মার্চের শেষ থেকে উজানে তুষার গলা পানি এবং পরের পুরো অঞ্চল জুড়ে মাঝারি মাত্রায় বৃষ্টি শুরু হবার কারনে মা তিস্তায় (পুরো উজান থেকে ভাটিতে) আনন্দ ধারা বাড়তে থাকে। যেমনটি এই মে মাসের প্রথম সপ্তাহেও দেখা যাচ্ছে। এই বাড়ায় আরেকটু অবদান আছে ফসলের মৌসুমের। সেটা হল এই সময়টাতে পশ্চিম বাংলা আর বাংলাদেশের কৃষকদের সেচের পানির চাহিদা কমে যায় বা আপাতত এই মৌসুমের জন্য পানি তোলা শেষ এরকম একটা ব্যাপার। যার কারনে গজলডোবা এবং দোয়ানি-ডালিয়া ব্যারেজ থেকে মূল তিস্তার পানি প্রত্যাহার কমে যায় (দোয়ানি-ডালিয়া ব্যারেজে পানিই থাকেনা, তুলবে বা আর কি!)। এই দুই কারনে ইদানিং তিস্তায় খানিকটা পানি দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কি পরিমান! সেটা কি সাধারন আগাপাশতলা তিস্তাপারের মানুষদের অভিজ্ঞতাকে সমর্থন করে? করেনা। বাস্তবত যেখানে এই সময়টাতে ১০ থেকে বার হাজার কিউবিক মিটার পানি থাকার কথা সেখানে আছে ৩.৫ থেকে ৪.৫ হাজার কিউসেক । এমনকি শুকনো মৌসুমে ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হবার আগে যে তিস্তায় কমের পক্ষে ৭ হাজার কিউবিক মিটার পানি থাকার কথা সেখানে নিচের ছবির মতই বিশাল চওড়া তিস্তার একপাশ দিয়ে সরু নালায় পানি প্রবাহিত হচ্ছে। যেখান অনায়াসে একটা কানা বক হেঁটে পার হয়।
ছবিটা ১০ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে দোয়ানি ব্যারেজের উপর থেকে তোলা। তাহলে আর পানি কোথায় গেল! সমস্যা কোথায় একটু ঘেঁটে দেখা যাক।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০০ ফুট ওপরে অবস্থিত উত্তর সিকিমের ছোলামু লেকে তিস্তার জন্ম। ছোলামু লেক চীন থেকে মাত্র ৫ কিমি দূরে অবস্থিত। এটি ভারতের সবচেয়ে উঁচু আর পৃথিবীর ১৫তম উঁচু লেক।
ছো লামু লেক
ছো লামু, গুরুডংমার লেক প্রকৃতির অপার বিস্ময়। হিমালয় পর্বতমালার বরফগলা পানি জমে এই অনিন্দ সৌন্দর্যের সৃষ্টি। যেখান থেকে তিস্তা শুরু। চলার পথে থাঙ্গু, ইয়ামথাং, আর ডনকিয়া লা পাসের আরও বহু বরফগলা মিষ্টি পানির ধারা উপধারা সংযুক্ত হয়ে বলবান হয় তিস্তা।
সিকিমে চু হল পাহাড়ি নদীর ধারা। পুরো সিকিম পাহাড়ি এলাকা। তিস্তার উৎপত্তি যেখান থেকে সেখানে একদম শুরুতে ছোম্বো চু , একই রাস্তায় লিসা চু, বারুম চু তিস্তাতে পতিত হয়। চলার পথে লোনাক চু পোক চুয়ের মিলিত ধারা, ইয়াম্থাং চু লাচুং চুয়ের মিলিত ধারা, রুকাই চু আর রিংপাই চুয়ের মিলিত ধারা, চাকুং চু, ডিক চু, রানিখোলা, রাংপো চু, রাম্মাম আর রাঙ্গিত এর মিলিত ধারা রাঙ্গিত নামে তিস্তায় পতিত হয়েছে। নাম বলে শেষ করার মতো নয়। শত শত পাহাড়ি নদীর খরস্রোতা ধারা, ভরা মৌসুমের প্রবল বৃষ্টিপাত তিস্তাকে সমৃদ্ধ করেছে, করেছে বলবান। আর পবিত্র সুজলা সুফলা সমৃদ্ধশালী করেছে সিকিম, উত্তর বঙ্গ, পশ্চিম বঙ্গ আর বাংলাদেশকে।
