |
941 |
Goalpara |
53.71 |
38.21 |
46.25 |
32.78 |
23.03 |
451 |
Barpeta |
59.36 |
40.19 |
47.00 |
44.67 |
19.62 |
521 |
Marigaon |
47.58 |
52.21 |
66.37 |
28.21 |
21.35 |
500 |
Nagaon |
50.99 |
47.79 |
60.22 |
31.23 |
22.26 |
583 |
Karimganj |
52.30 |
46.69 |
00.42 |
85.84 |
21.87 |
557 |
Hailakandi |
57.99 |
41.11 |
00.26 |
83.43 |
20.89 |
409 |
Cachar |
36.13 |
67.37 |
00.63 |
74.63 |
18.89 |
382 |
Bongaigaon |
38.52 |
59.17 |
42.61 |
38.78 |
22.09 |
355 |
Darrang |
35.54 |
57.73 |
39.15 |
30.76 |
22.18 |
411 |
TABLE 2: Population as percentage as per religion and language in districts of assam with substantial muslim population as per census of India 2001.
তাহলে দেখাই যাচ্ছে যে পার্টিশন ও স্বাধীনতার সময় থেকেই একটি বেশ ভালোরকম সংখ্যার দেশান্তরী মুসলিমেরা বসবাস শুরু করে দিয়েছেন নওগাঁ, গোয়ালপাড়া আর কামরূপ জেলায়। এই সব মানুষদের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং প্রচলিত জীবনধারার জন্যই এদের পরের প্রজন্মের সংখ্যাবৃদ্ধিও প্রচুর ছিল। কোনো রকম "অনুপ্রবেশ"এর তত্ত্ব ছাড়াই এই অস্বাভাবিক সংখ্যা বৃদ্ধিকে মেনে নেওয়া যেতে পারে।
"অনুপ্রবেশকারীরা নিজেদের ধর্মের লোকেদের মধ্যে লুকিয়ে ছিল সেই পার্টিশনের সময় থেকেই" - এই ধরনের তত্ত্বকেও ঝট করে মেনে নেওয়া যায় না। কেন না এইসব জেলাগুলিতে এমনিতেই জনসংখ্যার চাপ ছিলো খুব বেশি এবং বেঁচে থাকবার জন্য প্রতিযোগিতাও ছিলো প্রচণ্ড। এখনো জমি জিরেত নিয়ে মামলা মোকদ্দমার আর মারপিটের ছড়াছড়ি। তো এই অবস্থায় কেই বা আবার নতুন করে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এই সব অনুপ্রবেশকারীদের খামোখা ডেকে আনবেন?
বর্তমানের মুসলিম গরিষ্ঠ এলাকাগুলিও কিন্তু সেই একই অঞ্চল যেখানে কয়েক প্রজন্ম আগেই দেশান্তরীরা ঘর বেঁধেছিলেন। সুতরাং 'অনুপ্রবেশকারী' নয়, এই নতুন প্রজন্মের মানুষেরা যারা ভারতের নাঅগরিক, তারাই এই জনসংখ্যাবৃদ্ধির হেতু। এটা আরো পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাবে যদি আমরা অসমীয় ভাষাভাষী জনসংখ্যার জন্য সেন্সাস তথ্যটি দেখি সারণী ২ তে।
পার্টিশনের সময়, মুসলিম দেশান্তরীদের একটি বড় অংশ ভারতবর্ষেই থেকে যেতে চেয়েছিল। এই ভবিষ্যতের লক্ষ্যে তাঁরাও চেষ্টা করছিলেন তাঁদের নতুন বসতির মানুষদের সাথে তাদের মিশে যাওয়া। এই ব্যাপারে তাদের প্রথম অভীষ্ট ছিলো অহমিয়া ভাষা শেখা। এক প্রজন্ম ধরে অহমিয়া ভাষার শুলে পড়ে তারাই এই নতুন ভাষাটিকে প্রকৃত অর্থে নিজেদের ভাষা বলেই মেনে নিয়েছিলেন। যেমন দেখুন ধুবড়ীতে- যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা ৭৪% সেখানে অসমিয়া ভাষীদের সংখ্যা ৭০%। কিন্তু যদি বরাক উপত্যকার তথ্য দেখেন তো দেখবেন সেখানে ব্যাপারটা একেবারে উল্টো। করিমগঞ্জ আর হাইলাকান্দিতে বাংলা ভাষাই, হিন্দু আর মুসলমানের, দু জনেরই মুখ্য ভাষা রয়ে গেছে। আর এই সময়ের মধ্যেই অনেক উপজাতির মানুষ, যারা আগে নিজেদের মাতৃভাষা অহমিয়া বলতেন তারা সেটা বদলে নিজেদের কথ্যভাষাকে সেই পরিচয় দিলেন। ফলতঃ অহমিয়া বলে আগে যারা চিহ্নিত হতো তাদের এখন নতুন ভাষাভিত্তিক পরিচয় শুরু হল।
