এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • রাজধানীর ইতিকথা

    শমীক মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৯ অক্টোবর ২০০৯ | ৮৪৯ বার পঠিত
  • অনেকে এসেছিলেন সেদিন। ভোপালের বেগম একইসঙ্গে বোরখা এবং টেনিস শু পরেছিলেন। সাদা চামড়ার লোকজন ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল রাস্তার দুধারে। গান স্যালুট আর কামানের তোপধ্বনিতে চঞ্চল হয়ে উঠেছিল হাতি আর ঘোড়ার দল। তাদের ইতস্তত দাপাদাপিতে মারা গেছিল অনেক লোক। অবশ্যই, তারা কালা নেটিভ আদমির দল।

    রাজকীয় আদেশনামা খাঁটি উর্দুতে পাঠ করলেন একজন অশ্বারোহী ব্রিটিশ জেনারেল। কিন্তু তাঁরই সহকর্মী আরেকজন ব্রিটিশ অফিসার ছড়িয়ে লাট করলেন হিন্দিতে সেটা পড়তে গিয়ে। সওয়ার, মানে ঘোড়সওয়ার বাহিনীকে তিনি সম্বোধন করে বসলেন "শুয়ার' ( suwar ) বলে। পরের লাইনেই তিনি তাদের প্রদান করলেন ইংলন্ডেশ্বরী মহারাণীর প্রদত্ত "বিল্লি'। আসলে তিনি দিতে চেয়েছিলেন রানীমার নামাঙ্কিত বিল্লা, বা মেডেল।

    কী মনে হচ্ছে? ব্রিটিশ ভারতের কোনও এক রাজকীয় লাট বেলাটের অভ্যর্থনা সমারোহের বর্ণনা? তা হলে আরেকটু ইন্ধন দিই।

    এই বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছিল ডিসেম্বরের ১২ তারিখে। সালটা ১৯১১। রাজা পঞ্চম জর্জ ভারতে পদার্পণ করেছেন, তাঁর ওয়েলকাম সেরিমনি। সমস্তরকম স্বাগতভাষণের শেষে রাজামশাই অবশেষে একটি কাগজ তুলে নিলেন ভাইসরয়ের হাত থেকে, এবং অত্যন্ত নীচুস্বরে পাঠ করে গেলেন এক ঐতিহাসিক ঘোষণা। বাংলাকে ভাগ করার ফলে ক্ষেপে উঠেছে বাঙালি। ওদের সংস্পর্শে ব্রিটিশ রাজত্ব আর নিরাপদ নয়। অতএব আজ থেকে ভারতের রাজধানী স্থানান্তরিত করা হচ্ছে ... দিল্লীতে।

    ... ঠিক এইভাবেই, ব্রিটিশদের হাতে অষ্টম দিল্লির জন্মক্ষণ ঘোষণার কাহিনি লিপিবদ্ধ করেছেন মালবিকা সিং, আর রুদ্রাংশু মুখার্জি, তাঁদের বহু পরিশ্রমের ফসল, New Delhi : Making of a Capital বইটিতে। প্রকাশক, Roli Books । চমৎকার ঝরঝরে লেখার সঙ্গে উপরি পাওনা, অনেক দুর্লভ ছবি। দিল্লি যখন তৈরি হচ্ছে, তখনকার ছবি। এসব ছবি আগে কোথাও প্রকাশিত হয় নি।



    নর্থ ব্লক আর সাউথ ব্লকের মাঝখানে গড়ে উঠছে গভর্নমেন্ট্‌স হাউস, আজকের রাষ্ট্রপতি ভবন। সামনেই কিংসওয়ে। ইন্ডিয়া গেট তখনও তৈরি হয় নি।