প্রত্যেকটি খরস্রোতা ধারা পাহাড়ি ঢাল বেয়ে তীব্র শক্তি নিয়ে প্রচণ্ড বেগে তিস্তায় পতিত হয়েছে। ভর পেট পানির তীব্র প্রবাহ নিয়ে প্রমত্তা তিস্তা পুরো সিকিমের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দার্জিলিঙের কালিম্পং দিয়ে পশ্চিম বাংলায় ঢোকে। মোট ৩১৫ কিমি দৈর্ঘ্যের বাংলাদেশের ১১৫ কিমি এর শুরু রংপুর দিয়ে। মিশে গিয়ে শেষ হয়েছে ফুলছড়িতে প্রকৃতির আর এক বিস্ময় শক্তিমান ব্রহ্মপুত্রে। সিকিমে প্রকৃতির এই অপার সৌন্দর্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে সিকিম, উত্তরবঙ্গ এবং বাংলাদেশের জন্য। কেন! এই প্রশ্নের জবাব খুজতে গিয়ে যা পাওয়া গেল তাতে লেপচা, ভুটিয়া, উত্তর বঙ্গ, পশ্চিম বঙ্গ আর বাংলাদেশের সাধারন মানুষের সুখ দুঃখ দ্রবীভূত - একাকার হয়ে গেছে।
কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে? কাদের জন্য হচ্ছে? এই তিন প্রশ্নের জবাব খুঁজি প্রথমেই।
তিস্তার ওপর ইতিমধ্যে ৫টি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র চলছে।
১। লাগায়াপ - ১২ মেগাওয়াট
২। রাম্মাম ২ - ৫০ মেগাওয়াট
৩। রাঙ্গিত ৩ - ৬০ মেগাওয়াট
৪। তিস্তা ৫ - ৫১০ মেগাওয়াট
৫। রংনিছু - ৮ মেগাওয়াট
৪টির কাজ চলছে
১। রাম্মাম ৩ - ১২০ মেগাওয়াট
২। রোলেপ - ৩২ মেগাওয়াট
৩। তিস্তা ৩ - ১৩২ মেগাওয়াট
৪। তিস্তা ৪ - ১৬০ মেগাওয়াট
দুটি ব্যারেজ আছে
১। ভারতের গজলডোবায় ৯ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রকল্প চালানোর উদ্দেশ্যে। প্রায় ২০ বছর শেষে সেচের আওতায় এসেছে ৭০ হাজার হেক্টর জমি।
২। বাংলাদেশের ডালিয়ায় ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার উদ্দেশ্যে করা ব্যারেজ থেকে ৬ লাখ ৩২ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় আসা।
প্রস্তাব আছে সিকিমে তিস্তার উপর আরও ৩১টি জল বিদ্যুৎ প্রকল্পের।
প্রথমেই আসা যাক সিকিম এবং পশ্চিম বাংলার চালু এবং প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্প প্রসঙ্গে –
বিদ্যুৎ বর্তমান সভ্যতার জিয়নকাঠি। অব্যাহত উন্নয়ন বিদ্যুৎ ছাড়া অসম্ভব। কিন্তু বিষয় যদি এমন হয় ২ টাকার বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে পরিবেশ, মানুষ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের অপরিমেয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে তাহলে ব্যাপারটা কেমন দাড়ায়? এবং যদি এমন হয় যাদের জমি, পরিবেশ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ধ্বংস করে এই বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে তারা কোন বিদ্যুৎই পাচ্ছেনা, কিংবা তারা বিদ্যুৎ চাচ্ছেই না তাহলে? হ্যাঁ, সিকিমে এটাই হচ্ছে।
সিকিমের আদি আদিবাসী হল লেপচা জনগোষ্ঠী। মোট জনসংখ্যার ৭ ভাগ। ১৫ শতকের শেষের দিকে ভুটিয়ারা সিকিমে আসতে শুরু করে। এরা মূলত তিব্বতের অধিবাসী ছিল। আর আছে নেপালি। ভুটিয়াদেরও বহু পরে এরা সিকিমে আসতে শুরু করে। এখন সিকিমের ৮০ ভাগ নেপালি। সিকিমের মুল ভাষাও নেপালি। কিছু বাঙ্গালী, বিহারীও আছে। তবে সংখ্যায় খুব কম। সংখ্যায় যাই হোক না কেন, কোন একটি অঞ্চলে বসবাসরত জনগোষ্ঠীর ওই অঞ্চলের পরিবেশের সাথের সম্পর্কের ভিত্তিতে জীবন যাপনের ধরন নির্দিষ্ট হয়। মাটি, পানি, নদী, আলো হাওয়ার সাথে জীবনযাপন