অনিকেত কে? কী তার পরিচয়? কোন উত্তরাধিকারকে সে বহন করে??
আমরা এখন অনেকেই জানি কলকাতা মেডিকেল কলেজে গত ১১ দিন ধরে ৬ জন ডাক্তারি ছাত্র অনশনরত। নবনির্মিত একটি ১১ তলার হোস্টেলে স্বচ্ছ কাউন্সেলিং করে, যাতে সমস্ত উপযুক্ত ছাত্রছাত্রী সেই হোস্টেলে থাকার অধিকার পায়, সেই দাবিতে।
ভেবে দেখুন।
১. অনিকেত, অর্ণব, দেবাশিষ, হিল্লোল, সুমিত, অয়ন এর কেউ নিজের জন্যে অনশন করছে না।
২. এরা বলছে না কিছু নির্দিষ্ট ছাত্রছাত্রী কেই হোস্টেল দেওয়া হোক, যারা এদের ঘনিষ্ঠ।
৩. এরা কেউ বলছে না, ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের সরিয়ে দিয়ে ওদের হোস্টেল দেওয়া হোক।
৪. ওরা এতদিন যেমন মেডিকেল কলেজের সিনিয়র-জুনিয়র মিলে মিশে থেকেছে, পরীক্ষার আগের রাত থেকে, শরীর খারাপের গোটা দিন, ব্রেক-আপের মন খারাপ থেকে, কলেজ ফেস্টের উৎসবে, সেটাই চাইছে যাতে অবিরত থাকুক।
৫. ওরা কেউ নতুন হোস্টেল ভাংচুর করছেনা, কেউ সেখানে জবর-দখল করছে না, কেউ প্রিন্সিপ্যাল কে চেয়ার বা জলের বোতল ছুঁড়ে মারছে না।
এবার মেডিকেল কলেজ ছাড়িয়ে এসে, ছাত্র আন্দোলন ছাড়িয়ে এসে, অনশন ছাড়িয়ে এসে একটা অন্যকথা ভাবুন।
আপনার কথা ভাবুন। আপনার স্বাস্থের কথা ভাবুন।
স্বাস্থ্যের অধিকার আর স্বাস্থ্য আন্দোলনের কথা ভাবুন। উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে থাকা বহুতল কর্পোরেট হাসপাতাল আর তার স্বাস্থ্যব্যবসার কথা ভাবুন।
সরকারি হাসপাতলের যোগ্য চিকিৎসক আর স্বাস্থ্যকর্মী থাকা স্বত্বেও তার অব্যবস্থার কথা ভাবুন।
এই মুহূর্তে আমাদের দেশ তথা রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবা এক চরম সংকটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে বলছে জিডিপির ন্যুনতম ৫% স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ্য করতে, সারা পৃথিবীর গড় যেখানে ৬%, প্রথম বিশ্বের দেশগুলো যেখানে ১০-২০% ব্যয় করছে, সেখানে আমাদের দেশে ১.০২% ব্যয় করছে সরকার।
বছরের পর বছর সরকারি হাসপাতালের অবহেলা আর তাল মিলিয়ে বেসরকারি হাসপাতালের শোষণ- এই দুই যাঁতাকলের মধ্যে পড়ে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য একটা বড় প্রশ্ন চিহ্নের মুখে।
এই অবস্থায় বিভিন্ন জায়গায়, নানান সময়ে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভে ফেটে পড়া ছাড়া আর উপায় থাকছেনা।
গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রতীকি প্রতিনিধি হিসেবে বারবার তাই ডাক্তাররা জনরোষের মুখে পড়ছেন। অথচ এই জনবিমুখী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রকৃত রোগটা বিক্ষিপ্ত কয়েকজন ডাক্তারের 'সাধারণ মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার' বা উন্নাসিক আচরণের থেকে অনেক, অনেক গভীরে।
সচেতন, সংবেদনশীল এবং ওয়াকিবহাল নাগরিকরা এগিয়ে আসছেন এই রোগের প্রকৃত কারণটা খুঁজতে।
ঠিক এইখানে আমি একটু থামতে বলছি। ভেবে দেখতে বলছি, মনে করতে বলছি সেই সমস্ত ডাক্তারদের কথা, স্বাস্থ্যকর্মীদের কথা, যারা বিষয়টাকে নিজেদের পেশাগত জায়গার বাইরে এসে স্বাস্থ্যব্যবস্থার উল্টোদিকে থাকা সাধারণ মানুষদের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন।
ব্যবস্থাটার ভিতরে থেকে তারাই চিনিয়ে দিচ্ছেন এর মধ্যেকার দুর্নীতি, এর অসারতা, এর শুষ্ক কাঠামো থেকে ঝরে পড়া ঘুণ।
শুধু তাই নয়, পাশাপাশি তারা দেখাচ্ছেন সম্ভাব্য সমাধানের পথ। তাঁরা আহ্বান জানাচ্ছেন একটা বৃহৎ স্বাস্থ্য আন্দোলনে যোগদান করার। জনমুখী একটা কল্যাণকর স্বাস্থ্যব্যবস্থার। "সবার জন্যে স্বাস্থ্যের"।
অনিকেত এই চিকিৎসকদের সন্তান। অয়ন, সু্মিত, হিল্লোল এই চিকিৎসকদের উত্তরাধিকার। সুযোগ্য উত্তরাধিকার।
অনিকেতরা সেই ডাক্তারিছাত্রদের প্রতিনিধি যারা ১৯৮০-র দশকে স্বাস্থ্য আন্দোলনে পথে নেমেছিলেন সরকারি হাসপাতালে ২৪ ঘন্টা এক্স-রে, ই সি জি ও অন্যান্য জরুরি পরিষেবা চালু করার জন্যে। অয়নরা সেই ডাক্তারিছাত্রদের উত্তরসূরি যারা নব্বই এর দশকে কলকাতার বিভিন্ন বস্তি এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা দিয়ে গেছেন, বস্তিবাসী মানুষদের স্বাস্থ্যের হাল হকিকতের খোঁজ তাঁদের মধ্যে গিয়ে নিয়ে এসেছেন।
আর তাই শুধু বর্তমান নয়, যে কোন শাসক দলের কাছেই এই উত্তরাধিকার একটা বড় দু:স্বপ্ন। আসন্ন স্বাস্থ্য আন্দোলনের একটা প্রচ্ছন্ন হুমকি।
এইটা মেনে নিতে চাইছেনা রাষ্ট্র। এইটা মানতে রাজি নয় কর্তৃপক্ষ। তাই চাইছে একদম ফার্স্ট ইয়ার থেকে, একদম 'তৃনমূল' স্তর থেকে এই সম্ভাবনা সমূলে বিনাশ করতে।
অনিকেতদের এই আন্দোলন এই মূহুর্তে তাই এতখানি গুরুত্বপূর্ণ, এতখানি সময়োচিত, এতখানি জরুরি।
এই উত্তরাধিকার কে টিকিয়ে আমাদের রাখতেই হবে। আমাদের জন্যে, আমাদের স্বাস্থ্যের অধিকারের জন্যে, আমাদের ভবিষ্যৎ এর জন্যে। এ'ছাড়া আমাদের আর কোন পথ নেই।
অনিকেত শব্দের অর্থ -যার ঘর নেই। অনিকেতদের এই ঘর চাওয়ার দাবি মিলেমিশে যাক আমাদের সবার বিজ্ঞান সম্মত স্বাস্থ্য পরিষেবার দাবির সাথে। অনিকেতদের এই আন্দোলন মিলেমিশে যাক আমাদের "সবার জন্যে স্বাস্থ্যের" আন্দোলনের সাথে।
অনিকেতদের জয় হোক।
স্বাস্থ্য আন্দোলনের জয় হোক।