    তৈরি হচ্ছে দিল্লি। এলাহি কাণ্ড। তার তদারকিতে মোতায়েন রয়েছেন ঐ যে দুজন ব্রিটিশ, খাঁটি থ্রি-পিস স্যুট পরে, মাথায় শোলার টুপি, হাতির পিঠে চেপে ঘুরে বেড়াচ্ছেন রাইসিনা হিল নামক ঢিপিটির এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত, তাদের চিনতে পারছেন? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ওঁদের একজন হলেন, ল্যুটিয়েন। এডুইন ল্যুটিয়েন। দ্বিতীয়জন হলেন স্যর হার্বার্ট বেকার। এঁরা দুজনেই ছিলেন আজকের যা "নতুন দিল্লি' তথা অষ্টম দিল্লি শহরের জন্মদাতা। দুই আর্কিটেক্ট।

    অষ্টম কেন বলছি বারবার? অনেকেই হয় তো জানেন, তবু এইখানে আরেকবার বলে নেওয়া ভালো; দিল্লি বারে বারে গড়ে উঠেছে আর ধ্বংস হয়েছে শত্রুদের হাতে। অনেক প্রাচীন কাল থেকেই দিল্লি ছিল ভারতের শাসনক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, এপিসেন্টার। মহাভারতের ইন্দ্রপ্রস্থের কথা বাদ দিলেও, সন-তারিখের হিসেবের মধ্যে সাত সাতবার বিভিন্ন সময়ে গড়ে উঠেছে এই শহর, ধ্বংস হয়েছে সাত সাতবার। যে যে রাজধানীর নিদর্শন আজও দেখতে পাওয়া যায় দিল্লির আনাচে কানাচে, তাদের দিকে একটু ফিরে তাকানো যাক :

    ১। কিল্লা রাই পিথোরা : দশম শতাব্দীতে এই শহরের পত্তন করেন পৃথ্বীরাজ চৌহান। তাঁরই আরেক নাম ছিল রাই পিথোরা। পৃথ্বীরাজ চৌহানের পূর্বপুরুষ এই এলাকা দখল করেছিলেন "তোমর' নামক রাজপুত সম্প্রদায়দের সাথে যুদ্ধে জিতে। এই তোমররাই প্রথম দিল্লি শহর বানানোর কাজ শুরু করে। তোমর শাসক অনঙ্গপাল বানান দিল্লির প্রথম কেল্লা, লাল কোট, যা পরে পৃথ্বীরাজ চৌহানের হাতে পড়ে আরও বিস্তৃত হয়ে জন্ম নেয় প্রথম দিল্লি শহরের; কিলা রাই পিথোরা।

    ২। মেহরৌলি : একদিন পৃথ্বীরাজেরও দিন শেষ হল। মহম্মদ ঘোরির হাতে তিনি পরাজিত হলেন। ১১৯২ সাল। তাঁর এক দাসের হাতে এই বিজিত শহরের রক্ষণাবেক্ষণের ভার সঁপে দিয়ে ঘোরি চলে গেলেন নিজের দেশ। সেই দাসের নাম ছিল কুতুবুদ্দিন আইবক। ১২০৬ সালে ঘোরির মৃত্যুর পরে তিনি নিজেকে দিল্লির প্রথম সুলতান হিসেবে ঘোষণা করেন। সূত্রপাত হয় দাস বংশের। হিন্দু শাসক থেকে মুসলমান সুলতান। ইমপ্যাক্টটা বেশ জোরালোই হয়েছিল সেদিনকার দিল্লির পক্ষে। আশপাশের সমস্ত হিন্দু স্থাপত্য ভেঙে কুতুবুদ্দিন আইবক স্থাপন করতে লাগলেন নিজের শহর, মুসলমানী স্থাপত্যে মোড়া। সেই শহর হল মেহরৌলি। সেই সব স্থাপত্যের মধ্যে একটি হল এক বিজয়স্তম্ভ, যা আজও আমরা কুতুব মিনার বলে চিনি। কুতুব মিনার সংলগ্ন এলাকাটির নাম আজও মেহরৌলিই।

