আলফা মেল শব্দটা বেশিদিন আগে জানিনি। খুব বেশিদিন হল না, এ শব্দটা বাংলার যত্রতত্র আবোদা ষাঁড়ের মত ঘুরতে শুরু করেছে। ওই যে যে উপন্যাস, আর তা থেকে তৈরি সিনেমাটা, যেটা থেকে এখানকার মানুষ একটু আধটু বিডিএসএম ও প্রেম একসঙ্গে ঘটতে পারে বলে জানল, সম্ভবত তখন থেকে আলফা মেল শব্দটা উচ্চ মধ্য মেধা-বিত্ত মহলে কলকে পেতে শুরু করেছে।
বুদ্ধদেব গুহ নামে একজন লেখক ছিলেন। তিনি মারা গিয়েছেন, সম্প্রতি। ৮৫ বছর বয়সে। অসুস্থ ছিলেন। কোথায় যেন পড়লাম, তাঁর আচমকা মৃত্যুতে সাহিত্যমহল শোকাহত। গত এক বছরে বেশ কয়েকবার বুদ্ধদেব গুহর ভুয়ো মৃত্যুসংবাদ রটেছিল। তিনি অসুস্থ ছিলেন। স্ত্রী ঋতু গুহের মৃত্যুর পর আরও অশক্ত হয়ে পড়েছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর মৃত্যু যে আচমকা, এ খবর পড়ে শকিং লাগল। তাঁর মৃত্যুর খবরে শক নয়, ৮৫ বছরের অসুস্থ মানুষের মৃত্যু যে আচমকা বলে বর্ণনা করা যেতে পারে, শকিং বলতে এই।
বাংলা ভাষায় বুদ্ধদেব গুহ বেশ কিছু সংখ্যক উপন্যাস-গল্পাদি লিখেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর, সেগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটির পিডিএফ চাহিদা উঠেছে(উঠেছে, যেমনভাবে পুজোয় একসময় উঠত কোনও বিশেষ ডিজাইনের শাড়ি, যথা লোডশেডিং, অথবা ডিস্কো)।
বুদ্ধদেব গুহ যখন লিখছেন, এবং জনপ্রিয়তা পাচ্ছেন, তখন, তাঁর মূল প্রকাশনা সংস্থা বইয়ের পৃষ্ঠপ্রচ্ছদের ভিতরের ভাঁজে লেখক পরিচিতি দেওয়া শুরু করে দিয়েছেন। সেখান থেকে পাঠক অবগত হতে থাকেন, বুদ্ধদেব গুহ কোনও যে-সে লোক নন, নন বাংলাভাষার না-খাউগ্গা সাহিত্যিক, তিনি একজন সফল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, শিকারী, এবং আরও নানাভাবে উচ্চকোটির মানুষ। তাঁর মুখে পাইপ দেওয়া ছবিটি এ সময়ে ছড়িয়ে দেওয়া হতে থাকে। বুদ্ধদেব গুহ-র আরও বেশ কিছু ক্ষমতা ছিল। যথা, তিনি গান গাইতেন চমৎকার, তাঁর পরিচিত ও রসিকজনেরা বলে থাকেন। তিনি খুব ভাল ইংরেজি জানতেন, এ কথাও তখন থেকেই প্রচার পেতে থাকে। এসবের সঙ্গে সাহিত্যের যোগাযোগ নেই, কিন্তু এ কথাগুলো বাজারে, পাঠকমধ্যে চারিয়ে যেতে থাকে। বুদ্ধদেব গুহ নিজেও কোনও ঝুঁকি নেননি, তাঁর কাহিনির মধ্যে নায়ক চরিত্রগুলিকে তিনি এই উচ্চকোটির প্রতিনিধি হিসেবেই রেখেছেন। নায়ক, শব্দটা একটু পুরাতন, এখন প্রোটাগনিস্ট বলা নিয়ম, কিন্তু বুদ্ধদেব, গুহ বুদ্ধদেব (আমাদের একজন বসুও ছিলেন, সাহিত্য জগতে), নায়ক চরিত্রই এঁকেছেন, প্রোটাগনিস্ট নয়। তাঁর এই নায়ক চরিত্রগুলি, শুরুতে যা বলেছিলাম, তেমনই- আলফা মেল। কিঞ্চিৎ বাঙালিয়ানাসহ।
