মাথার মধ্যে একটা নতুন চিন্তা এলেই মনটা কেমন আনচান করে ওঠে আড্ডার জন্যে! এই আবেগ কতক্ষণ চেপে থাকবেন তার ক্ষমতা অবিশ্যি একেকজনের একেকরকম কিন্তু অনুভূতিটা সবার ক্ষেত্রেই সত্যি। আমার দেশের বাড়ি ছিল কোচি ব্যাকওয়াটার এর একটা ছোট্ট দ্বীপ,কদমকুড়ি গ্রামে।আর গ্রামের কবি জোসেকুট্টন ছিল আমার একনিষ্ঠ শ্রোতা।আজ যখন পিছন ফিরে তাকাই বুঝতে পারি তার প্রতি আমি খুব একটা সমদর্শী ছিলুম না।মানে যখন তার বলার আর আমার শোনার পালা আসতো আর কী! তখন আমার ভূমিকা হত বিদ্যার্থীর মতো। বিদ্যার্থী চ্যাটার্জী। আমার বন্ধু-সমালোচক তথা এক চূড়ান্ত একপেশে শ্রোতা!
আমাদের গ্রামের কাছেই একটা সিনেমা হল ছিল। নাম “শ্রী দুর্গা”। নৌকো বেয়ে গেলে আধা ঘন্টার পথ।বেশ কিছু দিন বাদ বাদ মা আমাকে আর ছোটো বোন কে নিয়ে সেখানে যেতেন ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখতে। সঙ্গে এসে জুটতো ওনার আড্ডার সইরা।বেলা ৪ টে নাগাদ খাবার আর জল নিয়ে কদমকুড়ি থেকে রওনা হতে হত। মাঝির নাম ছিল “পট্টন”। গায়েঁর লোকের দেওয়া নাম। পট্টন ছিল কালা আর আধা বোবা।“কথা” বলতে আমরা যা বুঝি তা সে কইতে পারতো না কিন্তু কোনক্রমে মুখ দিয়ে কিছু শব্দ করে মায়ের সঙ্গে বাত্চিত চালিয়ে নিত। টানা ৩ ঘন্টা নৌকো চালানো যাতায়াত মিলিয়ে। এহেন পরিশ্রমের কাজে পট্টন ছাড়া কে যাবে? একটা ফ্রী টিকিট আর কিছু নির্ভেজাল আমোদের বিনিময়ে রাজি হয়ে যেত সে।
আমার মা খুব নাটকীয় ভঙ্গিতে গপ্পো বলতে পারতেন। নোনা জলের খাড়ির মধ্যে দিয়ে বৈঠা বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছি আমরা। চারিপাশে ঢেউ এর মতো পর পর চাইনিজ জাল বিছোনো। মাঝে মাঝে জল থেকে একটা গ্লোব্ব গ্লোব্ব শব্দ উঠছে। ঠিক তক্ষুণি শুরু হত মায়ের গপ্পো। বিষয় নতুন কিছু না। এই আধঘন্টা আগে যে সিনেমা টা দেখে এলুম সেটাই।অথচ দেখুন আজ এতদিন পড়ে সেই সিনেমা গুলোকে বিলকুল ভুলে গেছি কিন্তু মায়ের বলা গল্পগুলো ছবি হয়ে গেঁথে আছে আমার স্মৃতি তে। গুহাচিত্রের মতো। আর হঠাৎ হঠাৎ সেই বাচিক চলচ্চিত্র বা ওরাল সিনেমার মধ্যে ঢুকে পড়তো পট্টন। তার সেই অদ্ভুত হাত নাড়া –সংকেত আর অদ্ভুত সব আওয়াজ নিয়ে।তখন বৈঠা যেত থেমে, চারদিক নিস্তব্ধ। যেন এক অলৌকিক বহুমাত্রিকতায় দর্শকের সামনে পরিবেশিত হচ্ছে ওরাল সিনেমা। আমার মা আবার এতটাই সৃষ্টিশীল ছিলেন যে পট্টনএর ভাষা শুধু বুঝতেন এবং অন্যদের বুঝিয়ে দিতেন তাই নয় সেখান থেকে আবার নতুন নতুন মাত্রা খুঁজে বের করতেন।
