১
শেষ ঘুমের আয়েস গায়ে মেখে অরুনমামা যখন সবে উঠবো উঠবো করছেন, সেই সময়েই তারস্বরে ঝাউর গিজোর গিজ ঘিনিতা বেজে উঠলো। ভোরের অলস আমেজটা চটকে যাওয়ায় উনি তেলে-বেগুনে জ্জ্বলে উঠলেন। মহাষষ্ঠীর সকাল সাড়ে সাতটাতেই কলকাতা ঘর্মাক্ত হল। তাতে অবিশ্যি কেউ খুব একটা চাপও নিল বলে মনে হল না। প্যান্ডেল-প্রতীমার শেষ সজ্জায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল সকলে। আরেকটা পুজো শুরু হয়ে গেল।
২
দোতলার ঝুল বারান্দাটার কোনে চেয়ারটায় বসে ব্রাশ করতে করতে মতু জগতের এই সব কান্ডকারখানা পর্যবেক্ষণ করছিল। বছরের বাকি দিনগুলির থেকে এই চার-পাঁচ দিন বারান্দার নিচের রাস্তাটার রুটিন পাল্টে যায়। এই গলির শেষ প্রান্তে প্যান্ডেল। এখান থেকে একটু ঝুঁকে ঘার ঘুরিয়ে তাকালে প্যান্ডেলের বড় গেটটার ভিতর দিয়ে অসুরটাকে দেখা যায়। আর একটু ঝুঁকলে অসুরের উপরে চেপে বসা সিংহের পাএর থাবাগুলি, আর একটু ঝুঁকলে...
- অ্যাই মতু অত ঝুঁকিস না, পড়ে যাবি।
বাবার বাজখাঁই আওয়াজে মতু রেলিঙের উপরে প্রায় ঝুলে পড়া অবস্থা থেকে চেয়ারে ফিরে আসে।
- তোকে কতবার বলেছি যে অমন ভাবে ঝুঁকবি না! পড়ে গেলে কি হবে? আর কতক্ষন ধরে দাঁত মাজবি! নে মুখ ধুয়ে নে এবারে...
বাবা ক্রাচ দুটো এগিয়ে দেন মতুর দিকে। ব্যাজার মুখে মতু ক্রাচ বগলে নিয়ে লম্বা বারান্দার উল্টোদিকে বেসিনের দিকে এগোয়।
৩
আনন্দময় হাজরার জীবনময় সাফল্যের ইতিহাসে একফোঁটা চোনা তাঁর বিবাহিত জীবন। সোমলতার সঙ্গে বিয়েটা একেবারেই সুখের হয়নি। দুজনেই উচ্চাকাঙ্খী এবং অনমনীয় হলে যা হয়। এই রকম সম্পর্কের ক্ষেত্রে শেষ ভরসা হিসেবে থাকে সন্তান। কিন্তু তাঁদের ছেলেটিও কোন সুখ বয়ে আনেনি পৃথিবীতে। জন্ম থেকেই আংশিক বিকলাঙ্গ এবং সামান্য জড়বুদ্ধি। মতুর জন্মের পাঁচ বছর পর থেকে তাঁরা আলাদা। ডিভোর্সের পর আদালত থেকে আনন্দময় মতুকে জিতে এনেছিলেন। সেও প্রায় চার বছর হতে গেল।
যদিও সামনা সামনি, বিশেষ করে ছেলের সামনে, তাঁরা স্বাভাবিক ভাবেই কথা বার্তা বলেন, সযত্নে তিক্ততা গুলিকে ঢেকে রেখে। ছেলের সাথে মায়ের দেখাও হয় প্রায়ই। তবে সোমলতা গেটের ভিতরে ঢোকেন না। এই দিনগুলিতে মতুর আনন্দ চোখে মুখে টের পাওয়া যায়। আজও পাওয়া যাচ্ছে। আজ মতু মায়ের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যাবে।
৪
অনেকদিন বাদে সোমলতা আবার এই গলিটার মুখোমুখি। মতুকে নিয়ে বেরোতে হবে আজ। গলির মুখের প্রসন্নর মিষ্টির দোকানটা পেরোলেই মনে হয় এবার সব হারানোর রাজ্য শুরু হল। পুরনো ক্ষয়িষ্ণু তথাকথিত বনেদী বাড়ির ভিতরে জীবনের কতগুলি বর্ণহীন বছর কাটানোর দু:সহ অভিজ্ঞতা মনে পড়ে বারবার। তবু স্রেফ মতুর মুখ চেয়ে কয়েকবার ফিরে আসা।
পুজোর কদিন এ গলির সব কটা বাড়ি আলোর মালায় সাজানো। দুপাশের আলোর সজ্জা দর্শনার্থীকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে প্যান্ডেল পর্যন্ত। ছোটর মধ্যে হলেও এ পাড়ার পুজোটার বেশ নামডাক আছে। তাই ভিড়ও হয়েছে বেশ। বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছতে হিমসিম খেতে হল সোমলতাকে। দোতলার ডোরবেলটায় হাত রেখে বেল বাজানোর আগে আবার একরাশ স্মৃতি ভিড় করে এল মনে।
৫
মতু সেজেগুজে মায়ের প্রতীক্ষায়। বাবা ঘরে টিভিতে সন্ধ্যের সংবাদে মগ্ন। মায়ের যেন আসতে একটু দেরিই হচ্ছে আজ। তবে মতু এখন ওর প্রিয় কোনটাতে ওর প্রিয় চেয়ারটায় বসে। পুজোর মধ্যে এই জায়গাটা আরো ভালো লাগে মতুর। এখান থেকে একটু ঝুঁকে ঘার ঘুরিয়ে তাকালে প্যান্ডেলের বড় গেটটার ভিতর দিয়ে অসুরটাকে দেখা যায়। আর একটু ঝুঁকলে অসুরের উপরে চেপে বসা সিংহের পাএর বড় বড় থাবাগুলি, আর একটু ঝুঁকলে... আচমকা কলিংবেল বেজে ওঠে... মতু ঝুঁকে পড়া অবস্থাতেই অন্যদিকে ঘার ঘুরিয়ে কে এলো দেখতে গিয়ে অনেক খানি ঝুঁকে পড়ে... পুরোনো নোনা ধরা রেলিং থেকে ইঁট খসে পড়ে... শেষ অবলম্বন হিসেবে মতু একটা ক্রাচকে ধরার আপ্রাণ চেষ্টা করে।
৬
শেষ পর্যন্ত কোন মন খারাপ করা দূর্ঘটনা ঘটেনি। মন ভালো করা একটা দূর্ঘটনা ঘটেছিল যদিও। মতুর চিৎকারে আনন্দময় শেষ মূহূর্তে মতুকে টেনে তোলেন। তার পর নিচে গিয়ে সামলান আতঙ্কবিহ্বল সোমলতাকে। মতুর চিৎকার শুনে উপরে তাকানোর পর থেকে দরজাটাকে আঁকড়ে ধরে তখনো থরথরিয়ে কেঁপে চলেছেন সোমলতা।
মতুর ঠাকুর দেখতে যাওয়াটা আজকে আর হয়ে ওঠেনি। তবে তার বদলে যেটা পাওয়া গেছে তার আনন্দ কোন অংশে কম নয়। আজ তারা তিনজনে একসাথে রাতের খাবার খাচ্ছে।
২৯শে মার্চ, ২০১০