( মুখবন্ধঃ এই কাহিনীর পটভূমিকা দশম শতাব্দীর বাংলাদেশ । বর্দ্ধিষ্ণু জনপদ বিক্রমপুরের বজ্রযোগিনী গ্রামের সেই দিগ্বিজয়ী বালক অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞানের বাল্যকাল সম্বন্ধে ইতিহাস নীরব। বিগত শতকের প্রত্নতাত্বিক খননে আবিষ্কৃত এই 'নাস্তিক পন্ডিতের ভিটেয়' পৌঁছতে কল্পনার সাহায্য ছাড়া আর কোনো উপায় ছিলোনা । ইতিহাস নির্ভর সম্পুর্ণ কল্পিত এই কাহিনীটি মূল সত্যকে সামনে রেখে ই লেখা .....
আশকরি পাঠকেরা দোষত্রুটি নিজগুণে মার্জ্জনা করবেন।)
ঘন জঙ্গলের মধ্যে বজ্রযোগিনীর মন্দির থেকে তখনো কাঁসরঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছিল বাতাসে। দিগন্তজোড়া গাছগাছালির মধ্যেকার ফাঁকফোকর দিয়ে অতি অল্প যেটুকু দৃশ্যগোচর হয়, তাতে কেবলমাত্র মন্দিরের আকৃতি টুকুই বোঝা যায়। সন্ধ্যার অন্ধকারে নাটমন্দিরের জ্বলন্ত প্রদীপমালায় কিছু দুর্বোধ্য অক্ষরের আভাস পাওয়া যায়। সন্ধ্যারতির সময় কিছু ভক্তসমাগম হয়, নারী পুরুষ, বালক, বালিকা সকলেই আসে, ভক্তিভরে অঞ্জলিপ্রদান করে তারা যে যার ঘরে ফিরে যায়। তারপরে শুরু হয় দেবদাসীদের পিশাচিনী নৃত্য। মন্দিরের অনতিদূরে মৃতদেহ সৎকার করতে আসা আত্মীয় পরিজন রা অতি সম্ভ্রমে দূর থেকে এই ডাকিনী নৃত্য দর্শন করে। কখনো বা মৃতদেহ সৎকার সম্পুর্ণ না করেই পালিয়েও যায়। কিছুক্ষন আগেই যে এই সব দেবদাসীরা স্বাভাবিক ভাবে ভক্তবৃন্দের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলো তা বিশ্বাস করাই দুষ্কর হয়ে ওঠে। তাদের দু এক প্রহর আগেও দেখলে মনে হতে পারে তারা আপন আপন গৃহস্থী সামলাতেই ব্যাস্ত। তারা সকলেই কৃশকায়, পরনের লালপেড়ে সাদা শাড়িটি রাঢ় বঙ্গের রীতি অনুসারে পরা। নদীমাতৃক বঙ্গভূমিতে শাঁখ ঝিনুক ইত্যাদির অভাব নেই তাই তাদের আভরণেও শঙ্খের প্রাধান্য। কদাচিৎ বিশেষ তিথিতে পোড়ামাটির গয়নায় সর্বাঙ্গ ঢেকে এই যুবতীরা একসাথে শ্মশানের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীবক্ষে নগ্নিকা নৃত্য করে। কিছু নিজ অভিজ্ঞতা কিছু জনরব আর বাকীটা কল্পনার পাঁচমিশেল-- এই সবে মিলে এই বজ্রযোগিনীর মন্দিরটি চূড়ান্ত রহস্যজালের সৃষ্টি করে সাধারণ গ্রামবাসীর কাছে।
