যারে অতিশয় ভালোবাসি সে আমারে প্রাণে মারিতে চায়,
করে দোষাদোষী সরলে গরল হল এখন ।।
মুখের কথাতে ভুলে কেন ভালোবেসেছিলে,
এখন মর তুষানলে পুড়ে পুড়ে সারাটা জীবন ।।
অতিশয় ভালোবেসে আমাদের গ্রামে মারা গিয়েছিল রামদা, কেষ্ট জামাই, কালোদা, সুবলদা - মারা যেতে চলেছে নিতাই, বুলা, হরি এরা সব আর তুষানলে পুড়ে পুড়ে মরছে অনেক। এই নিয়ে কোন উত্তেজনা নেই – ডাক্তারে জবাব দিয়েছে, ছেলে মনের আনন্দে তখনো ভালোবাসা ত্যাগ করতে পারছে না – আর আমরা আহা, আহা বলতে বলতে তাকে তার ভালো বাসা কিনে দিচ্ছি! আহা ভালোবাসুক না, কয় দিনই বাঁচবে আর! তবে সেই ভালোবাসা প্রথমে কীভাবে আরম্ভ হত সেই নিয়ে ডিটেলসে কোন স্টাডি হয় নি – কারণ আমাদের কাছে গোঁফ বেরোনো, জয়ন্তী সিনেমা হলে নুন শোয়ের মত এই ভালোবাসাবাসিও সময়ের হাতছানি বলেই বিবেচিত হত। অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামোর দিক থেকে অ্যাপ্রোচ করলে, প্রথম ভালোবাসা হত নয় থ্রি-এক্স রাম নয়ত লোকাল ধেনো দিয়ে। ভালোবাসাবাসি গরলে পরিণত করতে হলে যে পরিমাণে ডেডিকেশন থাকার দরকার তা বেশির ভাগেরই থাকত না। তুষানল ব্যাপারটাও প্রবলভাবে অর্থনৈতিক – মধ্যবিত্ত জ্বলত সেই আগুনে। ওই দিকে বাউরি পাড়ার রামদা বৌদিকে উত্তাল ক্যাল দিল আর তার পর প্রবল ভালোবাসাবাসি। মধ্যবিত্ত জ্বলছে অভিযোগে, জ্ঞান ফেরা মাতালের অনুশোচনায় – সুস্থ সামাজিক দোষাদোষীতে।
মাতালদের কৃতজ্ঞতা বোধ সাধারণত প্রবল আবার তার বহিঃপ্রকাশও দেখা যায় পুরুষালি – মেয়েলি, তরল – বায়বীয়, মুখ্য-গৌণ, প্রচ্ছন্ন-প্রকট নানাবিধ উপায়ে। আমাদের পাশের পাড়ার জেলেদের কার্তিকদার আর যাই থাক কৃতজ্ঞতাবোধ প্রবল ছিল, আর আমাদের প্রতি তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাত আমাদের বাড়ির নানাবিধ ফাইফরমাশ খেটে দিয়ে। কার্তিকদাকে ‘মাতাল’ ডাকনামে কে ডাকতে শুরু করেছিল জানা নেই, তবে হালকা সন্দেহ প্রকাশ করতে পারি যে এই কাজটি সম্পাদিত হয়েছিল আমার বড়জ্যাঠা বা মেজজ্যাঠা দ্বারা। আমাদের বাল্যকালে বাড়ির দুর্গাপূজার বিসর্জনে বাড়ির ভিতর মদ খাবার প্রচলন হয় পিসতুতো দাদা নিখিল বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে চাকরি পাওয়ার পর। তার আগে পূজার সময় কাকুরা একটু আধটু খেলেও তার সাপ্লাই আসত কার্তিকদার মাধ্যমে, কিন্তু জল মেশানো অবস্থায়। কার্তিকদা মদের বোতলের অর্ধেকের বেশি নিজে মেরে দিয়ে বাকিটা জল মিশিয়ে কাকাদের সাপ্লাই দিত, এবং সেই মদ খেয়ে আমার কাকারা ভোজন-অতিরিক্ত ঢেকুর তুলত। কাকাদের মাথার নিউরোন অ্যালকোহলের দ্বারা কতটা প্রভাবিত হত বলতে পারব না, তবে সেই নিউরোন বিসর্জনের সন্ধ্যবেলা এক ফাইন ব্যালেন্সের অভিনয়ের টিউনিং নিয়ে ব্যস্ত থাকত। বেশি টালমাটাল করাটা এক বাড়ি লোকেদের সামনে লজ্জার ব্যাপার – বিশেষত বৌদিদের বোনদের কাছে। আবার মদ খেয়েছি বোঝাতে না পারলেও পৌরুষ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ।