যে মুহূর্তে আপনার মাথায় কোনো নতুন চিন্তা খেলতে শুরু করেছে আর ভাবছেন যে কখন কোথায় সেটা প্রয়োগ করবেন ঠিক তখনি একটা সিনেমা জন্ম নিচ্ছে আপনার ভেতর। এরপর আপনি সেই মূল ভাবনাটিকে আরও বিস্তার করে জাবদা খাতায় টুকে রাখুন বা স্পাইরাল বাউন্ড স্ক্রিপ্ট-এ। মোদ্দা কথা হলো যখন কোনো অভিনেতা বা প্রডিউসার এর কাছে যাবেন নিজের গল্প নিয়ে তখন কিন্তু সেই ওরাল সিনেমার কৌশলই কাজে দেবে। প্রসঙ্গত আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু রবি একবার কমল হসন কে নিয়ে একটি সিনেমা তে এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার হিসেবে ছিল, নাম “অভয়”। এই সিনেমাটির সত্ব বিক্কিরি করা নিয়ে একাধিক প্রডিউসার এর সঙ্গে মিটিং এ আমিও তার সঙ্গে দিয়েছিলুম। টিপিকাল পাঞ্জাবি আর গুজ্জু একসেন্ট এ হিন্দি এবং চা-ঠান্ডাই দিয়ে আপ্যায়ন পর্ব মিটলে রবি ফিল্ম সম্বন্ধে অনেক লম্বা চওড়া কথা বলে একটা পরিবেশ বানিয়ে ফেললে। এরপর ভিডিও চালানো হলো। বেদম ঝাড়পিট –মনীষা কৈরালার সঙ্গে উত্তেজক খুনসুটি, কোনো মশলারই অভাব নেই। শেষে দাঁড়ালো কী? না সবকিছু দেখার পর প্রডিউসার সাহেব বল্লেন “সবই তো ঠিকাছে রাভি জি, কিন্তু হিন্দি ফিলিমের নায়কদের তুলনায় কামাল হাসান বড্ড বেঁটে!!” বেচারা রবি, তার মুখে কথা আটকে গেছে। ফিল্মএর ভালো মন্দ নিয়ে কথা উঠলে কী উত্তর দেবে সব তার ভাঁজা ছিল কিন্তু শেষে বলে কিনা নায়ক বেঁটে! এতে তার কী করার আছে? অবশেষে প্রডিউসার এর উদ্দেশ্যই সফল হয়েছিল। নায়ক এর উচ্চতা কে অজুহাত করে সিনেমার সত্ব মূল্য কিছুটা খর্ব করা হলো আর কী।
অন্য শহর। অন্য পরিবেশ। ফরাসী চলচিত্র ও সাহিত্য জগতের একাধারে জনপ্রিয় ও বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব ক্যেথেহ্রেইন বেহ্রেইল্য়া (Catherine Breillat)। ভদ্রমহিলার লেখালেখি এবং ফিল্ম এর মূল বিষয় যৌনতা এবং তাই নিয়ে ওনার কোনো ধরি মাছ না ছুঁই পানি নেই। এই ক্যেথেহ্রেইন এর পদবির বানান জানতে ফোন করেছিলুম ভিদ্যার্থী চ্যাটার্জি কে। সে এখন যাকে বলে লাতিন আমেরিকান আর ইউরোপিয়ান সিনেমার অথরিটি লোক।একথা সেকথার পর সিনেমা নিয়েও কথা উঠলো। ক্যেথেহ্রেইন নিজের লেখা গল্প গুলোকে নিজেই চিত্ররূপ দেন, সেই প্রসঙ্গও তুললো ভিদ্যার্থী।ব্যাপারটা আমারও জানা। ওনার গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো আমি দেখেছি।এইতো কয়েক বচ্ছর আগেই কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভালে। অংশু সুর তখন ডিরেক্টর।