বুদ্ধদেব গুহ যে সময়ে হিট হচ্ছেন, সেই সময়টা একটু মনে রাখা দরকার। তখন বাংলায় বাম রাজ চলে এসেছে, উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার বাংলা সিলেবাসে দোবরু পান্না সহ আরণ্যকের খণ্ডাংশ বিরাজমান হয়েছে বা হবে-হবে করছে, যুগলপ্রসাদকে ১৭-১৮-র তরুণ-তরুণীরা চিনছে, না-চাওয়ার অবকাশ খুব বেশি নেই। অবকাশ ও অবসর- সেই সময়ে খুব দূরবর্তী ছিল না। তখন, যখন মাধুকরী লেখা হচ্ছে বা বই আকারে প্রকাশিত, তখনও টেলিভিশনে সম্ভবত সেকেন্ড চ্যানেলও আসেনি। তখন পাড়ার ক্লাবে লাইব্রেরি আছে, সদর মহকুমায় একটা তো বটেই, একাধিক বড় লাইব্রেরি, এবং একটু দূরবর্তী হলেও সেসব লাইব্রেরির বাইরে বিকেলে সাইকেলের ভিড় জমে। সাইকেল – বাইক নয়। জীবন তখন এত গতি পায়নি, এবং জীবন, কেবলমাত্র কিছু-না-কিছু মিস করে ফেলার আশঙ্কা বহনকারী নয়।
ফলে, বই ছিল সম্বল। মধ্যবিত্ত পরিবারের ইয়ং বা ইয়ং অ্যাডাল্টদের মধ্যে, লিঙ্গ নির্বিশেষে, বইকে প্রাথমিক সঙ্গী করতেই হত। ছেলেদের মধ্যে একটা খেলাধুলোর প্রবণতা ছিলই, একটা বড় অংশের মধ্যে- এবং মেয়েদের মধ্যে তা ছিল প্রায় অনুপস্থিত, একটা বড় অংশের মধ্যে। বিশেষত তখন, শহরতলির স্কুলগুলিতে, ‘তুমি তখন নবম শ্রেণী, তুমি তখন শাড়ী’ – অর্থাৎ বছর চোদ্দ-পনেরোর মেয়ের মধ্যে নারীচেতনার, লিঙ্গচেতনার, জবড়জং চেতনার বাধ্যতামূলক উন্মেষ।
এরকম এক সময়ে বুদ্ধদেব গুহ। একদিকে তাঁর বড়দের জন্য লেখা, অন্যদিকে তাঁর শিকার কাহিনি, নায়ক ঋজুদা। শোনা যায়, ফেলু মিত্তিরের জনককে পছন্দ করতেন না বুদ্ধদেব। আর সেই না-পসন্দ থেকেই নাকি, ঋজুদার মর্ত্যে আগমন। ঋজুদা আর ফেলুদার কয়েকটা বৈশিষ্ট যদি দেখে নেওয়া যায়, তাহলে তফাত স্পষ্ট হবে। তবে এই স্পষ্টতার একটা সমস্যাও রয়েছে। ফেলু মিত্তির বলতে যে চেহারা চোখে ভাসে, সেটা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের। ঋজুদার তেমন কেউ নেই। কথক-চরিত্রের মাধ্যমে আমরা চিনতে পারছিলাম, উচ্চকোটির ঋজুদাকে, যিনি কিনা সরলবর্গীয় বৃক্ষের মত সকলকে ছাপিয়ে যাবেন, এমন আকাঙ্ক্ষাতে এ নাম প্রদত্ত। তিনি বিশাল চাকরি করেন, তাঁর যোগসাজশ রাজা-মহারাজাদের সঙ্গে, বিশাল মাপের বড়লোকদের ড্রয়িং রুম তো বটেই, এমনকি তাঁদের অন্দরমহলের রান্নার সঙ্গেও তিনি সুপরিচিত। এ অন্দরমহল, নেসেসারিলি, জানানা মহল নয়, এসব বড়লোকদের বাওর্চি থাকত, তাদেরও বংশপরম্পরা থাকত, খানা বানানোর ও খিদমতগিরির, তাঁদের ভালমন্দ দেখভালের দায়িত্বে থাকতেন এই ধনাঢ্যরা, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন স্থান ও ভূমির বাসিন্দারা, যেখানে কোনও