পদ্ধতি, ভাষা, চাল-চলন, ধর্মীয় পবিত্র স্থান, আচার অনুষ্ঠান সর্বোপরি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটে। এই ধারাবাহিকতায় তিস্তার সাথে সিকিমের মানুষের সম্পর্ক মায়ের মতো। তিস্তা তার সমস্ত মমতা সৌন্দর্য রূপ লাবণ্য যৌবন শক্তি হিংস্রতা অসহায়ত্ব দিয়ে শত শত বছরে এই জনপদ, তার সংস্কৃতি, জলবায়ু, আবহাওয়া, খাদ্যাভ্যাস, ফসল উৎপাদনের ধরন নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।
আবার তিস্তা প্রকৃতির নিয়মে বিকশিত। বিজ্ঞান প্রমান করেছে যে প্রাকৃতিক নিয়মে যেকোনো নদীর আচরন এবং চলার পথ পরিবর্তনশীল। সেই অনুযায়ী নদীর তীরের জনপদের পরিবেশের চলন পদ্ধতি পরিবর্তিত হয়। নদীর এই পরিবর্তনের উপর দুই তীরের জনপদের পরিবেশ, প্রতিবেশ, জীব বৈচিত্র্য ব্যাপক ভাবে নির্ভরশীল। নানান ভুপ্রাকৃতিক কারনে নদীর পথ এবং প্রবাহ পরিবর্তন হতে পারে। নদী ব্যবস্থার পুরো প্রক্রিয়াটিই প্রাকৃতিক। নদী এভাবেই বেঁচে থাকে। বাচিয়ে রাখে সবকিছুকে। তা সিকিমের জন্য যেমন সত্য তেমনি সত্য উত্তর বঙ্গ, পশ্চিম বঙ্গ এবং বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু মানুষ যখন নদীর এই পথ, প্রবাহ পরিবর্তন করে বা করতে চায়, স্বাভাবিক ভাবেই নদী তার অস্তিত্ব হারাতে শুরু করে। একই সাথে চরম প্রতিবেশগত ঝুঁকির মুখে পড়ে যায় এর সাথে সম্পর্কিত সবকিছু।
হ্যাঁ নদী বিপদে আছে। সেই সাথে বিপদগ্রস্ত এর উপরে দাড়িয়ে থাকা সমগ্র জনপদের মানুষ সহ পুরো পরিবেশ ও জীব বৈচিত্র্য, খাদ্য নিরাপত্তা, ভাষা, সংস্কৃতি, আচার অনুষ্ঠান সব। কী সেই বিপদ! বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরি করা ওই টানেল, বাঁধ আর সেচের জন্য তৈরি করা গজল ডোবা এবং ডালিয়ার ব্যারেজ। এগুলোর মাধ্যমে নদীকে তার নিয়মে চলতে দেয়া হয়নি। প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।
প্রথমত বাঁধ এবং ব্যারেজের মাধ্যমে নদীর পানি আটকানো হয়েছে একই সাথে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য টানেল তৈরি করে নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহের দিক পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে এবং হচ্ছে। চিন্তা করা অসম্ভব- যে নদী মুক্ত ভাবে প্রবাহিত হয়ে শত মাইল জনপদকে সুজলা সুফলা করে বাঁচিয়ে রেখেছে সে নদীর ৭০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনে টানেলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত। এর দুটি ভয়াবহ দিক আছে। একটি হল এমনিতেই নদীর প্রাকৃতিক দিক প্রবাহের পরিবর্তন ঘটালে তা পরিবেশের জন্য ব্যাপক বিপর্যয় ডেকে আনে, আরেকটি হল প্রতি কিলোমিটার টানেল বানানোর জন্য ১৫০ টন ডিনামাইট বিস্ফোরিত করা লাগে। তাহলে পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭০ ভাগ নদী টানেলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করার জন্য কি পরিমান ডিনামাইট বিস্ফোরণ হবে? সেই ধকল, বাড়িঘরে, মাটির উপরের স্তরে, অভ্যন্তরে ফাটল কি সিকিমের মত নদী অধ্যুষিত পাহাড়ি জনপদ নিতে পারবে?