এই ভাবেই চলছিল – মাঝে স্ক্রিপ্টে চেঞ্জ এসে গেল নিখিলদা বিএসএফ ক্যান্টিন থেকে ছাড়া দেওয়া মদ নিয়ে হাজির হওয়াতে।
যে নিশা লেগেছে আমার আর যেন না ছোটে ।
পলকে পলকে যেন তারে মন ওঠে।।
গাঁজার নিশা মদের নিশা তাতে হারা হই নাই দিশা
ভাবের নিশায় পাগল হৈলাম আশা নাহি মিটে
নিশা করে মিশামিশি জাতিকুলমান গেছে ভাসি ধর্মাধর্ম সকলি গেল ঐ নিশার চোটে
ঝুলি কাঁথা করঙ্গ সার নিশাতে হয়েছে আমার ঘৃণা লজ্জা ইত্যাদি ভয় বিকায়েছে হাটে ।।
নিখিলদার ব্যাগ থেকে সেই বোতলের উপস্থিতি টের পেলাম – সেখান থেকে মদ সরিয়ে আমি কার্তিকদাকে প্রথম চাখতে দিই। সেই সময়ের স্কুল অব থটস ছিল এই যে থ্রি এক্স রাম খেতে হয় হয় কষা মাংসের চাট দিয়ে। যথারীতি মাংস রান্নার ভার পড়ে কার্তিকদার উপরে – সেই বয়সে মদের ভাগ না-এলেও আমার প্রতি কার্তিকদার ভালোবাসার জন্য কষা মাংস আমি চেখে ছিলাম। দুর্গাপূজার ভাসানের সময় বাড়িতে মদের অনুপ্রবেশ নিমো গ্রামের সীমানায় বাঙাল অনুপ্রবেশের মতই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ঘটনা বলে পরে প্রমাণিত হয়েছে। আরো হালকা বয়েস বাড়লে প্রথম সময় এল মদ নিজের জিভে চাখার। আমার ছোটবেলার ফ্রেন্ড, ফিলোসফার ও গাইড ছিল গদাকাকু। এত দিন পর্যন্ত কেবল মদ সাপ্লাইয়ে সাহায্য করেছি – যখন খাওয়া হত তখন আমার বয়সীদের উপস্থিতি এ্যলাও ছিল না। ফলে পরিমাপে গোলমাল করে ফেললাম – প্রথমে নিখিলদার ব্যাগ থেকে হাতানো থ্রি-এক্স রাম ও পরে গদাকাকুর সামনে বসে তার গাইডেন্সে অক্টোবরের শেষের বিকেলে ছাদে জিন পান। সন্ধ্যা বাড়ছে, আমার বাড়ছে কনফিউশন – তখনও বাড়ির ঠাকুরকে প্রণাম করে বিজয়া দশমী করতাম সবাইকে – সেই প্রথম বার স্কিপ হল, বড় কারো কাছে যেতে পারছি না মুখে গন্ধের ভয়ে – মাথা ঘুরছে, পায়ের নিচে বসানো আছে আলি চাচার বানানো তুবড়ির বস্তা, নিজেদের বানানো রঙমশাল, আর অগুনতি বুড়িমার চকোলেট বোম্বের বাক্স। পরের স্মৃতি আবছা – নদুকাকুর ঘরে খাটের ধারে আমি বমি করছি মেঝেতে, আমার বাম পাশে শুয়ে আমার উপর দিয়ে উঠে মেঝেতে বমির চেষ্টা করছে আমার গাইড গদাকাকু। ফুলমা আমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে আর বলছে এই গদাটার জন্য – ফলত গদাকাকু কোন জলপট্টি পাচ্ছে না, না পাচ্ছে বমি করার জন্য কোন হেল্প। সে নিশা আমাদের সহজে ছোটে নি – এবং পলকে পলকে তারে মনে উঠেছে। গাঁজা আমাদের ঘোষ বাড়িতে কোন দিন ট্রাই হয় নি। সেই দিন নিশা করে আমার এবং গদা কাকুর ঘৃণা লজ্জা ইত্যাদি ভয় প্রায় হাটে বিকিয়েছিল।
বাসুলি কহিছে শুনহ দ্বিজ।
কহিব তোমারে সাধন বীজ।।
প্রথম দুয়ারে মদের গতি।
দ্বিতীয় দুয়ারে আসুক স্থিতি।।