ভূমিসংস্কার হয়নি ও তেমন কোনও রাজনৈতিক প্রকল্পও নেই। উল্টোদিকের ফেলুদাকে, প্রায় সর্বদাই দেখা যাবে এমন কোনও হোটেলে উঠতে, যেখানে লটবহর নিয়ে উঠতেন বাঙালি, মধ্য ও নিম্ন মধ্যবিত্ত বাঙালি, পুজো বা অন্য কোনও অবকাশে। সেখানটা কেমন হয় বা হতে পারে, তা আমবাঙালির জানা-শোনার মধ্যে। ঋজুদা, তেমন বৃত্তের নন। তিনি স্বপ্ন-স্বপ্ন। বড়লোক। তিনি কথায় কথায় ইংলিশ, বিদেশ, আফ্রিকার জঙ্গল, ইত্যাদি। এমনকি তিনি সোয়াহিলি ভাষাজ্ঞাতও। অন্যদিকে, ফেলুদা, মধ্য-মধ্যবিত্তের ফেলুদা তপেশরঞ্জনকে ইংলিশ শেখান, যে কোনও বিষয়ে জানার জন্য পৌঁছে যান সিধুজ্যাঠার কাছে। ফেলুদা, সব জানেন না। ঋজুদা, স্বপ্ন-স্বপ্ন যেহেতু, তিনি প্রতি অ্যাডভেঞ্চারে কারও কাছে সাহায্যের জন্য যাচ্ছেন, এমনটা আমাদের অসম্ভব লাগে।
আমবাঙালি, চিরকালই যেহেতু স্বপ্ন ভালবাসে, এবং তার স্বপ্নপূরণ অন্যের মাধ্যমে হওয়া পছন্দ করে, ঋজুদার একটা জনপ্রিয়তা তাই ঘটেই গেল। আফ্রিকার সিংহ, হিন্দি হিন্টারল্যান্ডের জঙ্গল, ইত্যাদি ভূগোল বইয়ের বাইরে বাংলা অক্ষরে চলে এল, এবং তার সঙ্গে স্বপ্ন স্বপ্ন পুরুষের গল্পও।
এবার এই ঋজুর সঙ্গে মাধুকরীর পৃথু বা অন্যদের একটু মেলান। টেমপ্লেট চরিত্র। পৃথুকে বড়দের ঋজু বা ঋজুকে ছোটদের পৃথু ভেবে ফেলতে আপনার অসুবিধা হবার কথা নয়। পৃথু ঘোষ, মনে মনে বোহেমিয়ান, উচ্চ কোটির, বড়লোক, বৃহন্মনা, রুষাকে আঁকেন প্র্যাকটিকাল চরিত্র হিসেবে, যে কিনা পৃথুকে তত বোঝে না, এবং শ্যানেল নম্বর ফাইভ ছড়ায় গোপন আস্তানায়, শরীরের, সে ক্রুড, এতটাই যে শরীরী সম্পর্কের সময়ে বলে ওঠে, “তোমার হলে বোল, আমার হয়ে গেছে।” এই অংশটা, পৃথুকে আরও বেশি পুরুষ করে তোলে – আলফা মেল, যে নিজের আগে সঙ্গিনীকে আসিয়ে ফেলতে পারে, সুতরাং কামও তার কথা শোনে ও ইরেকশন। কিন্তু পৃথু এমনটা চায় না। ম্যাগনোলিয়া গ্ল্যান্ডিফ্লোরা সে ফোটাতে চাইছিল বটে, কিন্তু…। কুর্চির এরকম নয়। কুর্চি এরকম হবে না। কুর্চি নরম-নরম, নর্ম-নর্ম। পুরুষের নর্ম্যাটিভে সে এক কাঙ্ক্ষিতা রমণী, যে ঋজুদা, থুড়ি পৃথুদার গুণমুগ্ধ। সে সমর্পণ চায়। যাঁহা তুম লে চলো।
মধ্য-মধ্যবিত্ত মেয়েদের কাছে ফিরে যাওয়া যাক। যারা ঋজু-পৃথুকে এমন করে দেখেছে। তাদের নবম শ্রেণি, বা বড়জোর একাদশ শ্রেণিতে শাড়ি। নারী চেতনা, পোশাক তথা চরিত্রচেতনার বাধ্যতামূলক উন্মেষ। এই সময়কালটা, মধ্য বা শেষ আটের দশকে, নয়ের গোড়াতেও – বাংলার নাগরিক মানুষের অর্থনীতি ও তদ-উদ্ভূত স্বপ্ন-কল্পনা এত জটিল নয়। তত বিশ্লেষণীও নয়। তথ্য বিপ্লব ঘটেনি। কম্পিউটার এক দূর কল্পনা। পুরুষ ঠিক কেমন হওয়া উচিত, কেমন