স্থানীয় জনগনের অভিজ্ঞতা কী বলে দেখা যাক। তিস্তা ৫ প্রকল্পের কাছাকাছি সিংবেল গ্রামে জং বাহাদুর ছেত্রির (বয়স ৭০) বাড়ি। তিনি জানাচ্ছেন “সরকার যদিও বাঁধ তৈরি করার জন্য তার বাড়িঘর জমিজমা অধিগ্রহন করেনি তথাপি এই প্রকল্পের কারণে তিনি তার সব হারিয়েছেন। উপর্যুপরি বিস্ফোরণের কারণে তার বাড়িতে এত পরিমান ফাটল দেখা দিয়েছে যে সেটা বসবাসের অযোগ্য। পরিবারের সদস্য ২০ জন। বর্ষায় তাদের অন্য কারো বাড়িতে গিয়ে থাকতে হয়। আরও ভয়ংকর ব্যাপার হল নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে টানেলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করার কারনে তাদের কৃষি জমি, ক্ষেত খামার পানিশূন্য হয়ে গেছে। চাষ করা সবজি, ফল মুল বিক্রি করে তাদের জীবিকা নির্বাহ হত। এখন তাদের খাবারও কিছু নেই বিক্রি করারও কিছু নেই।”
ভীম প্রসাদ নেপাল নামে অন্য একজন সিকিমবাসী জানাচ্ছেন বাঁধ তৈরির পর থেকে তারা কৃষি কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন, কারন আগে এখানে প্রচুর পানির সরবরাহ ছিল, এখন পুরো এলাকা পানিশূন্য। মাঠে ঘাস নেই, গাছ মরে গেছে, ফসল নেই, আমের সময় চলছে, গাছে কোন আম নেই। পানির অভাবে মুকুলই হয়নি। গ্রামবাসীরা অপুষ্টি আর ক্ষুদায় কাতর। ভিম প্রসাদরা এখন কারখানায় মুজুরির কাজ করেন। বাঁধ পুরো সিকিমকে কার্যত ধ্বংস করে ফেলেছে।
রালাপে নদীর তিরে বাড়ি এরকম একজন নারী বলছিলেন পানির সংগ্রহের জন্য তাদের প্রতিদিন পাহাড়ের উপরের দিকে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়। “কেউ যদি বিপদে পড়ে একগ্লাস পানিও চায় সেটা দেয়াও আমাদের জন্য কষ্টকর”।
বাঁধের কারনে জমা অতিরিক্ত পানি যেমন মাটির উপরিভাগের উপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করছে তেমনি টানেল তৈরির জন্য ব্যাপক মাত্রার ডিনামাইট বিস্ফোরণ পুরো অঞ্চলের ভু প্রাকৃতিক গঠনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। মাটির উপরিভাগে জমা করা পানির অতিরিক্ত চাপ সব সময় ভূগর্ভস্থ জলাধারের সাথে সংযুক্ত হতে চায়। ফলে এই জমা পানি প্রতিক্ষন মাটির উপরিভাগ থেকে দুর্বল পয়েন্ট খুজতে থাকে। পেয়ে গেলেই সেখান দিয়ে শুরু হয় ভূমিধ্বস। একারনেই বাঁধের মাধ্যমে তৈরি করা পৃথিবীর বেশিরভাগ জলবিদ্যুৎ প্রকল্প ঝুঁকিপূর্ণ। এর সাথে যদি ডিনামাইটের প্রতিনিয়ত বিস্ফোরণ যুক্ত হয় তাহলে অকস্মাৎ বাঁধ থেকে বন্যা - জলচ্ছাস, ভূমিধ্বস আর ভুমিকম্প ডেকে নিয়ে আসা হয়। সিকিমে এটাই ইতিমধ্যে ঘটেছে। ১৬ অগাস্ট ২০০৭, ২০ জুলাই ২০১৩ এর জলোচ্ছ্বাস, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১১ এর ভূমিকম্প ড্যাম ইনডিউসড সিসমিসিটি (dam induced seismicity) এর কারনে হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারনা। ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের একটি দল যারা কিনা টেকটোনিক প্লেটের নাড়াচাড়া এবং ড্যাম ইনডিউসড সিসমিসিটি নিয়ে কাজ করছিলেন তারা ২০০০ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের কাছে তিস্তার উপর কোন ধরনের বাঁধ তৈরি না করার জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
