হত্যা তালিকার সর্বশেষ সংযোজন অনন্ত বিজয় দাস। সিলেট, বাংলাদেশ। প্রতিবারের মতই এবারেও প্রতিবাদ, লেখালেখি, মিছিল – আর প্রতিবারের মতই প্রশাসনের নির্লিপ্ততা, পাশ কাটানোর চেষ্টা। বস্তুতঃ স্পষ্ট বার্তা – এই পথে চললে এইটাই পরিণতি, সুতরাং নিজেকে সামলে। আর হত্যাকারীদের তরফ থেকে বার্তার চেয়েও বেশী যেন তাচ্ছিল্য – যা পারিস করে নে, পরের নামটা কার বুঝে নে। সবাই জানে কিছু হবার নয় তবু কিছু চেঁচামেচি – নিজেকে জানান দেওয়া যে তবু তো কিছু করছি দাদা।
ইতিমধ্যে মাসখানেক আগে আরো একটি হত্যাকান্ড ঘটে গেছে তুলনায় নিঃশব্দে। পাকিস্তানের করাচীতে নাস্তিকতার শহিদ হয়েছেন সমাজকর্মী সাবীন মাহমুদ। হত্যার মোডাস অপারেন্ডি এবং চরিত্র অনন্ত বা তার আগে ওয়াশিকুর-অভিজিত প্রমুখদের চেয়ে খুব পৃথক কিছু নয়। অথচ তেমন করে কিছু লেখালেখি হয়নি এ নিয়ে। তার কারণ কি শুধুই সাবীন পাকিস্তানি বলে? সাবীনকে নিয়ে তেমন ঢেউ ওঠেনি আমাদের এই বাংলায় বা বাংলাদেশে, এটা ঘটনা। কারণটা শুধুই পাকিস্তান কি?
কেউ কেউ বলেছেন সাবীন মাহমুদের হত্যা ঠিক নাস্তিকতা বিরোধী হত্যাশৃঙ্খলার অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না – ওটা অন্য বিষয়। সাবীনা মারা যান তাঁর নিজের প্রতিষ্ঠান (দ্য সেকেন্ড ফ্লোর বা T2F) এ অনুষ্ঠিত একটি সেমিনার সেরে ফেরার সময়ে, যার বিষয় ছিল আনসাইলেন্সিং বালুচিস্তান। পাকিস্তানের নতুন সাইবার আইন যা বাকস্বাধীনতার পরিপন্থী বলে অনেকেই মনে করেন তার বিরুদ্ধে এবং বালুচিস্তানের স্বাধীনতার দাবীকে কন্ঠ দিতে এই সেমিনারের আয়োজন। যে সমস্ত বালোচ বিপ্লবী এবং সাধারণ নিরীহ মানুষ রাষ্ট্রের দ্বারা বন্দী হবার পর “নিরুদ্দেশ” হয়ে গেছেন, আদালতে যাঁদের দেখা যায় নি, বরং মাঝে মাঝে পাওয়া গেছে কিছু নিখোঁজের লাশ, তাদের অনেকের আত্মীয়-স্বজন উপস্থিত ছিলেন এই সেমিনারে। পাকিস্তানের বালোচদের এই স্বাধীনতার লড়াইকে অনেকে বিচ্ছিন্নতাবাদ আখ্যা দিয়ে থাকেন।ফলে তাঁদের মতে এটা অন্য লড়াই – অন্য পক্ষ। সাবীন নাস্তিকতার শহীদ হননি।
সাবীনের জীবন, তাঁর কাজকর্ম কিন্তু অন্য কথা বলে। এই সেমিনারটা কোন আকস্মিক ঘটনা নয় বরং সমাজকর্মী সাবিনের কর্মধারার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। রাষ্ট্রের খবরদারীর বিরুদ্ধে তাঁর কন্ঠ আজীবন স্বরবান ছিল – এবং পাকিস্তানের মত ধর্মীয় রাষ্ট্রে থেকে ধর্মের বিরুদ্ধেও। অতএব সাবীনের হত্যাকে আমরা এই শৃঙ্খলার অন্তর্ভুক্ত হিসাবেই দেখতে চাই। হ্যাঁ, নাস্তিক হত্যার যে শৃঙ্খলা এই