পুরুষের কাহিনি মনে রং লাগায়, কেন – সে বিশ্লেষণ হাতের কাছে আসা তখন দূর অস্ত। মন ও শরীর। শরীরের বিলাস ও কাঙ্ক্ষা, জঙ্গলমাঝে ফুল বা কোনও লতা থেকে আসা যৌনগন্ধের গল্প, তখন এক জানালা হয়ে উঠছে। উঠছে ঋজু-পৃথুর হাত ধরে। ছোট বাড়ি, ছোট ঘর, ছোট শহর ছাড়িয়ে যে বয়সে মন উড়তে চায়, সে মনকে বাসনাবৃক্ষে স্থাপিত করছেন বুদ্ধদেব গুহ, সঙ্গে অজস্র ফ্লন্ট। ইফ ইউ হ্যাভ ইট, ফ্লন্ট ইট- এ বুদ্ধদেব গুহের লিখনব্রত। এই দেখানেপনা। এক উপন্যাসের মধ্যে হাজির করে দিচ্ছেন ওয়াল্ট হুইটম্যান, আইগর আকিশমুকিন, তুলসীদাস। দূরবর্তী, ছোঁয়া যায় না, কিন্তু তবুও… এরকম এক আলফা মেল। বাঙালি রোমান্টিকতা সহ, রবীন্দ্রনাথপ্রেম সহ। ওই টুকু লাগে। ও ছাড়া হয় না।
এই আলফা মেল, বিভিন্ন কাহিনিতে তাঁর রাজনৈতিক চেতনার পরিচয়ও দিয়ে গিয়েছেন। পরের দিকের ঋজুদা কাহিনিতে স্পষ্ট মুসলিম বিদ্বেষের কথা নয়, তার আগেও। বিভিন্ন কাহিনিতে তিনি ইউনিয়ন নিয়ে স্পষ্ট বীতরাগ জানিয়েছেন, ইউনিয়ন মাত্রেই যে ইউনিয়নবাজি নয়, তা তিনি বোঝেননি, অন্যান্য অনেক উচ্চকোটির বাসিন্দাদের মতই। সংগঠন ও সংগঠিত মানুষ সম্পর্কে তাঁর বিরক্তি সাধারণভাবে গোপন করেননি তিনি, ভূপেন হাজারিকার ‘ও গঙ্গা তুমি’ গানটিকে বিদ্রূপ করে “বইচোওওও কেনওওও”- এমন বিকৃতরূপে উপস্থাপিতও করেছেন, বিরাগের তীব্রতা বোঝাতে বা তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে না-পেরে। কিন্তু, এহ বাহ্য। রাজনৈতিকভাবে যথাযথতা, কোনও লেখকের কাছে প্রত্যাশা না-করাও যেতে পারে। তাতে তাঁর সাহিত্য একেবারে খর্বকায় হয়ে পড়বে, মানবান হবে না, এ একেবারেই তুচ্ছ বিচার। তবে বাঙালি পাঠকের, সাধারণভাবে, বিশ্লেষণী শক্তি যেহেতু দুর্বল, ফলে উচ্চাবচতা বিচারের মাপকাঠিটিও ঠিক মাপক থাকতে পারে না। সে হেতুই, বুদ্ধদেব গুহকে বিভূতিভূষণের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, অন্তত প্রচারিত হয়েছে যে তিনি তেমন তুল্য। ঠিক কোন জায়গায় বিভূতিভূষণের সঙ্গে বুদ্ধদেব গুহ তুলনীয় হতে পারেন! সরকারেরা নিদান দেবেন- কেন, প্রকৃতি! পাল্টা যদি জিজ্ঞাসা করেন কীরকম, তাহলে লাগসই জবাব আসবে, বিভূতিও অরণ্যপ্রেমী, বুদ্ধদেবও তাই। এই নির্মম অশিক্ষিতপনাটুকু, বাঙালি নিম্ন ও নিম্নমধ্য সাহিত্যের অঙ্গীভূত। এর চেয়ে দুজনের নাম ব দিয়ে শুরু বললেও, কম খারাপ শোনাত মনে হয়- অন্তত তার মধ্যে একধরনের নাইভিটি থাকত। আরণ্যকের অরণ্য দর্শন, আর মাধুকরী সহ নানা উপন্যাসের জঙ্গল বর্ণনার মধ্যে ফারাক না-করতে পারার মত অপশিক্ষা, আমার ধারণা, আমাদের ইশকুলে শেখানো হত না। আরণ্যকের