আমার পরিচিত এক ভদ্রলোক বন্ধুমহলে কাউকে গালাগালি দিতে গেলে "অনিল বিশ্বাস" বলতেন। তবে অনিল বিশ্বাস মারা যাওয়ার পর উনি গালাগালির অভিধান থেকে এই শব্দটা বাদ দিয়েছিলেন বলে জানা গেছিল। এই সূত্রে মনে পড়ে প্রিয়রঞ্জন দাসমুন্সী একবার বলেছিলেন যে "এটা করতে না পারলে আমার নামে কুকুর পুষবেন"। উত্তরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর স্বভাবসিদ্ধ উত্তর ছিল "যাঁরা কুকুর পোষেন, তাঁরা জানেন অ-প্রিয় কোনো নামে পোষা কুকুরকে ডাকা যায় না"। দুই প্রজন্মের এই দুই সংলাপের সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা যোগ করে নিন্দা আর গালাগালির অন্তরমহলে একবার নজর দিতে ইচ্ছে হল।
গালাগালির কথা যদি বলেন তো গালাগালি কারে কয় / কে যে গালি কেন গালি, কে যে গালি নয়, ভাবতে গেলে তল পাবেন না। একটা শব্দ কেন গালি হয়ে উঠল তার কোনো সহজ ফর্মুলা থাকলে চিন্তা ছিল না, কিন্তু নেই। যেমন যে শব্দে আপনি অপমানিত হবেন, বা যে বিশেষণ আপনার খুব অপছন্দের, আপনার কাছে সেটা গালি। এইখানেই ব্যাপারটা জটিলে হয়ে গেল, কারণ ফর্মুলা থেকে বেরিয়ে সেটা আমার-আপনার পছন্দের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। যেমন আপনাকে গাধা বললে আপনি অপমানিত হলেন কিন্তু বাঘ, সিংহ এমনকি ঘোড়া বললেও হলেন না, বরং একটু যেন খুশিই হলেন, যদিও আপনার সঙ্গে গাধার তফাৎ যতটা, ঘোড়ারও ততটাই! কিন্তু ভেবে বলুন তো, সত্যি কি বাঘ-সিংহের যা স্বভাব, হিংস্রতা (পুরুষ-সিংহের আবার চূড়ান্ত কুঁড়েমি!) তা নিয়ে খুশি হবার কিছু আছে? তাই নিরীহ স্বভাবের মানুষ আমি হয়তো "গাধা" শুনে ততটা রাগ করলাম না বা "বাঘের বাচ্চা" শুনে ততটা খুশি হলাম না।
সিরিয়াস গালির মধ্যে অন্যতম হল "বাস্টার্ড" বা "বেজন্মা"। মানে সাদা কথায় একটা মানুষের মা-বাবা-র সঠিক পরিচয়টা জানা যাচ্ছে না, কিন্তু তাতে আপনার আমার কী এসে গেল? মা-বাবা একজোড়া আছে তো বটেই, আর তাদের পরিচয় এক্ষুণি জানা বা না জানার ওপর লোকটির ভালো-মন্দ-দোষ-গুণের বিশেষ কিছু এসেও যাচ্ছে না, তবু তাকে মন্দ বলতে গেলে এই বিষয়টা কেন উল্লেখ করতে হল, ভেবে বার করুন তো দেখি! আর সত্যি সত্যি পরিচয়হীন লোকেকেই যে বেজন্মা বলা হয়, তাও নয়, রাগের মাথায় এমন লোককেই হরদম "বেজন্মা" বলা হয় (আর সেও তা শুনে বেশ তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে), যার মা-বাবার আইডি নিয়ে কোনো সমস্যা নেই! ক্লীব বা নপুংসক কথাটাও বাঙলায় বেশ খারাপ একটা গালাগাল। কিন্তু আজকের যুগে যেখানে সংবিধান তৃতীয় লিঙ্গর অস্তিত্ত্বকে স্বীকৃতি দিচ্ছে, সেখানে এই শব্দটা গালি হল কেন বলতে পারেন? তবে হ্যাঁ, পুরুষতন্ত্রের চাপে যেখানে "মেয়েছেলে"ও একটা গালাগাল, সেখানে ক্লীব আর কতখানি সুবিচার পেতে পারে! তবে ওই যে গোড়ায় গলদ। যে হীনবল বা সাহসিকতার অভাব বোঝাতে ক্লীব শব্দটি ব্যবহৃত হয়, আমাদের দেখা নপুংসক গোষ্ঠীর সঙ্গে তার কোন সাযুজ্য নেই।