এই বর্ধিষ্ণু জনপদটির রাজা কল্যানশ্রীর চিন্তায় রাতে ঘুম হয়না। চন্দ্রগর্ভ যখন পঞ্চম বর্ষীয় বালক তখন থেকেই সে নিবিষ্ট মনে গবাক্ষ পথে বজ্রযোগিনীর মন্দিরপানে চেয়ে থাকে এবং বিড়বিড় করে কি জানি সব অদ্ভুত শব্দ উচ্চারণ করতে থাকে। সেই সময় তাকে যেন চেনা যায়না। পাঁচ বছরের আর পাঁচটা গ্রামবালকের থেকে চন্দ্রগর্ভ যেন সম্পুর্ণ স্বতন্ত্র। কেমন এক উদাসী সাধক যেন । গ্রামবালকেরা সচরাচর তার সাথে মিত্রতা করতে বড় একটা এগিয়েও আসেনা। একে রাজপুত্র তার ওপরে এমন অদ্ভুত স্বভাব। খেলতে খেলতে ক্রীড়াগোলক যদি নদীগর্ভে তলিয়ে যায় আর পাঁচজন বালকের সাথে সে ও জলে ঝাঁপ দেয় কিন্তু জল স্পর্শ করা মাত্র তার শরীর রোমাঞ্চিত হয়, চক্ষু বিস্ফারিত হয় এবং সেই বিড়বিড় করে দুর্বোধ্য ভাষা বলতে বলতে সাঁতরে ওপারে বজ্রযোগিনীর মন্দির পানে চলে যাবার চেষ্টা করে। রাজপুত্রের অঙ্গরক্ষীরা বহুকষ্টে মাঝনদী থেকে তাকে ফিরিয়ে এনেছে অনেকবার।
রাণী প্রভাবতী বালককে কোলে নিয়ে বহু আদরে অনেক বুঝিয়েছেন --- বজ্রযোগিনীর মন্দিরে গুপ্ত শক্তির কথা, শিশুহত্যার কল্পিত কাহিনী, কিন্তু তাতেও বালকের বিন্দুমাত্র পরিবর্ত্তন হয়নি।
দাসদাসীদের মধ্যে দাসী বল্লভা বালককে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছিল তাই কেবলমাত্র সে ই বালকের ভাষা কিছু বুঝতে পারত। দাসী বল্লভার কন্যা কমলিকাও চন্দ্রগর্ভের চেয়ে মাত্র তিনমাসের ছোটো। তাই একসঙ্গে এই দুইটি শিশুকেই মানুষ করেছে বল্লভা। দাসীমাতার মাতৃদুগ্ধের সফেন স্নেহধারায় এই দুটি শিশু দিব্যি বড় হচ্ছিলো।
সেদিন ও প্রাসাদের ছাদে দাঁড়িয়ে রাজকুমার চন্দ্রগর্ভ একমনে তাকিয়েছিল দূরে। দৃষ্টিতে অপার শূণ্যতা। সে দেখছে অথচ দেখছেনা। হাজার বৎসর পুর্বে বাংলাদেশের একটি শারদ গোধুলিবেলা। গাঢ় নীল আকাশে লঘু সাদা তুলো মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। গোপালন শেষে রাখাল বালকের বংশীরবে হাওয়ায় হাওয়ায় মনখারাপের গন্ধ। বন শিউলির মৃদুগন্ধে বালকের হঠাৎ কমলিকার কথা মনে পড়ে যায়। আজ তো সে খেলতে আসেনি। রোজ দুটিতে সারাবেলা খেলা করে। খেলার শেষে যথারীতি প্রবল খুনসুটি ও অশ্রুবর্ষণের সাথে নিত্যদিন কমলিকাই জিতে যায়। সে আজকাল বড় গিন্নিপনা দেখায় কিনা। নিজে চন্দ্রগর্ভের সঙ্গে যা নয় তাই ঝগড়া করবে কিন্তু যদি চন্দ্রগর্ভের বাকি দুই ভাই শ্রীগর্ভ আর পদ্মগর্ভের সঙ্গে বিবাদ বাধে , তবে কমলিকা কোমর বেঁধে চন্দ্রগর্ভের হয়ে তাদের সঙ্গে ঝগড়া করবে। রাণীমাতা মুচকি হেসে বলেন বল্লভা তো সাতচড়ে রা কাড়েনা তার পেটে এমন মুখরা সন্তান কি করে এলো? সত্যি ই কমলিকা যেন হারতে শেখে নি।
