পার্বত্য জেলা রাঙামাটি শহরের কল্যাণপুর পেট্রোল পাম্প এলাকায় গত ২০ মে বিকেল ৪ টায় পার্বত্য শান্তিচুক্তি পক্ষীয় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষে সমবেতদের ওপর কাপুরুষিত গ্রেনেড হামলায় ঘটনাস্থলেই অন্তত ১৫ জন ছাত্র আহত হন। আহতরা সকলেই কাপ্তাই উপজেলার সুইডিস পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের নিরীহ ছাত্র। গ্রেনেডের আঘাতে কারো দুই পা হাড়সহ ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, পেটে বিদ্ধ হয়েছে স্পিন্টার। কারো এক পা ও এক হাতের আঙ্গুলগুলো বিচ্ছিন্ন হয়েছে। কী হৃদয় বিদারক ঘটনা!
গুরুতর আহত মং চিং মারমা পরদিন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাত ১টার দিকে অপারেশনের পর পরই মারা যান। মারাত্নক আহত বাবুধন, কামনাশীষ ও জীবন চাকমাকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। বাবুধন ও কামনাশীষ চাকমার সফল অস্ত্রপচার সম্ভব হলেও এখনো জীবন-মৃত্যুর সন্দিণে রয়েছেন জীবন চাকমা। তার দুপায়ে, ডান হাতে ও ডান কাঁধ ঘেঁষে বুকে বোমার আঘাত লেগেছে। চিকিৎসকরা এখনো তাকে আশঙ্কামুক্ত করতে পারেননি। তাদের পরামর্শ, জীবন চাকমার বাম পা’টি কেটে ফেলার!
পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের দেড় দশক পর পর্যটন শহর খোদ রাঙামাটি শহরে কাপুরুষোচিত এই নৃশংস গ্রেনেড হামলার পর পাহাড়ের রাজনীতিতে সব ওলট-পালট হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট মহলে দেখা দিয়েছে প্রাসঙ্গিক কয়েকটি প্রশ্ন।
১। এই হামলা আসলে কারা করেছে? এতে কারা লাভবান হলো?
২। ঘটনার দিন জনৈক সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ সুপার মন্তব্য করেছেনঃ
‘এটি শক্তিশালী বিস্ফোরক দ্বারা হামলা হতে পারে।’
কিন্তু তদন্তকারী সিআইডি দল বলেছেন, এটি স্থানীয়ভাবে তৈরি হাত বোমা (বিস্ফোরক, কাঁচ, বালু দিয়ে তৈরি); দুই ধরণের মন্তব্যের রহস্য কী?
৩। রাঙামাটি ওসি মূর্খের মতো বক্তব্য দিলেন, বললেন, বোমাটি নাকী যারা হামলার শিকার, তাদের মধ্যেই কেউ বহন করছিলো! তার এই মন্তব্যের পেছনে কী মতলব থাকতে পারে?
যদি সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে পুরো বিষয়টি বিবেচনা করি, তাহলে কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
এক। হামলা হয়েছে পিসিপি’র প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনে, দুই। হামলা হয়েছে চাকমা রাজা ব্যরিস্টার দেবাশীষ রায়ের মালিকানাধীন পেট্রোল পাম্পে; এটি সাবেক গেরিলা নেতা সন্তু লারমার ভবনের অদূরে এবং পাহাড়ি আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এবং তিন। শান্তিচুক্তি পক্ষীয় জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) নেতা অনিল চাকমা গোর্কি হত্যাকাণ্ডের একদিন পরে হামলার ঘটনা সংগঠিত হয়েছে।
সুতরাং উপরিক্ত বিষয়ে আলোকপাত করলে কিসের আলামত পাওয়া যায়? এই ঘটনা কী তৃতীয় কোনো শক্তি দ্বারা সংগঠিত হতে পারে না? যারা শান্তিচুক্তি পক্ষের জেএসএসএবং
শান্তিচুক্তি বিরোধী ইউপিডিএফ (ইউনাইটেড পিপলস ডেমেক্রেটিক ফ্রন্ট) -এর সংঘাতকে উস্কে দিয়ে ফায়দা লুঠতে চায়? যারা জুম্ম (পাহাড়ি) জাতীয় অস্তিত্ব ধ্বংস করতে চায়? পাহাড়কে তারা আবারো অস্থিতিশীল করতে চায়?
উপরন্তু রক্তাক্ত হামলার ঘটনাটি যেহেতু পিসিপির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর দিনে, সেহেতু এতে গভীর এবং সুদূর প্রসারী উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে বলে মনে করি। … কারণ পিসিপি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং এই সংগঠনের আন্দোলন-সংগ্রামের ভূমিকা আমরা সবাই জানি। তাই হয়তো তৃতীয় কোনো অশুভ শক্তি আমাদের ভাতৃঘাতি সংঘাতের সুযোগ নিয়ে এই ন্যাক্কারজনক হামলার মধ্য দিয়ে পিসিপির মতো লড়াকু সংগঠন তথা আমাদের সংগ্রামকে বিপথগামী কিম্বা স্তব্ধ করে দেওয়ার অপচেষ্টা করছে।
লক্ষনীয়, শান্তিচুক্তির প্রশ্নে আদিবাসী পাহাড়িদের পক্ষ-বিপক্ষের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বাইরে
পাহাড়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাত রয়েছে সেনা-সেটেলার শক্তি তথা শাসক গোষ্ঠির সঙ্গে; নিপীড়ণমূলক এই দ্বন্দ্ব-সংঘাতই প্রধান। রাঙামাটির গ্রেনেড হামলার উদ্দেশ্য– চলমান এই বহুমাত্রিক দ্বন্দ্ব সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে কোনো না কোনো পক্ষের ফায়দা লাভ করা। গ্রেনেডের মতো দুর্লভ সামরিক অস্ত্র সন্ত্রাসীরা পেলো কী ভাবে, সেটিও অনুস্ন্ধান করে দেখা দরকার।
সুতরাং আমাদেরকে আবেগ বিবর্জিত হয়ে সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নিতে হবে; সঠিক রহস্য উদঘাটন করতে হবে। প্রশাসনের তরফ থেকে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার অপচেষ্টা চলছে বলে মনে হচ্ছে। নইলে জনৈক সেনা কর্মকর্তা, পুলিশ সুপার এবং ওসি, সিআইডি’র বক্তব্যে কেনো এতো গড়মিল? প্রকৃত সত্য উদঘটনে ব্যর্থ হলে এর দায়ভার সরকারকেই নিতে হবে।
—
*লেখক: সাংস্কৃতিক কর্মী ও লেখক, রাঙামাটি।
—
ছবি: গ্রেনেড হামলার ঘটনাস্থল, বিধায়ক চাকমা এবং নিহত মং চিং মারমার ফাইল ছবি, হিমেল চাকমা।
—
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।