পাবলিক যে ঝড়ের গতিতে প্রথম দুয়ার দিয়ে মদ খেতে ঢুকত, দ্বিতীয় দুয়ার দিয়ে ততোধিক শ্লথগতিতে বের হয়ে আসত। নিজের স্থিতি বজায় রাখায় ধীরগতি প্রবলভাবে সাহায্যকারী সেই সত্য মাতালদের মাথায় প্রতিবর্ত ক্রীড়ার মত বর্তমান। ঘটনা হচ্ছে, আমি কার্তিকদাকে মাতাল অবস্থায় কোনদিন দেখিনি, সেই অর্থে ধরণা করে নিতে হবে কার্তিকদার সাধন বীজের ব্যাপারটি জানা ছিল। দ্বিতীয় দুয়ারে স্থিতি ব্যাপারটা জানা ছিল না রামদা, সুবলদা, কালোদা সহ আরো অনেকের। কারণ ওরা লোকাল ধেনো ফাঁকা জায়গায় খেত।
তবে কার্তিকদাকে সর্বদাই পান খেতে দেখেছি। গৃহস্থ মাতালরা মদ খাবার পর গন্ধ ঢাকার জন্য পান খেত সেই যুগে – তাই এটা হতে পারে যে সর্বদা পান খাওয়া দেখে কেউ এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল কার্তিক পাঁড় মাতাল। দ্রুত র্যান্ডাম ভুল সিদ্ধান্ত পৌঁছাবার খ্যাতিবৈশিষ্ট্য যুক্ত আমার বড় বা মেজ জ্যাঠার দ্বারাই সেই কাজ সম্পন্ন হয়েছিল বলে ধারণা। আবার এই ভাবেও লজিক্যাল কনক্লুস্যানে পৌঁছানো যেতে পারে যে – মাতালদের আনুগত্য বেশি, আবার কার্তিকদার আনুগত্যবোধ বেশি ছিল – তাই কার্তিকদার নাম জ্যাঠারা দিয়েছিল ‘মাতাল’। কিন্তু দীর্ঘ ৩৪ বছর যাবত জ্যাঠাদের পর্যবেক্ষণ করে এই অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছানো গেছে যে কংগ্রেস পিরিওডে শঙ্কর মাছের চাবুক নিয়ে লোক পেটানো জ্যাঠাদের লজিক্যাল ও সমাজতাত্ত্বিক মনন এত পরিণত ছিল না কোন দিনই। সেই কংগ্রেস আমলে বড় জ্যাঠাই কার্তিকদাকে ব্লক সেটেলমেন্ট অফিসে চাকুরি পাইয়ে দেয় – শিক্ষাগত দিক থেকে যার যোগ্যতা কোন ক্রমে নাম সই। উপকার কার্য সম্পন্ন হবার পর সাধারণত উপকৃতের প্রধান কাজই হয়ে দাঁড়ায় উপকারীকে যেন তেন প্রকারেণ হেনস্থা করা এবং সে যে কারো দ্বারা উপকৃত হয়নি এটা প্রমাণ করার সর্বান্তকরণ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। কিন্তু এই নিয়মের ব্যতিক্রম হিসাবে কার্তিকদা আজীবন ঘোষ বাড়িকে কৃতজ্ঞতাপাশে বেঁধে রেখেছিল। কার্তিকদার ফেমাস ডায়লগের মধ্যে প্রধান ছিল, “আমি জানলা দিয়ে হ্যারিকেনটা গইলে দেব, তুই নিয়ে পাইলে আসবি”। আমাদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ভোট হত নিমো এক নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েতের ভোটার দের – প্রাক বোতাম টেপার যুগে, স্ট্যাম্পের কালি ছাড়া ভোটকেন্দ্রের দুই প্রধান আকর্ষণীয় বস্তু ছিল পাটের চট যা দিয়ে ভোট দেওয়ার ঘেরা জায়গা বানানো হত আর সেই চটের ঘুপরিতে অন্ধকার দূরীকরণে ব্যবহৃত হ্যারিকেন। একবার ভোট দিতে ঢোকার আগে কার্তিকদা আমাকে স্কুলের জানালার কাছে দাঁড়াতে বলেছিল যাতে করে ভোট দেওয়ার পর সে আমাকে জানলা দিয়ে হ্যারিকেনটা গইলে দিতে পারে – আমার কাজটা ছিল কেবল নিয়ে পাইলে আসার। বহুদিন যাবত এই প্ল্যান বানানো হয়েছিল – আমাদের বাড়িতে বসেই – টাইমিং, ব্লু-প্রিন্ট, এসকেপ রুট সব প্রস্তুত। কিন্তু সেই প্ল্যানের প্রধান ড্র-ব্যাক ছিল এই যে, স্কুলের জানালার দুই লোহার শিকের ফাঁক দিয়ে হ্যারিকেন তো দূরের কথা, খুব কষ্ট করে রয়েল বেকারির পাউরুটি গলত কেবল!