আজ রাজগৃহে মহোৎসব। চন্দ্রগর্ভের জন্মতিথি। রাজপুরোহিতের স্বস্তিবাচনে পুজার্চ্চনায় আজ সারাদিন কিভাবে কেটেছে তা টের ও পায়নি চন্দ্র। সে আজ দ্বাদশ বর্ষীয় কিশোর। সর্বাঙ্গে বয়সন্ধির ছোঁয়া লেগেছে। হালকা সবুজ গোঁফের ছায়া কচি মুখটাকে যেন আরো সুন্দর করে তুলেছে। আজকের দিনে কমলিকার অনুপস্থিতি তাকে বড্ড ভাবিয়ে তুললো। সে সারারাত ঘুমালোনা, আঁধারের বুক চিরে দুরে শ্মশানের শবদাহের আগুন আলো দেখে রাত্রি তৃতীয় প্রহর অবধি জেগে রইলো। তারপরে আধো ঘুম আধো জাগরণের মাঝে বালক যা দিনমানে কখনো শুনতে পায়না রাত্রির নীরবতায় তা যেন স্পষ্ট শুনতে পেল।
শতশত নগ্ন নারীদেহ ডাকিনী নৃত্যে মুখর। প্রত্যেকের হাতে জ্বলন্ত মশাল, সর্বাঙ্গে পোড়ামাটির গয়না। মৃদঙ্গের তালে তালে নৃত্যছন্দে তারা বিভোর। মেঘমন্দ্র স্বরে তন্ত্র সাধক মন্ত্রোচ্চারণ করছেন, আর তার পরে শত কন্ঠে এই বিভোর যোগিনীরা সেই মন্ত্রের প্রতিধ্বনি করছে। বড় গা ছমছম করা সে দৃশ্য। নাচতে নাচতে তারা অদ্ভুত সব মুদ্রায় এমন ভাবে পাশাপাশি দাঁড়াচ্ছে তা যেন দুর্বোধ্য কিছু অক্ষর বলে মনে হচ্ছে, কারণ প্রদীপের আলোকমালায় ঠিক এমন অক্ষর আগে চন্দ্র গর্ভ দেখেছে ঐ খানে।
খড়িমাটি দিয়ে ছাদের উপরে চন্দ্রগর্ভ বড় বড় হরফে লিখলে ' ওম সর্ব বুদ্ধ ডাকিনীয়ে, বজ্র বর্ণণীয়ে, বজ্র বিরোচনে, হুম ফট স্বাহা' আর তার নীচে খড়িমাটি দিয়ে আঁকলে ঠিক সেই দুর্বোধ্য অক্ষরটা।
দেখতে দেখতে প্রায় ভোর হয়ে এল। রাত্রি শেষযামে নাচ থেমে গিয়ে যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে চরাচর ভরে উঠল। চন্দ্রগর্ভ কখন নিদ্রায় অচেতন হয়ে গেছে তা নিজেও টের পায়নি।
অভ্যেস মত চন্দ্রগর্ভের ঘর ঝাড়মোছ করতে এসেছে বল্লভা। অন্যদিন কমলিকা এসে বাড়ি মাথায় করে এই সময়। নারিকেল ঝাড়ু এবং জলে ঘষাঘষির বিরক্তিপুর্ণ শব্দে তাকে জাগিয়ে দেয়। কখনো বা পাখির পালক দিয়ে কানে সুড়সুড়ি দিয়ে জাগায়। চন্দ্রগর্ভ চোখ মেলে দেখে সদ্যোস্নাত কমলিকা কোমরে আঁচল বেঁধে হাতে ঝাড়ু নিয়ে বজ্রযোগিনীর সাজে তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে যেন ভয় দেখাবে। এই সময়টায় চন্দ্রগর্ভকে ভয় পাবার ভান করতেই হবে না হলে পরের দিকে বেজায় গন্ডগোল হবার সম্ভাবনা আছে। নতুবা সারাদিনের নিত্যনতুন উদ্ভাবনী খেলায় চন্দ্রগর্ভের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। বলা বাহুল্য এই সব খেলা বালিকার নিজস্ব মস্তিষ্কপ্রসূত, তাই সে সব খেলার নিয়মাবিধি প্রতি নিয়তই বদল হতে থাকে। এমনকি বাকি দুই ভাই ও তাকে জব্দ করে উঠতে পারেনা।
বালক বালিকা প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মেই শৈশব পেরিয়ে কৈশোরে পা দিয়েছে।