এইখানে গালাগালির আসল সংশয়। আপনি আসলে যা, সেটা বললে আপনি অপমানিত হবেন, নাকি আপনি যা নন, অন্যায়ভাবে আপনাকে সেইটা বললে আপনি অপমানিত হবেন, এটা বোঝার কোনো সরল সূত্র নেই। তবে শুধু গালাগালি নয়, রোজকার জীবনে ব্যবহার করা অন্যন্য শব্দের অর্থ নিয়েই বা আমরা কতটা সচেতন? মনের ভাব প্রকাশ করার তাগিদে আমরা কতসময় শব্দের প্রকৃত(আভিধানিক) অর্থকে ছাড়িয়ে একটা অন্যরকম অর্থের মধ্যে ঢুকে পড়ি তা ভেবে দেখেছি কি? তখন আপাত: নিরপেক্ষ শব্দও হয়ে উঠতে পারে নিন্দাসূচক বা প্রশংসাসূচক। কেমন করে, তা একটু দেখা যাক।
এইরকম একটা শব্দ হল আত্মপ্রচার, মানে নিজের কথা লোকজনকে বলে বেড়ানো। নিজের কথা, যদি মিথ্যে বা অতিরঞ্জিত না হয় তো সেটা লোককে বলা তো এমনিতে খারাপ কিছু নয়। কিন্তু তবুও আত্মপ্রচার কথাটা নিন্দাসূচক। নিজের কোনো কৃতিত্ব বা আত্মত্যাগের কথা নিজমুখে লোককে জানালে তাকেই আত্মপ্রচার বলা হয়। অথচ কেউ বেড়িয়ে এসে ভ্রমণ কাহিনী লিখলে কিম্বা কেউ নিজের কোনো ভুল বা অন্যায়ের কথা জনসমক্ষে স্বীকার করলে, সেসব কিন্তু কেউ আত্মপ্রচার বলে মনে করে না। অর্থাৎ এই প্রচলিত অর্থে আত্মপ্রচার=আত্মগরিমা প্রচার, গরিমাটা শব্দে উহ্য থাকলেও অর্থটা সে-ই নিয়ন্ত্রণ করে। আবার দেখুন সহজলভ্য, মানে সহজে যা পাওয়া যায়, একেবারে নিরপেক্ষ শব্দ। কিন্তু কখনও কখনও তা বেশ নিন্দনীয় অর্থে ব্যবহার হয়। তখন মনে হয় যা সহজলভ্য তা যেন ততখানি মূল্যবান বা গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু জল, বায়ু, সূর্যের আলো এইরকম কয়েকটা অতিমাত্রায় সহজলভ্য জিনিসের কথা ভাবলেই বোঝা যাবে সহজলভ্যতার সঙ্গে রুচিহীনতার তেমন কোনো সরলরৈখিক সম্পর্ক নেই।
গত লোকসভা নির্বাচনে এইরকম একটি আপাত:নিরীহ শব্দ আমাদের খবরের কাগজের পাতায় উঠে এসেছিল। কথাটা হল "নিরপেক্ষ", অর্থাৎ যিনি কোন পক্ষেই মতামত দেন না। শব্দটা প্রশংসাসূচক। কিন্তু সত্যিই যিনি কারুর সাতে-পাঁচে থাকেন না, কাউকে ভালো-মন্দ বলেন না, তাঁকে ভালো বলার বা ভাবার কি কোন কারণ আছে? এইরকম লোক কিন্তু কোন অন্যায়েরই প্রতিবাদ করবেন না; ভেবে দেখুন তো, বাস্তবে তেমন লোকের ওপর আপনি কতটা ভরসা করতে পারবেন? আর আদালতের জজসাহেব এইরকম