তবে এর বহুকাল পরে কার্তিকদা তার মাতাল নাম সার্থক করেছিল মদ খেয়ে নয়, খটখটে শুকনো ডাঙা জমিতে সাইকেল থেকে আছাড় খেয়ে! পড়ে গিয়ে কার্তিকদার কিছু ভাঙেনি বটে, কিন্তু পা মচকে ফেলে। এবং সেই মচকানো পা নিয়ে বাকি জীবন কার্তিকদা একটু খুঁড়িয়ে হাঁটার মোডে শিফট করে গিয়েছিল। এই ঘটনা গ্রামবাসীর মনে স্থির ধারণার জন্ম দেয় যে কার্তিকদা আদপেই মাতাল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আমার গ্রাম সাইকেল থেকে মাতালদের পড়ে যাওয়া দেখে অভ্যস্ত – সেই লিস্টে লিড করত পালপাড়ার সুধীর এবং তার পাশের বাড়ির তপু যে পরে তান্ত্রিক হিসাবে এলাকায় ব্যাপক পরিচিত লাভ করেছিল।
নিতাইচাঁদ খুলেছে ভাল মদের আবগারি
এ মদ যে খেয়েছে সে বুঝেছে নেশার কেমন মাধুরী
বার বছর ছিল তা জাগে প্রথম এই কলিযুগে
ভাটি খুলে দিচ্ছে তুলে যা পায়নি কেউ আগে
এ মদ মহৌষধি ভবাবেগে তা খায় কত পুরুষ নারী
আমাদের গ্রামের আশেপাশে বিলেতী আবগারি বলতে ছিল কেবল ছিল মেমারী চেকপোস্টের কাছে মণ্ডলদের মদের দোকান। এই দোকান দীর্ঘকাল, অন্তত আমি যতদিন গ্রামে ছিলাম ততদিন জ্বালিয়েছে। মণ্ডলদের ছেলে কিশোর ছিল আমার সহপাঠী এবং সেই অর্থে আমাকে চিনত তার ফ্যামিলি – ফলত মদ কিনতে গেলে আমার অবস্থান কেবল দূরে সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা। আর দেশি লাইসেন্স দোকান ছিল নিমতলা – তবে দেশি মদের ভাটি গজিয়ে উঠেছিল আমাদের গ্রামের আশেপাশেই বেশ কয়েকটি। মল্লিকপুর, গ্রামের ধারে পদ্মের পুকুরের পাড়ে, ওই দিকে মশাডাঙা। মাঝে মাঝে পুলিস এসে ভাটিখানা ভেঙে দিয়ে যেত, কিন্তু কিছু দিন পরে আবার যে কে সেই। এর মধ্যে পদ্মের পুকুরের পাড়ের আকর্ষণ সবার কাছে ছিল একটু বেশি, কারণ ওই ধেনো যে পরিবেশন করত তার জিনিসপত্র (দিবাকরের ভাষায় মেশিন) অরণ্যের দিনরাত্রির সিমি গারওয়ালের থেকে কোন অংশে কম ছিল না। ধেনোর বোতল ফেরত দেওয়ার প্রায় এক দুঃস্বপ্নের কাজ – সেই দুঃস্বপ্ন থেকে পাবলিক মুক্তি পায় পলিপ্যাকের ব্যবহার শুরু হবার পর। ধেনো কারখানা থেকে নিমোতে হোম ডেলিভারি শুরু হয়ে গেল পলিপ্যাকের। তবে এটাও জানিয়া রাখা দরকার যে বাউরি পাড়ার বঊ সমেত আমাদের গ্রামের মেয়েরা মদ নামক মহৌষধি থেকে প্রায় বঞ্চিতই ছিল। মহৌষধি হিসাবে তাদের অনেকের নজর ছিল অন্য জায়গা থেকে নিঃসৃত রসে।
রসের গাছে মাসান্তরে রস পাবি গাছে চাচ দিলে
পাবে তুমি জিয়নে রস খাবে সুখে গুড় হলে
গাছে উঠবে গো ধীরে যতনে দুহাত ধরে
নল পুঁতে নলিয়ে নিও সে রস আছে গভীরে
যেন চোট না লেগে ভাড় পাত নিচে যোগাযোগ সুতোতে
ডেগোর রসে নোনা আছে সে রস যেও না খেতে।।