এমন অসময়ে কমলিকার অনুপস্থিতিতে বড় চিন্তায় পড়ল চন্দ্রগর্ভ। বল্লভাকে প্রশ্নে প্রশ্নে অস্থির করে তুললো বালক।
বল্লভা মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনা, চুপি চুপি কাঁদে। কমলিকা আর বালিকা নেই। রক্ত দেখে ভয়ে আতঙ্কে মাকে জড়িয়ে ধরেছিল। কিন্তু আতঙ্কের কারণটা ঋতুজনিত রক্তপাত নয়, আতঙ্কের কারণ অন্যত্র। কহ্বোরী গ্রামের প্রতিটি কন্যার প্রথম ঋতুদর্শনের দিনটি জাঁক করে পালন করা হয় বজ্রযোগিনীর মন্দিরে। সেদিন থেকে বোধিলাভের পাঠ দেওয়া হয় এই কন্যাদের। বালিকা থেকে নারী হয়ে ওঠার এই একবৎসর সময়কাল তাই বজ্রযোগিনীকে উৎসর্গ করতে হয়। কৃচ্ছসাধনার চরম স্তর.... কমলিকা খুব ভয় পেত এই তান্ত্রিকদের। সে কিছুতেই যাবেনা শ্মশানঘাটে। বল্লভা দাসী দু এক বার বুঝিয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে। অথচ এ কথা কি গোপন রাখা যায়? কমলিকা যে প্রস্ফুটিত শতদলের মত তার পাপড়ি মেলছে দিনে দিনে। পরে যখন জানাজানি হবে, তার দায়ভার কে নেবে? আর এই শাস্তি কে না জানে কি হয়!
কমলি আর আসেনা। চন্দ্রগর্ভ কিছুতেই ভুলতে পারেনা তাকে। মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখতে পায় তাকে চন্দ্র।
'কিরে চন্দু খেলবি?
'না, তুই কেন আসিসনা?'
'বা রে! আমি কি করে আসবো। আমি যে বড়ো হয়ে গেছি'
'তুই বড়ো হয়ে গেছিস? কতো বড়? কেন বড় হলে বুঝি খেলতে নেই?'
উত্তরে বালিকা মুখ চূন করে দাঁড়িয়ে থাকে। চন্দ্র আবার মিনতি করে,' আয় না কমলি। আজ সব খেলায় আমি হারবো, তুই একবারে আয় না! আয়না! আয়না!'
কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভেঙে যায়। কোথায় কমলিকা। শুধু নদীতীরের চোরাবালিতে আটকে পড়া ছাগশিশুর আর্ত্তনাদ ধীরে ধীরে মিইয়ে আসে। জ্ঞান হবার পরে প্রথমবার যখন শুনেছিলো, দৌড়ে যেতে চেয়েছিলো চন্দ্রগর্ভ কিন্তু রক্ষীরা যেতে দেয়নি। কড়া নিষেধ আছে ঐ চোরাবালিতে যাবার। ওখানে গেলে আর কেউ ফিরে আসেনা। কাউকে বাঁচানো ও সম্ভব নয়। ছাগশিশুর আর্ত্তনাদের সঙ্গে তারস্বরে চন্দ্রগর্ভ আর্ত্তনাদ করতে থাকে 'বাঁচাও বাঁচাও'! দাসদাসীরা দৌড়ে আসে, রানীমাতা আতঙ্কে নীল হয়ে যান, দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরেন চন্দ্র কে। চন্দ্র আঙুল তুলে দেখায় ঐ অসহায় ছাগশিশুকে। কিন্তু ওখানে যাওয়া মানে যে মৃত্যু তা কে না জানে! আর্ত্তনাদ ধীরে ধীরে মাটির তলায় তলিয়ে যায়। হাহাকার করে ওঠে চন্দ্রগর্ভ.......