ভীড় ঠাসা রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে অংশু সুর মশাই দর্শকদের সঙ্গে ক্যেথেহ্রেইন এর পরিচয় করিয়ে দিলেন। এবার ক্যেথেহ্রেইন বলবেন। এক ফ্রেঞ্চ পরিচালক একটু আগেই নিজের ফিল্ম সম্বন্ধে বলতে বলায় এরকম বক্তব্য রাখেন “এই ফিল্মটি দেখার আগে আলাদা করে কিছু বলা মানে অকারণ বিরক্ত করা এবং দেখা হয়ে যাবার পর আর কিছু বলতে যাওয়াটাই অতিরিক্ত।” ক্যেথেহ্রেইন কিন্তু এরকম কোনো ধুরন্ধর ওয়ান লাইনার এর ধার মাড়ালেন না।তিনি নিজের ফিল্ম এর গল্প শোনালেন না ঠিকই কিন্তু শুরু করলেন ফিল্ম নিয়ে কথা। তাঁর সিনেমা ভাবনা কী। কিভাবে সিনেমা বানান। ওনার ফিল্মএর মূল বিষয় যৌনতা। সেটাকে ঠিকভাবে তুলে ধরার জন্যে উনি পর্ন ছবির অভিনেতা অভিনেত্রী দের নেন যেটা মূল ধারার ফিল্ম এ বেশ নতুন ব্যাপার। ক্যেথেহ্রেইন এইসব বলছেন আর অংশু সুর মশাই মুখে একটা ভদ্রলোক সুলভ হাসি ঝুলিয়ে রেখে অস্বস্তিতে আইঢাই করছেন। একবার তো ইঙ্গিতে বোঝালেন যে সময় ফুরিয়ে আসছে! কিন্তু ক্যেথেহ্রেইন দমবার পাত্রী নন।
তিনি উন্মোচন করে চলেছেন চলচিত্র মাধ্যমের ভেতরের গল্প। সেই গল্প যা সবাই লুকিয়ে রাখতে ভলোবসে। তিনি বলছেন, কীভাবে শুটিং এর আলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে পুরুষ অভিনেতাটির কাম প্রশমিত হয়ে যায়, ঠান্ডা মেরে যায়। সেরকম অভিনেতা নিয়ে কি কাজ করা সম্ভব ? সম্ভব নয়। তাই অভিজ্ঞ পর্ন অভিনেতা –অভিনেত্রী দের নিতে হয়। তিনি আরো বলছেন যে এই দুনিযায় এমন কোনো সিনেমাটোগ্রাফার নেই যে একটি দৃশ্যের আলো কে ঠিকভাবে ক্যামেরায় ধরতে পরে যদি না সেই আলো আসে অভিনেতা –অভিনেত্রী দের আত্মার ভেতর থেকে। এইভাবে একটার পর একটা বেড়াল বেরিয়ে আসছে ক্যেথেহ্রেইন এর ঝুলি থেকে। উন্মুক্ত হচ্ছে সিনেমা শিল্পের নগ্ন দিক। ফেস্টিভ্যাল এর এর অয়োজক – পরিচালকদের নাভিশ্বাস উঠছে অথচ দর্শক –শ্রোতারা কিন্তু সেতু তৈরী করে নিয়েছেন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। একশন-রিয়্যাকশন সব কিছু জীবন্ত হয়ে ধরা পড়ছে স্টেজে। ওরাল সিনেমা যেন একশো ভাগ ওরাল হয়ে ধরা দিলো সেদিন কলকাতায়।