চলতি প্রকল্প গুলো বাদ দিয়েও আরও যে ৩০/৩১ টি প্রকল্প সামনে আসছে তাতে তিস্তা বলে কোন নদী থাকবেনা। বাংলাদেশে আসার বহু আগেই তিস্তা হারিয়ে যাবে। কারন সিকিম হবে ভারতের প্রধান বিদ্যুৎ রফতানি কারক অঞ্চল। সিকিম জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের স্বর্গ। ভারত সরকার পাহাড়ি এই জনপদের প্রাকৃতিক ব্যবস্থাকে পুঁজি করে ৫০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছে। কিন্তু কেন? এই বিদ্যুৎ কার কাজে লাগবে? সিকিমের প্রাকৃতিক সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে রাজ্য সরকার প্রাইভেট কোম্পানিদের সাহায্যে সারা সিকিম জুড়ে তিস্তার উপর বাঁধ দিয়ে টানেল তৈরি করে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে তার সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী তারা নয়।
সিকিমের জনগোষ্ঠীর মধ্যে লেপচা, ভুটিয়া, নেপালিরাই প্রধান। কিছু বাঙ্গালী, বিহারী, রাজস্থানি, উত্তর প্রদেশের মানুষ আছে। স্থানিয়ভাবে এরা সমতলের লোক বলে পরিচিত। লেপচা আদিবাসিরা সিকিমের সবচেয়ে পুরাতন একই সাথে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী (সিকিমের মোট জনসংখ্যার ৭ ভাগ = ৪০ হাজার)। প্রকৃতির বিস্ময় পৃথিবীর তৃতীয় সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার কাছাকাছি জঙ্গুতে থাকে এর মধ্যে ৭ হাজার। গিরিখাতের মানুষ বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করে লেপচারা। গত ২ শতাব্দী ধরে ব্যাপক মাত্রায় নেপালি অভিবাসন স্বদেশেই লেপচাদের সংখ্যালঘুতে পরিণত করেছে। তাদের ভাষা, সংস্কৃতি এমনিতেই হুমকির মুখে। জঙ্গু লেপচাদের পবিত্রভুমি। এমনকি সিকিমে যখন স্বাধীন রাজতন্ত্র ছিল তখনও জঙ্গু ছিল সংরক্ষিত। জঙ্গুর বাইরের যে কেউ সে যদি লেপচাও হয় তাকে অনুমতি নিয়ে জঙ্গুতে প্রবেশ করতে হত। জঙ্গুর লেপচারা ছাড়া অন্য কেউ জঙ্গুর জমির মালিক হতে পারত না। পবিত্রভুমি, মৃতপ্রায় ভাষা, সংস্কৃতি, সম্প্রদায় রক্ষার জন্য সমস্ত লেপচারা এই নিয়ম মেনে নিয়েছিল।
সংরক্ষিত এই জঙ্গুতেই ভারত সরকার ৭টি বাঁধ তৈরি করছে। হাজার হাজার শ্রমিক আসছে কাজ করার জন্য। লেপচাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, ধর্মীয় পবিত্র স্থানে মানুষের শ্রদ্ধাহীন অবাধ আনাগোনা হুমকির মুখে থাকা এই সম্প্রদায়কে নিজেদের মাটিতেই আরও বেশি ক্ষুদ্র করে দিয়েছে। যেন পিষে মেরে ফেলাটাই বাকি।
মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১২ ভাগের মালিকানা, ব্যাপক বিশাল উন্নয়ন, চাকুরির লোভ দেখিয়ে লেপচা, ভুটিয়া আর নেপালিদের নিজের ভুমি থেকে কার্যত উচ্ছেদ প্রক্রিয়া চলছে। একটা সম্পূর্ণ তাজা, জিবন্ত, প্রমত্তা নদীকে মেরে ফেলে টানেলের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত করার নাম নাকি উন্নয়ন। একটা বিশাল প্রানবন্ত সমাজ, তার চলতি অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক চর্চা ও ইতিহাস, স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত ঝুঁকিকে স্রেফ পুঁজিপতিদের লোভের কারনে পায়ের তলায় পিষে মারার নাম কি সেটা রাজনিতিবিদ আর শিল্প মালিকরা ছাড়া সবাই বোঝে। নিজেদের রক্ষা করার জন্য তাই Affected Citizens of Teesta (ACT), Sikkim Bhutia Lepcha Apex Committee (SIBLAC), Tribal Women’s Association, Buddhist Monks of Sikim ব্যানারে লেপচা ভুটিয়া এবং নেপালির সম্প্রদায় আন্দোলন সংগ্রাম করছে। নেপালিদেরও কয়েক শতাব্দী আগে ভুটিয়ারা এই ভুমিতে এসেছে। তাদের সাথে অভিন্ন স্বার্থে যোগ দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত বিহারী, বাঙ্গালীরাও, রাজস্থান উত্তর প্রদেশ থেকে ১৮৯০ তে সিকিমে আসা সমতলের অধিবাসীরাও। তারা সবাই একটা বিষয়ে একমত। জঙ্গু, কাঞ্চনজঙ্ঘা, সিকিম কোনমতেই পুঁজিপতি আর শিল্প মালিকদের হতে পারেনা। উন্নয়নের এই সংজ্ঞা তারা শিখতে চায় না।
বাঁধের আগে পশ্চিম বাংলায় তিস্তা প্রবল প্রমত্তা নদী হয়ে প্রবেশ করেছিল। কোথাও কোথাও ৩ থেকে ১১ কিলোমিটার চওড়া নদীতে ৭ হাজার থেকে ১৯ হাজার ৮ শত কিউসেক পানি প্রবাহিত হতে দেখা গেছে।
ইংরেজদের শাষনামল থেকেই সেচের জন্য তিস্তার পানি ব্যাবহারের পরিকল্পনা চলছিল। ৫০ এর দশকে পূর্ব পাকিস্থানের পক্ষ থেকে তিস্তার পানির ব্যাপারে প্রথম কথাবার্তা শুরু হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পানি ভাগাভাগির ব্যাপারে ভারতীয় পক্ষের সাথে আনুষ্ঠানিক আলোচনা চলতে থাকে। বাংলাদেশ তিস্তাকে মহানন্দার সাথে সংযুক্ত করার ভারতীয় পরিকল্পনার প্রতিবাদ করে। অভিযোগ উঠাতে এই আলোচনা ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত কোন ফলাফলের মুখ দেখেনি। কিন্তু দুইপক্ষ মোটামুটি এইরকম একটি সমাঝোতায় পৌছায় যে ভারত ৩৯ ভাগ, বাংলাদেশ ৩৬ ভাগ পানি গ্রহন করবে আর নদীর নাব্যতার জন্য থাকবে ২৫ ভাগ পানি। এই সমাঝোতা কোন চুক্তিতে পৌছাতে পারেনি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে লালমনিরহাটে দোয়ানিতে তিস্তা ব্যারেজের কাজ শুরু হয়। প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ প্রদানের লক্ষে এই প্রকল্প শুরু হয়ে ১৯৯৮ সালে চালু হয়। এখন এই প্রকল্প থেকে ৬ লাখ ৩২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়া হচ্ছে। ১২ টি উপজেলা এই প্রকল্পের আওতায় আসে। নীলফামারী, ডিমলা, জলঢাকা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর, রংপুর, তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, গঙ্গাচরা, পার্বতীপুর, চিরির বন্দর, এবং খানশামা। বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত শস্যের একটা বিরাট অংশ আসে এই প্রকল্পের মাধ্যমে।