উপমহাদেশে বিগত কয়েকমাস ধরে চলে আসছে সেই শৃঙ্খলা। এক্ষেত্রে নাস্তিক বলতে শুধু ধর্মীয় নাস্তিক বোঝাচ্ছি না। রাষ্ট্র, ধর্মের মতই একটা প্রতিষ্ঠান। তার বিরুদ্ধে যারা প্রশ্ন তোলেন, ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার সাহস রাখেন, তিনি অবশ্যই একজন নাস্তিক এবং কমরেড। বালুচিস্তানের দীর্ঘদিন ধরে “নিখোঁজ” মানুষগুলোকে, যাদের আমরা আগে থেকেই চিনি কাশ্মীরে বা জাফনায়, চট্টগ্রামে কিংবা লালগড়ে, কেন আদালতে পেশ করা হবে না, বিচার হবে না, কেন মাঝে মাঝেই তাদের লাশ পাওয়া যাবে, এ প্রশ্ন যিনি বা যাঁরা তোলেন, পাকিস্তানের মাটিতে তোলেন, আমাদের চোখে তাঁরা নাস্তিক বই কি।
এখন কথা হল, তাহলে কি ধরে নেব যে এই হত্যাকান্ড মূলতঃ পাকিস্তান সরকারের রাষ্ট্রীয় মদতেই ঘটানো? এর পিছনেও সেই কুখ্যাত আই এস আই? উত্তর আপাতদৃষ্টিতে - না। এই হত্যা মোটামুটি যতটুকু জানা গেছে, মৌলবাদীদেরই কাজ, রাষ্ট্রের নয় – ঠিক যেমনটি ঘটেছে দাভোলকার – পানসারে – হুমায়ুন – রাজীব – অভিজিৎ - ওয়াশিকুর – অনন্তদের ক্ষেত্রে। না কোন ক্ষেত্রেই রাষ্ট্র খুনী নয় – তারা এর ‘বিরুদ্ধে’। নিষ্ক্রীয় বিরোধিতা। এতগুলো খুন হল, একটা ক্ষেত্রেও ‘অপারগ’ রাষ্ট্র কোন খুনীর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি এখন পর্যন্ত (ফারাবীর মত কিছু লোক দেখানো ধরপাকড় হয়েছে অবশ্য)। তবে অন্ততঃ সাবীনার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়াটা অভিজিৎ বা ওয়াশিকুরদের চেয়ে বেশী বিশ্বাসযোগ্য শুনিয়েছে। কিন্তু আমাদের নোংরা মন যে খালি ছিদ্র খোঁজে। কেবলই মনে হয় কারণটা কি এই যে পাকিস্তানী আমলারা বাংলাদেশী আমলাদের চেয়ে নাটকটা বেশী ভালো লেখেন? বেশী বিশ্বাসযোগ্য করে?
বাংলাদেশী বন্ধুরা দুঃখ পাবেন না – এই বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব কিন্তু গুণগত মানের কারণে নয়, অভিজ্ঞতার তারতম্যের কারণে। ভারত বা পাকিস্তান রাষ্ট্র এই খেলাটা দীর্ঘদিন খেলে আসছে – তাই তাদের অভিজ্ঞতা অপেক্ষাকৃত বেশী বিশ্বাসযোগ্য নাটক লেখার সহায়ক। ফলতঃ বাংলাদেশে আওয়ামী সরকারের নিষ্ক্রীয়তা যতটা দৃষ্টিকটূভাবে ধরা পড়ে ভারত বা পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ততটা হয়না। ফলাফল কিন্তু একই। লিস্টিটা দীর্ঘতর হয়ে চলেছে – চলবে। এবং নাস্তিকতাও চলবে। আমরা অবিশ্বাস করে যাব। প্রশ্ন করে যাব। হাসতে হাসতে মরে যাব। লাশগুলো জেগে থাকবে একেকটা প্রশ্নচিহ্ন হয়ে। যে সুইস সাবীন – যে সুইস অনন্ত – যে সুইস আথে।