এই নিবন্ধটি যখন লেখা শেষ হয়েছে, তার পরে বিজেপির নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয়েছে। প্রাথমিকভাবে সংবাদসূত্র (http://www.dnaindia.com/analysis/column-consequences-of-a-pro-industry-land-acquisition-act-2011149) অনুযায়ী, এই আইনের কিছু অংশ বদলানো হচ্ছে; যার ফলে জমি অধিগ্রহণ করা কম ঝামেলার হবে। এই বদলের মধ্যে দিয়ে সরকারি-বেসরকারি যৌথ প্রকল্পগুলোর জন্য সম্মতির নিয়মটি সহজীকরণ করে দেওয়া হচ্ছে, বড়মাপের প্রকল্প বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত প্রকল্পে সামাজিক প্রভাবের খতিয়ান নেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, এবং বহুফসলী জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে যে নিষেধাজ্ঞা ছিল, তা তুলে নেওয়া হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এইসব পরিবর্তনগুলো লাগু করা খুবই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, বিকল্প হিসেবে, যে সমস্ত প্রকল্প এই আইনের মূল নিয়মগুলোর বাইরে আছে, সেই প্রকল্পের তালিকাটি আরও লম্বা করার পরিকল্পনা চলছে।
ভারতের জমিনীতি সংস্কার
প্রায় একদশকের টানা দ্রুতগতির অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাকা ক্রমশ মন্থর হওয়া থেকে বাঁচতে যে যে সমস্যার সমাধান আশু প্রয়োজন, জমি সমস্যা তার মধ্যে অন্যতম। মূলত এর দুটো কারণ আছে।
কৃষি থেকে শিল্প ও পরিষেবা খাতে সম্পদ পুনর্নিয়োগ করা হল উন্নয়নের একদম গোড়ার কথা। যতক্ষণ না কৃষি জমিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তার ফলে উদ্বৃত্ত শ্রম শিল্পে নিয়োজিত হচ্ছে, ততক্ষণ এই মূলগত পরিবর্তন সম্ভব নয়। ভারতে কৃষির উৎপাদনশীলতা কম হবার কারণ অনেক – অসাম্য, খন্ডিত জমি, বিশ্বাসযোগ্য জমি নথির অভাব, অসুরক্ষিত ও অনির্দিষ্ট সম্পত্তি আইন, জমি ভাড়ার সীমিত আয় ও জমি বন্ধক রেখে ঋণ পাওয়ার অসুবিধে। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে জমির উৎপাদন বাড়ানোর কোনো ব্যবস্থা না নিলে, খাদ্য যোগানও অসুবিধের হয়ে দাঁড়াবে।
দ্বিতীয় কারণ হল, আমাদের দেশের বিশাল জনসংখ্যার এক বড় অংশ নির্ভর করে উর্বর জমির ওপর। অকৃষিজনিত উৎপাদনের জমিও আসে কৃষি ক্ষেত্র থেকেই, আমরা বিগত দশকে এও দেখেছি নর্মদা বাঁচাও আন্দোলন থেকে সিঙ্গুর, জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে মানুষের স্বতস্ফূর্ত আন্দোলন। অবশ্যই এটা এক পরিণত গণতন্ত্রের উদাহরণ, যেখানে উন্নয়নের নাম যথেচ্ছভাবে গরীবদের উৎখাত করা যায় না।