বাংলাদেশের তিস্তা ব্যারেজের চালু হবার মাত্র কয়েক বছর আগে পশ্চিম বাংলার জলপাইগুড়ির গজলডোবাতে ভারত তিস্তা নদীর উপরেই আরেকটি ব্যারেজ নির্মাণের কাজে হাত দেয়। সেই আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত তার আন্তঃনদীসংযোগ পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিস্তার পানি গজলডোবা থেকে প্রত্যাহার করে বেশ কয়েকটি খালের মাধ্যমে মহানন্দার দিকে নিতে থাকে। উদ্দেশ্য তিস্তার পানি ব্যাবহার করে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর দিনাজপুর, দক্ষিন দিনাজপুর, মালদাতে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন আর বন্যা নিয়ন্ত্রন। শুরুতে ৯ লাখ ২২ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ দেয়ার পরিকল্পনা করলেও আজ পর্যন্ত ৭০ হাজার হেক্টরের মত জমিতে সেচ দেয়া সম্ভব হয়েছে। যদিও ইতিমধ্যে ১ লাখ ২৬ হাজার হেক্টর জমি সেচের আওতায় এসেছে। সেই থেকে ক্রমান্বয়ে শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে পানির প্রবাহ কমতে থাকে। নদীর গতিপথ পরিবর্তন করে ভারত সেচ, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বন্যা নিয়ন্রন, ট্যুরিজম শিল্পের উন্নয়ন এবং ব্যাপক সামাজিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করবে বলে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু বাংলাদেশ কি আদৌ পানি পাচ্ছে? বর্তমান অবস্থা হল জলপাইগুড়ির গজলডোবা ব্যারেজে অতিরিক্ত পানি প্রত্যাহারের কারনে একদা প্রমত্তা তিস্তার বাংলাদেশ অংশ কেবল মৃতপ্রায় নয়। মৃত। জনসংখ্যার তুলনামূলক বিচারে তিস্তার মোট সুবিধাভোগী জনগনের ৩০ ভাগ ভারতে আর ৭০ ভাগ বাংলাদেশে। অথচ বর্তমানে যে পরিমান পানি তিস্তা দিয়ে দার্জিলিং এর কালিম্পং পয়েন্টে (উজান থেকে তিস্তার মোট প্রবাহ কালিম্পং দিয়ে প্রবাহিত হয়) আসে তার ৯৫ ভাগ ভারত গজলডোবা ব্যারেজের মাধ্যমে প্রত্যাহার করছে। বাংলাদেশ পাচ্ছে মাত্র ৫ ভাগ। এটি কোন ন্যায্যতার ধারনা দেয়না। বাংলাদেশের ছয়টি জেলার কৃষকেরা পানির অভাবে অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করছে।
পশ্চিম বাংলা সরকার যে এত এত উন্নয়ন করবে বলে গজলডোবা প্রকল্প চালু করল তা কি সফলতার মুখ দেখবে? মনেহয় না। কারন মূল সমস্যা সেই সিকিমে। বাংলাদেশের দোয়ানিতে তিস্তা ব্যারেজ কিংবা গজলডোবার ব্যারেজের পরিকল্পনা কিংবা বাস্তবায়নের সময় উজানে সিকিমে জলবিদ্যুতের কোন প্রকল্প ছিল না। ফলে পানি ব্যাবহারের পরিকল্পনায় বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার তেমন কোন সমস্যা ছিলনা। সমস্যা ছিলনা এমনকি সিকিম অধিবাসীদেরও। এখন সিকিমে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য নদীর গতিপথ পরিবর্তন, পানি প্রত্যাহার আরও নানান কার্যক্রম চালানো