বল্লভাও বেশ কিছুদিন হল আর আসেনা, রাণীমাতাও কেমন যেন এড়িয়ে যান প্রশ্ন গুলো। নির্বান্ধব পুরীতে চন্দ্রগর্ভ আরো একাকী অসহায় হয়ে ওঠে। তাই সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় ছাদের কোণটুকু যেখান থেকে রাতভর ডাকিনী নৃত্যের উন্মাদনা ভেসে আসে। চন্দ্রের ওপর রাজা কল্যাণশ্রীর বড় ভরসা। তিন পুত্রের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ এই মধ্যম পুত্র। এর হাতেই রাজ্যপাট দিয়ে যাবার ইচ্ছে। তাই তাকে সংসারী করে না দিতে পারলে একটুও শান্তি নেই। মনে মনে ভাবেন ঘর গৃহস্থীর চাপ কাঁধে পড়লে সব ঠিক হয়ে যাবে। পিতৃস্নেহে মানুষ চিরকাল এমনটাই ভেবে এসেছে, তাই এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি।
বহুদিন পরে রাজপ্রাসাদে বিবাহ। এমন সুন্দর পাত্রের জন্যে রাঢ়ভূমে পাত্রীর অভাব? পাত্রী ঠিক হয়ে গেল মাত্র এক পক্ষকালের মধ্যে। পাশের গ্রাম গণকপাড়ার ভূস্বামী চিরসেনের অগ্রজা কন্যা মাধবী, কূল লক্ষণে, বংশমর্য্যাদায় কোনো অংশে সে কম যায়না। রাজা ও রাণীমাতা গিয়ে স্বর্ণবলয় ও রত্নহার দিয়ে আশীর্ব্বাদ করে এলেন। নিমন্ত্রণ পত্র নিয়ে রাজার অমাত্যরা দেশ থেকে দেশান্তরে দৌড়লো।
বিবাহের রীতি অনুসারে বর বিবাহ করতে যায় কন্যার গৃহে কিন্তু এক্ষেত্রে রাজা কল্যাণশ্রী সেই ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। পথে কত রকম বিপদ আপদ আছে তাছাড়া বজ্রযোগিনীর মন্দিরের পাশ দিয়ে যেতে হয়, এছাড়াও কহ্বোরী গ্রামে কমলিকা আর বল্লভাকে সে যে বড় ভালোবাসে। বল্লভার মাতৃদুগ্ধে সে বড় হয়েছে, তাই মায়ের থেকে অনেক বেশি টান তার বল্লভার ওপর। কমলিকা ছিলো তার খেলার সাথী, হঠাৎ করে এই বিচ্ছেদ চন্দ্রগর্ভ আজ ও মেনে নিতে পারেনি। বিবাহের শুভ কাজে যদি কোনো রকম বাধা পড়ে, এসব সাত পাঁচ ভেবে রাজা ঠিক করলেন পাত্রীপক্ষই বরং আসুক। একবার বিবাহ হয়ে গেলে তখন আর কোনো ভয় থাকবেনা।
বিবাহের পুর্ব দিন ভোরে দধিমঙ্গল সেরে পুরনারীরা নদীকে নিমন্ত্রণ করে এলেন। রাজগৃহে আত্মীয় স্বজন বন্ধুবান্ধবের কলরবে বিক্রমপুরের জনপদটি আনন্দবিধূর হয়ে উঠেছে। সাধারণ গৃহস্থেরাও দ্বারে দ্বারে তোরণ বেঁধেছে। আম্রপল্লব ও কদমফুলের মালা খাটিয়েছে দুয়ারপ্রান্তে। মঙ্গলঘট ও কলাপাতার ওপরে স্বস্তিকা চিহ্নে যেন সত্যি ই মনে হচ্ছে উৎসব আসছে।
আজকের এই আনন্দের মূলতম কেন্দ্রবিন্দু যে, সেই চন্দ্রগর্ভ ঘরের কোণে বসে একাকী মন্ত্রোচ্চারণ করছে,'ওম ওম ওম সর্ব্ব বুদ্ধ ডাকিনীয়ে .....' মন্ত্রের তালে তালে সারা শরীর দুলছে, চোখে জল.... চন্দ্রগর্ভ বলে চলেছে 'সর্ব্ব বুদ্ধ ডাকিনীয়ে... বজ্র বিরোচনে..... বজ্র বর্ণনীয়ে........'