তবে এমন নয়, যে এই সমস্যার কথা কেউ জানে না বা সুরাহার ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ ব্যাপারে খাদ্য সুরক্ষা আইন ও জমি অধিগ্রহণ বিষয়ক আইন প্রণয়নের দৃষ্টান্ত দেওয়া যায়। জমি সংস্কারের একটি বিল ও বিবেচনাধীন। দুর্ভাগ্যজনক যে, এই আইনগুলোর উদ্দেশ্য শুভ হলেও জনমানসে বাজারের শক্তির ভূমিকা বা সীমাবদ্ধতার ব্যপারে এরা বিশেষ মাথা ঘামায় নি। সিদ্ধান্ত নেবার উপযুক্ত তথ্যের অভাব ও নীতিগত জটিলতার ফলে জমি অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থরক্ষা করা সম্ভব হয়নি।
জমি অধিগ্রহণ আইন
১৮৯৪ সলের আইনের ওপর ভিত্তি করেই এখনো পর্যন্ত পণ্ডিতমহলের আলোচনা গড়ে উঠেছে, এই আইনানুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় বিক্রির সময়কালে ওই অঞ্চলের জমির দাম ও অন্যান্য বিক্রীত জমির লেনদেনের হিসেবের উপর ভর করে। নতুন আইনে এতে তিনটে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়। ১) ক্ষতিপূরণের পরিমাণ এক্ষেত্রে ধার্য্য হয়েছে অনেক বেশি – বাজার দরের দ্বিগুণ (শহর), চতুর্গুণ (গ্রামে) ২) জমির মালিক ও অন্য যাঁরা জীবিকা হারালেন (ভাগচাষি/ অন্যান্য কৃষি শ্রমিক যাঁরা চাষের জমির ওপর নির্ভরশীল), তাঁরাও এই ক্ষতিপূরণের দাবিদার হবেন ৩) জমি অধিগ্রহণের প্রশাসনিক দিকে আরো দৃঢ়তা আনা যাতে সরকারি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে আরো বেশি কমিটির ছাড়পত্র লাগবে ও যেখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থাকবে সেখানে অধিগ্রহণের ফলে ক্ষতিগ্রস্তদের কমপক্ষে ৭০%এর সম্মতি বাধ্যতামূলক।
নতুন আইনের মূল্যায়ন করার আগে পুরনো আইনের ফাঁকফোকর গুলো একবার দেখা যাক। বাজারদরের হিসেবে ক্ষতিপূরণ যে ন্যায্য নয় এটা সহজবোধ্য ব্যাপার কারণ বাজার দর আর জমির মালিকের কাছে মূল্য সমান নয়।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মূল্য নির্ধারিত হয় ফসল উৎপাদন, খাদ্য সুরক্ষা, বন্ধকী সম্পদ হিসেবে গুরুত্ব, মূল্যবৃদ্ধির প্রতিষেধক, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদির ওপর। জমির দাম এবং যে দামে মালিক বিক্রি করতে ইচ্ছুক হবেন সেটা অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং একজনের থেকে আরেকজনের ক্ষেত্রে অনেকটাই আলাদা। আমরা যদি এটা ধরেও নিই যে দেশে দক্ষ জমি বাজার আছে ও লেনদেন স্বচ্ছ, সেখানেও অনেক মালিকই জমির এমন মূল্য ধার্য করবেন যা বাজার দরের চেয়ে অনেক বেশি। এই কারণেই তাঁরা এখনো পর্যন্ত জমি বিক্রি করেন নি।
বাজার দরের হিসেবে ক্ষতিপূরণ তখনি কার্যকরী হত যদি এক নিখুঁত বাজারে (perfect market) যে পরিমাণ পার্থিব সম্পদ (physical asset) যে দামে বিক্রি হচ্ছে সেই দামেই কেনা যেত। নীচের উদাহরণ দুটো দেখলে ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে।