    ৩। সিরি : দাস বংশপ্রদীপও একসময় নিভল। খিলজি বংশ এল দিল্লির শাসনভার হাতে নিয়ে। এই বংশের সবচেয়ে পরিচিত সুলতানের নাম আলাউদ্দিন খিলজি। তাঁর হাতে গড়ে ওঠে দিল্লির তৃতীয় শহর। সিরি। একটি কেল্লা, সিরি ফোর্ট, এবং এক বিশাল জলাশয় ... হাউজ খাস নামে, তিনি তৈরি করেন। শহর তৈরি হয় এই কেল্লা এবং জলাশয় ঘিরে। সে জলাশয় আজ আর নেই, তবে হাউজ খাস জায়গাটি এখনও আছে সিরি ফোর্টের পাশেই।

    ৪। কেটে গেল আরও অনেক বছর। ১৩২০ সালে দিল্লি দখল করলেন গিয়াস-উদ্দিন তুঘলক। তুর্কিস্তানের লোক। দুর্বল খিলজি বংশধরদের এক রক্ষক, নাসিরুদ্দিন মহম্মদ, ইসলাম ধর্ম নেওয়া এক পওয়ার রাজপুত, তখন দেখাশোনা করছিলেন দিল্লির। ফলে দিল্লি জিততে কোনও অসুবিধেই হয় নি তুঘলকের। এই গিয়াসুদ্দিন তুঘলকের হাতে গড়ে ওঠে দিল্লির চতুর্থ শহর, তুঘলকাবাদ। তুঘলকাবাদ ফোর্টের ধ্বংসাবশেষ আজও বিদ্যমান আজকের দিল্লির দক্ষিণ প্রান্তে, ওখলার পেছন দিকে। এগারোজন তুঘলক রাজত্ব করে গেছেন দিল্লির বুকে।



    কিংসওয়েতে একইসাথে দুই ভারত। আজকের রাজপথ।

    ৫। এরপর ফিরোজাবাদ। পঞ্চম শহরটি স্থাপনা করেন তুঘলক বংশেরই ফিরোজ শাহ্‌ তুঘলক। দিল্লির ঊষর দক্ষিণ প্রান্ত থেকে এই প্রথম তিনি সরে এলেন যমুনার পারে। কোটলা ফিরোজ শাহ্‌ বা ফিরোজাবাদ। নামটি এখনও ধরে রেখেছে দিল্লির মুখ্য ক্রিকেট স্টেডিয়ামটি।

    ৬। শেরগড় : তৈরি হয় পাঠানদের হাতে। ফরিদ খান, যাঁকে ইতিহাস চেনে শের শাহ্‌ সূরী নামে, দ্বিতীয় মুঘল সম্রাট হুমায়ুঁকে তাড়িয়ে তিনি দখল করেন দিল্লি এবং তৈরি করেন ছ'নম্বরের এই শহর। আজ প্রগতি ময়দানের পাশে, যেখানে আমরা পুরানা কিলা বা ওল্ড ফোর্ট দেখতে পাই, সেইখানে হুমায়ুঁ তৈরি করছিলেন "দিনপনাহ্‌' নামে এক শহর। শের শাহ সম্পূর্ণভাবে এই দিনপনাহ্‌কে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেন, এবং নতুন শহর তৈরি করেন। সেই শহরেরই নিদর্শন এই পুরানা কিলা। শের শাহ্‌ যতটা নির্দয় ছিলেন হুমায়ুঁএর সৃষ্টির প্রতি, হুমায়ুঁ কিন্তু ছিলেন তার ঠিক উল্টো। ১৫৫৫ সালে যখন হুমায়ুঁ আবার দখল করেন দিল্লির মসনদ, তখন শের শাহ্‌ মৃত, পুরানা কিলা তখনও সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে ওঠে নি। হুমায়ুঁ এই কেল্লাকে নিজের হাতে সম্পূর্ণ করেন। এর ঠিক এক বছর পরে, লাইব্রেরির সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে মারা যান হুমায়ুঁ। সালটা ১৫৫৬।