নিরপেক্ষ হলে তো কোন মামলারই কোনদিন নিষ্পত্তি হবে না! এইখানে এসে নিরপেক্ষ শব্দটা আমাদের গভীর সঙ্কটের মধ্য ফেলে, আমাদের ভাবায় যে নিরপেক্ষতা তাহলে আসলে কি? কোন নিরপেক্ষতার কাছে আমরা আশ্রয় চাই? একটু ভাবলেই উত্তর মেলে। মতামতের নিরপেক্ষতা নয়, আসলে আমরা চাই বিচারবুদ্ধির নিরপেক্ষতা যার প্রকৃত অর্থ হল পক্ষপাতশূন্যতা। মানে সোজা কথায়, আমরা আশা করি ধর্ষকের অপরাধ বিচার করতে গিয়ে গিয়ে আপনি ধর্ষিতার চরিত্রের কথা ভাবেন না কিম্বা গানের ভালোমন্দ বিচার করতে গিয়ে গায়কের চেহারা বা ধর্মের কথা মাথায় রাখেন না। এই নিরপেক্ষতা কতদুর পর্যন্ত রক্ষা করা সম্ভব, ভালো খেলছে বা ভালো গাইছে বলে নিজের দেশের, কিম্বা নিজের রাজ্যের বা নিজের জেলার, নিজের ছোটবড়ো নানা বৃত্তের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষ সমর্থন কতটা সম্ভব এমনকি কতটা সঙ্গত, তা নিয়ে অনেক কথা ভাবার আছে। তবে সে অন্য গল্প।
এইসব জটিল বিষয়ের পাশ কাটিয়ে আমরা বরং বাঙলাভাষার প্রচলিত সবচেয়ে গন্ডগোলের শব্দবন্ধটার মধ্যে ঢুকে যাই : "পরনিন্দা-পরচর্চা"। মুখে মুখে যেটা এখন স্রেফ "পিএনপিসি"। আত্মগরিমায় টইটম্বুর হয়ে যে ভদ্রজনটি বলেছন "আমি পিএনপিসি করি না" আমরা বরং তাঁর কাছে জানতে চাই যে অন্যের নিন্দনীয় কাজ দেখলে তিনি কি করেন? পাশের বাড়ির দাদা বাচ্চা কাজের লোককে মারধোর করলে কিম্বা বাসে উঠে কেউ মেয়েদের সঙ্গে অসভ্যতা করলে, আপনি কি নিরপেক্ষতার দোহাই পেড়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে থাকেন, না প্রতিবাদ করেন? নিরস্ত্র মিছিলের ওপর পুলিশ গুলি চালালেও কি আপনি চুপ করে থাকেন আর বলেন "পরনিন্দা করব না না না না--" যদি তাই হয় তো জানবেন আপনি আদৌ মহান কিছু নন, ভীতু কিম্বা স্রেফ গা বাঁচানো লোক। আর যদি প্রতিবাদ করেন, তাহলে সেই তো নিন্দায় মুখর হলেন, আর তো পরনিন্দা করি না বলতে পারবেন না! তার চেয়ে মেনে নিন পরনিন্দা মানেই মন্দ কিছু নয়, বরং নিন্দনীয় কাজের নিন্দা না করাই অন্যায়। কিন্তু এই কথাটা আহলে আমরা বলি কেন? কারণ পরনিন্দা বলতে আসলে আমরা যা বোঝাই সেটা হল অপপ্রচার বা কুৎসা বা বিশ্বাসভঙ্গ করে কারুর সম্পর্কে কোন গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়া, এইসব। এইরকম বিচারে পরচর্চা হল আরও বেশি গন্ডগোলের বিষয়। কারণ চর্চা মানে আদৌ নিন্দা নয়; কারো বিষয়ে যে কোন আলোচনাই হল চর্চা (যেমন রবীন্দ্রচর্চা আর কি!)