দিন কয়েক আগে ট্যাক্সিত উঠতে গিয়ে দেখি গাড়ির সামনের কাচে লেখা ‘ইলাহি ভরসা’। ইলাহি মানে ঈশ্বর। হরিচরণেও তাই বলা হয়েছে। কিন্তু আমরা যখন বলি এ(ই)লাহি কাণ্ড কারখানা, এলাহি খাবার-দাবার, এলাহি বন্দোবস্ত। তখন সেখানে ঈশ্বর কোথায়। এভাবেই হয়তো কোনও শব্দ প্রসারিত হয়, বড় হয়, কোনও শব্দ আবার সঙ্কুচিত হয়ে যায়। হারিয়ে যায় কোনও শব্দ। কোনও শব্দ বেঁচে থাকে সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থ নিয়ে। অতি খারাপ লেখা, নিম্ন মানের লেখাকে গর্ভশ্রাবের সঙ্গে তুলনা করতে দেখা যায়। এই শব্দটি দিয়ে তুলনার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে শবরীমালার কুসংস্কার। যা সুপ্রিম কোর্টের রায়কেও চোখ রাঙায়। রাজশেখর বসুর দাদা শশীশেখর বসু তাঁর ‘শব্দের জাত’ প্রবন্ধে লেখকের নাম উল্লেখ না করে লিখেছেন, “প্রথম এডিশনে সন্তান ‘মাই খাচ্ছে’, দ্বিতীয় এডিশনে দেখি ‘স্তন্য পান’ করছে। ক্ষুধায় কাতর সন্তান সম্বন্ধেও আমাদের এত কুণ্ঠা।.....আমরা মনের কলুষ একটা শব্দের উপর প্রক্ষেপ করে আমাদের পাপ বিদায় করি ও সাধু সাজি। তাই বর্জিত শব্দ উচ্চারণে এত ভয়’। এমনই ঘটনার প্রমাণ পেলাম ১৫ অক্টোবরের বাংলা কাগজ খুলে। দমদমে সকেট বোমা বিস্ফোরণে এক শিশুর মৃত্যু হয়। তার পর আরেক জনের মৃত্যু হয় আর জি কর হাসপাতালে দিন কয়েক বাদে। ১৪ অক্টোবর মৃত্যু হয় শরৎ শেঠির (৫০)।খবরের কাগজে লেখা হয়েছে শরৎ শেঠি ছিলেন পেশায় রজক। ধোপা লেখা গেল না। কারণ এই পেশাকে আমরা ‘ছোট’ করে দিয়েছি অনেক আগেই।তাই মৃত ব্যক্তিকে সম্মান জানাতে বলতে হচ্ছে রজক। ধোপা বাংলায় অতি প্রাচীন শব্দ।মঙ্গল কাব্যেও এই শব্দ রয়েছে। প্রকৃত অর্থে রজক এবং ধোপা এক নয়, সেটাও ঠিক। তবে আধুনিক অভিধানে দুটি শব্দকে সমার্থক করে দেওয়া হয়েছে।
বজ্রডঙ্কুশ বা উদংষ্টিট্টিভ। এর মানে কী? শশীশেখর তাঁর ছেলের নাম রেখেছিলেন মৃগাঙ্কভূষণ। স্কুলে একদিন ছাত্রের মুখে বাবার নাম শুনে শিক্ষক বললেন,‘সেকী! শশীশেখরের ছেলের নাম মৃগাঙ্কভূষণ কেন? বাবাকে বল নাম বদলে মৃগাঙ্কশেখর করে দিতে। ছেলে বাবাকে বাড়ি ফিরে সেকথা বলতে শশীশেখরের জবাব, ‘মাস্টারকে বলিস আমার ছেলের নাম আমি বজ্রডঙ্কুশ রাখব না উদংষ্টিট্টিভ রাখব, তাতে মাস্টারের কী। এরকমই নতুন শব্দ সুকুমার রায়ের হিজবিজবিজ, কুমড়োপটাশ, কাঁকড়ামতী নদী বা ল্যাগব্যাগর্নিস পাখি। এরা কেউ বাস্তবে নেই, কিন্তু নাম থেকেই এদের কী কোনও ছবি মনে আসে? বা সুকুমার এই সব চরিত্রের চেহারার যে বর্ণনা লিখে গেছেন, মনে হয় নাকি, সেসব এক্কেবারে সঠিক! শব্দের এটাই শক্তি, এটাই জোর।