হচ্ছে ফলে তিস্তার পানি প্রবাহের মূল উৎসে গণ্ডগোল লেগে গেছে। কার্যত পানির পরিমান তিস্তায় এমন কমে গেছে যে তা দিয়ে গজলডোবা বা দোয়ানি ব্যারেজ কোনটিই ঠিকভাবে চলতে পারেনা। ব্যারেজ তৈরির আগে দেখা গেছে সর্বনিম্ন প্রবাহ থাকার সময়ও ৪০০০ কিউসেক পানি ছিল। ব্যারেজ তৈরির পর এই প্রবাহ কমে ৫০০ থেকে ১০০০ কিউসেকে এসেছে। সর্বোচ্চ প্রবাহ হয়ত কখনও কখনও ৪০০০ থেকে ৫০০০ কিউসেকে হয়েছে। ফলে পানির ভাগাভাগির হিসাব পশিম বাংলা সরকারও ঠিকঠাক করতে পারেনা। তিস্তার প্রাকৃতিক প্রবাহ চালু থাকলে মোটামুটি ধরনের একটি গ্রহণযোগ্য ভাগাভাগির আলোচনা অন্তত দুই সরকার শুরু করতে পারত।
মোটের উপর তিস্তায় পানির প্রবাহ কমেছে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্প, বাঁধ, ব্যারেজের সম্মিলিত পরিবেশগত প্রভাবের কারনে তিস্তার মুক্ত পানি প্রবাহ এবং পরিমান দুটোই ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। পাশাপাশি উভয় বাংলায় ব্যারেজের মাধ্যমে লাখ লাখ হেক্টর জমিতে ফসল উৎপাদনের পরিমাণও কমে গেছে। নদীর প্রাকৃতিক গতিপথ, প্রবাহ মানুষের লোভ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হবার কারনে তিস্তার বেঁচে থাকার জন্য সামান্যতম প্রবাহও নাই বললে চলে। একদা শক্তিশালী প্রমত্তা তিস্তা অসাধু রাজনিতিবিদ এবং ব্যবসায়ীদের লোভের কবলে পড়ে আজ মৃত।
জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে এবং তাদের পরিবেশ জীব – বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য সিকিমবাসী আন্দোলন সংগ্রাম চালাচ্ছে সেই ১৯৯৫ সাল থেকে। পশ্চিম বাংলা, আসামেও বিভিন্ন রাজনৈতিক, পরিবেশবাদী সংগঠন ক্ষতিকর এসব বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম চালাচ্ছে। গনসংহতি আন্দোলন সহ বাংলাদেশের বাম মোর্চা গত ৮ থেকে ১০ এপ্রিল ২০১৪ তিস্তার পানির দাবিতে ঢাকা থেকে লালমনিরহাট দোয়ানি পর্যন্ত রোড মার্চ করেছে। যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হল তিস্তা নিয়ে উদ্ভুত এই সমস্যা একা বাংলাদেশের মরুকরণ বা খাদ্য নিরাপত্তার সমস্যা নয়, কিংবা পশ্চিম বাংলার উন্নয়নের সমস্যা নয়। অথবা এককভাবে তা সিকিমের আদিবাসী, সাধারন মানুষদের জীবন, জীবিকা, ধর্ম, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও জীব – বৈচিত্র্য রক্ষার সংগ্রামও হতে পারেনা। ক্ষতিগ্রস্ত আমরা সবাই। ফলে বাসযোগ্য পৃথিবী নির্মাণের এই সংগ্রাম সিকিম, পশ্চিম বাংলা, বাংলাদেশ সহ সকলের।
লেখকঃ মাহবুব সুমন। পড়াশোনা ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। বর্তমানে আরএমজি খাতে এনার্জি কনসালট্যান্ট হিসেবে কর্মরত। নির্বাহী পরিচালক, এসইউএনইসি। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার বিষয়ে তার প্রবন্ধ লেখা একটি বই সম্প্রতি প্রকাশ করেছে সিবিএস। এছাড়া ‘প্রতিবেশ আন্দোলন’ নামের পরিবেশবাদী সংগঠনের কেন্দ্রীয় সদস্য।