এমন করে কতক্ষণ কেটেছিল জানা নেই। অর্দ্ধচেতনার গাঢ় আঁধারে একটি দিব্যমুর্ত্তির আবির্ভাব হল। গাত্রবর্ণ নানা রঙের কখন শ্বেত , কখন পীত, কখনো বা নীললোহিত, কখনো সে ঘন সবুজ, কখনো বা রক্তবর্ণ, আবার কখনো ঘোর অন্ধকারের মত কালো। কিন্তু তাঁর চোখের দৃষ্টিটি ভারী মায়াময়, সৌম্য। ঠিক যেন মাতা বল্লভার মত।
স্বপ্নদৃষ্ট মুর্ত্তি বললেন , ' চন্দ্রগর্ভ সংসার সুখ তোমার জন্য নয়। তুমি পৃথিবী কে পারমার্থিক সুখের পথ দেখাবে। পাঁচশত জন্মান্তর ধরে তুমি ভগবান বুদ্ধের পথবর্ত্তী ভিক্ষুব্রত ধারণ করছো -- তাই এমন অতি সাধারণ সংসারজীবন তোমায় মানায়না । বেরিয়ে পড় এখুনি। ভিক্ষু জেতারি তোমার জন্যে অপেক্ষা করছেন .... আর দেরী কোরোনা!'
মন্ত্রমুগ্ধের মত পথ চলছিল চন্দ্রগর্ভ। পথ তো চেনাই। এ পথে সে মনে মনে কতোবার এসেছে। কহ্বোরী গ্রামের পাশ দিয়ে শ্মশানঘাট , তার পারের ঐ বটগাছের সঙ্গে কতো কথা বলেছে মনে মনে এতোদিন ধরে। গাছের নীচে থমকে দাঁড়াল চন্দ্রগর্ভ। প্রভু জেতারি! শান্ত সৌম্য ধীর স্থির দুইচোখে করুণার ধারা। কিন্তু পঞ্চ মুন্ডাসনে উপবিষ্ট। সারা গায়ে চিতাভস্ম মাখা। থরে থরে সাজানো নরমুন্ডের ভিতরে কোনোটায় ঘৃতপ্রদীপ , কোনোটায় সুরা আবার কোনোটায় ঝলসানো পশুমাংস সাজানো আছে। গা শিউরে উঠলো চন্দ্রগর্ভের! তবু ঐ শান্ত চোখ দুটিতে কিছু একটা এমন ছিল, চন্দ্রগর্ভ সম্মোহিতের মত বসলো। একটি নরমুন্ডের ডালায় ভরা জমাট বাঁধা রক্ত ছিলো, বৃদ্ধাঙ্গুলে একটু ভরে নিয়ে কপালে তিলক কেটে দিলেন জেতারি। চারপাশে যত বিবসনা যুবতী ছিল তারা মুখে একরকম অদ্ভুত শব্দ করে উঠলো। ঘন্টাধ্বনি হুলুধ্বনি শাঁখের আওয়াজে রাত্রি মুখর হয়ে উঠলো।
শিক্ষা চলছিল পুরোদমে। মেধাবী চন্দ্রগর্ভ অতি দ্রুত দুর্বোধ্য থেরবেদ ব্যকরণ রপ্ত করে ফেলেছে, মহাযান তান্ত্রিকতার গুঢ় তথ্য সে প্রায় সব শিখে ফেলেছে। কিন্তু পরমবিদ্যা লাভ করতে হলে শবসাধনা করতে হয়। জাগতিক জ্ঞান সম্পুর্ণ বিনাশের জন্যেই এই সাধনা আবশ্যিক।
সেদিনও এমনই এক দুপুর বেলা চন্দ্রগর্ভ নাটমন্দিরে বসে বসে ধ্যানমগ্ন হয়েছিল । অধ্যয়নের চিন্তা ছেয়ে রেখেছিল তাকে। এ বিশাল জ্ঞান সমুদ্রের আর পার দেখা যায়না। অকস্মাৎ কাঁধের কাছে আলতো চেনা ছোঁয়ায় চমকে চোখ তুলে তাকিয়ে অবাক! কমলিকা!!