দুটি আপাত সম্পর্কহীন শব্দ কবিতায় পাশাপাশি বসে ভিন্ন এক অনুভব তৈরি করে, এমনটা কবিতায় প্রায়ই দেখা যায়। যখন বিনয় মজুমদার লেখেন, ‘আরও কাছে টেনে নাও, চিরকাল একত্রিত হয়ে থাকো- এই আমার সর্বদা সত্য অনুরোধ’। সত্য এবং অনুরোধ কাছাকাছি এসে, মনে হয় যেন একটা নতুন শব্দের সৃষ্টি হল। বা বিনয় যখন লেখেন, ‘আনন্দিত নিয়মেরা, আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছারা স্বকীয় মাধ্যমে স্নিগ্ধ ভালোবাসা ব্যক্ত করে যায়’, তখন ‘আনন্দিত নিয়ম’, নিয়ম এবং আনন্দকে ছাড়িয়ে অন্য এক বোধের জন্ম দেয়। শব্দের এই কেমিস্ট্রি, আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি না, কিন্তু আমরা জানি।
সন্ত্রাসবাদীরা যে শব্দটা আমাদের ভোকাবুলারি থেকে কার্যত ছিনিয়েই নিয়েছে তার নাম ‘লস্কর’। এই লস্কর শব্দটা আমরা আজকাল প্রায় ব্যবহারই করি না, যদি না লস্কর-ই-তৈবা নতুন করে কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনা ঘটায়। লস্কর-ই-তৈবার অর্থ মঙ্গলের সৈন্য, ভাল কাজের সেনা, ন্যায়নিষ্ঠার সৈন্য, অথবা নিষ্পাপ সৈন্য। যদিও ১৯৯০ সালে আফগানিস্তানে জন্ম নেওয়া পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত এই সংগঠনের প্রধান কাজই হল ধর্মের নামে নিষ্পাপ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা।
অতীতে কিন্তু লস্কর শব্দ নিয়মিত এমনকী কবিতায়ও ব্যবহার হত। যেমন ১৬০৩ সালে আকবরের বঙ্গদেশ জয়ের জন্য সেনা বাহিনী পাঠানোর কথা লেখা আছে ভারতচন্দ্রের কবিতায়, ‘আগে পাছে দুই পাশে দু’সারি লস্কর। চলেন মানসিংহ যশোহর নগর’।।
লস্কর মানে ফৌজ, সেনা। কথাটা ফারসি। বাংলায় অবশ্য আর একটা কথা আছে লস্কর নিয়ে। সেটা হল, ‘গদাই লস্করি চাল’। মোটেই ভালো অর্থে ব্যবহার হয় না। হরিচরণ যার অর্থ বলেছেন, লৌহময় অস্ত্র, যাহা মেঘবৎ শব্দ করে, সেই ভারি বস্তুটি নিয়ে তো আর দৌড়ানো যায় না, একটু মৃদুমন্দই হয় সেই যোদ্ধার গতি, সেই চলনকে বলা হত গদাই লস্করি চাল। আর গদাবিহীন যে ব্যক্তির ওই গদাই লস্করি চাল রয়েছে, তার অর্থ, কাজে উদ্যমহীনতা, কুঁড়েমি। যদিও ‘লস্করি চাল’-এর অর্থ হল, টগবগ করে হাঁটা, অভিধানে যার অর্থ বলা হয়েছে, লস্করের ন্যায় নিয়ন্ত্রিত চলন।
আমার এক শিক্ষক বন্ধুর কাছে গল্পটা শোনা। ভালো স্কুলের এক ছাত্র। শহরে থাকে। চাল-ডালের খবর তেমন জানা নেই। সে তার খাতায় ‘গদাই লস্করি চাল’ নিয়ে একটা বাক্য রচনা করতে গিয়ে লিখেছিল, এ বছর প্রবল বর্ষায় শস্যের বিপুল ক্ষতি হয়েছে, গদাই লস্করি চালের দাম এখন ৬০ টাকা কেজি।