লেখক, কোলাহল মুখরিত শহর ছেড়ে বাধ্যত জঙ্গলে যায়, সেখান থেকে ফিরে আসবে ভেবে, এবং ক্রমে জঙ্গল তাকে খেয়ে নেয়। জঙ্গল তার যাপন। আর বুদ্ধদেব গুহ চরিত্ররা, এখনকার ভাষায় এমনকি ট্র্যাভেলারও নয়, ট্যুরিস্ট। সে হাঁফ ছাড়তে জঙ্গলে যায়, আহা জঙ্গল কত ভাল, ঠুঠা বাইগা কত সরল, আধুনিকতার পাপ তাকে স্পর্শ করে না, ছোটলোকটা কেমন সরল ছোটলোকই থাকে। তার সঙ্গে চুট্টা খাওয়া যায়, এবং ফিরে এসে নাম-না-জানা দামি হুইস্কি খেতে খেতে বিলাপভাবন, জঙ্গলে থাকতে পারলে কী ভালই না হত! এই অপরীভবন, এই অবজেক্টিফিকেশন, বিংশ শতাব্দীর আলফা মেলের চিন্তাভঙ্গি, যা উনিশ শতকের বাবুদের ধারাবাহিকতা।
৮-এর দশকের দ্বিতীয়ার্ধে যাঁরা কৈশোর যৌবনে, তাঁদের কাছে এমনটি হওয়ার আকাঙ্ক্ষা স্বাভাবিক ছিল। পুরুষ তার মত হতে চাইবে, নারী তার কাছে সমর্পিত হতে চাইবে। ফলে, বুদ্ধদেব গুহ বিলাস-বিলাপে, চল্লিশোর্ধ্বদের ভিড়। সাধারণভাবে। সাধারণভাবে, নাইন্টিজ কিড বলে যারা পরিচিত, তারা এতে নেই, কারণ সে সময়ে চ্যানেল চলে এসেছে অনেক, রঙিন গোবিন্দা টিভিতে দেখা যায়, এমনকি লিওনার্দো দি কাপ্রিওকেও।
নিঃসন্দেহে, বুদ্ধদেব ও ঋতু গুহর প্রেমকাহিনি, খেলা যখন, বহু মানুষকে আন্দোলিত করেছিল, তার রোম্যান্টিকতার জন্য। পায়ের হলদেটে গোছমাত্র দেখে শরীরে উথালপাথাল অনুভব করা যুবার মত রোম্যান্টিক, তখনকার সময়ের ভাল মেয়েদের কামনা করার মতই বৈকি। খেয়াল রাখতে হবে, পায়ের গোছের রং। হলদেটে, কারণ দুর্গাপ্রতিম। দুর্গাপ্রতিমাপ্রতিম। ফর্সা মেয়ে। কালো হবে গোন্ড মেয়েরা, তাদের হবে জঙ্গল বিউটি। সে অন্য। এখানে তেমন চলে না। এখানে আকাশবাণী। ভবন।
বুদ্ধদেব গুহর ভুবন, আজীবন, সেই ভবনের ভুবন। জঙ্গল নিয়ে তাঁর বিলাসিতা, বাক্য নির্মাণে স্পষ্ট। তাঁর বিলাস হেডলাইটের আলোর মতই জ্বলজ্বল করে, জঙ্গলের শুঁড়িপথে। তিনি কেবল বাক্য রচনা করতে থাকেন, অজস্র উপমার সাহায্যে। সে সব উপমা, বাংলা ইশকুলের উঁচু ক্লাশের রচনার জন্য যথার্থ, তা দিয়ে সাহিত্য হয় না। বাংলা ভাষার মধ্য-নিম্নমধ্য সরকারপোষিত লেখক ও তৎশাসিত পাঠককুল উপমান ও উপমেয়ের মধ্যেও ভাল সাহিত্যকে প্রোথিত করে রাখতে চেয়েছিলেন। তা থেকে আমাদের মুক্তি ঘটে গিয়েছে, তবে সে মুক্তি অবমুক্তি। এখন কাপালিক-তান্ত্রিকরা আমাদের কপালে খেলা করে, আর মাঝে মাঝে মৃত বুদ্ধদেবের নবমৃত্যুতে বিলাপসাধন।
এ বিলাপের সম্ভাব্য কারণ- ফেলে আসা ৮-এর দশকের প্রতি মায়া। বুদ্ধদেব গুহের লেখা, সে মায়া ছাড়া আর পড়াই সম্ভব নয়। আর সে মায়া অত দীর্ঘক্ষণ টিঁকিয়েও রাখা যায় না, যতটা সময় লাগে বুদ্ধদেব গুহকাহিনি পড়তে।