মেয়েদের মহৌষধির রস যেখান থেকেই নিঃসৃত হোক, আমাদের কৈশোর বেলার আর এক প্রিয় ধরনের রস আসত খেজুর আর তালগাছ থেকেই। রামাশিসের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া শীতকালের খেজুর রসে স্বাদ থাকলেও নিষিদ্ধ গন্ধ ছিল না। সবটাই গার্হস্থ্য ব্যাপার – তালের রস আমাদের কাছে নিষিদ্ধ করে এবং জনপ্রিয় করে দিয়েছিল মনসা। তাড়ির সম্প্রসারণে সবাইকে তুমি করে বলা মনসার অবদান নিমোতে অনঃস্বীকার্য। বুধোর মা মাটির ভাঁড়ে করে তাড়ি এগিয়ে দিচ্ছে – সেই দৃশ্য মনে করে আমার পরবর্তীকালে প্রবল করুণা হত বারটেন্ডারের হাত থেকে মদ নেওয়া কলকাতাবাসীদের জন্য। তাড়ি খেয়ে ফুটবল খেলতে নামা রুটিন হয়ে গিয়েছিল – তাড়ি খেয়ে প্রবল ঘাম আর ততসহ দুর্গন্ধ। সেই ঘাম হেতু আমাদের শুধু ডগা নয়, পুরো শরীরেই নোনা রস লেগে থাকত যেন।
সুধীর মদ আর জি টি রোডের ধারে তার চায়ের দোকান নিয়ে ব্যস্ত ছিল – আর আমারই দূরতম ঘোষ বংশের মদনদা ব্যস্ত ছিল সুধীরের বৌকে নিয়ে। যৌথ পরিবারে ছোট থেকে মানুষ হলে মানসিক উদারতা যে বেড়ে যায় তার এক প্রধান দৃষ্টান্ত ছিল সুধীরের ছোট ছেলেকে পুরোপুরি মদনদার মত দেখতে হলেও তাদের পরিবারে প্রকাশ্যে এই নিয়ে কোন টেনশন ছিল না! রাতের বেলা চায়ের দোকান বন্ধ করে মদ খেয়ে সুধীর সাইকেল নিয়ে নিমো রেলগেট পেরিয়ে বাড়ি ফিরত। যথারীতি রেল গেট বাকি রাস্তার থেকে বেশী উঁচুতে থাকার জন্য উঠার সময় বেশ কষ্ট আর নামার সময় বেশ গড়িয়ে নামা যেত। তা সেই নামার সময় সুধীর সাইকেল রানিং করে দিত, কিন্তু তা বাঁ পা বেশির ভাগ দিনই প্যাডেল খুঁজে পেত না। ফলত সাইকেল সমেত সুধীরের পতন – বেশ কয়েকবার হ্যান্ডেল সোজা না-থাকার জন্য সাইকেল নিয়ে সুধীর রাস্তার পাশের খালে পড়ে। যাঁদের মাতাল হ্যান্ডেল করার অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা জানবেন যে মাতালরা ডাঙায় যতটা অকুতোভয়, জলে পড়ে গেলে ততটাই অসহায়। সেই সব ক্ষেত্রে সুধীরের উদ্ধার হয়েছিল গ্রামবাসী দ্বারা। এমনকী আমাদের ক্লাস সেভেন-এইটে সমাজসেবা নামক বস্তু চালু হবার পর এমনও দেখা গেছে যে ছেলেরা অপেক্ষা করছে রাত নয়টা নাগাদ নিমো রেলগেটে সুধীরের জন্য – তাকে জল থেকে উদ্ধার করবে বলে। এর থেকে বড় সমাজসেবার উদাহরণ আমাদের আশেপাশে কমই ছিল।
রসিক রসিক সবাই করে, কেহ সে রসিক নয়।
ভাবিয়া গণিয়া বুঝিয়া দেখিলে কোটিতে গুটিক হয়।।
সখি সে রসিক বলিব কারে।
বিবিধ মশালা রসেতে মিশায়, রসিক বলিব তারে।।
রস পরিপাটি সুবর্ণের ঘটি, সম্মুখে পুরিয়া রাখে।
খাইতে খাইতে পেট না ভরিবে, হাতাতে ডুবিয়া থাকে।।