এইসব জটিল ঐতিহাসিক তথ্য না বুঝেই শুধুমাত্র সেন্সাসের কয়েকটি তথ্যগুলিকে খামচা করে তুলে দেখেই চটজলদি সিদ্ধান্তে আসাটা কিন্তু উচিৎ নয়।
তা প্রায় একশো বছরেরও বেশি সময় এই দেশান্তরী আগন্তুকের দল ও আদি বসবাসকারীরা, অসমে কিন্তু বেশ মিলেজুলেই থেকেছেন। ছোটোখাটো সংঘর্ষ তো হতোই, জমি জিরেৎ নিয়ে, কিন্তু সেগুলি নেহাৎই স্থানীয় ঘটনা এবং খুব কমই ঘটেছে যে সেই স্থানীয় ঘটনা একটা বিশাল অঞ্চল জুড়ে জাতিগত বা ভাষাগত দাঙ্গায় পরিণত হয়েছে। দু এক ক্ষেত্রে যা ঘটেছে সেগুলি খুবই পরিকল্পিত ভাবে ঘটানো উষ্কানি, স্থানীয় মানুষ বনাম অভিবাসীদের মধ্যে এক বিচ্ছেদ ঘটানোর রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে।
আর এই "বেআইনী বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ" এর মিথকথা তৈরী হওয়ার আগের থেকেই শুরু হয়েছিলো আরেকটি শয়তানী গল্প - সেটি হচ্ছে "বহিরাগতদের" চাপে বিলীয়মান 'স্থানীয়' মানুষদের কথা। এর জন্য মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরা নয়, অন্য প্রদেশের হিন্দু যারা অসমে বসবাস শুরু করেছিলেন তারাই ছিলেন সেই আক্রমণের শিকার। না, জমির দখল নিয়ে সেই আন্দোলন ছিল না। সেটি দাঁড়িয়ে ছিল যে ভুল ভাবনার উপর সেটি হচ্ছে এই বাঙালি মধ্যবিত্তদের চাপে অহমিয়ারা তাঁদের জাতি পরিচয় ভুলে যাচ্ছেন। তাঁরা সরকারি চাকরিতে সুযোগ পাচ্ছেন না এবং স্থানীয় লোকেদের জন্য যে সুযোগ বা উপকার ছিলো সেগুলিও তাঁরা ভোগ করতে পারছেন না। আর এর ফলে ১৯৬০ সালে যা বঙাল খেদা আন্দোলন হয় তা শুধু শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বানানো কাহানীর ফল।
আর এই অহমিয়া মধ্যবিত্তশ্রেণীই ছিলেন অসমের রাজনীতির পুরোধা। স্বাধীনতার পরের তিন দশক ধরে যত সুবিধে ও ফায়দা, তাঁরাই ভোগ করে এসেছিলেন। কিন্তু ১৯৭০ নাগাদ স্থানীয় রাজনীতির ভরবিন্দু বদলাতে লাগলো এবং দিসপুরের সরকারের একাধিকবার পতন ঘটলো। একটি নতুন জোট দানা বাঁধতে লাগলো যার মধ্যে রয়েছে স্থানীয় উপজাতিরা এবং মুসলমান অভিবাসীরা। নীতির দিক দিয়ে এরা মোটামুটি বামপন্থী। (এই "অক্ষমিয়া" জোটের মুলধারা ছিলো এরা সকলেই অহমিয়াভাষী বলে পরিচয় দিত)। বামজোটই গুয়াহাটির মিউনিসিপ্যাল নির্বাচন জিতে যায় ও এর ফলে বিপদঘন্টি বেজে ওঠে। এর কিছুদিন পরেই "অসম আন্দোলন" শুরু হয়ে যায়।
খুব কম লোকেরই হয়তো মনে আছে, সুচনায় এই আন্দোলন কিন্তু এই "বেআইনী অনুপ্রবেশে'এর বিরুদ্ধে ছিল না, এটা সম্পুর্ন ভাবে ছিল "বহিরাগত"দের বিরুদ্ধে। সেই আন্দোলনের গোড়ার দিকে,অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন বা AASU এবং সরকারী প্রশাসন একযোগে এই "অবৈধ প্রবেশকারী"দের দূর করতে শুরু করেছিলেন। এই আন্দোলনের প্রথম শিকার কোনো অনুপ্রবেশকারী ছিল না। তাঁরা ছিলেন দুই বোড়ো ভাই, যাঁরা পালাতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। আসুর নেতৃত্বে একটি দঙ্গল উত্তর গুয়াহাটির ফুলং চাপরি থেকে এদের উৎখাত করতে এসেছং। উল্লেখ্য ১৯৮৫ সালের যে চুক্তির বলে এই হিংসাত্মক অসম আন্দোলন বন্ধ হয় তার শর্তবলে যে বর্ত্তমানের গুয়াহাটি আইআইটি অসমে প্রতিষ্ঠা হয় তা এই অঞ্চলের সামান্য দুরেই।
অনুবাদঃ দীপ্তেন
মূল লেখার লিংক