। আপনার লেখা কবিতা কিম্বা আপনার ছেলের চাকরি, যে কোন বিষয়ের প্রশংসা করতে গেল ও তো সেই চর্চা করতেই হচ্ছে, তাই না? সামাজিক মানুষের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ থাকলেই পরস্পরের প্রতি কৌতুহল, ভালো-মন্দ তথ্যের আদানপ্রদানও (মানে চর্চা!) থাকবে ; ততক্ষণ পর্যন্ত সেটা মন্দ নয়, যতক্ষণ আপনি সৎ থাকছেন, অপপ্রচার করছেন না। আসলে এইখানে পরনিন্দা-পরচর্চা কথাটা তার আক্ষরিক অর্থ থেকে সরে এসে অনেকটা ছোট পরিধিতে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, যার মধ্যে শুধু নিন্দাটুকুই ধরে।
আমাদের খুব পরিচিত ইংরেজি শব্দের মধ্যে দুটো কথা "ম্যানেজ" আর "প্রফেশনাল" নিয়ে কিছুদিন আগে আনন্দবাজার পত্রিকায় এক চমৎকার লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। সামাজিক অভিধানে ম্যানেজ মানে কিভাবে "ঠকানো" আর প্রফেশনাল মানে "ফাঁকিবাজ" হয়ে দাঁড়িয়েছে, তা সেখানে বেশ সুন্দর করে বোঝানো হয়েছিল। শব্দ এইভাবে কেন বদলে যায়, তার ভাষাতাত্ত্বিক কারণ নিয়ে ভাষাবিদরা ভাববেন। সামাজিক দিক থেকে ভাবা যায়, আক্ষরিক অর্থ থেকে বেরিয়ে সেই অর্থটুকুই টিঁকে থাকে বাস্তব যেটা সমর্থন করে। মানে অন্যের কথা বলতে গিয়ে আমরা হয়তো বেশির ভাগ নিন্দাই করি, তাই পিএনপিসি-র মানে কেবল নিন্দায় এসে দাঁড়িয়েছে! অর্থের প্রতি সচেতন থাকলে হয়তো শব্দনির্ভর অহেতুক নিন্দা বা প্রশংসার ভাগটা কমবে।
একটু অন্য প্রসঙ্গে যাই। দরকারের সময় জুৎসই শব্দ হাতের কাছে না পেলে আমরা অনেক শব্দ নির্মাণ করি, কিন্তু সবসময় কাজটা মন দিয়ে করি না। যেমন ধরুন "লিভ টুগেদার" এর বাঙলা হাতের কাছে না পেয়ে লিখে দিলাম "সহবাস"। অথচ সহবাস কথাটার একটা প্রচলিত অর্থ রয়েছে। কিন্তু একপা এগিয়ে আমরা যদি "সহবসবাস" লিখতাম, কি ক্ষতি হত? বাসও উঠত না, সম্পর্কটাও বেঁচে থাকত! তবে সবচেয়ে বড়ো ঝামেলাটা হল বাঙালির সবচেয়ে আদরের শব্দ "ভালবাসা" নিয়ে। ভালবাসার উল্টোপিঠে কি আছে না দেখেই লিখে ফেল্লাম "মন্দবাসা" কি "খারাপ বাসা"! যাব্বাবা : ভালবাসা হয়তো "ভালোবাসা" হতেও পারে, কিন্তু "ভালো বাসা"-তো কখনোই নয় যে শুধু ভালোর জায়গায় মন্দ লিখে দিলেই মানেটা উল্টে গেল (যেন বাসা বদলে গেল!)! এইরকম উদাহরণ আরো আছে। সেসব ঝামেলার বিস্তারে আর গেলাম না। কে কোথায় কি ভুল বলেছে তালিকা বানাবার চেয়ে বরং আসুন যেকোন শব্দ ব্যবহারের আগে তার অর্থ নিয়ে একটু ভাবা প্র্যাকটিস করি।
(কেবলমাত্র লেখকের ব্যক্তিগত ভাবনা ও ধারণার ওপর ভিত্তি করে এই লেখা; তথ্যগত / ব্যাকরণগত / ধারণাগত যে কোনো ভুল-ভ্রান্তি চোখে পড়লে পাঠক ব্যক্তিগত আলস্য অতিক্রম করে তৎক্ষণাৎ ভুলটি ধরিয়ে দেবেন, এই ভরসাতেই এই লেখা প্রকাশিত হল)