    ৭। সপ্তম, এবং ইতিহাসের পাতায় দিল্লির শেষ শহর, শাহ্‌জাহানাবাদ। আক্ষরিক অর্থে রাজকীয় মেজাজের ছিলেন আকবরের নাতি সম্রাট শাহজাহান। আগ্রার ফতেপুর সিক্রি যদি আকবরের মহান কীর্তি হয়, তা হলে তাকে হাজারগুণে টেক্কা দিয়ে গেছেন শাহজাহান, প্রেমের অনুপম সৌধ তাজমহল তৈরি করে। দিল্লির বুকে তিনি সৃষ্টি করেন এক বিশাল শহর, এবারেও যমুনার পাড়ে। লাল রংয়ের কেল্লার সুদীর্ঘ পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয় এই শহর। সেদিনের শাহজাহানাবাদ, আজকের পুরানি দিল্লি, ওল্ড ডেলহি। লালকেল্লা, চাঁদনি চক, জামা মসজিদ, মীনাবাজারে ঘেরা পুরনো দিল্লি, সপ্তম শহর। সেই গড়ে ওঠা আর ধ্বংস হয়ে যাওয়া সাত শহরের বুকে আট নম্বর শহর গড়তে এলেন এই দুই আর্কিটেক্ট। মনে উদ্দেশ্য, এই শহরের স্থাপত্য হবে মুঘল সাম্রাজ্যের থেকেও জাঁকজমকপূর্ণ, সৌন্দর্যে হবে নিউইয়র্ক বা প্যারিসের থেকেও মোহময়।

    ল্যুটিয়েন ছিলেন ডাচ বংশোদ্ভূত। বাবা ছিলেন একজন চিত্রকর। ১৪ সন্তানের মধ্যে ১১ নম্বর তিনি। শারীরিকভাবে তিনি ছিলেন রুগ্ন, কিন্তু সেই অক্ষমতা তিনি ঢেকে ফেলেছিলেন স্থপতি হিসেবে নিজের প্রতিভা দিয়ে। বাবার আঁকার ক্ষমতা তাঁর মধ্যেও সঞ্চারিত হয়েছিল। শরীরের প্রয়োজনে যখনই তাঁকে ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হত, তিনি ছবি আঁকতেন, পেনসিল দিয়ে কাগজে, কিংবা সাবানের টুকরো দিয়ে কাচের ওপর।

    বেকার ছিলেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু, দীর্ঘকালীন। আর ল্যুটিয়েনের স্ত্রী এমিলি লিটন ছিলেন আর্ল অফ লিটনের কন্যা। আর্ল ছিলেন ভারতের ভাইসরয়, ১৮৭৬ থেকে ১৮৮০ পর্যন্ত। দুজনেই দুচোখ ভরে দেখেছিলেন সেদিনের ভারতকে, কিন্তু দু রকম চোখ দিয়ে। এমিলি ছিলেন ভারতপ্রেমিক, ভারতের পরিবেশ, সেখানকার লোকজনকে, যতটুকু তিনি দেখেছিলেন, ভালোবেসে ফেলেছিলেন। অন্যদিকে এডুইন ভারতকে দেখেছিলেন এক শাসককূলের প্রতিভূ হিসেবে।

    ২০ বছর লেগেছিল, আজকের নতুন দিল্লি তৈরি হতে। প্রাথমিক বরাদ্দ ছিল ৯.১৭ কোটি টাকা। মাঝে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে কয়েক বছর অবশ্য কাজ বন্ধ ছিল। সেই ডামাডোলের বাজারে আরও একটা জিনিস ঘটেছিল, যা আজকের দিনে হলে টিভিতে "ব্রেকিং নিউজ' হয়ে যেত। কিন্তু ইতিহাস তাকে মিস্‌ করে গেছে, নীরবে।

    ঘটনাটা ছিল, লন্ডন থেকে দিল্লিতে প্রথম প্লেন চলা। দ্য ফার্স্ট ফ্লাইট। তখনকার ব্রিটেনের এয়ার মিনিস্টার স্যামুয়েল হোর এই ফ্লাইটে চেপে লন্ডন থেকে দিল্লিতে এসেছিলেন, মাত্র ১৩ দিনে। মাঝে কয়েকটা স্টপেজ ছিল : ইওরোপে ডিজন, মার্সেই, পিসা, নেপ্‌লস, মাল্টা, উত্তর আফ্রিকায় খোম, বেঙ্ঘাজি, সোলম্‌, আবৌকির, মধ্যপ্রাচ্যে জিজা, বাগদাদ, বুশির, জাস্ক (এইখানে ধুলোঝড়ের জন্য ফ্লাইট কিঞ্চিৎ ডিলেইড হয়েছিল), এরপর পাসনি, করাচি, যোধপুর হয়ে অবশেষে দিল্লি। ন্যাচারালি, ১৯২৭ সালের ৮ই জানুয়ারি, দিল্লির সেই এরোড্রোম থেকে সিভিল লাইন্‌সে ৭ কিলোমিটার দূরত্বে রাস্তার দুধারে লোক ভর্তি হয়েছিল তাঁকে স্বাগত জানাবার জন্য, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে!