সেই রস পান রজনী দিবসে অঞ্জলি পুরিয়া খায়।
খরচ করিলে দ্বিগুণ বাড়য়ে, উদ্বেলিয়া বহি যায়।।
আমরা বুঝতে পারতাম না সুধীর রসিক পর্যায়ভুক্ত কিনা – তবে মদনদা যে আপাদমস্তক রসিক ছিল সেই বিষয়ে আমরা নিঃসন্দেহ ছিলাম। নিজের সুন্দরী বউ থাকতেও সে সুধীরের বউয়ের সুবর্ণ ঘটিতে রস পুরে পুত্র উৎপাদনে সক্ষম হয়েছিল। এবং ভাইস ভার্সা মদনদা নিজেও সুধীরের বউয়ের রসে প্রায় সায়াহ্ন কাল পর্যন্ত ডুবে ছিল। আর রসিক ছিল আমাদের নাগাড়ে কিষেণ সুবলদা – যে ধেনো খেয়ে বাড়ি ফিরে বঊকে বলত, “এহ মা, গিভ মি এ গ্লাস অব ওয়াটার”। এই সুবলদাই আমাকে নিমো ষ্টেশনে সবার সামনে ইংরাজী চ্যালাঞ্জে হ্যাটা করেছিল কচুপাতার ইংরাজি বলতে পারি নি বলে! রসিক ছিল রামদাও যে পয়সার অভাবে বাড়ির দরজার কাঠের পাল্লা মাথায় করে ভাটিখানার দিকে পা বাড়িয়েছিল মদ খাবার জন্য।
বেশিরভাগ মহাপুরুষ, বামাক্ষ্যাপা এবং শিমলাগড়ের সেন্টু তান্ত্রিকের মত তপুদার বাল্যকালও শুরু হয়েছিল গতানুগতিক ভাবে। ছোটবেলায় তার মধ্যে কোন বিশেষ ক্ষমতার পরিচয় নিমো গ্রামবাসী পায় নি। আমাদের দেখা তপুদার পূর্বজন্ম ছিল এইরূপ - চাষ-আবাদ দেখাশুনা, পিয়ারলেসের এজেন্ট ও লটারি বিক্রেতা। অনেকদিন পর একবার বাড়ি ফিরে শুনলাম তপুদা নাকি তান্ত্রিক হয়ে গেছে! তবে মেমারী বামুনপাড়া মোড়ের গুঁড়া মশলার পাশের লটারির টিকিটবিক্রেতা থেকে তান্ত্রিক মোডে ট্রানজিশনের বিস্তারিত খবর আমাকে কেউ দিতে পারল না। তবে এটা জানা গেল তপুদার ব্যবসা নাকি জাঁকিয়ে বসেছে – গ্রামে পালপাড়ার তপুদের বাড়িতে চারচাকার গাড়ির আনাগোনা বেড়ে গেল। মেমারী থানার বড়বাবু ও মেজবাবু ছাড়াও লোক মুখে শুনা গেল সম্পন্ন ঘরের গৃহিনীদের আনাগোনাও নাকি দেখা গেছে তপুর বাড়িতে। কথায় আছে গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না – তায় আবার যদি সেই যোগীর গামছা পরে মাঠে পায়খানা বসতে যাবার সাথে পাবলিকের সম্যক পরিচয় থাকে! তপুদার বাড়ির চিরকালই পাকা পায়খানা ছিল – তার তান্ত্রিকে পরিণত আগেই। তবে সে ফাঁকা মাঠেই পায়খানা করতে ভালো বাসত। মাঠে পায়খানা করার এক অলিখিত নিয়ম হচ্ছে এই যে, বসে পায়খানা করাকালীন যদি কেউ হঠাৎ আলপথ দিয়ে কাছে চলে আসে তা হলে লজ্জাবশত উঠে দাঁড়ানো, বিশেষ করে যদি মেয়ে এসে যায়। কিন্তু তপুদা কোনওকালেই কাছে মেয়ে চলে এলেও পায়খানা করা ছেড়ে উঠত না – এত দিন পরে তার জীবন অন্যালিসিস করতে বসে দেখতে পাচ্ছি, তপুদার সেই নির্লজ্জতার মধ্যেই পরবর্তীকালের তান্ত্রিক হওয়ার বীজ লুকিয়ে ছিল, কেবল আমাদেরই দেখার চোখ ছিল না!
