এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ইস্পেশাল  উৎসব ২০১৪

  • বাঙালির মদ

    সংহিতা মুখোপাধ্যায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ইস্পেশাল | উৎসব ২০১৪ | ১৯ অক্টোবর ২০১৪ | ১১৫১ বার পঠিত
  • সে অনেককাল আগেকার কথা। তখন নিয়মিত পাওয়ার কাট হতো পশ্চিমবঙ্গে। এমন পাওয়ার কাট যে রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মগুলোতেও আলো জ্বলতো না। লোডশেডিং হলেই অনগ্রসর অসভ্য শিল্পসমৃদ্ধিহীন একটা দুনিয়া চেপে ধরত এ বাংলাকে। সে সময়ে বিকেল থেকে সন্ধে কেটে যেত রেলস্টেশনে আপ-ডাউন লাইনে ট্রেনেদের আনাগোনা দেখে, গোণাগুণতিতে। এরকমই এক বিকেল সবে সন্ধে ছুঁই ছুঁই যখন তখন একটা দাড়িওলা লোক জ্যোতিবাবু, জ্যোতিবাবু করে চিৎকার করে হাওয়ার সাথে ঝগড়া করছিল। তার হাতে ছিল একটা ঠোঙা। ঠোঙা থেকে মাঝে মাঝে একটা আধটা মুড়ি, ছোলা, বাদাম ঠিকরে ঠিকরে পড়ছিল মাটিতে। মনে করেছিলাম লোকটার মুড়িতে ঝাল বেশি পড়ে গেছে। তাই লোকটা রেগে গেছে। ব্যাখ্যা শুনে জ্যাঠামশাই থমথমে মুখে বলেছিলেন,“না, লোকটা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গেছে। খারাপ কথা বলছে। শুনো না ওর কথা।”

    তখনও জানতাম না যে জ্যাঠামশাইও মাতাল। তবে তাঁর মাতলামি মদ খেয়ে নয়,  সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডেই বাহিত হয় তাঁকে মাতাল করে রাখা,  তাঁর সময়কে আচ্ছন্ন করে রাখা এক মতবাদ। কারণ তখন তো জানতামই না যে সেরিব্রোস্পাইনাল ফ্লুইডের মতো শক্ত শক্ত কথারা বাংলার ব্যবহারিক শব্দপুঞ্জে আছে। জানতাম না দ্রবণ কী। জানতাম না যে দ্রাবক মানেই জল নয়, অ্যালকোহোলও হয়। অ্যালকোহল মানে দুটো কার্বন, ছটা হাইড্রোজেন আর মাত্র একটা অক্সিজেন পরমাণু জুড়ে তৈরি একটা অণু,, যাতে একটা হাইডোজেন আর একটা অক্সিজেন পরমাণু জুড়ে একটা ফাংশনাল গ্রুপ তৈরি করে যেটা অ্যালকোহলের জাত পরিচয়। জানতামও না যে এই দ্রাবকই মিষ্টি তেতো পচা তাজা দ্রাবের সাথে মিশিয়ে দ্রবণ বানিয়ে নেশা ধরিয়ে দেয়,  পা টলিয়ে দেয়, কথা জড়িয়ে দেয় দ্রবণে মাত্র তিন শতাংশ থেকে চল্লিশ শতাংশ থাকলেই। কিংবা পঁচানব্বই শতাংশের বেশি থাকলে টোটাল শুইয়ে দেয়। এপাড়ে আর উঠে দাঁড়ানোর কোনো সিন নেই।

    বাঙালি কতদিন মদ খাচ্ছে? নিওলিথিক মানুষও মদ খেত। তাহলে বাঙালি, মানে যদি বাংলা ভাষাতে কথা বলে যে মানুষরা তাদের গোষ্ঠী হয় তো, চিরকাল মদ খায় বললে ঐতিহাসিক ভুল হয় না। কারণ বাংলা ভাষাটার বয়স মেরে কেটে হাজার বছর যোগ-বিয়োগ আরও কিছু বছর। তবে বাঙালি মানেই যে বাচাল আর মাতাল তা নয়। তাবড় গম্ভীর লোকেও পেটে দুপাত্তর পড়লে বেশ বাচাল হয়ে যায়। তবে বাচাল লোকেদের পেটে কয়েক পাত্তর পড়লে কী হয় না হয় বলা মুস্কিল। 