    সেই এরোড্রোমের পরিত্যক্ত রানওয়ের ওপর দিয়ে এখন চলে গেছে ফ্লাইওভার। জায়গাটার নাম, সফদরজং।



    সাউথ ব্লক তৈরি হচ্ছে।

    এর ঠিক দশ বছর আগেই লর্ড মন্টাগু বলেছিলেন, এই দিল্লি একদিন হয়ে দাঁড়াবে দূরপ্রাচ্য এবং অস্ট্রেলিয়ায় যোগাযোগের মাধ্যম। এমন একদিন আসবে, যেদিন ব্রিটেন থেকে ইন্ডিয়াতে চিঠি আসবে এরোপ্লেনের মাধ্যমে।

    প্রাচ্যদেশে ব্রিটিশসিংহের নতুন রাজধানী হবে। তার স্থাপত্যের ডিজাইনার দরকার। প্রচুর প্রোপোজাল জমা পড়ল। ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে। দিল্লি রাজধানী হবে, সারা ভারত থেকে, দেশবিদেশ থেকে লোকজন আসবে এখানে থাকবে, দশকের পর দশক ধরে। সেই সব মাথায় রেখে প্ল্যান। অনেক কল্পনাবিলাসও ছিল সেই সব প্ল্যানে। এই রকম একটা প্ল্যান জমা পড়েছিল, যাতে লেখা ছিল যমুনার বুকে বাঁধ দিয়ে গড়ে তোলা হবে এক সুবিশাল লেক। বলা বাহুল্য, প্রস্তাবনাটি পরিত্যক্ত হয়েছিল।

    বহু ঝাড়াই বাছাই করে শর্টলিস্টেড হলেন এডুইন ল্যুটিয়েন আর হার্বার্ট বেকার। তাঁদের পারিশ্রমিক ছিল, মোট বাজেটের পাঁচ পার্সেন্ট। মোট বাজেট, পরিকল্পনার শেষদিকে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ১৩ কোটি টাকা।

    ব্যর্থ আর্কিটেক্টদের মধ্যে একজন ছিলেন হেনরি ল্যাঞ্চেস্টার। তিনি ছিলেন রাজার খুব নিকট লোক। নির্বাচিত হতে না পেরে তিনি পন্থা নিলেন সমালোচনার। বা বিরোধীপক্ষের। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বেকার আর ল্যুটিয়েনের কাজের ভুল বের করে তা রাজার কর্ণগোচর করাই হয়ে উঠল তাঁর নৈমিত্তিক কাজ। এবং সর্বক্ষেত্রেই এই সমালোচনার যা ফল হয়, শেষে এখানেও তাইই হল, ল্যুটিয়েন আর বেকার সহকর্মীর বদলে একে অপরের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠলেন, তাঁদের বন্ধুত্বে ফাটল দেখা দিল।

    কিন্তু সে-সব তো অনেক পরের কথা। প্রজেক্ট হাতে পাওয়ার পরে কী হল?