'তুমি এখানে?'
'হ্যাঁ আমি। আমি ই তো! চিনতে পারোনা! এই তো ছুঁয়ে দেখো!' বলে হাতটা বাড়িয়ে দেয় কমলিকা
'নারীদেহ সাধককে স্পর্শ করতে নেই জানোনা!'
'ছি! ছি! পন্ডিত! এই না তোমরা বুদ্ধ জ্ঞানী!, এতো নরমুন্ডের ওপর তপস্যা করো , বোঝোনা এই দেহে হাড় মাংস চামড়ার বেশি আর কিছু নেই! তুমি আমার হাত ছুঁলে কি ছুঁতে পারবে আমায়? আমাকে ছুঁতে হলে এখানে ছুঁতে হবে' --- বলে বুকের মাঝখানে হাত দিয়ে দেখায় কমলিকা।
'আত্মাকে ছুঁতে পারোনা তোমরা?' --- কমলিকা আর্ত্তনাদ করে।
একটুকরো ছোটোবেলা ফিরে আসে যেন এক লহমায়। ঠিক এমন করেই কতো অভিমান করতো কমলি। অসহায় স্বরে চন্দ্রগর্ভ বলে,' কমলি তোর কি হয়েছে? আমাকে বল!'
'আমি মানিনি তোমাদের নিয়ম। নারীত্বের প্রথম বছরটা তন্ত্রসাধক কে দিয়ে দিতে চাইনি। আমি যোগিনী হতে চাইনি। মুন্ডমালা পরে নগ্ন দেহে রাত ভর নাচতে চাইনি। দেহ গত বাসনা থেকে মুক্তি পাবার নাম করে তোমরা বাসনা চরিতার্থ কর, একথা কি আমার জানা নেই?'
চন্দ্রগর্ভের মুখ দিয়ে কথা সরেনা! নির্বাক হয়ে থাকে সে।
কমলিকা শান্ত ভাবে বলে ,'এখানে আমি কেন এসেছি জানো? এরা আমায় ধরে এনেছে। কহ্বোরী গ্রামে এমন প্রতিবাদী মেয়েমানুষ আছে জানলে তাকে এরা মৃত্যুদন্ড দেয়। আগামী অমাবস্যার রাত্রে বজ্রযোগিনীর সামনে আমায় বলি দেবে। সেই শবের ওপর সাধনা করবে তুমি! তুমি যে প্রভু জেতারির সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্র!'
সময় যেন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে! আচমকা শতবজ্রপাতেও হয়তো এতো ধাক্কা খেতোনা চন্দ্রগর্ভ। তবে অমাবস্যার রাতে যে শব সাধনার জন্যে সে অপেক্ষা করে আছে তা কমলিকার মৃতদেহ!!!!
নিরাসক্ত ভঙ্গিতে কমলিকা উত্তর দেয় 'তোমার কাছে একটি ই অনুরোধ করতে এসেছি -- রাখবে? '
চন্দ্রগর্ভের দুটি বাষ্পায়িত চোখ আর কিছু দেখতে পায়না.....