তান্ত্রিক হবার পর তপুদাকে মদ খাওয়া ধরতে হলই – পিয়ারলেসের এজেন্ট বা লটারিবিক্রেতা যে কোনওটাই হওয়ার জন্য তীব্র বুদ্ধি দরকার হয়, তা তপুদার বুদ্ধি তান্ত্রিক হবার পর যে এক্সপোনেন্সিয়্যালি বেড়ে গেছে তাও আমরা দেখতে পেলাম সামনাসামনি। তপুদা মদ খেয়ে সাইকেলে করে ফিরছে রাতের বেলা, আমরা বসে আছি মনসা মন্দিরের দুয়ারে। মন্দিরের সামনের বাড়ির চাঁপি তখন সবে আত্মহত্যা করেছে – সাইকেল থেকে হট করে তপুদা দেখলাম পড়ে গেল – মাতাল হবার জন্য ব্যালেন্স করে আর উঠতে পারে না! আমাদের চেষ্টায় মাটি থেকে ওঠার পর দেখি পিছন দিকে তাকিয়ে অদৃশ্য কাউকে উদ্দেশ্য করে তপুদা বলছে “এটা কী হচ্ছে ! এ্যাঁ, এটা কী হচ্ছে? আমাকে যেতে দিবি না? ভেবেছিস কী তুই – টেনে ধরে রাখবি?” আমরা মাতালের প্রলাপ ভেবে বাড়ি পাঠিয়ে দিলাম – পরের দিন মচকানো হাত নিয়ে আমাদের কাছে এসে বলে, “জানিস আমাকে কালকে পিশাচ পিছন থেকে টেনে ধরেছিল? আর ওই পিশাচের সাথে জুটেছিল তোদের ওই চাঁপি। আমাকে ওই চাঁপিই ঠেলে দিল সাইকেল থেকে!”
বিদেশে পুরস্কার পাওয়ার পর যেমন দেশি সিনেমার কদর বাড়ে, তেমনি বাইরের খদ্দের বাড়ার পর গ্রামের ভিতরেও তপুদার শিষ্য বেড়ে গেল – প্রকাশ্যে কেউই সেই শিষ্যত্ব স্বীকার করে না। তবে আমাদের জানামতে নিমো তথা আশেপাশের গ্রামের প্রথম শিল্পপতি আমাদেরই বন্ধু স্থানীয় রাজুর দুই হাত আঙটিতে আর পাথরে ভরে গেল। সেই পর্যন্ত ঠিক ছিল, কিন্তু তপুদার কথায় চলতে গিয়ে শেষে রাজুর বিয়ে আর হয় না! জাত-পাত, ঠিকুজি-কুষ্ঠি তো আছেই, তার সাথে নাকি মেয়ের গণও নাকি মেলাবার ব্যাপার আছে! অনেকদিন দেখার পর রিকোয়ারমেন্টে ঢিলে দিলে তবেই মনে হয় মেয়ে পাওয়া গিয়েছিল!