    কোন বাঙালি মদ খেলে (বা না খেলেও) কী করবে তাও বলা মুস্কিল। কেউ গায়ত্রী জপে, কেউ উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত গায়। আর আপামর বাঙালির মদ হয়ে ওঠে এই মতবাদ সেই আদর্শ। তখন অ্যালকোহলের প্রয়োজন হয় না। নিজের সেরিব্রো-স্পাইনাল ফ্লুইড-এর সংকেতেই সে নেশাতুর হয়ে যায়। ভ্রমাতুরও হয়ে ওঠে। পড়শির জমি থেকে, কড়া মাস্টারের ধমক সবেতেই সে শ্রেণীগত শত্রুতা দেখতে শুরু করে। তারপর হঠাৎ রাত পুইয়ে সকাল হওয়ার মতো নেশা কেটে একদম ঝকঝকে বেচুবাবু হয়ে যায়। 

    বেচুবাবু বললে মনে হয় যে বাবু কালচারে বোধহয় বাঙালি মদে ভাসলো, জগাই-মাধাই যেন খাপছাড়া লাম্পট্যের ব্যতিক্রমী কিন্তু ছোটো-খাটো খুচরো ঘটনা। কোন সমাজেই বা আপামর জনতা মদের নেশায় চুর? আবার একসময় ওষুধ কোম্পানির বেচুবাবুরা একত্র হলেই গেলাস বোতলের ঠুনঠুনানি শোনা যেত। পাড়ার যে বাড়িতে অন্য লোকেদের আড্ডা থেকে সেই শব্দ আসত, তাদেরও তকমা হয়ে যেত চরিত্রহীন। হয়তো এতে সত্যিও ছিল খানিক.....। কারণ আজও যৌন আচরণে কামনায় অনিচ্ছুককে চোবাতে মদই জবরদস্তদের প্রিয় পছন্দ বলে দেখা যায়।

    বাঙালির জীবনে মদ যেন স্খলনের মাধ্যম, দ্রাবক। তাই লক্ষ্মীমন্ত মা এরোপ্লেনে চেপে ভারতের আকাশসীমা ছাড়িয়ে বিমানসেবিকার হাত থেকে ওয়াইনের পাত্র নিয়ে বাবাকে দিয়েই বলতেন,-ঘুমিয়ে পড়ি বাবা, ঝিম ধরবে এখ্‌খুনি, নাকে অল্প গন্ধ গেছে না!... গল্পটা বলতে বলতে ধিঙ্গি মেয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে। কারণ তার আবার বিয়ার-টিয়ার চলে না, তার অভিধানে বিস্ময়, “টেকিলা ছাড়া আর কিছু খেয়ে নেশা হয় নাকি?”

    এদিকে অ্যাডভেঞ্চারে ব্লাডিমেরি শুষে ঝিম ঝিম মনে কারুর এও মনে হয় যে, - টোম্যাটো জুসটা নষ্ট করে ফেলল ভদকা-ফদকা মিশিয়ে।“ কারু মনে হয় কার্বোনেটেড স্পার্কলিং ওয়াইনের বাব্বলগুলোই প্রেমের ফ্রেম কিংবা প্রেম। ফ্রেম কারণ ধরে রাখতে পারে না, নিজেই শূন্যে গায়েব হয়ে যায়। কিংবা ধরার আগেই ভ্যানিস। কেউ কেউ প্রথম বিয়ার অ্যামস্টারডামে খেলে জাপান থেকে জগদ্দল সবর্ত্রই কিরিন বা কল্যাণী ব্ল্যাক লেবেল নয়, হানামাচি বা হেওয়ার্ডস নয়,এমনকি হয়তো মঙ্গলে, চাইবে হেইনিকেন খেতে। মদের নেশারুদেরও নিজস্ব ব্র্যাণ্ডবদ্ধতা থাকে।

    বিদেশে সেই অনাবাসী দাদারা সহজেই জনপ্রিয় হন যাঁরা অকাতরে ভিন্টেজ ওয়াইন বর্ষাতে পারেন সদ্য প্রবাসী মাতৃভূমিতুতো কিংবা মাতৃভাষাতুতো ভাইবোনকে। অতি পচা টক মিষ্টি আর অল্প, খুব অল্প অ্যালকোহলের অল্প ঝিমঝিমে নেশাতে কী সুখ বোঝা ভার। স্বাদে না পাওয়া যায় সুখ, না নেশা করে হওয়া যায় টুং। এ যেন পশমের বা কম্বলের ওমটুকু ছেড়ে মন্টেকার্লোর পকেট গরম স্টেটমেন্ট।