১) সরকারের প্রয়োজনবশত কিছু নাগরিকের থেকে গাড়ি অধিগ্রহণ করা ২) আপৎকালীন সময়ে কিছু নাগরিকের বাধ্যতামূলক শ্রম দান। আমরা যদি স্বাধীনতা / সম্পত্তি আইন ইত্যাদি দূরে রাখি কিছুক্ষণের জন্য, তাহলে দেখব প্রথম ক্ষেত্রে বাজার দরে ক্ষতিপূরণ ন্যায্য মনে হলেও, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে একেবারেই নয়। কারণ প্রথম ক্ষেত্রে ইচ্ছে করলেই ক্ষতিপূরণের অঙ্কে ওই গাড়ি আবার কেনা সম্ভব, কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে সেই একই সময় তাঁদের পক্ষে কিনে নেওয়া সম্ভব হবে না।
দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তাই শ্রমিকদের সময়ের সঠিক মূল্যায়ন করতে হবে। ধরুন কোনো স্বনিয়োজিত (self employed) উকিল, ডাক্তার, বা ব্যবসায়ীকে জোর করে কোনো সরকারি প্রকল্পে কাজ করিয়ে বাজারের বর্তমান শ্রমমূল্য অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ দেওয়া যদি ন্যায্য হত, তাহলে আমরা কি এটাই আশা করতাম না যে ওঁরা নিজেদের ব্যক্তিগত পেশা ছেড়ে চাকরি করবেন? ঠিক একইভাবে স্বেছায় জমি বিক্রি করতে চাওয়া বা চাকরি করা মানুষদের স্বীকৃত দামে কাউকে জমি বিক্রি করতে বা চাকরি করতে বাধ্য করা যায় না। জমি অধিগ্রহণ অনেকটা গাড়ির উদাহরণ মনে হয়, কিন্তু আমরা যদি বাস্তবের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, প্রকৃতপক্ষে উদাহরণটা বাধ্যতামূলক শ্রম দানের মত। জমি বাজারের অপ্রতুলতা উন্নয়নশীল দেশের একটা বড় সমস্যা (Deininger and Feder,2001 and Deininger,Jin and Nagarjan, 2009)। জমির বাজার দরের কোনো গুরুত্ব নেই, যদি না সেই দামে একই সমপরিমাণ জমি একই অঞ্চলে কেনা সম্ভব। একই ভাবে বেকারত্ব ও সংঘাতপূর্ণ শ্রম বাজারে বর্তমান শ্রমমূল্যে চাকরি পাওয়া কঠিন।
বাজারদরের হিসেবে ক্ষতিপূরণ না দেওয়ার আরো অনেক যুক্তি আছে – প্রচুর পরিমাণে কৃষিজমি অধিগ্রহণ এলাকার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির যোগানের ওপর প্রচুর চাপ সৃষ্টি করে। যোগান ও চাহিদার নিয়ম মেনেই এলাকার জমির মূল্য ও ভাড়া দুই ই বেড়ে যায়, ফলে যেখানে জমির দাম এতই বেড়ে গেহে যে বিক্রির দামে সমপরিমাণ কৃষিজমি কেনা অসম্ভব, সেখানে ঐতিহাসিক জমির দামের ওপর ভিত্তি করা সম্ভব হবে না। নতুন প্রকল্পের আশেপাশে উদ্বৃত্ত অর্থনৈতিক উন্নতি আরো সহকারী শিল্প গড়ে তুলতে সাহায্য করে, এলাকায় জমির দাম আরো বাড়িয়ে তোলে অনেক ক্ষেত্রে। এছাড়াও অতীত লেনদেনের ওপর ভরসা করাও অসুবিধে এজন্য, বেশির ভাগ সময়েই স্ট্যাম্প ডিউটি এড়ানোর জন্য জমির বিক্রয়মূল্য কম করে দেখানো হয়। এ আলোচনা থেকে বোঝা যায় যে বাজার দরে ক্ষতিপূরণ, যথেষ্ট নয়।এটা কতটা বাড়ানো হবে তা আঞ্চলিক জটিলতার ওপর নির্ভর করে, যা একেক জায়গায় একেক রকম। ক্ষতিপূরণ নির্ধারিত হয় জমির বাজার কতটা নিখুঁত, কতটা অধিগৃহীত এলাকার ওপর প্রকল্প গড়ে উঠবে, যেসব চাষি জমি হারাবেন তাঁদের বিশেষত্ব কী, এসব আলোচনার ওপর ভিত্তি করে। জরিপ করে দেখা গেছে, এ ব্যাপারে বৈচিত্র্য প্রচুর।
সিঙ্গুরে এটাই দেখা গেছে যে চাষের জমির বৈচিত্র্য হিসেবে না ধরে ক্ষতিপূরণ ঠিক করায় বিক্ষোভ আরো দানা বাঁধে (Ghatak, Mitra, Mookherjee, and Nath, 2013)। ক্ষতিপূরণের অঙ্ক মোটামুটি সে অঞ্চলে জমির গড় দামের কাছাকাছিই ছিল তবুও ১/৩ অংশ জমি বেচতে অস্বীকার করেন। এই ক্ষতিপূরণ প্যাকেজ জমিতে সেচের প্রয়োজন, বহুফসলী বা যানবাহনের নৈকট্য ইত্যাদি ব্যপার হিসেব করে নি, যা নিঃসন্দেহে ব্যর্থতা ডেকে এনেছিল। এমনকি যাঁদের ঘরে অধিকাংশ কৃষি জমির ওপর নির্ভরশীল বা মূল আয়ের অধিকাংশ কৃষি ভিত্তিক তাঁরাও বিরোধিতা করেন। আর্থিক সুরক্ষা এজন্যেই জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণের সাথে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, বিশেষ করে চাষের মত দক্ষতানির্ভর জীবিকার ক্ষেত্রে, যা একজনের থেকে আরেকজনের কাছে জমির মত হস্তান্তর করা যায় না। যাদের কাছে জমির মূল্য একমাত্র বৈষযিক (যাঁরা জমি উত্তরাধিকার সূত্রে পাননি, বরঞ্চ কিনেছেন বা জমি রক্ষণাবেক্ষণ করতে না পারা জমির মালিক সম্প্রদায়) তাঁরাও এ প্যাকেজে বিশেষ আগ্রহী হবেন না।
নতুন আইনে যে স্থির গুণিতক (দ্বিগুণ/ চারগুণ) কথা বলা হয়েছে তার মধ্যে একমাত্র শহর বা গ্রাম বাদে আর কোনো পার্থক্য স্বীকার করা হয়নি। সঠিক গুণিতক এক্ষেত্রে বের করা বেশ সমস্যার, যদি খুব কম বেশি দাম হয়ে যায় তাহলে শিল্পের পক্ষে অলাভজনক ও তাদের অনীহার ফলে ইচ্ছুক চাষিরা মোটা লাভ থেকে বঞ্চিত হবেন, কম দাম হলে সিঙ্গুরের মত ঘটনা ঘটবে। এই দুই বা চার কিভাবে হবে তার কোনো যুক্তিও পেশ করা হয়নি, তাই গড় করে নিলেও সমস্যা মিটবে না।
বিকল্প ব্যবস্থা –জমি নিলাম
(Ghatak and Ghosh, 2011) মতে নিলামভিত্তিক দাম নির্ধারণ কোনো গুণিতকভিত্তিক হিসেবের থেকে বেশি বাস্তবসম্মত। প্রথম ধাপে সরকার যেখানে প্রকল্প গড়ে তুলছে সেই এলাকায় মোটামুটি সমান মাপের জমি নিলাম করে কিনবে, তারপর প্রকল্প এলাকার মধ্যে যাঁরা জমি বেচেন নি তাদেরকে জমির বদলে জমি হিসেবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।এভাবে প্রকল্পের জন্য জমিও এক জায়গায় সহজে করা যাবে।
এ ব্যবস্থায় সর্বপ্রথম দাম নির্ধারণ দুর্নীতিগ্রস্ত সরকারি কর্মচারীদের হাত থেকে নিয়ে সরাসরি নিলামের মাধ্যমে সরাসরি কৃষকের নির্ধারিত মূল্য অনুযায়ী করা হয়েছে। ফলে পণ্ডিতদের জোরাজুরি না থাকায় রাজনৈতিক জমি আন্দোলনের সম্ভাবনাও কম থাকবে। দ্বিতীয়ত উদ্বৃত্ত্ জমি তাঁদের মধ্যেই ভাগ করে দেওয়া হবে যে চাষিরা জমির ওপর সর্বাধিক দাম রেখেছেন। ধরা যেতেই পারে যে নিলামে এঁরাই সবথেকে বেশি দর হাঁকবেন ও শেষ পর্যন্ত নগদ নয় বরং জমির বিনিময়ে জমি হিসেবে ক্ষতিপূরণ পাবেন। এভাবে জমির বাজার না থাকার সমস্যাও দূর করা যাবে।
এই নিলাম পদ্ধতি আরো অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। কোন জায়গায় শিল্প প্রকল্প চালু হবে তাও বহুস্তরী নিলাম ব্যবস্থায় ঠিক করা যায়। প্রথমত সরকার ন্যূনতম প্রয়োজনীয় জমি ও তার রিজার্ভ দাম ঠিক করবে। এরপরে বিভিন্ন সমিতি তাদের এলাকায় শিল্প স্থাপনের জমির জন্য দর দিতে পারবে। সমস্ত দরই ঠিক হবে ন্যুনতম ধার্য জমি মূল্যের হিসেবে, যা দিয়ে তারা তাদের এলাকায় ইচ্ছুক জমি মালিকদের থেকে প্রয়োজনীয় জমি কিনতে পারবে।
এই নিলাম পদ্ধতি বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় পঞ্চায়েতকে দিলে তা জনমানসে সরকার থেকে চাপিয়ে দেওয়া অধিগ্রহণ হিসেবে প্রতিফলিত হবে না। শুধু পঞ্চায়েতকর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিতে হবে সরকারি আধিকারিকদের থেকে, কিভাবে নিলাম করতে হয়। এর ফলে পঞ্চায়েত তার নিজ এলাকায় শিল্প স্থাপনের ক্ষেত্রে আরো বেশি ইতিবাচক ভূমিকা নিতে পারবে।
প্রাক্তন গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ ও তাঁর সঙ্গী মোহাম্মদ খান জমি অধিগ্রহণে সরকারের প্রত্যক্ষ ও কেন্দ্রীয় ভূমিকায় বিশ্বাসী। তাঁদের মতে ভারতে জমির বাজার নিখুঁত নয় এবং ক্রেতা ও বিক্রেতার মধ্যে প্রচুর ক্ষমতা ও তথ্যের পার্থক্য আছে।
বাজার না থাকলে যা প্রয়োজন তা হলো ১) এমন দাম স্থির করা যেটা বাজার গড়ে উঠলেও থাকে এবং প্রকল্প জনিত সমস্ত তথ্য ও অর্থনৈতিক ভূমিকা সবার কাছে পৌছে যায় সহজে; ২) প্রকল্প চালু হলে, চাষিদের বিকল্প অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রাখা।
আমাদের এই বিকল্প ব্যবস্থায় ঠিক এইগুলোর কথাই বলা হয়েছে যেখানে নতুন আইনে এর কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না, বরঞ্চ আনুমানিক ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করা হয়।
গ্রামীণ জমির বাজার সংস্কার
আমরা এতক্ষণ যা দেখলাম, বহু জায়গায় জমি বাজারের অস্তিত্ব না থাকা অধিগ্রহণের মূল সমস্যা।
গ্রামে এরকম ছিন্নবিচ্ছিন্ন জমি বাজারের অবস্থানের কারণ অনেক – অস্বচ্ছ জমির হিসেব ফলে হস্তান্তরে অসুবিধা, জমির উর্ধ্বসীমা আইনের ফলে মালিকানা গোপন, বিক্রির জটিলতা, বিক্রেতাদের বেশিদূর যেতে না চাওয়া, দালালির সুযোগ না থাকা, ব্যাঙ্কের হাত সীমাবদ্ধ হওয়ায় উপযুক্ত ঋণের অভাব।
অন্য দিকে জমিই যেখানে বীমা, সঞ্চয়, আয়ের উৎস সেখানে জমির বাজার ঠিক হলেও গরীব চাষিরা নিছক লাভ দেখে জমি বিক্রি করবেন না। যেহেতু জমি সহজে বিক্রি করা যায় না, সেহেতু জমি বন্ধক রেখে ঋণও পাওয়া শক্ত। ঋণ বাজারও নিখুঁত না হবার ফলে কম উৎপাদনশীল চাষির থেকে বেশি উৎপাদনশীল চাষির হাতে জমির হস্তান্তর কঠিন। ঋণ বাজার নিখুঁত না হবার ফলে মালিক চাষির পক্ষে নতুন প্রযুক্তির চাষ, উচ্চ ফলনশীল বীজ, সেচ, কীটনাশক ইত্যাদি আধুনিক চাষ ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ঋণ নেওয়া অসম্ভব। শুধু বৈষম্য কমানোর জন্য নয়, আমরা যদি জমির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কথা ভাবি যার ফলে উদ্বৃত্ত শ্রম শিল্প ও পরিষেবার জন্য ব্যবহার করা যাবে, জমি সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। সম্পত্তি অধিকার আইনের সুষ্ঠু ব্যবহার শুধুমাত্র যে ব্যক্তিগত জমির মালিকানা চূড়ান্ত (optimum holding) করে তাই না, অপ্রত্যক্ষ ভাবে ঋণ বাজার সংগঠিত করে উৎপাদনশীলতা বহুগুনে বাড়িয়ে তোলে। সরকার অধিগৃহীত জমি থেকে ক্ষতিপূরণের অধিকার নির্দিষ্ট করার প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য, কারণ সিঙ্গুর থেকে আমরা দেখেছি ১/৩ অংশের বিরোধিতার মূল কারণ মেয়াদ উত্তীর্ণ জমির রেকর্ড। শেষ আয়যোগ্য জমির পরিমাপ জানতে জরিপ হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে, তারপরে সেই রেকর্ড কতটা ঠিকঠাক করা হয়েছে তা পুরোটাই জমির মালিক কতবার দুর্নীতিপ্রবণ জমি প্রবন্ধন দফতরে নিজের জমি হিসেব সংশোধন করতে গেছেন তার ওপর নির্ভরশীল। অনেকেই স্ট্যাম্প ডিউটি দেওয়ার ভয়ে সংশোধন করেন নি ও পরবর্তীকালে এর ফলে ভুল জমি ভাগ হয়েছে ও ক্ষতিপূরণ সঠিক মালিকের কাছে পৌঁছায় নি। সেচযোগ্য জমির সঠিক হিসেব না থাকায় জমির শ্রেণীবিভাগ ঠিক মত হয়নি ও অসেচযোগ্য জমির হিসেবে যারা সেচের জন্য খরচা করেছিলেন তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। যা অবশ্যই খুবই অল্প। যাদের জমির হিসেব ঠিকঠাক ছিল তাঁরা স্বভাবতই প্রতিবাদ করেছেন কম, ক্ষতিপূরণ দর কম ছিল না কিন্তু সমস্যা ছিল জমির শ্রেণীবিভাগ নিয়ে। সেইজন্য সঠিক বাজার দর জানানর জন্য জরুরী জমির সঠিক শ্রেণীবিভাগ।
নতুন জমি/ ভূমি সংস্কার আইন এজন্যেই গুরুত্বপূর্ণ কারণ প্রশাসনের লক্ষ্য সমস্ত তথ্য নথিভুক্ত করা ও কম্পিউটারাইজ করা। এর জন্য যা দরকার জমি মালিকদের সঠিক জমির হিসেব দেওয়ার সহযোগিতা। জমির উর্ধ্বসীমা আইনের ফলে প্রচুর জমির মালিকানা গোপন ও বেনামী, অন্যদিকে সরকারি অধিগ্রহণ হলে মালিকরা অবশ্যই চাইবেন সঠিক ক্ষতিপূরণ যার জন্য জমির হিসেব ঠিকঠাক থাকা প্রয়োজন। এই ভাবেই জমি সংশোধন ও অধিগ্রহণের মধ্যে এক সহজ সম্পর্ক আছে। দ্বিতীয় অংশ ঠিকঠাক কাজ করতে হলে প্রথম অবস্থার উন্নতি প্রয়োজন, আর প্রথম ক্ষেত্রে উন্নতি হলে স্বাভাবিক ভাবেই দ্বিতীয় ক্ষেত্রে অনেক সুবিধে হবে। সঠিক পরিসংখ্যান দিতে মালিকদের উৎসাহ দিতে, কিছু পুরস্কার যেমন, সরকারি সুযোগ সুবিধে দেওয়া যেতেই পারে। সহজে সরকারি ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ, NREGA, ভর্তুকি, জন বন্টন ব্যবস্থা ইত্যাদির ব্যবস্থাও করা যায়। একই ভাবে গত পঞ্চাশ বছরে জমি সংস্কার বলবৎ করতে আমাদের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে কিছুদিনের জন্য উর্ধ্বসীমা আইন কিছুটা শিথিল করা যেতেই পারে যাতে মালিকরা সঠিক তথ্য দিতে আগ্রহী হন। বিশেষত দেখা গেছে যে জমিসংস্কার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কৃষি উন্নতির পরিপন্থী হয়েছে, ও এর দায়ভাগ আরো বেশি বর্তায় জমির উর্ধ্বসীমা আইনের ওপর (Ghatak and Roy, 2007 )। এমনকি জমির রেকর্ড ঠিক করার জন্য ও সঠিক তথ্য জানালে আয়করে ছাড় দেওয়াও যেতে পারে। আদিবাসী এলাকায় কৃষি জমি বিক্রির ওপর অকারণ বিধিনিষেধ আরোপ, আদিবাসীদেরই স্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে। এই বিধিনিষেধ তফশিলী জাতি, উপজাতি আদিবাসীদের সঠিক জমি ব্যবহারে সাহায্য তো করেই নি উপরন্তু তাদের জন্য বিকল্প জীবিকা ও গড়ে তোলে নি। আপাতদৃষ্টিতে বৈষম্যের নামে শিল্পায়নে বাধা সৃষ্টি করে আদতে কিছু লাভ হয়নি। জঙ্গল রক্ষা আইন সংরক্ষণের নীতির বিরোধী হয়ে উঠেছে । সম্পত্তি আইনে আওতায় জঙ্গল জমি আনার উদ্দেশ্য অবাধ কৃষি ও বন কাটা নয় বরং, তাদের পুরুষানুক্রমে চলে আসা শিকার ও সংগ্রহণ বৃত্তি থেকে যদি তারা উচ্ছেদ হয় তার প্রকৃত ক্ষতিপূরণ ব্যবস্থাও করা। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে, বাস্তবের সাথে আদর্শের মেলবন্ধন না ঘটাতে পারা আমাদের ব্যর্থতা, ঠিক যেরকম বন্টন ব্যবস্থা শক্তিশালী করার পাশাপাশি সমষ্টিগত উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শিল্প স্থাপন ও বন ধ্বংস রোধ করার ভারসাম্য রক্ষা করতেও আমরা সক্ষম হইনি। সামাজিক ন্যায় বিচারের জন্য জমির বন্টন আরো সমান ভাবে হওয়ার সাথে সুষ্ঠু জমি বাজার ও জমির আরো উন্নত ব্যবহার পদ্ধতি গড়ে তোলার মধ্যে যে কোনো সংঘাত নেই সেই সত্যি যত তাড়াতাড়ি বোঝা যায় ততই মঙ্গল।
যোজনা পত্রিকায় নভেম্বর ২০১৩-এ প্রকাশিত মৈত্রীশ ঘটক, পরীক্ষিৎ ঘোষ, ও দিলীপ মুখার্জী রচিত “রিফর্মিং ইন্ডিয়া’স ল্যান্ড পলিসি” প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ।
মূল প্রবন্ধটির সূত্র : http://econ.lse.ac.uk/staff/mghatak/yojana.pdf । সেখানে উল্লিখিত অন্যান্য প্রবন্ধগুলির সূত্রও পাওয়া যাবে।
অনুবাদঃ সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শমীক মুখোপাধ্যায়