    প্রথমে জায়গা বাছাই। সিঙ্গুর, না সিঙ্গাপুর। অনেক খোঁজাখুঁজির পর দুটো জায়গা ফাইনাল হল। তখনও পর্যন্ত দিল্লির কেন্দ্রস্থল ধরা হত জামা মসজিদকে। তখনও পর্যন্ত যা ছিল দিল্লির সপ্তম তথা শেষ শহরের কেন্দ্রস্থল। এই দুটো জায়গা ছিল জামা মসজিদের দুদিকে, অনেক দূরে দূরে। জামা মসজিদকে ঘিরে তৎকালীন দিল্লি, শাহজাহানাবাদের কঙ্কাল তখনও ছিল ঘনবসতিপূর্ণ, তা ছিল দুদিকেই বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। তাই অবশেষে মসজিদের দক্ষিণ প্রান্তের ঊষর এবড়োখেবড়ো জমি চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হল একটাই কারণে, যা আজও প্রাসঙ্গিক।

    কারণ ছিল, লোকসংখ্যা কম, জমি অধিগ্রহণে কম সমস্যা হবে, পুনর্বাসনেও বেশি চাপ হবে না।

    সেই জমির মাঝে ছিল একটা উঁচু পাথুরে ঢিবি। তাকে ডাকা হত রাইসিনা হিল বলে। তার ওপরে বানানোর সিদ্ধান্ত হল ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু, দ্য গভর্নমেন্ট'স হাউস। যাকে আজকের লোক জানে রাষ্ট্রপতি ভবন নামে। তাকে ঘিরে মনোরম গাছে ছাওয়া অ্যাভেনিউ, সমস্ত রাস্তা তিরিশ কিংবা ষাট ডিগ্রিতে কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে একে অপরকে, ক্রশিংগুলোতে একটা করে রাউন্ড-অ্যাবাউট। সেদিনের ডিজাইন। আজও একই রকম। ল্যুটিয়েন্‌স দিল্লি। রাস্তার ধারে ধারে সরকারি আমলাদের জন্য স্পেশিয়াস বাংলো। সেদিনের সেই এবড়োখেবড়ো জমি থেকে আজকের এই হাই প্রোফাইল নিউ দিল্লি তৈরি হতে সময় নিয়েছিল ১৭ বছর। ডাইনামাইট দিয়ে ব্লাস্ট করে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল রাইসিনা হিলের মাথা। সারা দেশের সেরা ইঞ্জিনীয়ারদের একত্র করা হয়েছিল এই সুবিশাল প্রজেক্টে। ১৯২৫ সালের এক হিসেব অনুযায়ী, প্রায় ১৫০০ লোক এই শহর নির্মাণে কাজ করছিল। গরুর গাড়ি আর বহুমূল্য ফোর্ড গাড়ি একসঙ্গে দেখা যেত তখন কিংসওয়েতে। কিংসওয়ে আজকের রাজপথ। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে যে রাস্তাটা সোজা বেরিয়ে গিয়ে মিশেছে ইন্ডিয়া গেটের পায়ে।

    ১৯২০ সালে লন্ডনের ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ প্রবন্ধ লিখেছিল : "The New Delhi : A City to Rival Paris and Washington' । এর এগারো বছর বাদে, ১৯৩১ সালে ফর্মালি উদ্বোধন হয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এই নতুন রাজধানীর। রাজকীয় প্যারেড, আর ভাইসরিগ্যাল পার্টি থ্রো করা হয়েছিল গভর্নমেন্ট হাউসের সামনের লনে, যেখানে আজ হোম আর ডিফেন্স মিনিস্ট্রির অফিস।

    সেখান থেকে একটু দূরে, জামা মসজিদের আশেপাশে, পুরনো দিল্লিতে, গরুর গাড়ি আর ধুতি-গামছা পরা লোকজনের ভিড় লেগে গেছিল জনসাধারণের হরিরলুটের ভাগ নিতে।

    আরও ডিটেল্‌সে জানতে চাইলে, কিনে ফেলুন বইটা। নেটে পাওয়া যাচ্ছে ১৭৭৭ টাকায়। কালেক্টর্স এডিশন।



    চিত্রসৌজন্য: হিন্দুন্তান টাইমস লেখা:হিন্দুস্তান টাইম্‌সে বেরনো এক রিভিউ থেকে মোটামুটি টুকলি

    (Neelesh Mishra : Many Delhis Ago, HT, 2 August, 2009)

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১৯ অক্টোবর ২০০৯ | ৮৪৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন