কবীর সাহেব,
মূলতঃ শেয়ার ও লাইক পাওয়ার আশায় লিখছি এই চিঠি, আপনি ঠিক পড়বেন জানি তাই আরেকটা তাগিদও কাজ করছে। হোপফুলি পুরোটা পড়লে সেই জায়গাটা ধরতে পারবেন। সমাজ-রাজনীতির অনেকটাই আসলে আপনার গান আর ডায়লগ থেকে শিখেছি। একপাতা স্পিভাক না পড়েও 'Can Subaltern speak' নিয়ে চা-এর আড্ডা ফাটিয়েছি স্রেফ সাঁওতাল তার ভাষায় বলবে রাষ্ট্রপুঞ্জে- লাইনগুলো সম্বল করে। কিম্বা কলামন্দিরে যেদিন বললেন 'বিচ্ছিরি সময়ে সুন্দর থাকতে পারাই সবচেয়ে বড়ো প্রতিবাদ', গান্ধিজির লেখা থেকে 'Constructive Programmes' এর ওপর প্রবন্ধগুলো পড়ার দরকার হয় নি আর। এরকমভাবে বড় হতে হতে আমার প্রেমের গান হয়ে ওঠে 'সব অভিমান আকাশের চেনা চেনা/ সবার জন্য সুদিন কি আসবেনা' কিম্বা 'ফুলের চেয়ে ভাতের গন্ধ ইচ্ছে করে/ আমার দেশে সবার দেশে সবার ঘরে'। চিনতে শিখি 'ধারা বদলায় মাও সে তুং-এর চিন' কিম্বা আইডেন্টিটির প্রশ্নে দিব্যি গানগুলোকে মিলিয়ে নিতে পারি- 'দরকার হলে আমি খুব প্রাদেশিক/ রাষ্ট্র মানিনা নিজের ভাষাকে ভুলে', তার কারণ 'ভাষার থালায় ভাত খেতে বসে অপার নিখিল'। রোজা-লেনিন তর্ক না পড়েও জেনে যাই 'বিরোধীর স্বাধীনতাটাই স্বাধীনতা সাব্যস্ত হোক'।
ফলে, আপনার গান-টান শুনেই আমি জেনে গেছি আমার কান্না আগুন জ্বালালে আমি সন্ত্রাসবাদী আর ফুলমণির মতন ইশরাত জাহানও আমার বোন। ঠিক হোক বা ভুল হোক, শর্মিলা হোক বা কোটেশ্বর রাও। লড়াইটা সত্যি আর সত্যি সেই ঘটনাগুলো যা এদের কে লড়াইয়ে এনে ফেলেছে।ইশরাত হত্যার নায়ককে নিয়ে সারা ভারতের মিডিয়া যখন নাচানাচি করে, আমার রাজিয়া খাতুনকে দেখে সত্যিই মনে হয়- 'যে যেখানে লড়ে যায় আমাদেরই লড়া'। ভুল আমরা কে করছিনা? ভুল পথে আমরা কে হাঁটছি না? উন্নয়নের ওই ধারে দেশজুড়ে মৃত্যুর মিছিলে আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবেও কি দায়ী নই? আমরা প্রগতির পথে রাজনৈতিক ভাবে সঠিক হয়ে থেকেছি তখনও, যখন মরিচঝাঁপিতে গুলি চলল কিম্বা রাজারহাটে সেচের জল বন্ধ করে দেওয়া হল। তাই এবার অন্তত ভুল করার সাহস দেখিয়ে বলি রাজিয়া-আমিনাও আমার বোন। ওদের পথ ভুল হলেও তা এটুকুই শুধু দেখায় যে, যে রাস্তার নামে আমরা জয়ধ্বনি করছি তা আরও বড় ভুল, আরও অন্যায়ের। খাগড়াগড় যেদিন ঘটল, ফেসবুকে জনৈক ভদ্রলোক লিখলেন, এ নিয়ে কবীর সুমন গান লিখবেন না? আমি দেখলাম আমিও তো কান পেতে রয়েছি, যেরকম জঙ্গলমহলে যৌথবাহিনী যাওয়ার সময়ে ছিলাম ছত্রধরের গান শুনবো বলে। কিন্তু 'অপাপবিদ্ধ'দের এই উল্লাস বড় পীড়া দিল, সেই মে-মাস থেকে পীড়া দিয়ে আসছিল, আপনার হয়ে নিজেই লিখে ফেললামঃ
'ছোটবিজ্ঞান বড়বিজ্ঞান অর্থনীতির গাছপাথর
রাইফেল হাতে রাজিয়া বেগম দুর্গ করেছে খাগড়াগড়
সেজো সেকুলার মেজ সেকুলার আলোকপ্রাপ্ত কলোনিঘর
অন্ধকারের অন্দর থেকে ধর্মযুদ্ধে খাগড়াগড়
জান কবুল ঐ গাঁয়ের বধূর আঁচলে বোমার আগুনভর
মার্জিন থেকে কেন্দ্র নাচায় আমিনাবিবির খাগড়াগড়।'
এটা লিখে ফেলায় প্রচুর গালাগালি খেলাম। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, শতাব্দী ধরে উন্নয়নের উল্টোপিঠে দুর্ভিক্ষ অশিক্ষা আর অস্থিরতায় ফেলে রাখা 'কোনো এক গাঁয়ের বধূর' নাতনিরাই যে রাজিয়া আমিনা হয়ে বন্দুক তুলে দাঁড়াচ্ছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়,সন্ত্রাসবাদ যে আর্থসামাজিক বৈষম্যেরই ফল সেইটা বলার লোক দেখলাম কমে আসছে। দশবছর আগেও অনেকে এগুলো বলতেন। এখন পৃথিবী ক্রমেই একমেরুর দিকে এগিয়ে চলেছে, হয় তুমি আমাদের নাহলে শত্রুপক্ষ- মাদ্রাসা কী ও কেন সেই প্রশ্নে না গিয়েই চলল মাদ্রাসাবিরোধী প্রচার। ডাক্তার-স্বাস্থ্যকেন্দ্র না বানাতে পারলে কোয়াকদের তুলে দেওয়া যায় না। গ্রামে স্কুল না বসিয়ে মাদ্রাসা তোলা যায় না। বসিয়েও যায় কিনা প্রশ্ন। কিন্তু যে রাষ্ট্র নাগরিকদের শিক্ষার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা করতে পারেনা, সে কী করে বিকল্প শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো তোলার কথা বলে সেই প্রশ্ন করার লোকও কমে যাচ্ছে দেখলাম। 'স্লোগান পালটে হয়ে যায় ফিসফাস'।
ভারত ক্রমশঃ তার ব্রাহ্মণ্যবাদী চরিত্রটা মেলে ধরছে। অর্থনীতির পাশাপাশি সামাজিক আচারগুলোতেও সংখ্যালঘু-দলিতদের সরিয়ে দেওয়ার পর্যায়টা চলছে। বছরখানেক আগে,হায়দারাবাদ গেছিলাম। জামা মসজিদ ঘোরার সময়ে আমি ও আমার বন্ধু একটি করে ফেজ টুপি কিনে মাথায় পরি। তারপর এদিক ওদিক ঘুরে হুসেন সাগরে নৌকোয় উঠলাম, যাওয়ার সময়ে টুপিটা খোলা ছিল, পাশে কিছু সহযাত্রী বসেছিলেন, আইটিতে চাকরি করেন বা ওরকম। নৌকোয় ফেরার সময়ে টুপিটা মাথায় দিতে দেখি পাশে আর কেউ এসে বসছেন না। পরিতাপের বিষয়,আমাদের দেশে এটাই রিয়েলিটি- মার্জিনের ওপারে এক বিশেষ পরিচিতির বাইরের লোককে ঠেলে দেওয়া। আর, সেখান থেকে যে প্রতিরোধ-প্রতিবাদ আসে, তাকেও আমাদের শর্ত মেনে হতেই হবে, এও আমাদের দাবি। আর, তার পাশাপাশি স্বামীর মৃতদেহের সামনে রাইফেল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা অশিক্ষিতা গ্রাম্য কিশোরীকে দেখে একজন বামপন্থী নেতাও অন্ততপক্ষে বলতে পারেন না- They took to violence due to helplessness …. These heroes had conquered the fear of death. Let us bow to them a thousand times for their heroism. But we should not imitate their act..
যাই হোক, এই সময়ে, প্রায় সমাজের বিবেকের মতন আপনি বলে উঠলেন, আশ্বস্ত হলাম। কিন্তু, আরও দরকার। আরও বেশি বলার দরকার, আরও বেশি ডাক দেওয়ার দরকার। চ্যালেঞ্জ দেওয়ার নয়। আপনাকে আমিও চ্যালেঞ্জ দিতে পারি, আপনার দেহ-মননে যতই সঙ্গীত ঘুরুক নাকেন, আমার গলায় এক লাইন সুর তোলাতে পারবেন না। তাই কে গাইতে পারলেন, কে মাঠে নেমে রাজনীতি করলে্ সেইসব চ্যালেঞ্জ নয়। আহ্বান দিন, ডাক দিন। আমরা একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছি আপনার ডাক শুনে, আপনি চাইলে আবার হয়তো পথে নামাতে পারবেন আমাদের। আমি বিশ্বাস করি, এই আকালেও আপনি গান গাইলে তেমন কিছু কিছু হয়। গেয়ে উঠুন, চেঁচিয়ে উঠুন, আরও জোরে- প্লিজ।
- সুমনাইট (সুমনায়িত)
সোমনাথ।