    কাক যেমন কাকের মাংস খায় না তেমনও চন্দনগরের চোলাইওয়ালিরা চোলাই খায় না। সমস্ত আপিস টাইম জুড়ে তারা ভারী ভারী বেঢপ বেঢপ নাইলনের ব্যাগ নিয়ে একে কনুইয়ের গুঁতো,  ওকে চিমটি দিয়ে উঠে পড়ে যাবতীয় গ্যালপিং ট্রেনে। ব্যাগগুলোর মুখে থাকে কাপড় বাঁধা। পচা শস্যের গন্ধ ম ম করে ওঠে চৌহদ্দি। ব্যাগের গায়ে হাত দিলে টের পাওয়া যায় ভেতরের মালের টলটলানি। তাতে গন্ধ আরও তীব্র হয়ে ওঠে যেন। মনে হয়,-ম্যা গো, এইটাও আবার লোকে সেধে খায়? কখনও কখনও ব্যাগের সাথে থাকে কালো রঙের জ্যারিকেনও। তারপর তাদের বোঁচকাগুলো তারা ঠেলে ঠেলে ঠুসে দেয় ইএমইউ কোচের সিটের নিচে। ভদ্রমহিলাদের তখন গন্ধে ওয়াক উঠে আসে। তাঁরা নাকে হাত চাপা দেন কিংবা দরজা দিয়ে মাথা বাড়িয়ে তাজা হাওয়ায় নিশ্বাস শুদ্ধ করে নিতে ঠেলাঠেলি লাগিয়ে দেন। আবার এঁদের দরজা থেকে ঠেলে সরিয়ে লিলুয়া আর হাওড়ার মধ্যের এলাকায় ট্রেন দাঁড়ালে ঝপাং ঝপাং করে ট্রেনের দরজা দিয়ে ঝরে পড়ে বোঁচকাগুলো। যাদের বোঁচকা তারা বেশ নিশ্চিন্ত থাকে যে মোড়ক ফেটে মাল পড়বে না। কিন্তু সহযাত্রীনিরা সন্ত্রস্ত হয়ে থাকেন এই ভেবে যে বাধা মালের এত দূর্গন্ধ, না জানি মালের ফোয়ারা ফুটলে কী নরক যন্ত্রণা সইতে হবে। এই সব ব্যাগের মালকিনরাও মাসি। কোনো মাসি হাওড়া স্টেশনে নেমে পার্টি বা মধ্যবর্তী লোকটিকে খুঁজে বের করে মাল হস্তান্তর করে প্ল্যাটফর্মেই। দারুণ অর্থনৈতিক লেনদেন। তবে অগ্রন্থিত। তাই কার লাভ কার ক্ষতি তার খতিয়ানও নেই। ব্যবসার সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষগুলো তাই হদ্দ গরীব, অন্ত্যোদয় যোজনার চাল পেতে অভ্যস্ত। সেই চাল থেকেই কী...।