'ষোড়শী যুবতীকে বলি দেবার আগে তাকে বিবাহ করে সম্ভোগ করেন তন্ত্রসাধক!-- তুমি তাঁকে বুঝিয়ে বলবে, আমাকে মৃত্যুর পরে যেন দেহের সাথে সম্ভোগ করেন উনি-- অন্যথায় আমাকে আত্মহত্যাই করতে হবে। করুণাময় প্রভু তথাগত কিছুমাত্র রুষ্ট হবেননা!'
আজ কথা যেন ফুরোয়না কমলিকার ,' আমার আত্মা শুধু তোমাকেই চেয়েছে চন্দ্রগর্ভ। এই কামনা দৈহিক নয়। আত্মিক। এই বন্ধন থেকে মুক্তি চেয়ে যদি তুমি আমারই শবের ওপর সাধনা করো তবে সেই আমার জীবনের সার্থকতা। দেহকে তোমরা নষ্ট করে দিতে পারবে, কিন্তু আত্মা কে? নৈনং ছিন্দতি শস্ত্রাণি, নৈনং দহতি পাবক নচৈনম ক্লেদয়ন্ত্যপো ন শোষয়তি মারুত! সামান্য দেহের মোহমুক্তির জন্যে তোমাদের এতো সাধনা! আত্মার থেকে মুক্তি পাবে? '
লবণাক্ত জলে চন্দ্রগর্ভের বুক ভেসে যায়। শুধু দুই হাত জোড় করে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলেন 'হে তথাগত-- তুমি পথ দেখাও।--- ধীরে ধীরে সন্ধ্যাকাশ জুড়ে বুদ্ধের মুখ ভেসে ওঠে। সে মুখ করুণার মুখ। মানবতার মুখ! উত্তর পেয়ে যান চন্দ্রগর্ভ। মেঘমন্দ্র স্বরে প্রার্থনা করেন ' বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি!'
ধীরে ধীরে দিগন্তরেখায় মিলিয়ে যায় কমলিকার দেহাবয়ব।
বিদ্রোহে গর্জ্জে ওঠে চন্দ্রগর্ভ। নাস্তিকতার বদনাম মাথায় তুলে নিয়ে এই ধর্মাচারের প্রবল বিরোধিতা করে সে। সেদিনের চুপচাপ মৃদুভাষী ছেলেটা আজ এমন তেজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা তুলে কথা বলতে পারে ..... দেখে অবাক হয়ে যায় আশ্রমের মানুষ! রাঢ় বাংলা থমকে যায় তাঁর সামনে। তীক্ষ্ণ ধীশক্তির অধিকারী এমন ছাত্রটিকে অস্বীকার করা যায়না... প্রভু জেতারি দক্ষিণাপথের রাহুলগুপ্তের কাছে চন্দ্রগর্ভের শিক্ষার ব্যবস্থা করে দেন।
অমাবস্যার আগেই দক্ষিণাপথ যাত্রা করতে চায় চন্দ্রগর্ভ। বজ্রযোগিনী মাঠ পেরিয়ে ঘন জঙ্গলের প্রবেশ মুখে দাঁড়িয়ে ছিল মাতা বল্লভা! চোখে কৃতজ্ঞতার অশ্রুবিন্দু মুক্তোদানা হয়ে গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে। হাতে একবাটি পরমান্ন। ভিক্ষু চন্দ্রগর্ভ মা কে প্রণাম করে পায়েস গ্রহণ করেন। দাসীমাতা আশীর্ব্বাদ করে,' তুমি প্রকৃত বুদ্ধ হও পুত্র, এই আশীর্বাদ করি।'
শিক্ষাশেষে চন্দ্রগর্ভ হয়ে ওঠেন অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান..... বিক্রমশীলা এবং নালন্দা মহাবিহারের আচার্য্য।
কমলিকার কি হয়েছিল সে কথা কিছু জানা যায়না।
চিত্রঃ সৈকত দত্ত