কলিম খান এবং রবি চক্রবর্তীর লেখা ‘বাংলাভাষা, প্রাচ্যের সম্পদ ও রবীন্দ্রনাথ’ বইয়ে কলিম খানের লেখা ‘বাংলা ভাষাঃ সাতরাজার ধন মানিক আছে যেখানে’ নামে অসাধারণ একটি প্রবন্ধ আছে। সেখানে কলিম বলেছেন, আমরা বলি ‘আশেপাশে’। পাশে মানে আমরা জানি, আশে মানে কী? তাঁর আরও প্রশ্ন, কালেভদ্রে-র মধ্যে কালে মানে কী, ভদ্রে মানেই বা কী? বা বাসনকোশনের কোশন কাকে বলে? কলিম খান এসবের উত্তর খুঁজেছেন ওই লেখায়।
‘ডেভিলস ডিকশেনারি’ লিখেছিলেন মার্কিনি লেখক অ্যামব্রোস বিয়ের্স বহু বছর আগে। তাতে সব শব্দের উল্টো মানে লিখেছিলেন তিনি। যেমন তিনি ‘অ্যালায়েন্স’ শব্দের মানে লিখেছিলেন, ‘বিশ্ব রাজনীতিতে দুই চোরের এমন বন্ধুত্ব, যে তারা পরস্পরের পকেটে বহু দূর হাত ঢুকিয়ে ফেলেছে, ফলে এখন আর তারা আলাদা ভাবে কোনও তৃতীয় পক্ষকে লুঠতে পারছে না’। ‘কমার্স’ শব্দের অর্থ লিখেছিলেন, ‘এক ধরনের লেনদেন যেখানে ‘ক’ ‘খ’-এর কাছে গচ্ছিত রাখা ‘গ’-এর টাকা লুঠ করলে, ক্ষতিপূরণের জন্য ‘খ’ তখন ‘ঘ’-এর পকেটে রাখা ‘ঙ’-এর গচ্ছিত রাখা টাকা ছিনিয়ে নেয়’। কামান বা ‘ক্যানন’- অর্থ, ‘এক ধরনের অস্ত্র যা দিয়ে বিভিন্ন দেশ তাদের সীমানা নির্ধারণ করে’।’
বাংলায় ‘স্ল্যাং অভিধান’ লিখে একটি বড় কাণ্ড করেছেন অভ্র বসু। তাঁর ‘শব্দগল্পদ্রুম’ নামে ‘বাংলা ব্যুৎপত্তি অভিধান’-এ তিনি শব্দের আদি অর্থ খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছেন। যেমন লবণ শব্দের অর্থ নুন। তা থেকেই এসেছে লাবণ্য। যদিও লাবণ্যে কিছুই নোনতা নেই। ‘একি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, প্রাণেশ হে আনন্দবসন্তসমাগমে…’। আর ‘নাবালক’ এল কোথা থেকে? ফারসি শব্দ ‘না’ আর আরবি শব্দ ‘বালিগ্’ থেকে। বালিগ্ মানে প্রাপ্ত বয়স্ক। স্ত্রীলিঙ্গে বালিগাহ্ । এই না আর বালিগ্ বা বালিগাহ্, মিলে বাংলায় এসেছে, নাবালক, নাবালিকা। অর্থাৎ ‘না-প্রাপ্ত বয়স্ক’। স্নাতক মানে যে স্নান করে সেই স্নাতক। গুরুগৃহে প্রথাগত শিক্ষা অর্জনের পর শিষ্যকে করতে হত আনুষ্ঠানিক স্নান। এখান থেকেই এসেছে স্নাতক। শেষ করি শ্বশুরমশাইকে দিয়ে। অভ্র বসু লিখেছেন, শ্বশুর শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ, যে তাড়াতাড়ি খায়। তবে স্ত্রী বা স্বামীর পিতার সঙ্গে তাড়াতাড়ি খাওয়ার যে কী সম্পর্ক, তা বোধহয় নিরুপণের কোনও উপায় নেই। শাশুড়িদের বিরুদ্ধে এমন কোনও প্রশংসা বা অভিযোগ কোনওটাই অভ্র বসুর বইয়ে নেই।
গুরুচন্ডালিতে প্রথম প্রতিবেদন এটিই পড়লাম! ঝটপট মন্তব্যের নোটিফিকেশনের সাথে লেখাটা এতো ভালো লাগলো লগইন করে ফেললাম!