তবে ওরল ট্র্যাডিশন মনে শুধুই কিছু খুচরো আলোচনা নয়।একজন চলচ্চিত্র পরিচালক যখন কোনো শিল্প নিয়ে নিজের বক্তব্য রখেন তখন সেটা শুধু বক্তব্য থাকে না। সেটা হয়ে দাঁড়ায় বাকিদের কছে একটা অনুপ্রেরণা।সহিত্যে এই ব্যাপারটা বিনা আয়াসেই ঘটে থাকে কিন্তু সিনেমাতে এটি দুর্লভ। উৎকর্ষের চূড়ান্তে দাঁড়িয়ে সিনেমা হলো অন্তর্জগতের বহির্জাগতিক প্রকাশ। আর খুব নিম্নমানের হলে শুধুই বহির্জাগতিক। বাজারেই এর জন্ম। যে বাজার সুধু বোঝে বেচাকেনার ভাষা। অথচ বিগত বছরগুলিতে কিন্তু সিনেমা শুধু ব্যবসায়ী দের পুঁজির জায়গা ছিলো না, ছিলো শিল্পীদের সমাবেশ। উদ্ধৃতি করছি একটু :
“ঋত্বিকএর আগে এমন ছবি কেউ বানায়নি। একদিক দিয়ে দেখলে ছবিটা খুব একঘেয়ে। নায়ক হলো একজন ড্রাইভার আর নায়িকা, বলতে গেলে তার ঐ গাড়ি। এখন এখনে সবচেয়ে সাহসের কাজ হচ্ছে ঐ নিষ্প্রাণ গাড়ির ওপর এক জীবন্ত চেতনাকে অরোপ করা। অমি বলবনা যে এই মনুষ্যত্ব আরোপ করার চেষ্টাটা সব দৃশ্যে ঠিকঠিক উতরে গেছে কিন্তু যখন ভাবি যে ফিল্মটার দর্শক হচ্ছে বাঙালি সমাজ তখন অবাক হই যে শুধু এই পরীক্ষাটুকু করার সাহস ঋত্বিক কিভাবে দেখালেন। আর আমার আরও একটা কথা মনে হয় যে অযান্ত্রিকে মূল বিষয়বস্তু বাদ দিলেও শুধুমাত্র সিনেমা প্রকৌশলের এর দিক দিয়ে একটি বিরাট অর্থপূর্ণ ব্যাপার। একটা উদাহরণ দি: কিছু শট আছে যেখানে আলাদা করে একেকটি শট এর বিষয়বস্তু বলে কিছু নেই বা থাকলেও তা খুব নগণ্য। অথচ সেগুলোই সিনেমার মধ্যে দেখলে বুঝবেন যে কী অসম্ভব গীতিকবিতার মত মূর্চ্ছনা তৈরি করেছে ঐ মুহূর্তগুলি, আলাদা আলাদা করে অর্থহীন হয়েও। এটা শুধু ঋত্বিকের মত একজন বড় পরিচালকের পক্ষেই করা সম্ভব। ঐ মোটরগাড়িটা নিয়ে অনেকরকম কাজ আছে। যেমন ধরুন, বিকেলের আলোয় একটা নদীর ধারে গাড়িটা চুপ করে দাঁড় করানো আছে। ঐ আঙ্গল আর কম্পোজিশনটা এমনই যে মনে হয় যেন গাড়িটা কথা বলছে, বা অনেক কিছু বলার আছে আমাদেরকে।”
এভাবেই, একটি মাত্র স্ফুলিঙ্গ থেকে সিনেমার নির্মাণ শুরু হয় যা ক্রমশঃ একটা জৈবনিক ঋদ্ধির পথ পেরিয়ে আমাদের সামনে পর্দায় ফুটে ওঠে। ওরাল সিনেমা তাই আপনাকে খুব গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। যখন “মীট দ্য প্রেস” এ আপনাকে নিজের সিনেমার কথা নিজের মুখে বলতে হয় এবং আপনার সেই মুখে বলা বক্তব্যের ভিত্তিতেই প্রশ্নের বাণ আসতে থাকে। এইভবে সিনেমা থেকে আবার ভাবের জন্ম হয়,অর্থাৎ যে আদি উৎস থেকে সিনেমা এসেছিলো সেখানেই ফিরে যায় আবার। কী অদ্ভুত, তাই না? মস্তিষ্ক না আমাদের এই মুখের ভাষা, কোথায় এই চলচ্চিত্রের শুরু বলুন তো?
অনুবাদ - শান্তনু দেবনাথ