    এই সব অপরিমিত মাপের মদ চালান হয়ে যায় শহর কলকাতা আর শহরতলির নানান ঠেকে। খোদ চোলাই মদের শহর চন্দননগরেই পৌরসভা পরিচালিত মূল বাজারের কাছে আছে পর্দা ঢাকা দরজা খোলা দেশি মদের ঠেক। সেটা অবশ্য হাওড়ার কদমতলা কিংবা সল্টলেকের উদয়ন লাগোয়া মদের দোকানের মতো গরাদ ঘেরা নয়। মদ তৈরি করে, বাজারে সরবরাহ করে মদ্যপায়ীর কাছে খুচরো ব্যবসায় বেচা অবধি একটা বন্টন ও ব্যবসায়িক ব্যবস্থা রমরমিয়ে চললেও,  সেটাকে বেআইনি তকমা দিয়ে আসলে রাজস্বে ফাঁকির একটা ব্যাপক ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারওপর এই উৎপাদন ও বণ্টন ব্যবস্থায় যুক্ত সব কর্মীই আইন ভেঙে অপরাধী হয়ে থাকছেন। তাতে আখেরে সুবিধে হচ্ছে (অর্থনৈতিক মুনাফা হচ্ছে) আইনের রক্ষকদের আর(অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক মুনাফা হচ্ছে) আইন প্রণয়নকারীদের। এই ব্যবসা থেকে প্রচুর কর আদায় করা হলে,  ব্যবসাটা মার খেয়ে কমে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল হয়তো। তবে উৎপাদনের তুলনায় যোগান কমলে অবশ্য নিতান্ত গরীবের পানীয়ের মূল্য বৃদ্ধিতে গরীবই শুকিয়ে যেত পান করতে না পেরে (আহা রে!)। তাই বোধ হয়, এই ভোগ্যদ্রব্যকে উৎপাদন,বণ্টন ও ভোগ করার পুরো ব্যবস্থাটাই আইন করে নিষিদ্ধ রাখা হয়েছে। তাতে গরীব (করে) রাখতে আর গরীব পালতে একদল দরিদ্রদরদীর বড্ড সুবিধেই হয়েছে। গরীবেরও অনেক সুবিধে হয়েছে, কারণ চৌর্যবিদ্যা মহান বিদ্যা ধরা না পড়া অবধি, ছেঁড়া শার্ট আর রঙ চটা লুঙ্গির আড়ালে গরীব অবতার যাপনকরা হয়েছে, অগ্রন্থিত মুনাফা ও মালিকানায় লাল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও। এই ব্যাপারটা অবশ্য এক্সট্রাপেনিনসুলার ইন্ডিয়ার সর্বত্র একই রকম। ব্যাপারটা মদের সাথে বাঙালির এক্সক্লুসিভ সম্পর্ক নয়। কিন্তু যেমন বাঙলাভাষী মানেই বাঙালি, তেমনই বাঙালি মানে এক্সট্রাপেনিন্সুলার ইণ্ডিয়ার বাসিন্দাও বটে। তাই মদের সাথে বাঙালির সম্পর্ক বর্ণনায় চোলাই মদের উৎপাদন, সরবরাহ, বণ্টন বিপণন নিশ্চয়ই প্রাসঙ্গিক আলোচনা।

    সেই যে দেড়েল মাতালের কথা দিয়ে বাঙালির মাতলামি বা মাতলামির মূলে থাকা মদ খাওয়ার কথা শুরু হয়েছিল, তাঁর পেশা ছিল রিক্সাটানা। তিন চাকার সাইকেল রিক্সাটানা। যাঁরা অমন পরিশ্রমের কাজ করেন তাঁদের নাকি না খেলে চলে না। খেলে অধিকাংশ সময়েই বেসামাল হয়ে পড়েন। তখন ব্যাথার গোড়া উগরে ঢেলে দেন সাহসে কুলোলে জ্যোতিবাবুর ঘাড়ে। আর মিনমিনে মেনিমুখোরা জ্বালা মেটাতে পেটান বউকে, মেয়েকে, ছেলেকে। এই কর্মটি যে নেহাৎ খেটে খাওয়া মানুষের শ্রেণীচরিত্র নয়, তাও স্পষ্ট হয়ে যায় যখন দেখি এক কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসার সাহেব তাঁর রাজ্য সরকারি অফিসার স্ত্রীকে পিটিয়ে পরোটা বানাচ্ছেন শুক্র, শনি, রবিবার। তাঁরা এক নতুন পাড়ায় বাসা নেওয়ার পর বছর চারেক ধরে কর্তাটির শুক্রবার মধ্যরাত্র থেকে শুরু হওয়া পাড়া কাঁপানো খেউড় আর তাঁর প্রহারে আহত, আক্রান্ত কর্ত্রীর আর্তনাদে পাড়া কাঁপলে পরে পাড়ার লোকের মাতাল পেটানোর নেশা হয়। এক শুক্রবার তাঁরা বাড়ির দরজা ভেঙে মাতালকে বার করে নিয়ে বেধে রাখে পাড়ার সব থেকে ক্ষয়াটে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে। উন্মত্ত কিছু চড়-চাপড় আর জোর করে তেঁতুল জল দিয়ে নেশা ভাঙানোর প্রয়াস চলে। কেউ পুলিস ডাকে নি।