এখনকার শিষ্যসকল মাগী না পেয়ে বেজার হয়।
মাগী পেলে শিষ্যসকল আনন্দে মেতে রয় ।।
কলিকালের গুরু যত, মাগী দেয় তারা মনের মত
তাইতে শিষ্য থাকে রত, গুরু যা বলে শিষ্য তাই কয় ।।
মাগী লাথি মারলে পরে আনন্দ প্রাণে নাহি ধরে
গুরুবাক্যে মন বেজার করে, মাগীর লাথি বড় সয় ।।
সত্য ধর্ম বলিতে নাই কুকর্ম কেবল দেখতে পাই
আমার দুঃখ কারে বলব ভাই, গোঁসাই গোপাল কয় সব মাগীময়।।
সাধারণত এই ধরণের গুরু তান্ত্রিক জাতীয় ব্যাপারগুলোর মধ্যে মেয়েঘটিত ব্যাপার লুকিয়ে থাকে। জানিনা তপুদার শিষ্যরা মাগী পেয়েছিল কিনা, বা মাগী না পেয়ে বেজার হয়েছিল কিনা। কলিকালের গুরু হয়েও আমাদের সামনা সামনি তপুদাকে মনের মত মাগী সাপ্লাই দিতে দেখিনি – তবে বাইরে কী ছিল বলতে পারব না! মেয়েঘটিত ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত ছিল তপুদার ভাই রমেশ যে বাউরিপাড়ার নরেনের বউয়ের সাথে পাশের শহর মেমারীতে সন্ধ্যাযাপন করতে যেত পাঁচটার ট্রেনে। পরস্ত্রীর দিকে ঝোঁক বেশি – এই জাতীয় কেস সাধারণত তান্ত্রিকদের কাছে অনেক আসে। তপুদা অনেককে সেই বিষয়ক তাবিজ দিলেও, নিজের ভাই রমেশকে নরেনের বউয়ের হাত থেকে (বা ভাইস ভার্সা) ফিরিয়ে আনতে পারে নি – রমেশের বিয়ের পরেও! ঘরে বাইরে মাগীর লাথি প্রায় বলতে গেলে নিত্যকার কেস হয়ে গিয়েছিল – তবে তপু বা রমেশ তাতে আনন্দ পেত কিনা তা ডিটেলসে বলতে জানা নেই। তপুদার গুরুত্বে সন্দেহ থাকলেও, সবই যে মাগীময় সেই বিষয়ে আমাদের মনে বিন্দু মাত্র দ্বিধা কোন কালেই ছিল না। মাগীর সাথে পিরিতিও জড়িয়ে গেল যত বয়স বাড়তে লাগল – নেশার সাথে ভিতরে চাপা থাকা কামনার কথা – তা সে সরস্বতীপূজার বিজয়ার সময়ে অপর্ণার বাড়ির সামনে থেকে চন্দনের উঠতে না-চাওয়া বা দেবুদার হলেও-হতে-পারত বেয়াইয়ের রাতেরবেলা অন্য গ্রাম থেকে এসে তার মেয়ের সঙ্গে প্রেম করার জন্য দেবুদার ছেলেকে উত্তাল শাসন। অনেক কথা অকথিত থেকে গেল – সে সব অন্য কোনও বার। কৈশোরে মাতাল আমাদের পিরিত নিয়ে ভাবনা ছিল এই রূপ -
পিরিতি নগরে বসতি করিব পিরিতে বাঁধিব ঘর ।
পিরিতি দেখিয়া পড়শি করিব ভাবিনু সকলি পর ।।
পিরিতি দ্বারের কপাট করিব, পিরিতে বাঁধিব চাল ।
পিরিতি আসক সদাই থাকিব পিরিতে গোঙাব কাল ।।
পিরিতি পালঙ্কে শয়ন করিব পিরিতি শিথান মাথে ।
পিরিতি বালিশে আলিস ত্যেজিব থাকিব পিরিতি সাথে ।।
পিরিতি সরসে সিয়ান করিব পিরিতি অঞ্জন লব ।
পিরিতি ধরম পিরিতে পরাণ দিব।।
এতদিন পরে ভেবে দেখি আমাদের পিরিতে আমরা পরাণ দিতে পারিনি যেমনটা পেরেছিল রামদা বা কেষ্ট জামাই। তবে পিরিতে পড়ে আমরা অনেককাল গোঙানির সাথে কালযাপন করেছি, রেসপেক্টিভ বাপেদের প্রহারের সাথে।
[এখানে ব্যবহৃত পদগুলি প্রচলিত বাউল-ফকির পদাবলী থেকে নেওয়া]
অলংকরণঃ সুমেরু মুখোপাধ্যায়