    ডাকলে কী হতো? পুলিশ, মানে বাঙালি পুলিশ হয়তো (নব্বই শতাংশ প্রোবাবিলিটি ছিল) মাতালের থেকে বোতল বোতল মদ চাইত ঘুষের অংশ হিসেবে; হয়তো (নব্বই শতাং প্রোবাবিলিটি ছিল) পাড়ার অভিযোগকারীকে রসালো ভাষায় জানাত মাতালের বউয়ের নিতম্বের গড়ন আকর্ষণীয় কিনা। হয়তো (নব্বই শতাং প্রোবাবিলিটি ছিল)পাড়ার মাতাল ঠ্যাঙানির উদ্যোক্তার সাথে মাতালের বউয়ের একটা এক্সট্রা ম্যারিটাল প্রেম চলছে, তাই যৌন হিংসে থেকেই এমন ... হরিদাসপালদের কী দরকার ভদ্দরলোক দ্যাবাদ্যাবিদের কেসে থাকার? বলে সুপরামর্শ দিত।

    পুলিশের এই মেথিলেটেড স্পিরিটে জল মিশিয়ে নিষ্কর্মা থাকার নেশা যে কবে কাটবে কে যেন। হয়তো কাটবে না। কালীপদ সাঁতরার কাল থেকেই ডিউটি ফ্যাটিগে কাৎ পুলিশের তো চৌত্রিশ বছরের শ্রমজীবী হিসেবে অধিকাংশ শোষণ দূর হয়ে গেছে, মাইনে, ঘুষ থেকে ডিউটি সবেতেই তো আরামের ব্যবস্থা হয়ে গেছে। তাহলে পাতা হাতে প্রণামী না পড়লে কেন চোখ লাল হয়ে যায় পুলিশের? নাকি জবরদস্তির মদ রক্তে এমন মিশেছে যে মারের চোটে ভুবন ভোলাবার নেশাটা স্বাভাবিক স্বয়ংক্রিয়তায় জাগে?

    বাঙালি অবশ্য নেশা করে মদ না ছুঁয়েই। সেসব নেশা অন্যরকম। সেসব নেশায় ধর্মের আফিমের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠার জন্য থাকে বিদ্রোহের মদ। দিনবদলের স্বপ্ন সার্থকের বাস্তবজ্ঞানরহিত খুনোখুনিতে থাকে বিপ্লবের মহতীপনার মদ। যেমন মাতাল ঠ্যাঙানোর মধ্যে থাকে পাড়া-উদ্ধারের প্রেরণার মদ। কারণ দেশের মানুষের খাওয়া-পরা-থাকা সংক্রান্ত বেজায় সংকট না থাকলে দেশোদ্ধারের মদের পিপেটাই ছোটো ছোটো করে ভেঙে পিন্ট পিন্ট পাত্তরে পাড়া উদ্ধারের বা এলাকা উদ্ধারের বা বাড়ি উদ্ধারের বা উঠোন উদ্ধারের মদ বিলি হতে পারে। আবার এর পাশাপাশি আরেকটা মদেরও স্রোত বয়ে যায়, একই দিকে না বিপরীতে কখনই স্পষ্ট বোঝা যায় না যদিও, সে মদের নাম কখনও ধর্ম, কখনও ক্ষমতা। আবার এদের বিরুদ্ধতার মদও ফিনকি তোলে আর বিরুদ্ধতাটাই কখনও ধর্ম আর ক্ষমতা হয়ে যায়। আর তার বিরুদ্ধতার মদও চোলাই হতে থাকে। যেন এক চক্রাকার স্বয়ঙক্রিয় সংশ্লেষ, পচন ও পুনর্সংশ্লেষ প্রক্রিয়া।

    বাঙালির মদ নিয়ে প্রচুর ভ্রান্তিবিলাসও আছে। কিডনির অসুখ হলে বা কিডনি কাজ না করলে এবং অসুস্থ ও/কিংবা অকেজো কিডনির জন্য কেউ মারা গেলে আত্মীয়চক্রে, পাড়ায়, পরিচিত মহলে রটে যায়, “লোকটা খুব ড্রিঙ্ক করত তো....”এক ঘটনা ঘটে সেরোসিস অব লিভারেও। মধ্যবিত্ত পরিবারের রক্ষণশীল গিন্নিরা রক্তবমি করে মারা গেলে তাঁর রোগ লুকোনোর ব্যারামটাই তাঁকে ট্র্যাজিক হিরোইন বানিয়ে দেয়। অথচ রক্তবমির পরে বা আগে সেরোসিস অব লিভার নির্ণয় হলে বাঙালি আকাশ থেকে পড়ে, “মদ-বিড়ি না খেলেও ক্যান্সার হয়?” যেন জগৎ সংসারে হেপাটাইটিস এ ভাইরাসের কোনো অস্তিত্বই নেই। আবার কিছু বাঙালির মদের নেশা এমন যে পয়সার অভাবে পুজোর নতুন জামাটাই বাঁধা রাখে মদ খেতে। জামাটা, বলাবাহুল্য, তারস্বোপার্জনে কেনা নয়। জামাটা তাকে রোজগেরে মা, বোন, বৌ কিংবা বাবা, ভাই, ভায়রা কেউ কিনে দিয়েছিল। মদে ডুবে থেকে এরা ভুলেই যায় যে শুধু খাবার নয়, পানীয়ও ফোকটে জোটে না।

    কারও কারও মদ খেয়ে এমন হুঁশ গায়েব হয় যে কাকে মারছে খেয়াল থাকে না। একটা লোক আপিসের কোয়ার্টারে থাকত। আপিসে তার যত শুভাকাঙ্খী (নাকি ওস্তাদি আর দাদাগিরির আখড়া) ছিল, সব্বাই মাইনের দিন তার মাইনের আদ্ধেকটা তাকে দিয়ে বলত, “মাতলামো করেছ, কাজ কর নি, তাই মাইনে কাটা গেছে।“ সেও ঢক ঢক করে ঘাড় নেড়ে চলে যেত। তারপর সারা বাড়ির, বিশেষত রান্নাঘরের, সমস্ত জিনিস ছুঁড়ে ফেলে, ভেঙে খুঁজে বেড়াত তার বাকি মাইনেটা কোথায় আছে। সে নিশ্চিত জানত যে বাকিটা তার বউকে দেওয়া হয়েছে। একবার তো বউয়ের থেকে টাকা আদায় করতে না পেরে বউকে পিছমোড়া করে বেধে তার মাথায় কেরোসিন ঢেলে আগুনে পুড়িয়ে মারার জোগাড় করেছিল লোকটা। তাকে পুলিশে দেওয়া হলে,  সে কবুল করেছিল  থানায় যে তার সন্দেহ হয় কিনা তার বউয়ের পিরীত চলছে তার আপিসের একজনের সাথে, তাই সে বউকে ভয় দেখিয়ে লোকটার নাম জানার চেষ্টা করছিল। যদিও লোকটার ছেলেমেয়েরাও লোকটার নাতিপুতিদের ট্যাঁকে নিয়ে ড্যাবড্যাবিয়ে শুনেছিল পুলিশের কাছে লোকটা যে বয়ান দিয়েছিল সেটা, কিন্তু তারা বিশ্বাসই করতে পারে নি যে প্রৌঢ়ত্বের সীমায় তাদের বাবা-মা এক্সট্রা ম্যারিটাল অ্যাফেয়ারে জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। তারওপর পুলিশ মদ খেয়ে বা না খেয়ে নারী-পুরুষের সম্পর্কের সব ধরনের টানাপোড়েনকে “এক্সট্রা ম্যারিটাল”-এর খোপে পুরতে পারে পেশাদারি দক্ষতায়।

    আসলে মদ আর বাঙালির সম্পর্ক যেমনই হোক এক্সট্রা ম্যারিটাল নয়। বাঙালি বাংলা খাক আর বিলায়েতি, মাতলামো করুক বা না করুক বাঙালি যত ধরনের হয়, বাঙালি মাতালও তত ধরনেরই হয়। একধরনের মাতালের মনে হয় তাদের মাতলামি কদর্য নয়, মাধুর্যময়। যাদের মাতলামি তাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে কদর্য তাদের চোখেও এরা এবং এদের মাতলামো খারাপ। আবার অন্যরকমও হয়। তাই বাঙালি যে অবলীলায় মদ (এবং তার বিরোধিতায়ও) মত্ত থাকবে আগামীতে, সেটাও নিশ্চিত।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ইস্পেশাল | ১৯ অক্টোবর ২০১৪ | ১১৫১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই মতামত দিন